হুযুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র জীবনী মুবারক । (পর্ব- ৫৮৫-৭৫০) (ঢ)


পবিত্র আকাবা উনার প্রথম বাইয়াত শরীফ ও হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ:

পবিত্র মদীনা শরীফ উনার অধিকাংশ অধিবাসী ছিলেন আওস ও খাযরাজ সম্প্রদায়ভুক্ত। আর উনাদের সাথে কিছু ইহুদীও বাস করতো; যারা ছিলো আহলে কিতাব। পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে যেহেতু ইহুদীরা সংখ্যালঘু তাই যখনই তাদের সাথে আওস ও খাযরাজ সম্প্রদায়ের ঝগড়া-বিবাদ লেগে যেতো, তখনই ইহুদীরা বলতো, শিগগিরই যিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যমীনে তাশরীফ আনছেন, আমরা উনার আনুগত্য করবো এবং উনাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা তোমাদেরকে আদ ও ইরাম জাতির মতো ধ্বংস ও পর্যুদস্ত করবো।
উল্লেখ যে, যখন পবিত্র হজ্জ উনার মাওসুম এলো, খাযরাজ সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন উনারা পবিত্র মক্কা শরীফ আগমন করলেন। এটা ছিলো আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত শরীফ প্রকাশের ১১তম বর্ষ। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তাদের নিকট তাশরীফ আনলেন এবং পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি আহ্বান করলেন, তাদের সামনে পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করলেন। ওই সমস্ত ব্যক্তি উনাকে দেখে চিনে ফেললেন এবং পরস্পর উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! ইহুদীরা যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কে উল্লেখ করতো, উনি সেই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সুবহানাল্লাহ! উনারা পরামর্শ করলেন, দেখুন! এমনটি যেনো না হয় যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতের ব্যাপারে ইহুদীরা আমাদের অগ্রগামী না হয়। আর ওই মজলিস থেকে উঠার পূর্বেই উনারা পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমরা তো আপনার প্রতি ঈমান আনলাম আর ইহুদীদের সাথে আমাদের প্রায় ঝগড়া হয়। যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলে আমরা ফিরে গিয়ে তাদেরকে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি আহ্বান করবো। যদি ওরা পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনাকে গ্রহণ করে আর এ অবস্থায় তারা ও আমরা ঐক্যবদ্ধ হই তা হলে সবাই মিলে আমরা আপনার খিদমতের আঞ্জাম দিবো ইনশাআল্লাহ। এই মজলিসে ঈমান আনয়নকারী হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সংখ্যা ছিলেন ছয়জন।
১.      হযরত আসয়াদ ইবনে যুরারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
২.     হযরত আউফ ইবনে হারিস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
৩.     হযরত রাফি ইবনে মালিক ইবনে আজলান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
৪.     হযরত কুতায়বা ইবনে আমির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
৫.     হযরত উকবা ইবনে যুরারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
৬.     হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে রাবাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
তবে কতিপয় ‘জীবনী মুবারক-এর’ লিখক হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পরিবর্তে হযরত উবাদা ইবনে সামিত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নাম মুবারক উল্লেখ করেছেন। (ফতহুল বারী, সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
অতঃপর যখন পরবর্তী বৎসর এলো যা ছিলো আনুষ্ঠানিক পবিত্র নুবুওওয়াত শরীফ উনার দ্বাদশতম বর্ষ। বারোজন ব্যক্তি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ মুবারকের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা শরীফ আগমন করেন। পাঁচজন পূর্বের আর বাকি সাতজন ছিলেন নতুন। উনাদের সকলের নাম মুবারক নি¤œ দেয়া হলো।
১। হযরত আসয়াদ ইবনে যুরারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
২। হযরত আউফ ইবনে হারিছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
৩। হযরত রাফি’ ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
৪। হযরত কুতায়বা ইবনে আমির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
৫। হযরত উকবা ইবনে যুরারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তবে এ বৎসর হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে রাবাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উপস্থিত ছিলেন না।
৬। হযরত মু’য়ায ইবনে হারিছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অর্থাৎ আউফ ইবনে হারিছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ভাই।
৭। হযরত যাকওয়ান ইবনে আব্দুল কায়িস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। যিনি পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে যান পরবর্তীতে হিজরত করে পবিত্র মদীনা শরীফ আসেন। এ জন্যে কেউ কেউ উনাকে মক্কী ছাহাবী হিসেবে গণ্য করেছেন।
৮। হযরত উবাদা ইবনে সামিত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
৯। হযরত ইয়াযীদ ইবনে সা’লাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
১০। হযরত আব্বাস ইবনে উবাদা ইবনে নাযলা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
১১। হযরত আবুল হায়ছাম মালিক ইবনে তাইহান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
১২। হযরত উয়াইম ইবনে সায়ীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
উনারা আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক খিদমতে উপস্থিত হন এবং মিনা প্রান্তরে আকাবার সন্নিকটে এই মর্মে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হাত মুবারকে বাইয়াত হন যে, উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে কাউকে শরীক করবেন না। চুরি এবং ব্যভিচার করবেন না। মেয়ে সন্তানদের হত্যা করবেন না, কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ও দুর্নাম করবেন না। ইহা ছিলো হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের প্রথম বাইয়াত মুবারক, যাকে পবিত্র আকাবা উনার প্রথম বাইয়াত শরীফ বলা হয়।
উনারা যখন বাইয়াত হয়ে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে প্রত্যাবর্তন করতে উদ্যত হন, তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাদেরকে পবিত্র কুরআন শরীফ এবং পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার বিধি-বিধান তা’লীম বা শিক্ষা দানের জন্যে উনাদের সঙ্গে প্রেরণ করা হয় এবং উনারা পবিত্র মদীনা শরীফ পৌঁছে হযরত আসয়াদ ইবনে যুরারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হুযরা শরীফ-এ অবস্থান করেন। হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি লোকদের পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি দাওয়াত দিতেন এবং পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে অবস্থিত মুসলমানগণ উনাদের নামাযের ইমামতি করতেন। তিনিই ছিলেন ইমাম। একদিন হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি লোকদের পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি আহ্বান করছিলেন। অনেক লোকজন একত্রিত হয়েছিলেন। উসায়ীদ ইবনে হুযাইর যখন এ খবর পেলেন, তখন তিনি খোলা তরবারী হাতে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আমাদের নারী ও শিশুদের কেনো বিভ্রান্ত করেছেন? আপনার এখান থেকে চলে যাওয়া উত্তম।
হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, যদি সম্ভব হয়, তবে দয়া করে সামান্য সময় আমাদের মজলিসে বসুন, আমি যা বলি মেহেরবানী করে শুনুন।
যদি পছন্দ হয় গ্রহণ করবেন আর না হলে চলে যাবেন। হযরত উসায়ীদ ইবনে হুযাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, এটা অবশ্যই আপনি ইনসাফপূর্ণ কথাই বলেছেন। এ বলে তিনি মাজলিসে বসে পড়লেন। হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার সৌন্দর্য বর্ননা করলেন এবং পবিত্র কুরআন শরীফ উনার থেকে তিলাওয়াত করলেন যা শুনে হযরত উসায়ীদ ইবনে হুযায়র রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন,
ما احسن هذا الكلام واجمله
“কতই উত্তম, কতই না চমৎকার কালাম পাক।” এবং জিজ্ঞেসা করলেন এ পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে প্রবেশ করতে হলে কি করতে হয়? হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, প্রথমে শরীর এবং পোশাক পবিত্র করুন এবং গোসল করুন। এরপর পবিত্র কালিমা-ই শাহাদাত শরীফ পাঠ করুন এবং পবিত্র নামায আদায় করুন।
হযরত উসায়ীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি তৎক্ষণাৎ উঠে লিবাস বা পোশাক পবিত্র করে গোসল করলেন এবং পবিত্র কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করে মুসলমান হলেন এবং দু’রাকায়াত নামায আদায় করলেন। সুবহানাল্লাহ!
অতঃপর তিনি বললেন, আর এক ব্যক্তি আছেন তিনি হচ্ছেন সা’দ ইবনে মু’য়ায। যদি তিনি মুসলমান হয়ে যান, তাহলে আওস সম্প্রদায়ের কেউই অমুসলমান থাকবেন না। আমি এখনই গিয়ে উনাকে আপনার নিকট প্রেরণ করছি। হযরত সা’দ ইবনে মুয়ায রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হযরত উসায়ীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে আসতে দেখেই বললেন, যে উসায়ীদ এখান থেকে গেলেন এ যেনো তিনি উসায়ীদ নন। নিকটে পৌঁছলে হযরত সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হযরত উসায়ীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি করলেন? হযরত উসায়ীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আমি তো উনার আলোচনায় ক্ষতিকর কোনো কিছু পাইনি। হযরত সা’দ ইবনে মুয়ায রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি এতে গোস্বা হলেন। তরবারী খুলে নিয়ে নিজেই সেখানে উপস্থিত হলেন এবং হযরত আসয়াদ ইবনে যুয়ারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে সম্বোধন করে বললেন, যদি আপনার সাথে আমার বন্ধুত্ব বা নৈকট্য না থাকতো এবং যদি আপনি আমার খালাতো ভাই না হতেন, তাহলে এখনই এ তরবারী দিয়ে ফয়ছালা করে দিতাম। সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার জন্যে আপনিই উনাদের এখানে এনেছেন। হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, হে হযরত সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! এটা কি হতে পারে না যে, আপনি এখানে কিছু সময় বসে আমার কথা শুনবেন, পছন্দ হলে গ্রহণ করবেন আর না হলে যা খুশি করবেন? হযরত সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আপনি ইনছাফপূর্ণ কথাই বলেছেন। এটি বলে মাজলিসে বসে পড়লেন। হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনার সামনে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনাকে উপস্থাপন করলেন এবং পবিত্র কুরআন শরীফ উনার থেকে কিছু পবিত্র আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করলেন। শোনামাত্রই হযরত সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেলো। তিনি বললেন, এ পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে প্রবেশের পথ কি? হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, প্রথমে শরীর এবং পোশাক পবিত্র করুন এবং গোসল করুন। এরপর পবিত্র কালিমায়ে শাহাদাত শরীফ পাঠ করুন এবং দু’রাকায়াত নামায আদায় করুন। হযরত সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি তৎক্ষণাৎ উঠে পোশাক পবিত্র করে গোসল করলেন এবং কালিমা শরীফ পাঠ করে মুসলমান হয়ে দু’রাকায়াত নামায আদায় করলেন।
এখান থেকে উঠে তিনি সোজা নিজের কাওমের মাজলিসে ফিরে গেলেন। উনার সম্প্রদায়ের লোকজন উনাকে দূর থেকে দেখেই বুঝে ফেললেন যে, হযরত সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনাকে গ্রহণ করে পরিবর্তন হয়েছেন। মসলিসে পৌঁছে তিনি স্বীয় সম্প্রদায়কে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা আমাকে কেমন মনে করো? সকলেই সমস্বরে বললেন, আপনি আমাদের সাইয়্যিদ, সকলের মতামত আপনি গ্রহণকারী, প্রসিদ্ধ, সবচেয়ে উত্তম ও মর্যাদাবান। হযরত সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! আমি সে পর্যন্ত আপনাদের সাথে কথা বলবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনারা মহান আল্লাহ পাক উনার এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর ঈমান আনছেন। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হলো না, বনী আব্দুল আশহাল গোত্রের এমন কোনো পুরুষ কিংবা নারী অবশিষ্ট থাকলেন না- যাঁরা মুসলমান হননি।
বনী আব্দুল আশহাল গোত্রের মাত্র এক ব্যক্তি হযরত আমর ইবনে সাবিত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যাঁর লক্বব ছিলো উসায়রিম, পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণে বিরত রয়ে গেলেন। তিনি উহুদ জিহাদের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেই জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শহীদ হয়ে যান। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেন। হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি রসিকতা করে বলতেন, বলুন তো ওই ব্যক্তি কে ছিলেন, যিনি এক ওয়াক্ত নামাযও পড়েননি অথচ জান্নাতে পৌঁছে গেছেন? যখন লোকজন জবাব না দিতেন তখন তিনি নিজেই বলতেন, তিনি হলেন, বনী আব্দুল আশহাল গোত্রের হযরত উসায়রিম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। সুবহানাল্লাহ! (যারকানী, সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১ম খন্ড ৩০৮, ৩০৯ ও ৩১০ পৃষ্ঠা)
খছায়িছুল কুবরা ১ম জিলদ ৩০০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,
قال حضرت رفاعة بن رافع الزرقى رضى الله تعالى عنه انه خرج هو وابن خالته حضرت معاذ ابن عفراء رضى الله تعالى عنه، حتى قدما مكة .......... فعرض عليه الاسلام، وقال : من خلق السموات والأرض والجبال؟ قلنا: الله. قال: "فمن خلقكم"؟ قلنا: الله. قال: "فمن عمل هذه الأصنام"؟ قلنا: نحن. قال "فا لخالق أحق بالعبادة أم المخلوق؟ فأنتم أحق ان يعبدوكم وأنتم عملتموها والله أحق ان تعبدوه من شيء عملتموه، وأنا أدعو إلى عبادة الله وشهادة أن لا إله إلا الله وأني رسول الله صلى الله عليه وسلم، وصلة الرحم، وترك العدوان"
অর্থ : “হযরত রিফায়া ইবনে রাফি যুরাকী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন। তিনি এবং উনার খালাতো ভাই হযরত মুয়ায ইবনে আফরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারা উভয়ে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মধ্যে পৌঁছেন।..... সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত রিফায়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি আহ্বান করেন এবং ইরশাদ মুবারক করেন, বলতো আসমান, যমীন এবং পর্বতমালাকে সৃষ্টি করেছেন কে? হযরত রিফায়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, এ প্রশ্নের জাওয়াবে আমি বললাম, মহান আল্লাহ পাক তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, তোমাকে কে সৃষ্টি করেছেন? আমি বললাম, মহান আল্লাহ পাক তিনি। তিনি আবার বললেন, এই প্রতিমাকে কে তৈরি করেছে? আমি বললাম, আমরা তৈরি করেছি। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন, যিনি সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ পাক তিনি ইবাদতের যোগ্য, না সৃষ্টি? এর সরাসরি জবাব হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা। তিনি বললেন, কাজেই তোমাদের উচিত প্রতিমাদের পূজা না করা। কেননা তোমরা তাদেরকে তৈরি করেছো। তোমরা যে প্রতিমা তৈরি করেছো তাদের চেয়ে খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদের ইবাদত পাওয়ার হক্বদার। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আমি যে সব বিষয়ের প্রতি আহ্বান করি সেগুলো হচ্ছে, ১. মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত করা। ২. এই বিষয় সাক্ষ্য দেয়া যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল বা হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং ৪. অবাধ্যতা বা শত্রুতা পরিহার করা।
قلنا: لو كان الذي تدعو إليه باطلا لكان من معالى الأمور ومحاسن الأخلاق، ثم ذهبت، فطفت وأخرجت سبعة قداح فجعلت له منها قدحا فاستقبلت البيت، فضربت بها وقلت: اللهم إن كان ما يدعو إليه حضرت محمد صلى الله عليه وسلم حقا، فاخرج قدحه سبع مرات، فضربت فخرج سبع مرات: فصحت أشهد أن لاإله إلا الله وأن محمدا رسول الله صلى الله عليه وسلم-
আমি বললাম, আপনি যে পবিত্র দ্বীন ইসলাম ধর্ম উনার প্রতি দাওয়াত দেন; তা বাতিল হলেও তাতে মহান চারিত্রিক গুণাবলী-এর সন্নিবেশিত রয়েছে। হযরত রিফায়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, অতঃপর আমি চলে গেলাম এবং ঘরে গিয়ে সাতটি তীর নিয়ে আসলাম। এগুলোর মধ্যে একটি তীর মুবারক সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারকে নির্দিষ্ট করলাম এরপর বাইতুল্লাহ শরীফ উনার সম্মুখে এসে এসব তীরের মাধ্যমে সুন্নতী লটারী করতে মনস্থ করলেন। আমি দোয়া করলাম- হে মহান আল্লাহ পাক! সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে দ্বীনের দাওয়াত দেন, তা যদি হক্ব বা সত্য হয়, তবে উনার নাম মুবারকে তীর সাতবার বের করুন। এরপর তীরগুলো সুন্নতী লটারীতে দিলাম। আশ্চর্যের বিষয়, সাতবারই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারকের তীর বের হয়ে গেলো। তিনি উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
أشهد أن لاإله إلا الله وأن محمدا رسول الله صلى الله عليه وسلم
অর্থ: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
(হযরত হাকিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এ রেওয়াতটি বিশুদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন।) (সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
এ বৎসরই হযরত আসয়াদ ইবনে যুরারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে জুমুয়ার নামাযও আদায় করেন। তিনি যখন দেখলেন যে, ইহুদী ও খ্রিস্টানদের একত্রিত হওয়ার জন্যে সপ্তাহে একটি বিশেষ দিন নির্দিষ্ট আছে ইহুদীরা ইয়াওমুস সাবতি বা শনিবার এবং খ্রিস্টানরা ইয়াওমুল আহাদী বা রোববার এক জায়গায় একত্রিত হয়। এজন্যে তিনি মুসলমানদের জন্যে সপ্তাহে একটি দিন এভাবে নির্দিষ্ট করলেন, যে দিন সব মুসলমানগণ উনারা একত্রিত হয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির-ফিকির ও শুকরিয়া আদায় করবেন, ছলাত বা নামায আদায় করবেন এবং উনার ইবাদত বন্দেগী করবেন। হযরত আসয়াদ ইবনে যুরারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি এ জন্যে ইয়াওমুল জুমুয়াতি বা শুক্রবার দিন বেছে নিলেন এবং ঐ দিন সবাইকে নিয়ে নামায আদায় করলেন।
মোটকথা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তাযালা আনহুম উনারা ইজতিহাদের মাধ্যমে প্রথম জুমুয়ার নামায আদায় করেন মদীনা শরীফ উনার মধ্যে। দ্বিতীয়তঃ পবিত্র জুমুয়ার দিনটি যাকে জাহিলী যুগে আরূবা অর্থাৎ ইয়াওমুল আরূবা বলা হতো এ দিনের নাম ‘ইয়াওমুল জুমুয়াতি’ নির্ধারণ করা হলো। মহান আল্লাহ পাক তিনি তা অনুমোদন করেন। যে প্রেক্ষিতে পবিত্র আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হয়।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِي لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ
অর্থ: “হে মু’মিনগণ! জুমুয়ার দিন যখন নামাযের আহ্বান করা হয় তখন তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির বা স্মরণের লক্ষ্যে ধাবিত হও এবং ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ রাখো।” (পবিত্র সূরা জুমুয়া শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ-৯)
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া উনার ২য় জিলদ ১৫৩, ১৫৪ ও ১৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,
فلما وقع أمره بالمدينة وتحدثوا بما بين قريش فيه من الاختلاف قال أبو قيس بن الاسلت أخوبنى واقف. قال حضرت السهيلى رحمة الله عليه هو أبوقيس صرمة بن أبى أنس واسم أبى أنس قيس بن صرمة بن مالك بن عدى بن عمرو بن غنم بن عدى ابن النجار، قال وهو الذى أنزل فيه وفى حضرت عمر عليه السلام (أحل لكم ليلة الصيام الرفث إلى نسائكم) الاية. قال حضرت ابن اسحاق رحمة الله عليه وكان يحب قريشا، وكان لهم صهرا. كانت تحته أرنب بنت أسد بن عبد العزى ابن قصى وكان يقيم عندهم السنين بامرأته. قال قصيدة يعظم فيها الحرمة وينهى قريشا فيها عن الحرب ويذ كر فضلهم وأحلامهم ويذكرهم بلاء الله عندهم ودفيه عنهم الفيل وكيده ويأمرهم بالكف عن رسول الله صلى الله عليه وسلم :
অর্থ: “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আলোচনা মুবারক যখন পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে গিয়ে পৌঁছলো এবং কুরাইশদের সাথে উনার মতবিরোধের ঘটনা যখন মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছিলো, তখন বনু ওয়াকিফ গোত্রের কবি আবূ কায়স ইবনে আসলাত তিনি একটি কবিতা রচনা করছিলেন। আবূ কায়সের পরিচয় বর্ণনা করে হযরত সুহায়লী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, তিনি হলেন আবূ কায়স সারমা ইবনে আবূ আনাস কায়স ইবনে সারমা ইবনে মালিক ইবনে আদী ইবনে আমর ইবনে গানাম ইবনে আদী ইবনে নাজ্জার। তিনি আরো বলেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম এবং এই আবূ কায়সকে উপলক্ষে করে পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল করেন।
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَآئِكُمْ
“সিয়াম বা রোযার রাতে তোমাদের জন্য নির্জনবাস বৈধ করা হয়েছে।” (পবিত্র সূরা বাকারা শরীফ : আয়াত শরীফ- ১৮৭)

0 Comments: