সুওয়ালঃ রাবেতাতুল কুলুব্বিশ শায়েখ বা ওয়াছেতাতুল কুলুব্বিশ শায়েখ বলতে কি বুঝায়? এদের
মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?
কেননা অনেকে রাবেতাতুল কুলুব্বিশ শায়েখ ও তাসাউরে শায়খকে
একই বুঝিয়েছেন আবার কেউ কেউ পার্থক্য করেছেন। আবার আজকাল কেউ কেউ বলে থাকে, তাসাউরে
শায়খ করা শিরক বা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। আবার কেউ কেউ দোয়া-দুরুদ, যিকির
আযকার, তাসবীহ-তাহলীল,
নামায-কালাম ইত্যাদি প্রত্যেক ইবাদতে তাসাউরে শায়খ করা
জরুরী বা অবশ্য কর্তব্য মনে করেন। উপরোক্ত বক্তব্যের কোনটি সত্য তা জানতে বাসনা
রাখি। উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ সম্পর্কে শরীয়তের ফয়সালা কি?
জাওয়াবঃ রাবেতাতুল কুলুব্বিশ শায়েখ বা ওয়াছেতাতুল কুলুব্বিশ শায়েখ
উনার এক কথায় অর্থ হলো তাআল্লুক মাআশ শায়েখ বিলক্বুলুব অর্থাৎ শায়েখ উনার সঙ্গে
ক্বলবের সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া। প্রত্যেক মুরীদেরই পীর ছাহেব উনার সঙ্গে আন্তরিক
সম্বন্ধ একান্ত দরকার। যে মুরীদের সঙ্গে পীর ছাহেব উনার সাথে সরাসরি সাক্ষাত হয়
সেই মুরীদের অন্তরে পীর ছাহেব উনার খেয়াল আরও দৃঢ়ভাবে থাকা উচিত। যেমন হযরত
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার রেওয়ায়েত
করার পর বলেছেন, আমি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র বগল মুবারক উনার শুভ্রতাকে
দেখছি। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনাদের মত মুবারক ও পথ
মুবারক আমাদের নিকট একান্ত অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। সেই কর্মপন্থা অনুসরণকল্পে
প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য,
স্বীয় পীর ছাহেব উনার সীরত মুবারক ও সুরত মুবারককে
যথেষ্টরূপে অন্তরে বিরাজমান রাখা। পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার সীরত মুবারক ও সুরত
মুবারককে মুহব্বতের সাথে অন্তরে জাগ্রত থাকাকেই রাবেতাতুল কুলুব্বিশশায়েখ বা ওয়াছেতাতুল
কুলুব্বিশশায়েখ বলা হয়। তাসাউরে শায়খকে সরাসরি জায়েযও বলা যাবে না, আবার
সরাসরি নাজায়েযও বলা যাবে না। শর্ত সাপেক্ষে তাসাউরে শায়খ জায়েয আবার শর্ত
সাপেক্ষে নাজায়েযও। এটার জায়েয হবার শর্তগুলি নিম্নে আলোচনা করা হলো- ‘তাসাউরে শায়খ’ এর অর্থ
এক কথায় হলো- তাখাল্লাকু বেআখলাক্কিশ্ শায়েখ বা ফানাফিশ শায়েখ অর্থাৎ শায়খ উনার
চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া। এটা নকশবন্দীয়া তরীকা উনার একটি শোগল (সবক)। যা আদায় করা
অবশ্যই জায়েয। অর্থাৎ শায়খ উনার মধ্যে যে সমস্ত কামালত ও সৎগুণাবলী আছে তা অর্জন
করার জন্য মুরীদ যদি এ শোগল আদায় করে তবে শায়েখ উনার সাথে তার মুহব্বত মুবরক ও
নিছবত মুবারক দৃঢতর হয় সেই ব্যক্তিই এটা আদায় করতে পারবে যার পীর ছাহেব এ সবক তাকে
আদায় করতে দেবেন এবং পীর ছাহেব ক্বিবলা তিনিও মুরীদের যোগ্যতা অনুযায়ী
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উপযুক্ত হলে তাকে এ সবক আদায় করতে দেবেন। আম লোকদের তাসাউরে
শায়খ কিছুতেই শিক্ষা দেয়া উচিত নয়, আর খাছ বা বিশেষ লোক যাদেরকে
শিক্ষা দেয়া হবে তাদেরকেও খুব ইহতিয়াতের (সাবধানতার) সঙ্গে দেয়া দরকার। কেননা এ
মাকামে ঈমান নষ্ট হবার সম্ভাবনা রয়েছে, আর অনেকেই ইতিপূর্বে এ মাকামে
ঈমান নষ্ট করে ফেলেছে। এটার দ্বারা একাগ্রতা হাসিল হয় অর্থাৎ তাসাউরে শায়েখ উনার
মাধ্যমে একসই বা একাগ্রতা পয়দা হয় এবং পীর ছাহবে উনার সংগে রাবেতা বা সম্পর্ক
কায়েম হয়। কাজেই উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা এটাই বুঝানো হলো যে, তাসাউরে
শায়েখ নকশবন্দীয়া মুজাদ্দিদীয়া তরীকা উনার একটি সবক। সুতরাং অন্যান্য ইবাদতের সময়
তাসাউরে শায়েখ করা বা এর খেয়াল রাখা সম্পূর্ণ নাজায়েয।
নাযায়েয হবার শর্তসমূহ: কোন মুরীদ যদি দোয়া-দুরূদ, তাসবীহ-তাহলীল, যিকির-আযকার, নামায-কালাম, হজ্জ-যাকাত
আদায় করার সময় বা অন্য কোন ইবাদতে ইচ্ছাকৃতভাবে তাসাউরে শায়খ করে বা মুরীদ হযরত
পীর ছাহেব উনার অবিকল সুরত মুবারককে অন্তরের মধ্যে এরূপ গাঢ়ভাবে ফিকির করে যে, হযরত
মুর্শিদ ক্বিবলা উনার সুরত ভিন্ন সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে এরূপ
আমল স্পষ্টতই মহান আল্লাহ পাক উনার তাওহীদ পরিপন্থী এবং ওটা মহান আল্লাহ পাক উনার
মুহব্বত ও মারেফতে বাধা জন্মায়ে থাকে। যেমন একদিকে মুর্শিদ ক্বিবলা তিনি মুরীদের
ক্বলব মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত ও মারেফত মুবারক উনার নূর মুবারক লাভের জন্য
তাওয়াজ্জুহ দিতে থাকেন অপরদিকে মুরীদ উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার ধ্যান ছেড়ে পীর
ছাহেব উনার সুরত বা আকৃতি আকর্ষণে নিমগ্ন থাকে। কাজেই পীর ছাহেব উনার ধ্যান মহান
আল্লাহ পাক উনার নাম মুবারক উনার যিকির উনার ধ্যানে মারেফত মুবারক উনার নূর মুবারক
লাভের পর্দা বা অন্তরায় স্বরূপ। সুতরাং এটা নিষিদ্ধ বা হারাম। যেরূপ সূর্যের আলো
সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করে তথাপি সময় সময় আকাশের মেঘরাশি সূর্যের কিরণ এ পৃথিবীতে
আসতে বাধা প্রদান করে। তদ্রুপ পীর ছাহেব উনার তাওয়াজ্জুহ মুবারক উনার ফলে মহান
আল্লাহ পাক উনার মারিফত মুবারক উনার নূর মুবারক মুরীদের ক্বালবে পতিত হবার পথে এ
প্রকার তাসাউরে শায়খ বাধা প্রদান করে। অতএব, দেখা গেল এ পদ্ধতিতে তাসাউরে শায়খ
মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির ও ফিকির উনার ফয়েজ মুবারক লাভে বাধা প্রধান করে সুতরাং
ওটা সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত ও তরীকত অনুযায়ী নিষিদ্ধ বা হারাম।
আবার যদি
কেউ মহান আল্লাহ পাক উনাকে নিজের শায়খ উনার সুরতে ধ্যান করে মনে করে যে, শায়খই
মহান আল্লাহ পাক তিনি বা মহান আল্লাহ পাক তিনিই শায়খ এবং তাতেই মহান আল্লাহ পাক
উনাকে পাওয়া যাবে,
এটা কুফরীর বা শিরক-এর অন্তর্ভূক্ত। তাসাউফের কোন ইমাম
ছাহেব উনারা তাসাউরে শায়খ উনাকে এ অর্থে কখনও শিক্ষা দেননি। তাসাউরে শায়খ করতে
করতে শেষে যদি শায়খ উনার সুরত মুবারক সকল সময় সামনে দেখতে পায়, তবে এটা
ধারণা করা জায়েয হবে না যে,
শায়খ মহান আল্লাহ পাক উনার মত সর্বত্রই হাযির-নাযির। তবে
কেউ যদি নামায, রোজা, যিকির-আযকার,
তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি সকল ইবাদতে ইচ্ছাকৃতভাবে শায়খ উনার
স্মরণ করে তবে তা শিরক হবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার একত্ববাদের শান মুবারক উনার
খলাফ হবে। আর যদি কারও অনিচ্ছাকৃতভাবে স্মরণ হয়ে যায় অর্থাৎ নামায-কালাম, দোয়া-দুরূদ, তাসবীহ-তাহলীল
উনাদের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে শায়খ উনার সুরত মুবারক তার মানসপটে ভেসে উঠে, তাহলে
তার এ স্মরণ পরিহার করার কোশেশ করতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে সমস্ত ইবাদত
বন্দিগীতে মহান আল্লাহ পাক উনার খেয়াল রাখা। কাজেই তাসাউরে শায়খ হলো নকশবন্দীয়া
তরীকা উনার একটি সবক। যার মাধ্যমে হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা উনার সুরত ও সীরত এবং
কামালত, বেলায়েতের ফয়েযের মাধ্যমে হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা উনার সাথে রাবেতা পয়দা হয়। আর
রাবেতাতুল কুলুব্বিশশায়েখের নির্দিষ্ট কোন সবক নেই। অন্য যে কোন সবকের মাধ্যমে বা
নির্দিষ্ট সবক ব্যতীত পীর ছাহেব উনার সাথে রাবেতার (সম্পর্কের) কারণে যে সম্পর্ক
পয়দা হয়।
দলীলসমূহঃ- (১) তিরমিযী শরীফ (২) মকতুবাত শরীফ (৩)
তাফসীরে আযীযী (৪) নুরুল আলা নূর (৫) ইলমে তাসাউফ নকশবন্দীয়া মুজাদ্দিদীয়া (৬)
আনিসুত তালেবীন (৭) তালিমুদ্দীন।
আবা-৯
0 Comments:
Post a Comment