সুওয়াল: বাবা-মা জীবিত থাকলে নাকি পীর সাহেব ধরা যায় না। অনেকে বলেন পিতা-মাতার
অনুমতি ব্যতীত কোন পীর ছাহেব গ্রহণ করা যাবে না। এটা কতটুকু সত্য তা জানালে বাধিত
হবো।
জাওয়াব: এটা একটি অবান্তর প্রশ্ন, যা সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত উনার সাথে কোন মিল নেই। পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে,
طلب العلم فريضة على كل مسلم ومسلمة.
অর্থঃ- “প্রত্যেক
মুসলমান নর-নারীর জন্য ইলম অর্জন করা ফরজ।”
পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ করা হয়েছে,
العلم
علمان علم فى القلت فذا ك علم النافع علم على اللسان فذالك حجة الله عزودل على ابن
ادم.
অর্থঃ- “ইলম দুই
প্রকার। এক প্রকার হলো ক্বালবী ইলম, যা উপকারী ইলম, আরেক
প্রকার হলো জবানী ইলম,
যা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বান্দার জন্য দলীলস্বরূপ।
অর্থাৎ একটি হলো ইলমে ফিকাহ্, আরেকটি হলো ইলমে তাসাউফ। হযরত ইমাম আ’যম আবু
হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “ইলম শিক্ষা করা ফরজ বলতে বুঝায় ইলমে ফিকাহ্ ও ইলমে তাসাউফ, উভয়টাই
জরূরত আন্দাজ শিক্ষা করা।”
হযরত
ইমাম আ’যম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বিশ্ববিখ্যাত আলেম হওয়া সত্বেও তিনি
বলেন,
لولا سنتان لهلك ابو نعمان.
অর্থঃ- “আমি ইমাম
আ’যম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ধ্বংস হয়ে যেতাম যদি দু’বছর না
পেতাম।” অর্থাৎ তিনি এই দু’বছরে হযরত ইমাম জাফর সাদিক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দরবারে থেকে ইলমে তাসাউফ
হাসিল করেন।
উল্লেখ্য,
হযরত ইমাম আ’যম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি প্রথমে হযরত ইমাম বাকের রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনার কাছে মুরীদ হন এবং উনার ইন্তেকালের পর উনারই ছেলে হযরত ইমাম জাফর
সাদিক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে বাইয়্যাত হয়ে কামালিয়াত হাসিল করেন। যা বিশ্ববিখ্যাত
দুররুল মুখতার সাইফুল মুকাল্লেদীন, (ইছনা আশারীয়া, হযরত শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি) ইত্যাদি কিতাবে এ
ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে।
হযরত
মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিশ্ববিখ্যাত কিতাব ‘মিশকাত
শরীফ’র শরাহ মিরকাত শরীফে হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাওল উল্লেখ
করেছেন যে, (যিনি মালেকী মাযহাবের ইমাম) হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “যে ইলমে
ফিকাহ্ শিক্ষা করলো কিন্তু ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করলো না, সে ফাসেক
অর্থাৎ গুণাহ্গার এবং যে শুধু ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করলো অর্থাৎ সে বলে মারেফত করি, মারেফত
করি কিন্তু সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত উনার ধার ধারে না, সে যিন্দিক কাফির। আর যে দু’টোই
অর্জন করলো সে মোহাক্কেক।”
আর ইলমে ফিকাহ অর্থাৎ অজু, গোসল, ইস্তিঞ্জা, মোয়ামেলাত, মোয়াশেরাত
ইত্যাদি শিক্ষার জন্য ওস্তাদ গ্রহণ যেমন ফরয (আবশ্যক) অর্থাৎ মাদ্রাসায় গিয়েই হোক
অথবা ব্যক্তিগতভাবে কোন ওস্তাদের নিকট থেকেই হোক তা জরূরত আন্দাজ শিক্ষা করা ফরজ।
তদ্রূপ ইলমে তাসাউফের জন্যও ওস্তাদ গ্রহণ করা ফরজ। আর এ ওস্তাদকেই আরবীতে ‘শায়খ’ বলা হয়।
আর ফারসীতে ‘পীর’ বলা হয়।
‘দুররুল মুখতার’
যা বিশ্ববিখ্যাত কিতাব তার মধ্যে একটি উসুল উল্লেখ করা
হয়েছে,
مالا
يتم به الفرضى فهو فرض ما لا يتم به الواجب فهو واجب.
অর্থঃ- “যে আমল
ব্যতীত ফরজ পূর্ণ হয় না,
সে আমল করাও ফরজ। যে আমল ব্যতীত ওয়াজিব পূর্ণ হয় না, সে আমল
করাও ওয়াজিব।”
ইলমে
ফিক্বাহ শিক্ষা করার জন্য প্রত্যেকের পিতা-মাতা অথবা মুরুব্বিগণই মাদ্রাসায় ভর্তি
করিয়ে থাকেন, কারো যদি পিতা-মাতা অথবা মুরুব্বী জীবিত না থাকে, তাহলে
তার পক্ষে ইলমে ফিকাহ্ শিক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং সময় সময় অসম্ভবও হয়ে যায়।
কেননা ইলমে ফিকাহ্ শিক্ষা করার সময় যেমন থাকা-খাওয়া, পড়া-লেখা ইত্যাদির জন্য
টাকা-পয়সার জরূরত হয়,
সে টাকা-পয়সার আঞ্জাম দেন পিতামাতা অথবা মুরুব্বীগণ। অনুরূপ
ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করার সময়ও থাকা-খাওয়া, লেখা-পড়া ইত্যাদির জন্য টাকা
পয়সার জরূরত হয় এবং সে টাকা পয়সার আঞ্জাম দেন পিতামাতা ও মুরুব্বীগণ। এটাই যদি
সত্য হয় যে, পিতামাতা অথবা মুরুব্বীগণ জীবিত থাকাকালীন ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করা যাবে না, তাহলে যে
সকল সন্তানেরা পিতামাতা জীবিত থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করে, তাদের
পক্ষে ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করা সম্ভব নয়। যার ফলে তারা একটি ফরজ আদায় করা হতে
মাহরূম থেকে গুণাহ্গার হলো। আর যদি পিতামাতা জীবিত থাকা অবস্থায় ইলম অর্জন করা না
যায়, তাহলে সন্তানদের ইলম অর্জন করার জন্য পিতামাতার মৃত্যু কামনা করতে হবে। কেননা
যেহেতু ইলম অর্জন করা ফরজ এবং এই ফরজ পিতামাতার মৃত্যু ব্যতীত অর্জন করা সম্ভব নয়, তাই এই
ফরজ আদায়ের জন্য সন্তানদের পিতামাতার শুধু মৃত্যু কামনা করেই নয় বরং তাদের মৃত্যুবরণ
করায়ে ইলম অর্জন করতে হবে। অথচ পিতামাতার মৃত্যু কামনা করা শক্ত গুণাহ্। যে কোন
কাজ করার পূর্বে পিতামাতার অনুমতি নেয়া বরকতের কারণ। কিন্তু সেজন্য যে বিষয়ে
পিতামাতার জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে এজাযতের জরূরত নেই বরং বরকতের জন্য জানানো দরকার।
কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “যদি তোমরা না জান, তাহলে
যারা জানেন, তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও। আর যদি কারো পিতামাতা পীর, বুজুর্গ, ওলী
আল্লাহ্ অথবা হক্কানী আলেম হন, তাহলে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। যার পিতামাতার ইলম কালাম নেই
তাদের নিকট যদি পীর ছাহেব গ্রহণ করার অনুমতি চাওয়া হয়, আর তারা
অনুমতি না দেন, তথাপিও তাকে পীর ছাহেব গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু পীর ছাহেব গ্রহণ করা ফরজ। কেননা
মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ
উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
وان
جاهداك على ان تشوك بى ماليس لك به علم فلا تطعهما وصاحبهما فى الدنيا معروفا.
অর্থঃ- “যদি তারা
তোমাদের শরীক (শিরক) করার জন্য আদেশ করে, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তবে
তাদেরকে অনুসরণ করোনা এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে উত্তমভাবে বসবাস কর।” (পবিত্র সূরা লোকমান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ-১৫)
এবং পবিত্র
হাদীছ শরীফ এবং এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় বলা হয়,
لاطاعة لمخوق فى معصية الخالق.
অর্থঃ- “কোন
মখলুকের অনুসরণ করতে গিয়ে মহান আল্লাহ পাক
উনার হুকুমের খেলাফ করা যাবে না।”
উপরোক্ত পবিত্র
আয়াত শরীফ এবং পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের দ্বারা এটাই বুঝা যায় যে, পিতা-মাতা
কোন আদেশ করলে যদি সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত সম্মত হয়, তাহলে তা মানা যাবে। আর যদি সম্মানিত
ইসলামী শরীয়ত উনার খেলাফ হয়, তাহলে তা মানা যাবে না। তবে সৎভাবে তাদের সাথে জীবন-যাপন
করতে হবে।
অতএব
প্রত্যেক পিতামাতার কর্তব্য হলো- কোন হক্কানী পীর ছাহেব গ্রহণ করে ইলমে তাসাউফ
শিক্ষা করা, আর তাদের দায়িত্ব তারা স্বীয় সন্তানদিগকে যেভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায়
ভর্তি করায়ে থাকে,
ঠিক সেভাবে কোন হক্কানী পীর সাহেবের দরবারে ইলমে তাসাউফ
শিক্ষা করার জন্য পৌঁছিয়ে দেবে।
আবা-১১
0 Comments:
Post a Comment