আব্বাসীয় খেলাফতের পতনের পর তুরস্কের উসমানীয় সুলতানরাই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেন। প্রায় সাড়ে ছয় শ বছর (১২৯৯-১৯২৩ খ্রি.) দোর্দ- প্রতাপে শাসন করেন তাঁরা। তিন মহাদেশ (ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা) বিস্তৃত তুর্কি খেলাফতের অসামান্য সব কীর্তির সাক্ষ্য বহন করে আছে আজকের ইস্তাম্বুল। বিশেষত মুসলিম সভ্যতার বহু নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে তুরস্কে। দেশটির বিভিন্ন জাদুঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইসলামের সোনালি যুগের অসংখ্য স্মারক ও নিদর্শন। তুরস্কের অন্যতম সমৃদ্ধ জাদুঘর তুর্কি সুলতানদের বাসভবন ‘টপাকোপি’। তবে দেশটির অন্য সব জাদুঘরের তুলনায় এটির শ্রেষ্ঠত্ব অন্যখানে। টপাকোপির একটি কক্ষে সংরক্ষিত রয়েছে ইসলামের সহস্র বছরের মহামূল্য দুই হাজার নিদর্শন, যা ‘দ্য হলি রিলিক্স’ নামে পরিচিত।
সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ (১৪৫১-৮১) নির্মিত ‘টপাকোপি প্যালেস’ (১৪৫৯ খ্রি.) ছিল তুর্কি সুলতানদের প্রধান বাসভবন। তুর্কি খেলাফতের পতন হলে ১৯২৩ সালে তা জাদুঘর করা হয়। তবে ‘দ্য হলি রিলিক্স’-এর প্রতিষ্ঠা তার বহু আগে। টপাকোপি প্যালেসের ভেতর যে কক্ষে হলি রিলিক্স প্রতিষ্ঠিত তা মূলত তুর্কি সুলতানদের ব্যক্তিগত কক্ষ ছিল। কক্ষটি নির্মাণ করেন দ্বিতীয় মুহাম্মদ। সুলতানরা এই কক্ষে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপন পরামর্শ সম্পন্ন করতেন। ঐতিহ্য অনুযায়ী তাঁরা সিংহাসনে আরোহণের আগে এই কক্ষে প্রার্থনা করতেন এবং অভিষেকের আগে এখানেই কর্মকর্তারা সুলতানকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতেন। দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘরটিতে উন্নতমানের ইজনিক টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। সুলতানদের একান্ত ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত কক্ষটি পরে ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের জন্য নির্বাচন করা হয়।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্যতম শাসক (প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা) সুলতান সেলিমের পর থেকে ১৯ শতকের শেষ পর্যন্ত এসব স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ করা হয়। ১৫১৭ সালে সুলতান সেলিম মিসর জয় করার পর ইসলামী খেলাফতের নেতৃত্ব আব্বাসীয়দের থেকে উসমানীয়দের হাতে চলে যায়। এ সময় সর্বশেষ আব্বাসীয় খলিফা তৃতীয় মুতাওয়াক্কিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র চাদর উপহার দেন সুলতান সেলিমকে। পরবর্তী সময়ে ইসলামের পবিত্র স্মারক সংগ্রহের এই ধারা অব্যাহত থাকে। বিশেষত ১৮ শতকে আরবে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হলে ইসলামের বহু স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের জন্য তুরস্কে পাঠানো হয়। একইভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মদিনা থেকে অনেক ঐতিহাসিক স্মারক-নিদর্শন তুরস্কে স্থানান্তর করা হয়।
দীর্ঘ চার শ বছরে তুর্কি শাসকরা ইসলামের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্মারক সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত স্মারকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা করা হয় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি চাদর, একটি দাড়ি মোবারক, তাঁর দাঁত, যা উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল, পায়ের চিহ্ন, চিঠি, ধনুক ও তরবারি। মুহাম্মদ (সা.) ছাড়াও অন্যান্য নবী (আ.)-এর স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে এখানে। যেমন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পাত্র, মুসা (আ.)-এর লাঠি, দাউদ (আ.)-এর তরবারি, ইউসুফ (আ.)-এর জুব্বা ও পাগড়ি ইত্যাদি। এ ছাড়া একাধিক সাহাবির ব্যবহৃত তরবারি, হজরত ফাতেমা (রা.)-এর জামা, চাদর, জায়নামাজ ও সিন্দুক (বক্স) রয়েছে এই জাদুঘরে।
মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে কাবাঘরের ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল তুর্কি সুলতানদের ওপর। তাঁরা কাবাঘরে ব্যবহৃত ঝাড়বাতি, মোমদানি, গোলাপ জলের পাত্র ও কোরআনের অনুলিপি সরবরাহ করতেন। নতুন আসবাব প্রেরণের পর পুরনো আসবাব টপাকোপিতে নিয়ে আসা হতো। এ জন্য পবিত্র কাবাঘরে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসও বিশেষ এই কক্ষে সংরক্ষিত রয়েছে। যেমনÍকাবাঘরের তালা-চাবি, ছাদের পানির নালা, দরজা, হাজরে আসওয়াদের খাপ, গিলাফ, কাবা প্রাঙ্গণের মাটি ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে মসজিদে নববী ও মসজিদুল আকসার বিভিন্ন সময়ের মডেল, কোরআনের আয়াত অঙ্কিত কাঠের টুকরা, কোরআনের প্রাচীন কপি ও রেহাল, রুপার পাত্র, প্রাচীন জায়নামাজ ইত্যাদি।
প্রতি রমজানের ১৩ ও ১৪ তারিখ উসমানীয় সুলতান নিজ হাতে পবিত্র স্মারকগুলো গোলাপ জল দিয়ে পরিষ্কার করতেন। সুলতান অসুস্থ থাকলে বা কোনো কাজে দেশের বাইরে থাকলে তিনি বিশেষ কাউকে এই দায়িত্ব অর্পণ করতেন। পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ হলে ১৫ রমজান সুলতান ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জুব্বা পরিদর্শনে যেতেন। ব্যক্তিগত এই কক্ষে সুলতান সেলিম রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাদর নিয়ে আসার সময় থেকে এখানে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াত হয়। খেলাফতের পতনের পর ধর্মনিরপেক্ষ তুর্কি রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার পরও এই ধারা অব্যাহত ছিল। সম্প্রতি তুর্কি সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থায়ীভাবে কোরআনের হাফেজ নিয়োগ দিয়েছে।
‘দ্য হলি রিলিক্স’ চার ভাগে বিভক্ত। ১. দ্য ডেস্টিমাল চেম্বার : এখানে রয়েছে পূর্ববর্তী নবী (আ.)-এর স্মৃতিচিহ্ন। যেমন ইবরাহিম (আ.)-এর পাত্র, ইউসুফ (আ.)-এর পাগড়ি, মুসা (আ.)-এর লাঠি, দাউদ (আ.)-এর তলোয়ার, ইউহান্নার (খ্রিস্টধর্ম প্রচারক) ভাঁজ করা কাগজ ও মুহাম্মদ (সা.)-এর পায়ের দাগ বা চিহ্ন ইত্যাদি।
২. সাদরিভানি সোফা : এতে রাখা হয়েছে, কাবাঘরের চাবি, ছাদের নালা, হাজরে আসওয়াদের খাপ, দরজা এবং সাহাবি (রা.)-এর তলোয়ার ও স্মৃতিচিহ্ন।
৩. দ্য অডিয়েন্স চেম্বার : এটা হাউস অব পিটিশন ও পবিত্র ভা-ার নামেও পরিচিত। এতে রয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দাঁত, দাড়ি, সিল, তাঁর নামাঙ্কিত চিঠি, তলোয়ার, ধনুক ইত্যাদি। এখানেই সর্বক্ষণ কোরআন তিলাওয়াত করা হয়।
৪. দ্য চেম্বার অব দ্য ব্লিজড মেন্টল : এখানে রয়েছে মুহাম্মদ (সা.)-এর চাদর ও পতাকা। বলা হয়, সংরক্ষিত এই চাদরটি রাসুলুল্লাহ (সা.) কবি কাব বিন জুহাইরকে উপহার দেন। অসুস্থ কবি মহানবী (সা.)-এর প্রশংসায় কবিতা লিখলে স্বপ্নযোগে এই অনন্য উপহার লাভ করেন তিনি। আর পতাকাটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যবহৃত অথবা তাঁর সময়ে তৈরি। তুর্কি সুলতানরা এই পতাকাকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করতেন। গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তাঁরা পতাকাটি বহন করতেন। হাবসবার্গস (১৫৯৩ খ্রি.) ও হাঙ্গেরি (১৫৯৪ খ্রি.) যুদ্ধে পতাকাটি ব্যবহার করেন তুর্কি সুলতান তৃতীয় মুহাম্মদ। অবশ্য ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইগার বিজয়ের পর পতাকাটি তুর্কি বাহিনীর বিজয়ের প্রতীক হিসেবে গণ্য হতো। ১৮২৬ সালের পর তুর্কি বাহিনীর পতাকা বহনের রীতি পরিহার করা হয়।
0 Comments:
Post a Comment