নছীহতে উম্মুল উমাম আলাইহাস সালাম -(১ম খণ্ড) নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত মুবারক পালনের অফুরন্ত ফযীলত-পর্ব-৩


 নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত মুবারক পালনের অফুরন্ত ফযীলত-পর্ব-৩

৪ঠা মুহররম, ১৪৪২ হিজরী (ইয়াওমুল ইসনাইন শরীফ)

মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ মুবারক করেন,

وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ﴿٣﴾ سورة القلم 

নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী। [সূরা কলম শরীফ: ৪]

মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সুমহান চরিত্রের অধিকারী করেছেন, তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُوْلِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ﴿۲۱﴾ سورة الاحزاب

অবশ্যই তোমাদের জন্য নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ মুবারক। সুবহানাল্লাহ! [সূরা আহযাব শরীফ: ২১]

এই আদর্শ মুবারক গ্রহণ করা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ

মুবারক করেন,

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (۳۱) آل عمران

হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা খলিক মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনাকে মুহাব্বত করে থাকো, তাহলে তোমরা আমার অনুসরণ করো। তাহলে মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদেরকে মুহাব্বত করবেন এবং তোমাদের গুনাহখতা ক্ষমা করে দিবেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু। সুবহানাল্লাহ! [সূরা আলে ইমরান শরীফ: ২১]

সুতরাং যারা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদর্শ মুবারক উনার অনুসরণ করবে তারা মহান আল্লাহ পাক উনার মুহাব্বত লাভ করবে এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। এছাড়া আরো অসংখ্য নিয়ামত লাভে ধন্য হবে। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,

وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا (۵۴) سورة النور

আর যদি তোমরা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইত্তেবা তথা অনুসরণ করো, তাহলেই তোমরা সম্মানিত হিদায়েত মুবারক লাভ করবে। সুবহানাল্লাহ! [সূরা নূর শরীফ: ৫৪]

আর পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

فَمَنْ أَخَذَ بِسُنَّتِي فَقَدِ اهْتَدَى وَ مَنْ تَرَكَهَا ضَلَّ .

যে ব্যক্তি আমার মহাসম্মানিত সুন্নত মুবারক গ্রহণ করবেন, তিনি অবশ্যই হিদায়েত মুবারক লাভ করবেন। সুবহানাল্লাহ! আর যে ব্যক্তি মহাসম্মানিত সুন্নত মুবারক ছেড়ে দিবে, সে গোমরাহ হবে। নাউযুবিল্লাহ!

[আল মু'জামুল কাবীর লিত ত্ববারানী ৭/২৫২]

অন্যত্র বর্ণিত রয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ مَالِكِ بْنِ أَنَسٍ رَحْمَةُ اللَّهِ عَلَيْهِ مُرْسَلًا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِهِ. (رواه الموطا)

হযরত মালেক ইবনে আনাস রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে মুরসাল সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমি তোমাদের কাছে দু'টি বিষয় রেখে যাচ্ছি। এই বিষয় দু'টি আঁকড়ে ধরে থাকলে কখনই গোমরাহ হবে না। ১. মহান আল্লাহ পাক উনার কিতাব মুবারক ২. পবিত্র সুন্নাহ শরীফ তথা পবিত্র হাদীছ শরীফ। [মুয়াত্তা শরীফ]

পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ حَفِظَ سُنَّتِي أَكْرَمَهُ اللَّهُ تَعَالَى بِأَرْبَعِ خِصَالٍ الْمَحَبَّةُ فِي قُلُوْبِ الْبَرَرَةِ وَالْهَيْبَةُ فِي قُلُوْبِ الْفَجَرَةِ وَالسَّعَةُ فِي الرِّزْقِ وَالتَّقَةُ فِي الدِّيْنِ.

মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যে ব্যক্তি আমার সুন্নত মুবারক হিফাযত করবে, মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাকে চারটি ছিফত বা গুণ দ্বারা সম্মানিত করবেন:-

১. নেককারদের অন্তরে সুন্নত পালনকারী ব্যক্তির প্রতি মুহাব্বত পয়দা করার দ্বারা সুন্নত পালনকারী ব্যক্তি উনাকে সম্মানিত করবেন। ২. পাপীদের অন্তরে সুন্নত পালনকারী ব্যক্তি সম্পর্কে ভয়-ভীতি পয়দা করার দ্বারা সুন্নত পালনকারী ব্যক্তি উনাকে সম্মানিত করবেন।

৩. রিযিকের ব্যাপারে সচ্ছলতা দান করার দ্বারা সুন্নত পালনকারী ব্যক্তি উনাকে সম্মানিত করবেন।

৪. দ্বীনের ব্যাপারে দৃঢ়তা দান করার দ্বারা সুন্নত পালনকারী ব্যক্তি উনাকে সম্মানিত করবেন। অর্থাৎ সম্মানিত দ্বীন উনার উপর ইস্তিক্বামত থাকার তাওফীক দান করবেন। [তাফসীরে হাক্কী ৭/২৪৫, তাফসীরে রুহুল বয়ান-৩/২৬২]

পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلَاثَةٌ لَا تَمَسَّهُمْ فِتْنَةَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ الْمُقِرُّ بِالْقَدَرِ وَالَّذِي لَا يَنْظُرُ فِي النُّجُوْمِ وَالْمُتَمَسِكُ بِسُنَّتِي.

হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, তিন প্রকার লোক রয়েছেন যাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের কোনো ফিতনা (বিপদ-আপদ, আযাব-গযব) স্পর্শ করবে না। (১) যাঁরা তাকদীরের উপর বিশ্বাস করেন, (২) যাঁরা তারকা দেখেন না অর্থাৎ নক্ষত্রের প্রভাব বিশ্বাস করেন না এবং (৩) যাঁরা আমার পবিত্র সুন্নত মুবারক দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবেন। সুবহানাল্লাহ!

[জামি'উল আহাদীছ ১১/৪৮০, জাম'উল জাওয়ামি' ১/১১৩৭৮, আল ফিরদাউস ২/৯৬ ইত্যাদি]

পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ تَمَسَّكَ بِسُنَّتِي عِنْدَ فَسَادِ أُمَّتِي فَلَهُ أَجْرُ

مِائَةِ شَهِيدٍ. (رواه بیهقی)

হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যে ব্যক্তি আমার উম্মতের ফিতনা-ফাসাদের যামানায় একটি সুন্নত মুবারক আঁকড়ে ধরবে, তার জন্য রয়েছে একশত শহীদের সওয়াব। সুবহানাল্লাহ!

[বাইহাক্বী শরীফ]

পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ الله تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَحَبُّ سُنَّتِي فَقَدْ أَحَبَّنِي وَمَنْ أَحَبَّنِي كَانَ مَعِيَ فِي

الْجَنَّةِ . (رواه الترمذي)

হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যে ব্যক্তি আমার সুন্নত মুবারক উনাকে মুহাব্বত করল সে অবশ্যই আমাকে মুহাব্বত করল আর যে আমাকে মুহাব্বত করল সে আমার সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সুবহানাল্লাহ! [তিরমিযী শরীফ]

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ الْمُتَمَسِكُ فِيْهِ بِسُنَّتِي عِنْدَ اختلاف أُمَّتِي كَالْقَابِضِ عَلَى الْجَمْرِ.

হযরত ইবনে মাস'ঊদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, মানুষের উপর এমন একটি সময় আসবে, যে সময়টি হবে আমার উম্মতের ইখতিলাফের সময়। তখন আমার একখানা পবিত্র সুন্নত মুবারক দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরে থাকা, হাতের তালুতে জ্বলন্ত অঙ্গার রাখার ন্যায় অত্যন্ত কঠিন হবে। নাউযুবিল্লাহ!

[নাওয়াদিরুল উচ্ছ্বল ২/৩২৭, জামি'উল আহাদীছ ২৩/৪৫৪, জাম'উল জাওয়ামি' লিস সুয়ূত্বী ১২/৭৯৫ ইত্যাদি]

উল্লিখিত ফযীলত লাভ করতে হলে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত মুবারক উনার ইত্তেবা বা অনুসরণ করতে হবে। সুন্নত মুবারক উনার অনুসরণ বলতে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদর্শ মুবারক উনার অনুসরণ-অনুকরণ করাকেই বুঝানো হয়েছে। নিজস্ব কোনো মতাদর্শ বা সুন্নতকে বুঝানো হয়নি। আর এর দ্বারা কোনো ফযীলতও লাভ করা যাবেনা। দৈনন্দিন জীবনে আমলের জন্য কিছু সুন্নতের বর্ণনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. মুসলমান পরস্পরের সাথে দেখা-সাক্ষাত হলে সালাম বিনিময় করা এবং মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করা। বিপদ-আপদে পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগীতা করা।

২. সর্বাবস্থায় প্রত্যেকের সাথে উত্তম ব্যবহার করা এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও গালি-গালাজ না করা, ঠাট্টা-বিদ্রূপ বা উপহাস না করা।

৩. সুন্নতের অনুসরণে নিত্য সামগ্রী ব্যবহার করা এবং সুন্নতের অনুসরণে পোশাক-পরিচ্ছদ বানিয়ে পরিধান করা। প্রত্যেক কাজ বিসমিল্লাহ বলে ডান দিক থেকে শুরু করা।

৪. খাবার খাওয়ার সময় দস্তরখানা বিছিয়ে মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে বিসমিল্লাহ বলে সামান্য লবণ মুখে দিয়ে বসে ডান দিক থেকে খাবার খাওয়া শুরু করা। দুপুরে খাওয়ার পর কিছু সময় কায়লুলা বা বিশ্রাম করা।

৫. নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে সমস্ত খাবার গ্রহণ করেছেন সে সমস্ত খাবার সুন্নতের খেয়ালে অর্থাৎ মনে মনে সুন্নত পালনের নিয়ত করে খাওয়ার চেষ্টা করা। সুন্নতি খাবার যেমন- রুটি, গোশত, ভাত, মাছ, ডাল, শাক-সবজি, ফল, পনির, ঘি, মাখন, দুধ, ডিম, জয়তুন, ত্বীন, মধু, শশা ইত্যাদি।

৬. ইস্তিঞ্জাখানায় প্রবেশের সময় প্রথমে বাম পা প্রবেশ করানো বের হওয়ার সময় ডান পা দিয়ে বের হওয়া।

৭. চোখে সুরমা দেয়া। মাথা ডান দিক থেকে আঁচড়ানো, মাঝখানে সিঁথি করা, জয়তুনের তেল ব্যবহার করা, পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন থাকা। মিসওয়াক করা।


৮. শোয়ার সময় ওযু করে বিছানা ঝেড়ে ডান কাত হয়ে শোয়া।

মহান আল্লাহ পাক তিনি যেন আমাদেরকে সর্বাবস্থায় নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত মুবারক পালন করার যোগ্যতা দান করেন। (আমীন)





















0 Comments: