আজ ঐতিহাসিক 'ইয়াওমুল ফিল' বা হস্তীবাহিনী দিবস :
আজ পবিত্র মুহররমুল হারাম শরীফ মাসের ২২ তারিখ। আজকের এই দিনেই আবরাহা লা'নতুল্লাহি আলাইহি মহাপবিত্র ও মহাসম্মানিত কা'বা শরীফ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা শরীফ-এ এসেছিল।
পৃথিবীতে খ্বলিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার অনন্য নিদর্শন হলো- মহাপবিত্র ও মহাসম্মানিত 'কা'বা শরীফ'। ভৌগোলিকভাবে গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে বরকতময় পবিত্র কা'বা শরীফ অবস্থান- দুনিয়াবাসীর নিকট এটাও একটি আশ্চর্যজনক বিষয়! কা'বাগৃহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- ইহা পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও সুপ্রাচীন ঘর। খ্বলিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন- "নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর; যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। সেটিই হচ্ছে এ ঘর; যা পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত।" (সূরাতুল আল ইমরান শরীফ : আয়াত শরীফ নম্বর ৯৬)
ইসলামী জ্ঞানের তথ্যমতে- পৃথিবীতে ভূমির সৃষ্টি হয় বিশাল সাগরের মাঝে; যা পবিত্র মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কা'বা ঘরের স্থলকে কেন্দ্র করেই। তাই, পবিত্র কা'বা ঘরের নিচের জমিনটুকু-ই হচ্ছে- পৃথিবীর প্রথম মাটি। ধীরে ধীরে এর চারপাশ ভরাট হয়ে সৃষ্টি হয় একটি বিশাল মহাদেশের। পরে এক মহাদেশ থেকেই ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হয় সাত মহাদেশের। মাটিতে রূপান্তর হওয়ার আগে কা'বা সাদা ফেনা আকারে ছিল। সে সময় পৃথিবীতে পানি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। খ্বলিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার আরশ মুবারকও ছিল পানির উপর। মাটি বিছানোর পর জমিন হেলতে-দুলতে থাকে। এটাকে স্থির করার জন্য খ্বলিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেন। এ সম্পর্কে খ্বলিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন- "তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন; যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয় অর্থাৎ হেলে না যায়।" (সূরাতুল আল নাহল শরীফ : আয়াত শরীফ নম্বর ১৫)
এভাবেই পবিত্র কা'বা শরীফ-এর বরকতে পৃথিবী স্থির হয়ে যায়। ধীরে ধীরে এখান থেকেই মানবসভ্যতার গোড়াপত্তন শুরু হয়।
আবরাহা লা'নতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক পবিত্র কা'বা শরীফ আক্রমণের ইতিহাস : আবরাহা ছিল ইথিওপিয়ার (তৎকালীন হাবশা) সম্রাট নাজ্জাশীর পক্ষ থেকে ইয়ামেনের গভর্নর। এ সম্পর্কে ইতিহাসে বর্ণিত রয়েছে, যখন ইথিওপিয়ার সম্রাট নাজ্জাশী কর্তৃক এক ইথিওপিয়াবাসী-কে ইয়ামেনের গভর্নর নিয়োগের পরোয়ানা ঘোষণা করা হলো; তখন ইয়ামেনের সৈন্যরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলো। তারা ইথিওপিয়াবাসী ওই ব্যক্তির পরিবর্তে আবরাহাকে ইয়ামেনের গভর্নর পদে নিয়োগের দাবি জানাতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত আবরাহাকেই ইয়ামেনের গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়া হলো। আবরাহা ছিল ইথিওপিয়ার আদুলিস নৌবন্দরের এক গ্রীক খ্রিস্টান ব্যবসায়ীর ক্রীতদাস।
যাইহোক, ইয়ামেনের গভর্নর হয়ে আবরাহা যখন দেখলো- আরববাসীসহ সমগ্ৰ বিশ্বের মুসলমানগণ পবিত্র কা'বা শরীফ-এ হজ্জব্রত পালন করছেন এবং এই পবিত্র কা'বা শরীফ-এর উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন সেখানে আগমন করছেন। সে সুবিধায় পবিত্র মক্কা নগরী অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ কারণে আবরাহা ঈর্ষায় ফেটে পড়ে।
সে পবিত্র কা'বা শরীফ-এর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ইয়ামেনের তৎকালীন রাজধানী সানআ'য় একটি বিরাট গির্জা নির্মাণ করলো এবং আরববাসীসহ সমগ্ৰ বিশ্বের মুসলমানদেরকে পবিত্র কা'বা শরীফ-এর পরিবর্তে সেখানে হজ্জব্রত পালন করার আহবান জানালো। আরব ঐতিহসিকগণ একে 'আল কালীস' নামে উল্লেখ করেছেন। আবরাহা আশা করেছিল- আস্তে আস্তে মানুষ এখানে আসা শুরু করবে এবং ইয়ামেন নতুন কেন্দ্রে পরিণত হবে। (নাউযুবিল্লাহ)
কিন্তু আরববাসীগণ তার এ আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। ইতিমধ্যে 'বনু কিনানা' গোত্রের লোকজন যখন এ সংবাদ অবগত হলেন; তখন তাঁরা এক রাত্রে গোপনে আবরাহা কর্তৃক নির্মিত গির্জায় প্রবেশ করে তার চারপাশে ইস্তেঞ্জা (মানুষের মল-মূত্র) লেপন করে একদম নোংরা করে ফেললেন। পরের দিন এ দৃশ্য দেখে আবরাহা বুঝতে পারলো যে, এটা সম্পূর্ণ মুসলমানদের কাজ! তাই সে ভয়ানক ক্রোধান্বিত হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে শপথ গ্রহণ করে বললো যে, "মুসলমানদের কা'বাকে গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আমি স্থির হয়ে বসবো না।" (নাউযুবিল্লাহ)
যুগশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক মুহম্মদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে, নবনির্মিত গির্জার এই পরিবেশ দেখে সে ইথিওপিয়ার বাদশাহ নাজ্জাসীর নিকট চিঠি লিখে জানায়, "আমি আরবদের হজ্জকে মক্কার কা'বার পরিবর্তে সানআ'র গির্জার দিকে ফিরিয়ে না দিয়ে ক্ষান্ত হবো না।"
অবশেষে ৫৭০ ঈসায়ী সনের ২২শে মুহররমুল হারাম শরীফ তারিখে (হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশের ৫০ দিন আগে) 'মাহমুদ' নামক সবচেয়ে শক্তিশালী একটি হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করে ১৩টি শক্তিশালী হস্তী আর ৬০ হাজার অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে পবিত্র কা'বা শরীফ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হয়।
এ সেনাদল তায়েফের নিকটবর্তী হলে 'বনু সকীফ' সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ আশঙ্কা করে যে, হয়তো তাদের 'লাত' দেবতার মন্দির তারা ভেঙে ফেলবে। ফলে তাদের সরদার মাসউদ একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আবরাহার সাথে দেখা করে। তারা তাকে বলে, "আপনি যে উপাসনালয়টি ভাঙতে এসেছেন; আমাদের এ মন্দিরটি সে উপাসনালয় নয়। সেটি মক্কায় অবস্থিত। কাজেই আপনি আমাদেরটায় হাত দেবেন না। আমরা মক্কার পথ দেখাবার জন্য আপনাকে পথ প্রদর্শক সংগ্রহ করে দিচ্ছি।"
আবরাহা তাদের এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। ফলে 'বনু সকীফ' সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ 'আবু রিগাল' নামক এক ব্যক্তিকে তার সাথে দিয়ে দেয়। মক্কা পৌঁছতে যখন আর মাত্র তিন ক্রোশ বা ৬ মাইল পথ বাকি রয়েছে,; তখন 'আবু রিগাল' অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
এরপর আবরাহা মক্কাবাসীদের কাছে নিজের একজন দূতকে পাঠায়। তার মাধ্যমে মক্কাবাসীদের কাছে এই মর্মে বাণী পাঠায়- "আমি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমি এসেছি শুধুমাত্র এই ঘরটি (কা'বা শরীফ) ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। যদি তোমরা যুদ্ধ না কর; তাহলে আমি তোমাদের প্রাণ ও ধন-সম্পত্তির কোনো ক্ষতি করবো না।"
অতঃপর সে অপর আরেক দূতকেও মক্কাবাসীদের কাছে পাঠিয়ে জানায় যে, "মক্কাবাসীরা যদি তার সাথে কথা বলতে চায়- তাহলে তাদের সরদারকে যেন আমার নিকট পাঠিয়ে দেয়।"
আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দাদা সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি ছিলেন মক্কার সরদার। দূত তার সাথে সাক্ষাৎ করে আবরাহার পয়গাম তার কাছে পৌঁছয়ে দেয়। তিনি বলেন, "আবরাহার সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। এটা খ্বলিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার ঘর; তিনি চাইলে উনার ঘর রক্ষা করবেন।"
দূত বলে, "আপনি আমার সাথে আবরাহার কাছে চলুন।"সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি সম্মত হন এবং দূতের সাথে আবরাহার কাছে যান।
সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি এতই সুশ্রী, আকর্ষণীয় ও প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে, আবরাহা তাকে দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সে সিংহাসন থেকে নিচে নেমে তাঁর সাথে এসে বসে। সে প্রথমে জিজ্ঞেস করে- "আপনি কি চান?"
সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন : "আমার যে উটগুলো ধরে নেয়া হয়েছে, সেগুলো আমাকে ফেরত দেয়া হোক।"
আবরাহা বললো : "আপনাকে দেখে তো আমি বড় প্রভাবিত হয়েছিলাম। কিন্তু আপনি নিজের উটের দাবি জানাচ্ছেন, অথচ এই যে ঘরটা আপনার ও আপনার পূর্ব-পুরুষদের ধর্মের কেন্দ্র সে সম্পর্কে কিছুই বলছেন না। আপনার এ বক্তব্য আপনাকে আমার দৃষ্টিতে মর্যাদাহীন করে দিয়েছে।"
প্রত্যুত্তরে সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন : "আমি তো কেবল আমার উটের মালিক এবং সেগুলোর জন্য আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি। আর এই ঘরের একজন মালিক রয়েছেন। তিনি নিজেই এই ঘরের হেফাজত করবেন।"
আবরাহা দাম্ভিকতার সাথে জবাব দেয়, "তিনি তো এই ঘরকে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন না।"
সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন : "আচ্ছা ঠিক আছে, এ ব্যাপারে আপনি জানেন ও তিনিই ভালো জানেন।" এ কথা বলে তিনি সেখান থেকে উঠে পড়লেন।
আবরাহা তাঁকে তাঁর উটগুলো ফিরিয়ে দেয়। আবরাহার নিকট থেকে ফিরে এসে সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি কুরাইশদেরকে বললেন : "আপনারা নিজ-নিজ পরিবার-পরিজনদের নিয়ে পাহাড়ের উপর চলে যান। তাহলে তাঁরা ব্যাপক গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা পাবেন।"
অতঃপর সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি কুরাইশদের কয়েকজন সরদারকে সাথে নিয়ে পবিত্র কা'বা শরীফ-এ গিয়ে হাজির হন। সবাইকে নিয়ে পবিত্র কা'বা শরীফ-এর দরজার কড়া ধরে খ্বলিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট সরাসরি এই বলে দোয়া করতে থাকেন-
"আয় আল্লাহ পাক! তাদের মোকাবিলায় আপনি ছাড়া কারো প্রতি আমার আশা নেই। হে আমার রব! তাদের হাতে থেকে আপনি আপনার পবিত্র ঘরকে হেফাজত করুন। এই ঘরের শত্রু আপনার শত্রু। এই জনপদকে ধ্বংস করা থেকে আপনি তাদেরকে বিরত রাখুন। আপনি আপনার ঘর ও এই ঘরের খাদিমদের হিফাযত করুন।"
এমন সময়ে খ্বলিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি এক ঝাঁক ছোট ছোট পাখি প্রেরণ করলেন। সেই পাখিগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাথরের ছোট ছোট টুকরো সৈন্যদের উপর নিক্ষেপ করতে লাগলো। প্রত্যেকটি পাখি তিনটি করে পাথরের কংকর নিয়ে আসতো একটি ঠোঁটে এবং দুইটি দুই পায়ে। কংকরগুলোর আকার-আকৃতি ছিল ছোলার মতো। কিন্তু কংকরগুলো যার যে অঙ্গে লাগতো সেই অঙ্গ ফেটে গিয়ে সেখান দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে হতে সে মারা যেত।
এ অলৌকিক ঘটনায় সকলেই ভীষণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। প্রাণভয়ে পলায়নের উদ্দেশ্যে যখন বেপরোয়াভাবে ছুটাছুটি শুরু করলো তখন পদতলে পিষ্ট হয়ে অনেকেই প্রাণত্যাগ করলো। কংকরাঘাতে ছিন্নভিন্ন এবং পদতলে পিষ্ট হয়ে মুহূর্তের মধ্যে বীরপুরুষরা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লো।
এদিকে আবরাহার উপর খ্বলিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি এক মুসিবত প্রেরণ করলেন যে, তার আঙ্গুল সমূহের জোড়া খুলে গেল। তার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে হৃদপিণ্ড বেরিয়ে এলো। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পাখির বাচ্চার মতো হয়ে গেলো। অবশেষে সে ইয়ামেনের রাজধানী সানাআ'য় ফিরে যেতে চাইলো। কিন্তু সানাআ'য় ফিরে যেতে না যেতেই সে মৃত্যুমুখে পতিত হলো।
0 Comments:
Post a Comment