মহিলাদের ইসলামিক পর্দা কেমন হবে কুরআন সুন্নাহর আইনে।

মহিলাদের ইসলামিক পর্দা কেমন হবে কুরআন সুন্নাহর আইনে।



প্রসঙ্গ পর্দা: হাত-পা, মুখ খোলা রাখবেন, নাকি পুরো শরীর ঢাকবেন? দেখি ইসলাম কি বলে?কুরআন শরীফ হাদীছ শরীফে সব বর্নিত থাকার পরও কিছু মূর্খ তথা নব্য আবু জাহিল পর্দার বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। কেউবা আবার নামাজের হাদীছ শরীফ শরয়ী পর্দার মূল হুকুমের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে।

নিম্নে এর দলীল ভিত্তিক আলোচনা করা হলো: কুরআন শরীফে
قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ
পবিত্র কুরআন শরীফে মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন ‘হে নবী (ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)! মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। এটি তাদের জন্য পূত-পবিত্র পদ্ধতি। তারা যা কিছু করে, আল্লাহ তা জানেন।( সুরাঃ নূর, আয়াত- ৩০)
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُوْلِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاء وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُون
আর মুমিন মহিলাদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। আর তারা যেন স্বীয় সাজসৌন্দর্য না দেখায়, তবে যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় । তা ছাড়া তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে। এবং তারা কারো সামনে তাদের সাজসৌন্দর্য প্রকাশ করবে না এই মাহরাম আত্মীয়গণ ব্যতীত যথা স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, ভ্রাতা ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত, বাঁদী, নারীর প্রতি স্পৃহাহীন সেবক, ওই সব বালক যারা নারীর গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়নি। তারা যেন পথচলার সময় এমন পদধ্বনি না করে যাতে তাদের অপ্রকাশিত সৌন্দর্য পদধ্বনিতে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরাঃ নূর, আয়াত-৩১)।

লক্ষনীয়, আয়াত শরীফ এই অংশে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ
“তারা যেন বক্ষদেশে নিজদের ওড়না ফেলে রাখে” । ‘খুমুরুন’ শব্দটি ‘খিমার’ শব্দের বহুবচন। ‘খিমার’ ঐ কাপড়কে বলা হয় যা নারীরা মাথায় ব্যবহার করে এবং তাদ্বারা মুখ, গলা ও বক্ষ পানি ভরা কুপের ন্যায় আবৃত হয়ে যায়। সুতরাং,মুখ, গলা আবৃত করার নির্দেশের দ্বারা চেহারা আবৃত করার র্নিদেশ প্রমাণিত হয়। কারণ, নারীর মুখমন্ডল তার যাবতীয় রূপ ও সৃষ্টিগত সৌন্দর্যের মূল উৎস ও আকর্ষণ। কেউ যখন বিয়ের জন্য পাত্রী দেখে তখন মুখই দেখে। তাহলে এ মুখ কিভাবে পরপূরুষের সামনে উম্মুক্ত রাখা যেতে পারে?

মূলত: খুমুরুন শব্দ দ্বারা মুখ থেকে বক্ষদেশ পর্যন্ত ঢেকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মাথার ওড়না দিয়ে বক্ষদেশ পর্যন্ত ঢাকতে হলে অবশ্যই মুখ ঢাকতে হবে। যা নিম্মে বর্নিত দলীল সমূহ দ্বারা আরো স্পষ্ট হবে।
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى
মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘(হে নারীগণ!) তোমরা আপন গৃহে অবস্থান করো এবং জাহেলিয়াতের যুগের মতো সাজসজ্জা সহকারে অবাধে চলাফেরা করো না।’ (সূরা আহজাবঃ আয়াত-৩৩)
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِن وَرَاء حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ
মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর যখন তাদের কাছে তোমরা কিছু চাইবে, তখন (তারা) তোমাদের দৃষ্টির অন্তরালে হিজাব বা পর্দার ভেতরে অবস্থান করবে, আর তোমরা তাদের কাছে পর্দার বাইরে থেকে চাইবে। তোমাদের এ কাজ তোমাদের অন্তর ও তাদের অন্তরকে কুচিন্তার আবরণ থেকে উত্তমভাবে পাক-পবিত্র রাখার উপায় হবে।’ (সূরা আহজাবঃ আয়াত-৫৩)।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاء الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন, ‘হে নবী(ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)! স্ত্রীগণকে বলে দিন যে তারা যেন চাদরের কিছু অংশ নিজেদের মুখের ওপর টেনে দেয়, এতে তাদের চেনা সহজতর হবে ফলে তাদের কেউ উত্ত্যক্ত করবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সূরা আহজাবঃ আয়াত-৫৯)

উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা আলাইহাস সালাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি এবং মায়মুনা আলাইহাস সালাম রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম -এর কাছে থাকাকালীন হঠাৎ অন্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উম্মে মাকতুম তথায় আগমন করলেন। তিনি আমাদের বললেনঃ আপনারা কাছে পর্দা করো। এই ঘটনার সময়কাল ছিল পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর।

উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালমা আলাইহাস সালাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম তিনি তো অন্ধ, আমাদের দেখতে পাবেন না এবং আমাদের চেনেনও না। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বললেন, আপনারা তো অন্ধ নও, আপনারা উনাকে দেখছেন। (আবু দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ)

হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘হে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রথম দৃষ্টির পর দ্বিতীয় দৃষ্টি যেন নিক্ষেপ করা না হয়। প্রথমটি ক্ষমার যোগ্য কিন্তু দ্বিতীয়টি নয়।’

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা আলাইহাসসালাম বলেন,
كان الركبان يمرون بنا و نحن محرمات مع الرسول فإذا حاذونا سدلت إحدانا جلبابها على وجهها من رأسها فإذا جاوزنا كشفناه.
আমরা রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে এহরাম অবস্থায় ছিলাম, উষ্ট্রারোহী পুরুষরা আমাদের পার্শ্বদিয়ে অতিক্রম কালে আমাদের মুখামুখি হলে আমরা মাথার উপর থেকে চাদর টেনে চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিতাম। তারা আমাদেরকে অতিক্রম করে চলে গেলে আমরা মুখমন্ডল খুলে দিতাম। (আহমাদ শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ)

সহিহ বুখারি ও মুসলিমে শরীফে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা আলাইহাসসালাম হতে বর্ণিত আছে:
كان رسول الله يصلي الفجر معه نساء من المؤمنات متلفعات بمروطهن ثم يرجعن إلى بيوتهن ما يعرفهن أحد من الناس.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার ফজরের সালাতে কিছু সংখ্যক মহিলা চাদর পরিহিত অবস্থায় পরিপূর্ণ পর্দা করত: তাঁর পিছনে সালাত আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে আসতেন। সালাত শেষে আপন আপন গৃহে ফেরার পথে তাদেরকে চেনা যেত না। উল্লেখ্য, যদি মুখ খোলা থাকতো তাহলে অবশ্যই চেনা যেত। আরেকটা বিষয়: মহিলাদের মসজিদে গমন পরবর্তীতে নিষিদ্ধ হয়।

হাবীবুল্লাহ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: من جر ثوبه خيلاء لم ينظر الله إليه يوم القيامة
“যে ব্যক্তি অহংকার বশে (পায়ের গোড়ালীর নীচে) কাপড় ঝুলিয়ে চলবে আল্লাহ পাক কিয়ামত দিবসে তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করবেন না”।
উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা আলাইহাসসালাম জিজ্ঞাসা করলেন, নারীগণ চাদরের নিম্নাংশ কতটুকু পরিমাণ ঝুলিয়ে রাখবে? রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অর্ধহাত পরিমাণ। উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা আলাইহাসসালাম আবারও প্রশ্ন করলেন এ অবস্থায় মহিলার পা দৃষ্টিগোচর হবে। তদুত্তরে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তাহলে একহাত পরিমাণ ঝুলিয়ে রাখবে এর অধিক নয়।

এ হাদীসে প্রমাণিত হল যে, মহিলার পা আবৃত রাখা ওয়াজিব, যা উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা আলাইহাসসালাম এবং মহিলা ছাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনাদের অজানা ছিল না। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মহিলার পা দর্শনে যতটুকু ফিৎনার আশংকা রয়েছে তার চাইতে হাত ও মুখমন্ডল দর্শনে ফিৎনার আশংকা বেশি । অতএব পা দর্শন যা ফিৎনার নগণ্যতম মাধ্যম তাতে সতর্কবাণীর ফলে হাত ও মুখমন্ডল দর্শন যা সন্দেহাতীতভাবে অধিকতর ফিৎনাস্থল তার বিধান স্পষ্ট হয়ে গেল। আপনারা ভালোভাবে অবগত আছেন যে, প্রজ্ঞাভিত্তিক সুসম্পূর্ণ নিখুত শরিয়তে মহিলার পা যা ফিৎনার নগণ্যতম পন্থা তাতে পর্দার নির্দেশ দিয়ে হাত ও মুখমন্ডল যা ফিৎনার মূল উৎস তা উম্মুক্ত রাখার অনুমতি প্রদান করবে, তা কস্মিণকালেও হতে পারে না। অতএব প্রমানিত হলো মহিলাদের মুখমন্ডল, হাত,পা সবঅঙ্গই পর্দার অন্তর্ভূক্ত।

উল্লেখ্য, অনেকে বুখারী শরীফের দলীল দিয়ে থাকে যে, মুখমন্ডল, হাত-পা খোলা রাখা যায়েজ । কিন্তু সেটা হলো নামাজের হাদীছ শরীফ একমাত্র নামাজের জন্যে প্রযোজ্য। নামাজের মধ্যে মুখমন্ডল হাত-পা মুখ খোলা রাখা যেতে পারে। কিন্তু নামাজের হাদীছ শরীফ অন্যস্থানে খাটালে হবে না। নামাজে এক নিয়ম বাহির এক নিয়ম। আরেকটা বিষয় উল্লেখ্য নামাজ যেহেতু মহিলারা ঘরে পড়বে সেহেতু হাত , মুখ, পা খোলা তার জন্য জায়েজ। কিন্তু যখনই সে ঘর থেকে বের হবে অথবা পর পূরূষের সামনে দিয়ে চলতে হবে তখনই তাকে পুরো শরীরের পর্দা করতে হবে। মহিলাদের পড়াশোনাও করতে হবে। অবস্থানুযায়ী যাদের বিশেষ জরুরী তারা চাকুরী ব্যবসাও করতে পারবে। তবে অবশ্যই সেটা পুরো শরয়ী পর্দার মধ্যে থেকে করতে হবে।



0 Comments: