ইদানিং পত্রিকায় খবরে দেখা যাচ্ছে, ইসলামের নামধারী তথাকথিত বড় বড় শাইখুল হাদীছ, মুফতী, মাওলানা, মুফাস্সিরে কুরআন, খতীব, আমীর সবাই ব্লাসফেমী আইন তলবের ব্যাপারে একাট্টা। ইসলামের প্রতিনিধি দাবী করেও তারা কুরআন-সুন্নাহ্ আইন বাদ দিয়ে ইহুদী, নাছারাদের প্রবর্তিত ব্লাসফেমী আইন তলব করছে।
এক্ষেত্রে ব্লাসফেমী আইনের সংজ্ঞা, ইতিহাস-উৎস্য জানা দরকার।
ব্লাসফেমী আইনের সংজ্ঞা, প্রকৃতি, উৎস ও ক্রমবিকাশ:
Latin Blasphemia থেকে Blasphemy শব্দটি এসেছে। এর শব্দগত অর্থ হলো ঈশ্বর নিন্দা, পবিত্র বিষয়ের নিন্দা, অপবিত্র ভাষা প্রয়োগ ইত্যাদি। (Irreverence in speaking of God or sacred things, profane Language etc.) প্রচলিত অর্থে ব্লাসফেমী আইনটি খ্রীস্টানদের ধর্মীয় বিধির সাথে যুক্ত। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- Blasphemy in English and American Law the criminal offence, of malciously and publicly condemning God. Christ the Bible, or the Christian religion. Although formerly denial of the accepted, doctrines of Christianity was punishable as blasphemy offence has been modified to include only those expression designed to wound the feelings of mankind to excite contempt and hatred against religion or the church or to promote immorality. (The American peoples Encyclopedia vol-3).
বলা হয়েছে- ঈশ্বর, যীশু খ্রীস্ট, বাইবেল অথবা খ্রীস্টান ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ন হয়ে, প্রকাশ্যে দোষারোপ করা ইংলিশ ও আমেরিকান আইনে ফৌজদারী অপরাধ। আগে যদিও খ্রীস্টান ধর্মের গৃহীত মতবাদসমূহ অমান্য করলে ব্লাসফেমী অপরাধ হিসেবে গণ্য হত কিন্তু পরে তা সংশোধিত হয়েছে। সংশোধিত রূপ হল- এমন কিছু যা জনসাধারণের অনুভূতিতে আঘাত হানে, ধর্ম ও চার্চের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও উপহাসের উদ্রেক করে অথবা নীতিহীনতার উদয় ঘটায়। অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, ব্লাসফেমী একান্তই খ্রীস্টানদের ধর্ম রক্ষার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ সম্পর্কে তাদের Old Testament-এ বলা হয়েছে- “And he that blasphemeth the name of the Lord he shall surely be put to death and all the congregation shall certainly stone him. (hev, xx1v.10)
অর্থাৎ তাদের প্রভূর বিরুদ্ধাচারণের জন্য যে ব্যক্তি ব্লাসফেমীর অভিযোগে অভিযুক্ত হবে, তাকে নিশ্চিতভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে এবং ধর্মসভার সকলে তাকে পাথর ছুঁড়ে মারা হবে। এ ক্ষেত্রে অপরাধীকে স্যানিড্রিম নামক ধর্মীয় আদালতে হাজির করা হত। এটি ৭১ সদস্য নিয়ে গঠিত হত এবং এতে দোষী সাব্যস্ত হবার পর তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হতো। প্রত্যেক সাক্ষী তাদের হাত অপরাধীর মাথায় রেখে বলত “Thy blood be on thine own head, which thou trnst brought upon thyself by thine own guilt.” অর্থাৎ “তোমার রক্ত তোমার মাথায় উঠবে, যা তাড়াতাড়ি তোমাকে তোমার শাস্তি পাইয়ে দিবে। অপরদিকে Colliers encyclopedia তে New Testament-এর বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে আরও মজাদার তথ্য। এতে বলা হয়েছে- In the New Testament The Jew accused Christ of Blasphemy (Matt. 1x.3,xv1:65) …but the jews regection of Christ is also regarded as blaspgemy. (Luke x11:65)
অর্থাৎ যে ইহুদীরা হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালামকে নষধংঢ়যবসু-এর দায়ে অভিযুক্ত করে আর যীশুকে অস্বীকার করার কারণে ইহুদীদের বিরুদ্ধেও ব্লাসফেমীর অভিযোগ করা হয়। সুতরাং বলা যায় যে, ব্লাসফেমী ইহুদী ও খ্রীস্টান বা বিশেষ করে খ্রীস্টানদের ধর্ম রক্ষার আইন হিসেবেই ব্যবহৃত হত। এবং তাদের এই ব্লাসফেমীর ধরন ছিল তিন প্রকৃতির। এ সম্পর্কে ‘Faiths of world’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “This sin was distinguished into three kinds which was noticed by-Bingham in his Autiquities of the christian church. The first these was the blasphemy of apostates whom the heathen Persecutors obliged not to only deny; but to curse christ.
The second sort of blasphemy which was visited with the heaviest censures of the church in early time was that of those who made a profession of christianity, but yet either by impious doctrines or profane discourses uttered blasphemous words against God derogatory to his majesty and Honour.
The third species of blasphemy, which was heavily punished in the early church was one of so great importance as to call separate consideration. (that is) Blasphemy against the HOLY GHOST.
অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে হয় যে, তিন ধরনের ব্লাসফেমীর কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম প্রকার হল- স্বপক্ষ বা স্বধর্ম ত্যাগের কারণে ব্লাসফেমী। দ্বিতীয়তঃ যারা খ্রীস্টানতত্ত্বকে একটি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তারা অনেক অখ্রীস্টানীয় মতবাদ বা নিন্দামূলক উপদেশ যা তাদের ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ছিল তা বলত বা প্রকাশ করত। তৃতীয় প্রকার ব্লাসফেমী হল- খ্রীস্টানদের কার্যতঃ পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমী, যা কখনও ক্ষমা করা হত না বা যার চূড়ান্ত শাস্তি নির্ধারিত হত। ঐতিহাসিকদের মতে রোমান সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের (৫২৭-৫৬৫) সময় রাষ্ট্রীয় আইনে ব্লাসফেমীর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- প্রবর্তিত হয়। এ সম্পর্কে Encyclopedia Americana-তে লেখা হয় “The Roman law code of Emperor Justinian prescribed capital punishment as the penalty for blasphemy.”
অর্থাৎ কেবল ধর্মীয় উদ্দেশ্যই নয় বরং এর সাথে তার রাজনৈতিক স্বার্থও বিশেষভাবে কার্যকর ছিল। মূলতঃ এই বিধান করার পিছনে জাস্টিনিয়ানের প্রবল ধর্মানুরাগ সক্রিয় ছিলনা। ছিল রাজতান্ত্রিক কায়েমী স্বার্থ রক্ষার প্রয়াস। খ্রীস্টান ধর্ম শুধু ‘ঈশ্বর প্রভুকেই প্রণিপাত করার’ শুধু ‘তাহারই আরাধনা করার’ কথা বললেও [লুক, ৪ ঃ ৮] পরবর্তীকালে সেন্টপল ‘প্রত্যেক প্রাণীকে প্রাধান্যপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষদের বশীভূত’ থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল ‘ঈশ্বরের নিরূপণ ছাড়া কর্তৃত্ব হয়না এবং যে সকল কর্তৃপক্ষ আছেন, তাহারা ঈশ্বরের নিযুক্ত।’ ‘অতএব, যে কেহ কর্তৃপক্ষের প্রতিরোধী হয়, সে ঈশ্বর নিয়োগের প্রতিরোধ করে।’ [রোমীয়, ১৩ঃ ১-৩] সেন্টপলের এ উক্তিই প্রকৃতি পূজায় অভ্যস্থ রোমান শাসকদের খ্রীস্টধর্ম গ্রহণে বেশ অনুপ্রাণীত করে ছিল। কারণ, সেন্টপলের বক্তব্যের মধ্যে রোমান রাজারা প্রজা-বিদ্রোহ দমনের ধর্মাশ্রয়ী হাতিয়ারের সন্ধান পেয়েছিলেন। সেন্টপলের বক্তব্য অনুযায়ী রোমান রাজকর্তৃপক্ষ ঈশ্বরের নিযুক্ত। এই নিযুক্তির কোন প্রকার বিরোধিতা মুলতঃ ঈশ্বরেরই বিরোধিতা করা- ব্লাসফেমী। এই ছিল ব্লাসফেমী আইন সক্রান্ত ধারণার রাজনৈতিক পটভূমি।
ইউরোপীয় সমাজ ও ইতিহাসের নানা জটিল-কুটিল পথ ধরে ব্লাসফেমী আইন অতঃপর রোমান ক্যাথলিক চার্চের শাসন-শোষণ ও নিপীড়নের নিরঙ্কুশ হাতিয়ারে পরিণত হয় একাদশ শতাব্দীতে, পোপ সপ্তম গ্রেগরির আমলে। তিনি নিজেই রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন এবং তার সময়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও রোমান রাজ্যকে একাকার করে দেন। এরপর তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘চার্চ কখনও ভুল করেনি, কখনও ভুল করবে না, করতে পারে না।’ রাজাকে সিংহাসনচ্যূত করার এবং রাজার উপর থেকে প্রজাদের আনুগত্য তুলে নেয়ার আদেশদানের ক্ষমতাও তিনি চার্চের হাতে ন্যস্ত করেন। সপ্তম গ্রেগরী এ কথাও প্রচার করেন যে, চার্চকে টাকা দেয়ার বিনিময়ে কোন পাপী খ্রীস্টান নিজের পাপ মোচনের নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে পারেন। শুধু নিজের নয়, ইতোপূর্বে মৃত্যুবরণ করা কোন বন্ধুর শাস্তিপ্রাপ্ত আত্মাকেও টাকার বিনিময়ে তিনি মুক্ত করতে পারবেন। ইতোমধ্যে এসব জবরদস্তিমূলক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিধানের বিরুদ্ধে খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের ভেতর থেকেই বিদ্রোহ দানা বাঁধে। এই বিদ্রোহ ধর্মের নামে নির্মমভাবে দমন করার জন্য পোপ নবম গ্রেগরি ইনুক্যুইজিশন বা ধর্মীয় আদালতের প্রতিষ্ঠা করেন ১২৩৩ সালে।
ইনক্যুইজিশনের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মদ্রোহিতা বা হেরেসিকে ব্লাসফেমী আইনে বিচার করা। তবে সকল দেশের ইনক্যুইজিশনের ভেতর স্পেনের ধর্মীয় আদালতেই সবচেয়ে বেশি কুখ্যাতি অর্জন করে। রাজা ফার্দিনান্দ ও রাণী ইসাবেলার রাজত্বকালে, ১৪৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্প্যানিশ ইনক্যুইজিশন। কথিত আছে, যেসব ইনক্যুইজিশনের প্রধান বিচারক টমাস ডি টরকুমেডা একাই দুই হাজার মানুষকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে হত্যা করে। এবং ইউরোপের অনেক রাজাই ব্লাসফেমীকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করেছিলেন। এক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের Tayler’s case (1675)-এর কথা স্মরণ করা যায়। Chief Justice Matthew বলেন …and Blasphemous words were not only on offense against God and religion but a crime against the law, state and Government. অর্থাৎ ব্লাসফেমী কেবল ধর্ম ও খোদার বিরোধীতার কারণেই পাপ নয় বরং এটি আইন, রাষ্ট্র ও সরকারের ক্ষেত্রেও অপরাধ হিসেবে গণ্য। আলোচনার এই পর্যায়ে এসে বলা যায় যে, এ সত্য স্বীকৃত হতে বাধ্য যে, ব্লাসফেমী মুসলমানদের তরফ থেকে উদ্ভাবিত হয়নি বরং এর উৎপত্তি হয়েছে খ্রীস্টানদের দ্বারা, ব্যবহৃত হয়েছে খ্রীস্ট ধর্ম রক্ষার কাজে, জালেম ও গোড়া খ্রীস্টানদের মাধ্যমে।
ব্লাসফেমী আইন দাবী করা নাযায়িয ও হারাম:
এখন বিবেচনার বিষয় হলো- শরীয়তের বিচারে ব্লাসফেমীর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? অর্থাৎ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের কোন বৈধতা আছে কি? কেননা যারা মনে করছেন যে, ব্লাসফেমী নামে আইন প্রনয়ন করলে তা ইসলামের অনুকূলে আবহাওয়া তৈরী করবে, তথা মুরতাদদের দমনে সহায়ক হবে। তারা বুঝতে পারছেন না যে, এটা দিয়ে প্রকারান্তরে তারা ইসলামের প্রতিকূল আবহাওয়াই জিইয়ে রাখবেন। এবং এটা হবে তাদের গরু হারিয়ে জুতো পাওয়ার মত। তদুপরি এটা একদিকে যেমন হবে বিজাতীয় সংস্কৃতির লালন, তেমনি অপরদিকে হবে ইসলামের অপূর্ণতার(?) মিথ্যা বহিঃপ্রকাশ। আর এর মূলে থাকছেন তারা- যারা না বুঝেই ব্লাসফেমীর পক্ষে জোর সাফাই গাইছেন।
মহান আল্লাহ্ পাক বলেন,
افحكم الجاهلية يبغون ومن احسن من الله حكما لقوم يوقنون.
অর্থঃ- “তারা কি জাহিলিয়াতের নিয়ম-কানুন তালাশ করে বা চায়। অথচ আল্লাহ্ পাক থেকে কে উত্তম হুকুম দাতা ঈমানদারদের জন্য।” (সূরা মায়িদা/৫০)
আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
تركت فيكم امرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله وسنتى.
অর্থঃ- “আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। তোমরা সে দু’টিকে আঁকড়ে থাকলে কখনোই গোমরাহ্ হবেনা। একটি হচ্ছে আল্লাহ্ পাক-এর কিতাব, দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমার সুন্নত।” (বুখারী শরীফ)
উপরোক্ত আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক নিজে বলেছেন যে, “তোমরা জাহিলিয়াতের আইন-কানুন গ্রহণ করোনা। কেননা, আল্লাহ্ পাক নিজেই উত্তম আইনদাতা।”
আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা কখনো কুরআন-সুন্নাহ্ ছেড়ে বেদ্বীনি, বদ্ দ্বীনি আইন-কানুন গ্রহণ করোনা। করলে নিশ্চিত গোমরাহ্ হয়ে যাবে।” কাজেই মু’মিনদের উচিত হবে তারা যেন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার তরফ থেকে দেয়া আইনই গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়ন করে।
ব্লাসফেমী আইনকে শরীয়তসম্মত মনে করে গ্রহণ করলে কাট্টা কাফির হয়ে চির জাহান্নামী হবে। আর যদি ব্লাসফেমী আইনকে হারাম মনে করেও গ্রহণ করে তাহলে চরম ফাসিকের অন্তর্ভূক্ত হবে।
খিলাফত কায়েমের জন্য কোশেশ করতে হবে সকলকে। তবে এ কোশেশটা যে অবশ্যই গণতান্ত্রিক আর কম্যুনিস্ট পদ্ধতিতে নয়। হরতাল, ঘেরাও, লংমার্চ, গাড়ী ভাংচুর, গজারীর লাঠি দিয়ে মাথা ভেঙে, ছবি তুলে, ভি.ডি.ও করে, আর রাস্তায় মেয়েলোকের মিছিল করিয়ে নয় বরং কেবলমাত্র ইসলাম নির্দেশিত মতে ও পথেই চালিত হয়ে, তা অবশ্যই স্মর্তব্য।
0 Comments:
Post a Comment