তাবলীগ শব্দের অর্থ হলো প্রচার করা। তাবলীগ সম্পর্কে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,
“তোমরা (হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার কারণে) শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং আল্লাহ পাকের প্রতি ঈমান আনবে।” (সূরা আল ইমরান ১১০)
উপরোক্ত আয়াত শরীফের মাধ্যমে আল্লাহ পাক তাবলীগ করা তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের কথা বলেছেন। তবে সাথে সাথে আরো একটি শর্তও আরোপ করেছেন, সেটা হলো আল্লাহ পাক ও রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন সম্পর্কে যাবতীয় বিষয়ে সঠিক ও পরিশুদ্ধ ঈমান আনা অর্থাৎ তৎসম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা। অর্থাৎ তাবলীগ করতে হবে আক্বীদা শুদ্ধ রেখে।
সাধারণভাবে দ্বীন প্রচার করাকে তাবলীগ বলে এবং যিনি দ্বীন প্রচার করেন অর্থাৎ তাবলীগের কাজ করেন তাকে মুবাল্লিগ বা দ্বীন প্রচারক বলে।
তাবলীগ ও মুবাল্লিগের প্রকারঃ সাধারণতঃ ইসলাম বা দ্বীন দুইভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে-
১) তাবলীগে আম বা সাধারণভাবে
২) তাবলীগে খাছ বা বিশেষভাবে
আবার তাবলীগের ধরণ অনুযায়ী দ্বীন প্রচারক বা মুবাল্লিগও দুইপ্রকার-
১) মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ দ্বীন প্রচারক
২) মুবাল্লিগে খাছ বা বিশেষ দ্বীন প্রচারক
মুবাল্লিগে আম ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্রঃ মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ দ্বীন প্রচারকের দ্বীন প্রচার করতে বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু দ্বীনি সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। তিনি বা তারা খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার অধীনস্থ সকলকে দ্বীনি আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের তাকীদ বা উৎসাহ প্রদান করবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কালামে পাকে ইরশাদ করেন,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে বাঁচাও।” (সূরা তাহ্রীম ৬)
আর হাদীস শরীফে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
“সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ফতহুল বারী, ওমাদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, মিরকাত, লুমায়াত ইত্যাদি)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,
“তোমরা আমার থেকে একটি আয়াত (হাদীস) হলেও তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দাও।” (বুখারী, ফতহুল বারী, ওমাদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী)
অন্য হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, তখন হযরত সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমরা সৎ কাজের আদেশ দিব না? অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমস্ত খারাবী হতে ক্ষান্ত হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি অসৎ কাজে নিষেধ করবো না? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- “না, বরং তোমরা সৎ কাজের আদেশ দান করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করতে না পার। তদ্রুপ মন্দ কাজে নিষেধ করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে বেঁচে থাকতে না পার।” (তিবরানী শরীফ)
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “দ্বীন হচ্ছে নছীহত স্বরূপ।” হযরত সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের জন্য? হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আল্লাহ পাকের জন্য এবং আল্লাহ পাকের প্রিয় রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য এবং মুসলমানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এবং সাধারণ মুসলমাদের জন্য।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
উপরোক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এর হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। কাজেই যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত হাদীস শরীফের আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত হাদীস শরীফের উপর আমল করবেন।
অতএব প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তা’লীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ, যা করা- মুবাল্লিগে আম-এর জন্য ফরজে আইনের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মায্হারী, রুহুল বয়ান, ফতহুল ক্বাদীর, খাযিন, বাগবী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, কবীর)
মুবাল্লিগে খাছ ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্রঃ
মুবাল্লিগে খাছ বা বিশেষ দ্বীন প্রচারক, মুবাল্লিগে আম-এর মত নয় অর্থাৎ তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখে।
আর যারা মুবাল্লিগে খাছ বা বিশেষ দ্বীন প্রচারক, তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন,
“তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণ-এর (কুরআন-সুন্নাহ তথা ইসলামের) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে, আর তারাই মূলতঃ কামিয়াব।” (সূরা আল ইমরান ১০৪)
অর্থাৎ তাঁকে অবশ্যই দ্বীনি বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইল্ম, আমল এবং ইখ্লাছ হাছিল করতে হবে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন,
“কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফিরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনি ইল্মে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (সূরা তওবা ১২২)
আর আল্লাহ পাকের রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“তোমরা দ্বীনি ইল্ম শিক্ষা কর এবং মানুষকে তা শিক্ষা দাও।” (দারেমী, দারে কুত্নী, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছছাবী, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত ইত্যাদি)
মূলতঃ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁদেরকে অবশ্যই উলামায়ে হক্কানী-রব্বানী হতে হবে। আর হক্কানী-রব্বানী আলিমগণের প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,
“নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলিমগণই আল্লাহ পাককে ভয় করেন।” (সূরা ফাতির ২৮)
এ আয়াত শরীফের তাফসীর হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী আল্লাহ ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলিম।”
আর হাদীস শরীফে রয়েছে,
“(জিজ্ঞাসা করা হলো) আলিম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইল্ম অনুযায়ী আমল করেন। পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ জিনিস আলিমের অন্তর থেকে ইল্মকে বের করে দেয়? তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইতায়দি হাছিলের আকাঙ্কা)।” (দারেমী, মিশকাত, মিরকাত, মুজাহিরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত ইত্যাদি)
অর্থাৎ যিনি ইল্ম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হক্কানী-রব্বানী আলিম। কাজেই যিনি ইল্ম, আমল ও ইখলাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হক্কানী আলিম, আর তিনিই নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“আলিমগণ হলেন- আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, ইবনে মাযাহ, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, বজলুল মাজহুদ, উরফুশ্ শাজী, তালীক)
অর্থাৎ আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের দাওয়াত ও তাবলীগ, তা’লীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁরা আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে তাঁদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তা’লীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মদের প্রতি প্রযোজ্য। আর এ আম তা’লীম ফরজে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও বর্তমানে উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ তাছাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদী লিখে, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদি নানানভাবে দাওয়াত ও তা’লীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-এর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, তাবলীগে আম-এর (ফরজে কিফায়ার) ও তাবলীগের খাছ-এর (ফরজে আইনের) খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তাবলীগে আম করার হুকুম এবং মুবাল্লিগে খাছ-এর যোগ্যতা ও তাবলীগে আম-এর শর্তঃ
স্মরণীয় যে, যারা মুবাল্লিগে আম অর্থাৎ যাদের জন্য তাবলীগে খাছ করা ফরজে আইনে, তাদের জন্য কোনক্রমেই এবং কষ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়েজ নেই।
এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক তাঁর সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ঐ সকল আয়াত শরীফের আমল করেছ?” যা কুরআন শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে- (১) সূরা ছফ-এর ২য় আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?” “তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না। (২) তিনি আবার বললেন যে, আল্লাহ পাক সূরা বাকারার ৪৪তম আয়াত শরীফে বলেছেন, “তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভূলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।” “তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না। (৩) পুণরায় তিনি বললেন, তুমি কি ঐ আয়াত শরীফের আমল করেছ? যা হযরত শুয়াইব আলাইহিস সালাম তাঁর ক্বওমকে বলেছিলেন, “আমি এটা চাইনা যে, তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার খিলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।” (সূরা হুদ ৮৮) “তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না। তখন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ আয়াত শরীফসমুহের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর।”
অর্থাৎ উপরোক্ত আয়াত শরীফের আমল ব্যাতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়িজ নেই।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এই প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ, মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যই ফরজে আইন। মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্য তাবলীগে আম করা কখনোই শুদ্ধ হবে না বরং তাদের জন্য তা করা সম্পূর্ণ নাজায়িজ ও হারাম হবে। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী আলিমগণের জন্যই প্রযোজ্য, যা তাঁদের জন্য ফরজে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত।
কেননা এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
“সকল মু’মিনদের জন্য একসাথে কোন কাজে বের হওয়া উচিৎ নয়।” (সূরা তওবা ১২২)
ইমাম-মুজতাহিদ তথা আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ এই আয়াত শরীফ থেকে উছূল বের করেছেন যে, মু’মিনদের জন্য সমষ্টিগতভাবে কোন কাজ করা ফরজে আইন নয় বরং তা ফরজে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মায্হারী, রুহুল মা’য়ানী, রুহুল বয়ান, ফতহুল ক্বাদীর, আশশাফ, হাশিয়ারে সাবী, যাদুল মাসীর, খাযিন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
অর্থাৎ মুসলামানদের জন্য যেসব কাজ সমষ্টিগতভাবে করতে হয়, সেটা ফরজে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। তা কখনো ফরজে আইন নয়, যা উপরোক্ত আয়াত শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে।
অতএব, যদি কেউ বলে- মূর্খ হোক, আলিম হোক, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, সকল পেশার সকল মুসলমানের জন্য তাবলীগ করা ফরজে আইন। তবে তা সম্পূর্ণই কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-ক্বিয়াসের খিলাফ বা পরিপন্থী হবে। আর ফরজে কিফায়াকে ফরজে আইন বলাও হারাম ও কুফরীর নামান্তর, যা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই ওয়াজিব।
প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের তাদের প্রচলিত তাবলীগকে যে জন্য নবীওয়ালা কাজ বলতে চায়, সেটা হলো- তারা মনে করে যে, নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণ যেভাবে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন, তারাও বুঝি সেভাবেই ইসলামের দাওয়াত দেয়। কিন্তু হাক্বীক্বতে এ দু’য়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। কারণ নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণ সকলেই মা’রিফাতে পূর্ণ হয়ে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং তা দেয়া হয়েছে কাফিরদেরকে। সে কারণে বলা হয় যে, সকল নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের তাছাউফ এক, কিন্তু শরীয়ত আলাদা। কিন্তু প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের প্রায় সবাই একেবারেই তাছাউফ শুণ্য হয়ে তাদের ৬ উছূলভিত্তিক দাওয়াত দেয়। যে দাওয়াতটা মূখ্যতঃ মুসলমানদেরকে দেয়া হয়।
কাজেই প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত যা করে, তা মুসলমানদেরকে সাধারণ তা’লীম-তালক্বীন দেয়া ব্যতীত কিছুই নয়।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে আরো কথা এসে যায়, সেটা হচ্ছে এই যে, মাদ্রাসা-মক্তবে কিতাবী দর্স ও তা’লীম দেয়া, মসজিদে, জনসমাবেশে ওয়াজ-নছীহত করা, দ্বীনি ইল্মের জন্য কিতাব প্রনয়ণ করা সর্বোপরি, পীরানে তরীক্বত, আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ উনাদের খান্কা শরীফে ও দরগায় এই ইল্মে তাছাউফ ও ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা দেয়া কি তাহলে নবীওয়ালা কাজ নয়? তবে কি এটি শয়তানওয়ালা কাজ? (নাঊযুবিল্লাহ্ মিন যালিক) কোন ব্যক্তি যদি এরূপ আক্বীদা পোষণ করে, তাহলে সে ঈমান হারা হয়ে কুফরীতে নিপতিত হবে।
উল্লেখ্য, যদিও প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা সুরতান নবীওয়ালা কাজ বলে দাবী করে, কিন্তু হাক্বীক্বতান তারা নবীওয়ালা কাজ করেনা। কারণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“নিশ্চয়ই আলিমগণ নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ এবং নিশ্চয়ই নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের কোন দিনার-দিরহাম রেখে যাননি বরং তাঁরা ইল্মে দ্বীন রেখে গিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করলো, সে পূর্ণ অংশ (বিরাট সফলতা) লাভ করলো।” (আহ্মদ, তিরমিযী)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,
“ইল্ম দু’প্রকার, একটি হচ্ছে- ক্বালবী ইল্ম (ইল্মে তাছাউফ), যা উপকারী ইল্ম। অপরটি হচ্ছে- জবানি ইল্ম (ইল্মে ফিক্বাহ), যা আল্লাহ পাক-এর তরফ থেকে বান্দার প্রতি দলীল স্বরূপ।” (দারেমী, মিশকাত, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত)
মিশকাত শরীফের শারেহ, হযরত মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর মিরকাত শরীফে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, মালেকী মাযহাবের ইমাম, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
“যে ব্যক্তি ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো, কিন্তু ইল্মে তাছাউফ শিক্ষা করলো না, সে ব্যক্তি ফাসেকের অন্তর্ভূক্ত। আর যে তাছাউফ করে অর্থাৎ মা’রিফাত চর্চা করে অথচ ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করে না অর্থাৎ শরীয়ত মানে না বা অস্বীকার করে, সে যিন্দিক বা কাফিরের অন্তর্ভূক্ত। আর যে উভয়টাই শিক্ষা করলো, সেই মুহাক্কিক অর্থাৎ সেই নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা হক্কানী আলিম।”
উল্লেখ্য যে, যিনি ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফ হাছিল করেছেন, তিনিই হচ্ছেন নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা নায়েবে নবী। যাঁরা নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা নায়েবে নবী, তাঁদের পক্ষেই একমাত্র নবীওয়ালা কাজ পূর্ণভাবে করা সম্ভব। অথচ প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের উছূলের মধ্যে তাছাউফ-এর কোন শিক্ষাই নেই, শুধুমাত্র ইল্মে ফিক্বাহ্র শিক্ষা যৎসামান্যই রয়েছে। তাহলে কি করে প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের পক্ষে হাক্বীক্বতান নবীওয়ালা কাজ করে দাবী করা সম্ভব?
উল্লেখ্য ইলিয়াস ছাহেব যদি স্বপ্নের মাধ্যমে ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াতের কাজের নির্দেশ পেয়ে থাকেন, তবে তা তার জন্য নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে গণ্য হবে, যা অপরের জন্য আদৌ দলীল নয় | কারণ স্বপ্ন আরেকজনের জন্য দলীল নয়, এর উপরই ফতওয়া |
আর ইলিয়াস ছাহেব যদি তার এলাকার মুসলমানের দুরাবস্থার কারণে ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াতের কাজের ব্যবস্থা করে থাকেন, তবে তাও তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ মাত্র | কিন্তু যখনই বলা হবে যে, তাবলীগের কাজ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর ইলিয়াস ছাহেবই পূনরুজ্জীবিত করেছে, তবে তা হবে সম্পূর্ণই অশুদ্ধ, নাজায়েয ও কুফরী |
কারণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানায় প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াতের কোন অস্তিত্বই ছিলনা | বরং তা মাওলানা ইলিয়াস ছাহেব কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি বিদয়াত বা নতুন উদ্ভাবিত পন্থা | সুতরাং তার পূনরুজ্জীবনের কোন প্রশ্নই আসেনা |
উল্লেখ্য, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি করেছেন পরিপূর্ণ ইসলামের তাবলীগ | যার অন্তর্ভূক্ত ছিল সম্পূর্ণ শরীয়ত তথা ইলমে ফিক্বাহ্, ইলমে তাসাউফ, দাওয়াত, তাবলীগ, জ্বিহাদ, হুকুমাত ইত্যাদি সব কিছুই |
অতএব ইলিয়াস ছাহেব যে তাবলীগ করেছেন, তা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি যে তাবলীগ করেছেন তার পূনরুজ্জীবন তো নয়ই, এমনকি তার পূর্ণ অনুসরণ পর্যন্ত নয় |
আরো উল্লেখ্য যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি যে তাবলীগ করেছেন, তার অনুসরণ পূর্ণভাবে করেছেন- হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ থেকে শুরু করে তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, ইমাম-মুজতাহিদ ও প্রত্যেক যামানার আওলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ |
মূলতঃ তাবলীগের কাজ কোনদিনই থেমে থাকেনি | হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের ধারাবাহিকতায় অতীতেও চলেছে এবং এখনও চলছে, এর বিরতি কোনদিনই হয়নি | অতএব যে কাজের গতিধারা সবসময়েই প্রবাহমান বা বিরাজমান, তার আবার পূনরুজ্জীবন কি করে হতে পারে? তাই কেউ যদি বলে যে, ইলিয়াস ছাহেব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর তাবলীগের পূনরুজ্জীবন দান করেছেন, তাহলে সে কথা কুফরী হবে | কারণ এ কথার অর্থ তাহলে এই দাঁড়ায় যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ করেছেন | অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের তর্জ-তরীক্বা মাত্র প্রায় ৯০ বছর পূর্বে উদ্ভাবন করা হয়েছে | কাজেই তাদের এ বক্তব্য হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নামে মিথ্যারোপ করার শামিল, যা স্পষ্টতঃ কুফরী |
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
من كذب على متمدا فاليتبؤا مقعده من النار
অর্থঃ- “যে স্বচ্ছায় আমার নামে মিথ্যা কথা বলে, সে যেন দুনিয়ায় থাকতেই তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয় |” (তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ, মেশকাত শরীফ, মেরকাত শরীফ ইত্যাদি)
এখানে উল্লেখ্য যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরে ইলিয়াস ছাহেব তাবলীগ পূনরুজ্জীবিত করেছে, এই কথা যদি বলা হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠে যে, খোলাফা-ই-রাশেদীন, হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, ইমাম-মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, আওলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ কি দ্বীনের প্রচার-প্রসার, তা’লীম-তালক্বীন, দাওয়াত-তাবলীগ, দর্স-তাদরীস, ইজতিহাদ-তাজদীদ, জ্বিহাদ, হুকুমত পরিচালনা ইত্যাদি করেননি? অথচ পবিত্র হাদীছ শরীফে রয়েছে,
ان الله يبعث لهذه الامة على رأس كل مأة سنة من يجددلها دينها
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক প্রত্যেক হিজরী শতকের শুরুতে এই উম্মতের (ইসলাহর) জন্য একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেন, যিনি দ্বীনের তাজদীদ করবেন |” (আবূ দাউদ শরীফ, বজলুল মাজহুদ, মেশকাত, মেরকাত ইত্যাদি)প্রদত্ত হাদীছ শরীফের প্রেক্ষিতে তাহলে এ যাবত যাঁরা মুজাদ্দিদ হিসেবে এসেছেন, উনারা কি তাজদীদ-ইজতিহাদ, তাবলীগ ও দাওয়াতের কাজ করেননি?
মূলতঃ উনারা সকলেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত মুতাবেক বর্ণিত দ্বীনের দাওয়াত বা কার্যাবলী যথাযথভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন |অতএব, কি করে এটা বলা যেতে পারে যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরে ইলিয়াস ছাহেব তাবলীগ পূনরুজ্জীবিত করেছেন | বস্তুতঃ তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বিভ্রান্তিকর, কল্পনাপ্রসূত ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত |
অতএব প্রচলিত ৬(ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত আক্বীদা পোষণ করা হতে বিরত থাকা ওয়াজিব |
0 Comments:
Post a Comment