কদমবুছী খাছ সুন্নত

Image result for কদমবুছিকদমবুছী খাছ সুন্নত
কদমবুছীর সংজ্ঞাঃ “কদমবুছী” (بوسي قدم)-এর “কদম” (قدم) শব্দটি আরবী যার অর্থ “পা”, আর “বুছী” (بوسي) শব্দটি ফার্সী যার অর্থ “চুম্বন করা”। সুতরাং “কদমবুছী” অর্থ হলো “পায়ে চুম্বন করা”। অর্থাৎ সরাসরি মুখ দিয়ে পায়ে চুম্বন দেয়াকে “কদমবুছী” বলে। কিন্তু প্রচলিত অর্থে কদমবুছী বলতে আমাদের দেশে হাত দিয়ে পা স্পর্শ করে হাতে চুমু খাওয়ার যে প্রচলন তা মূলতঃ কদমবুছী নয় বরং তা দস্তবুছী।
কদমবুছীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখিয়েছেন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ। আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ্‌, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কদম মুবারকে সরাসরি চুম্বন করতেন বা বুছা দিতেন তাঁরা, এমনকি তাঁরা একে অপরকেও কদমবুছী করেছেন। আর তাই কদমবুছী হচ্ছে খাছ সুন্নত।

কদমবুছী হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিতঃ
হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত আছে, “হযরত ওযায়ে ইবনে যারে, তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা আব্দুল কায়েস গোত্রে থাকা অবস্থায় যখন মদীনা শরীফ-এ আসতাম তখন তাড়াতাড়ি করে নিজেদের সওয়ারী হতে নেমে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ্‌, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাত মুবারক এবং কদম মুবারকে চুম্বন করতাম।” (আবূ দাউদ শরীফ, ২য় জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৭০৯; বযলুল মাজহুদ, ৬ষ্ঠ জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৩২৮; ফতহুল বারী, ১১ জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৫৭; মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, ৭ম জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৮০; আশয়াতুল লুময়াত, মুযাহিরে হক্ব)
হযরত সাফওয়ান ইবনে আস্‌সাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, “একবার ইহুদীদের একটি দল এসে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ্‌, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উভয় হাত মুবারক ও পা মুবারকে বুছা (চুম্বন) দিলো।” (আবূ দাউদ শরীফ; নাসাঈ শরীফ; ইবনে মাযাহ শরীফ, পৃষ্ঠা ২৭০; তিরমিযী শরীফ, ২য় জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৯৮; ফতহুল বারী, ১১ জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৫৭; তুহফাতুল আহওয়াযী শরহে তিরমিযী, ৭ম জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৫২৫; মুছান্নিফে ইবনে আবী শায়বা, ৭ম জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৫৬২)

হাদীছ শরীফ-এ আরো বর্ণিত আছে, “এক ব্যক্তি আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ্‌, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, ইয়া রসূলাল্লাহ্‌ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে এমন কোন বিষয়ে আদেশ করেন, যা আমার বিশ্বাসকে আরো বৃদ্ধি করবে। তখন আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ্‌, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “তুমি ঐ গাছটিকে ডেকে আনো।” অতঃপর সে ব্যক্তি গাছটির নিকটে গিয়ে বললো, নিশ্চয় রসূলাল্লাহ্‌ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাকে ডেকেছেন। সুতরাং গাছটি এসে আল্লাহ্‌ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাম করলো। আল্লাহ্‌ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে চলে যেতে বললেন, গাছটি তখন চলে গেল। অতঃপর ঐ ব্যক্তি অনুমতি সাপেক্ষে আল্লাহ্‌ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাথা মুবারক ও উভয় কদম মুবারক বুছা দিল।” (মুস্তাদিরেকে হাকিম; ফতহুল বারী, ১১ জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৫৭; তুহফাতুল আহওয়াযী শরহে তিরমিযী, ৭ম জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৫২৮; আল কালামুল মুবীন, পৃষ্ঠা ১৪৬)
হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “(গাছের সিজদা দেয়ার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর) একদিন আমি আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ্‌, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে আরজ করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ্‌, ইয়া হাবীবাল্লাহ্‌ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাক আপনার উভয় হাত মুবারক এবং পা মুবারকে বুছা দেয়ার অনুমতি দিন। আল্লাহ্‌ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দিলেন। অতঃপর তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উভয় হাত মুবারক এবং পা মুবারকে বুছা দিলেন।” (নাসীমুর রিয়াজ শরহে কাজী আয়াজ ৩য় জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৫০; কিতাবুল আযকার লিন্‌ নববী)
হযরত যায়েদ বিন সাবিত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা রয়েছে যে, “নিশ্চয়ই তিনি হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর হাত মুবারকে বুছা দিয়েছেন। তিনি এটাও বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয়ই হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর হাত ও পা মুবারকে বুছা দিয়েছেন।” (ফতহুল বারী, ১১ জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৫৭; তুহফাতুল আহওয়াযী শরহে তিরমিযী, ৭ম জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ৫২৮)

শুধু তাই নয় বরং হাদীছ শরীফ-এ মাকেও কদমবুছী করার ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহের কিতাবে উল্লেখ আছে, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ্‌, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি তার মায়ের কদমবুছী করলো সে যেন জান্নাতের চৌকাঠে চুম্বন করলো।” (মাবসূত লিস্‌ সারাখ্‌সী, ১ম জিলদ্‌, পৃষ্ঠা ১৪৯)

ইমাম-মুজতাহিদ তথা আউলিয়ায়ে কিরাম রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি-এর জীবনীতে কদমবুছীঃ
বস্তুত গভীর শ্রদ্ধা, আদব, মুহব্বত এবং আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে কদমবুছীর মাধ্যমে। আর তাই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ্‌, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কদম মুবারকে সরাসরি চুম্বন দিয়ে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, মুহব্বত, তা’যীম এবং আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রকাশ করেছেন। এই ধারাবাহিকতায় মুরীদও তাঁদের অনুসরণে একইভাবে স্বীয় মুর্শিদ ক্বিবলার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, পরম মুহব্বত এবং আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে কদমবুছীর মাধ্যমে। কেননা হাদীছ শরীফ-এ এসেছে, “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, শায়খ (বা মুর্শিদ বা পীর ছাহেব) তাঁর ক্বওম তথা মুরীদের কাছে তেমন; নবী (আলাইহিস্‌ সালাম) তাঁর উম্মতের মাঝে যেমন।” (দাইলামী শরীফ, মাকতুবাত শরীফ, আত্‌ তায্‌কিরাহ ফি আহাদীসিল মুশ্তাহিরাহ, মাকাছিদুল হাসানা)
হাদীছ শরীফ-এ আরো এসেছে, “হযরত আনাছ বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা পীর-মাশায়িখকে সম্মান করবে। পীর-মাশায়িখকে সম্মান করা আল্লাহ্‌ পাককে সম্মান করারই নামান্তর। কাজেই যে ব্যক্তি তাঁদের যথাযথ সম্মান করে না সে আমাদের দলভূক্ত নয়।” (দাইলামী শরীফ, আত্‌ তায্‌কিরাহ ফি আহাদীসিল মুশ্তাহিরাহ)
আর তাই চিশ্‌তীয়া তরীক্বার মাশায়িখ (রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহিম)-এর মাঝে কদমবুছীর এতো অধিক প্রচলন ছিল যে, তাঁরা স্বীয় মুর্শিদ ক্বিবলার কদমবুছী করতে পারাকে বিশেষ নিয়ামত প্রাপ্তি মনে করতেন। যখনই কোন সালিক মুর্শিদ ক্বিবলার দরবার শরীফ-এ যেতেন তখনই মুর্শিদ ক্বিবলার কদমবুছী করতেন।
শায়খুল মাশায়িখ, সুলতানুল আউলিয়া, হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “বুধবার আমার পীর ছাহেব সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি-এর কদমবুছীর বরকত নছীব হলো।” (দলীলুল আরিফীন)
চিশ্‌তীয়া তরীক্বার ইমাম, ইমামুশ্‌ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত, হাবীবুল্লাহ্‌, সুলতানুল মাশায়িখ, কুতুবুল আক্তাব, কুতুবুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্‌তী আজমিরী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি একবার দিল্লীতে আসলেন। তাঁর প্রধান খলীফা শায়খুল মাশায়িখ, সুলতানুল আউলিয়া, হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফ-এ হাজির হলেন। কদমবুছী করার জন্য দিল্লীর লোকেরা দলে দলে তাঁর খিদমতে ভিড় জমালো। সুলতান আলতামাশা রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহিও আসলেন। কিন্তু শায়খুল আলম, বাবা ফরীদুদ্দীন গঞ্জে শকর রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি আসলেন না। সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্‌তী আজমিরী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সম্মন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। শায়খুল মাশায়িখ, সুলতানুল আউলিয়া, হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি বললেন, সে রিয়াজত-মুশাক্কাতে রত রয়েছে। এটা শুনে তিনি বললেন, তুমি সত্যি বখ্‌তিয়ার। এমন “শাহ্‌বায”কে কবলে এনেছ যার বাস “সিদরাতুল মুন্তাহা”র এদিকে নয়। এমন লোকের উপর আর কঠোরতা করা সমীচীন নয়। তাঁর রিয়াজত-মুশাক্কাত বন্ধ করে দেয়া উচিত।
অতঃপর তাঁরা উভয়েই শায়খুল আলম, বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শকর রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি-এর হুজরা শরীফ-এ গেলেন এবং বাবা ছাহেব রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহিকে উভয়ের মাঝে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে দু’য়া করলেন, “আল্লাহ্‌ পাক! আপনি ফরীদকে কবুল করুন।” গায়েব হতে আওয়াজ আসলো, “আমি ফরীদকে কবুল করলাম।” তারপর তাঁরা উভয়ে তাঁকে অনেক ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ দান করলেন এবং বললেন, “ফরীদ এমন একটি প্রদীপ যা আমাদের সিলসিলাকে আলোকিত করবে এবং যুগের অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব হবে।”

সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্‌তী আজমিরী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহিও তাঁকে “বাবা” বলে সম্বোধন করতেন। এই বরকতে আজ পর্যন্ত তাঁকে “বাবা” লক্ববে সম্বোধন করা হয়।
ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ প্রদানের পর শায়খুল মাশায়িখ, সুলতানুল আউলিয়া, হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “তোমার দাদা পীর ছাহেব, তাঁর কদমবুছী করো।”
শায়খুল আলম, বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শকর রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি গিয়ে স্বীয় পীর ছাহেব হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি–এর কদমবুছী করলেন। তিনি আবার আদেশ করলেন, “তোমার দাদা পীর ছাহেব সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি–এর কদমবুছী করো।” এবারো তিনি স্বীয় পীর ছাহেব শায়খুল মাশায়িখ, হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি–এর কদমবুছী করলেন। হযরত বখতিয়ার কাক্বী রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি এবার একটু ধমকের স্বরে বললেন, “আমি তোমাকে “তোমার দাদা পীর ছাহেব সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি–এর কদমবুছী করতে বলছি। আর তুমি করছ আমার কদমবুছী তার কারণ কি?”
বিনিত-বিনম্র স্বরে জাওয়াব দিলেন শায়খুল আলম, বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শকর রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি, “আমি আপনার কদম মুবারক ব্যতীত আর কোন কদম মুবারক দেখতে পাচ্ছি না।”
শায়খুল আলম, হযরত বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শকর রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি-এর এরূপ জাওয়াব শুনে সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “বখতিয়ার! মাসউদ ঠিকই বলেছে। সে মঞ্জিলে মাকছুদে পৌঁছেছে। সেখানে এক ভিন্ন দ্বিতীয়ের কোন অস্তিত্বই নেই। কাজেই সেখানে তুমি ভিন্ন আমি তাঁর দৃষ্টিতে আসবো কেন?” (তাযকিরাতুল আউলিয়া)
সুতরাং কদমবুছী গভীর শ্রদ্ধা, আদব, মুহব্বত এবং আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ তো বটেই, অধিকিন্তু এটা কামিয়াবী ও বিজয়ের সোপানও বটে। কারণ কদমবুছী করা সেই ব্যক্তির পক্ষে সহজ ও সম্ভব যে স্বীয় মুর্শিদ ক্বিবলাকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মনে করে। আর নিজেকে ভাবে সর্বনিকৃষ্ট, হীন ও তুচ্ছ, যা ইলমে তাছাউফের বুনিয়াদী শিক্ষা। এরূপ মনোভাবই তাকে আল্লাহ্‌ পাক পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ্‌, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নৈকট্যভাজনে পরিণত করে। কেননা হাদীছ শরীফ-এ এসেছে, “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ পাক-এর জন্য বিনয়ী হয় আল্লাহ্‌ পাক তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।” (ইহ্‌ইয়াউ উলুমিদ্দীন, কিমিয়ায়ে সা’য়াদাত)
পক্ষান্তরে যারা অহংকারী, যাদের অন্তরে রয়েছে আত্ম-অহংকার তারা কখনও কদমবুছীর ফযীলত, বরকত লাভ করতে পারে না। অন্তরে লালিত অহংকারই তাকে কদমবুছী থেকে বিরত রাখে। অহংকার ব্যক্তি কখনও হাক্বীক্বীভাবে কদমবুছী করে না। যদি লোক লজ্জার ভয়ে কিংবা অবস্থার চাপে করে তা হয় একান্ত অন্তঃসারশুন্য। খুব কমসংখ্যক লোক নিজেকে নিকৃষ্ট, হীন ও তুচ্ছ মনে করতে পারে, “বড় যদি হতে চাও ছোট হও আগে” এই নীতি বাক্যের উপর আমল করতে পারে।

কদমবুছীর সময় অনিচ্ছাকৃত মাথা ঝুঁকে যাওয়া সিজদার অন্তর্ভূক্ত নয়ঃ
আমাদের সমাজে কিছু আত্ম-অহংকারী মহল আছে যারা কিল্লতে ইলম কিল্লতে ফাহম অর্থাৎ কম জ্ঞান ও কম বুঝের অধিকারী তারা কদমবুছীকে নাজায়িয ও শিরক বলে থাকে। তারা বলে থাকে কোন সম্মানিত ব্যক্তিকে মাথা নীচু করে কদমবুছী করা, তাশাব্বুহ্‌ বিস্‌ সিজদাহ-এর কারণে হারাম।
মূলতঃ কদমবুছীর সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও যে মাথা ঝুঁকে যায় তা সিজদার অন্তর্ভূক্ত নয়। কেননা শুধুমাত্র মাথা নীচু করলেই সিজদা হয় না বরং সিজদার জন্য যমীনে কপাল ও নাক লাগানোর সাথে সাথে সিজদার নিয়ত থাকাও শর্ত। কিন্তু কদমবুছীর ক্ষেত্রে এসবই অনুপস্থিত। উল্লেখ্য, মাথা নীচু করলেই যদি হারাম হয়, তবে দৈনন্দিন অনেক কাজ করার সময় মাথা নীচু করতে হয়। যেমন- ঘর ঝাড়ু দিতে, খুঁটি পুতার সময়, যমীনে চারা রোপন করতে ইত্যাদি কাজগুলি কি হারাম হবে? কখনই নয়।

কদমবুছী করার সময় মাথা ঝুঁকানো সম্পর্কে কিতাবে উল্লেখ করা হয়, “কদমবুছীর সময় মাথা ঝুঁকানো মূলতঃ উদ্দেশ্য নয়। কারো সম্মানার্থে ইচ্ছাকৃত সিজদার ন্যায় মাথা ঝুঁকানো নাজায়িয। তাই, সিজদার নিয়ত ব্যতীত মাথা ঝুঁকানো নিষেধ নয় এবং স্থান বিশেষে এর থেকে বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়। যেমনঃ কোন বস্তু উঠাবার সময়, রাখার সময়, দেখার সময় ইত্যাদি কারণে স্থান বিশেষে মাথা নিচু করতে হয়। অথচ উপরোক্ত কারণে মাথা ঝুঁকানোকে কেউ নাজায়িয বলেন না, কারণ সিজদার নিয়ত করে তা করা হয় না।” (রদ্দুল মুহতার, মুহীত, যাহিদী, শেফা লি কাজী আয়াজ, মকতুবাতে ইমামে রব্বানী)
এ প্রসঙ্গে কিতাবে একটি ঘটনা উল্লেখ আছে, এক মাওলানা ছাহেব বিদেশ হতে সদ্য পাশ করে এসেছে। সে যখন তার গ্রামের বাড়ীতে গেল, বাড়ীতে যাওয়ার পথে দেখলো কৃষকরা ক্ষেত্রের মধ্যে ধানের চারা রোপন করছে। যেহেতু ক্ষেতের মধ্যে পানি ও কাদায় ভর্তি, তাই কৃষকরা উপুড় হয়ে মাথা নীচু করে ধানের চারা রোপন করছিল। মাওলানা ছাহেব কৃষকদের এ অবস্থা দেখে বলতে লাগলো, আস্তাগফিরুল্লাহ্‌! শেরেক করে করে ধান রোপন করার কারণেই তো ফসলে বরকত হয় না। সেই কৃষকদের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি মোটামুটি আলিম। মাওলানা ছাহেবের উক্ত ফতওয়া যখন তিনি শুনলেন, তখন তিনি বললেন, মাওলানা ছাহেব আপনার ফতওয়াটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। তাই আপনি ফতওয়াটি লিখিতভাবে দিলে হয়ত আমরা এ শিরক থেকে বেঁচে থাকতে পারবো। মাওলানা ছাহেব যখন তার পকেট থেকে কাগজ-কলম বের করতে লাগলো, ঘটনাক্রমে কলমখানা তার হাত থেকে মাটিতে পড়ে যায়। মাওলানা ছাহেব (মাটি থেকে কলমটি উঠাবার সময় মাথা নীচু করতে হয়) যখনই কলম উঠাবার সময় মাথা নীচু করল, তখন সেই কৃষক বললেন, আস্তাগফিরুল্লাহ্‌! শেরেক করে করে ফতওয়া দিলে সে ফতওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। তখন মাওলানা ছাহেব বুঝতে পারলো যে, শুধুমাত্র মাথা ঝুঁকালেই সিজদা হয় না, বরং নিয়ত থাকা শর্ত।
তাই ফুক্বাহায়ে কিরাম রহ্‌মতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যদি সিজদার নিয়তে মাথা ঝুঁকানো হয়, তবে তা সম্পূর্ণ হারাম। আর যদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কদমবুছী করার সময় মাথা কিছুটা ঝুঁকে যায়, তবে তা কদমবুছীরই অন্তর্ভূক্ত, তা সিজদার অন্তর্ভূক্ত নয়।

তা’যীমি সিজদা ও কদমবুছী এক নয়ঃ
তা’যিমী সিজদা এবং কদমবুছী একতো নয়ই বরং ব্যবধানে আসমান-যমীন পার্থক্য। তা’যীমি সিজদা তথা সম্মান প্রদর্শনার্থে কাউকে সিজদা করা প্রকাশ্য হারাম ও শির্‌কের অন্তর্ভুক্ত।
আখিরী রসুল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমি যদি মানুষকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম তবে স্ত্রীদেরকে আদেশ করতাম তারা যেন তাদের স্বামীকে সিজদা করে।” (আহমদ, মিশকাত শরীফ)
এ হাদীছ শরীফ, পূর্বের সমস্ত তা’যীমি সিজদাকে রহিত বা বাতিল করেছে। একজন মানুষ যত মর্যাদা-মর্তবা সম্পন্ন হোক না কেন তাকে সিজদা করা জায়িয নেই। আল্লাহ পাকই একমাত্র সিজদার উপযুক্ত অন্য কেউ নয়। কাজেই যারা সিজদা করে আর যারা সিজদা নেয় উভয়ই কাট্টা কাফির এবং মুশরিক।
আল্লাহ পাক বলেন, “আল্লাহ পাক-এর সাথে শরীক (অংশীদার স্থাপন) করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ্‌।” (সূরা লুকমান ১৩)
আখিরী রসুল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যদি তোমাকে হত্যা করা হয় কিংবা আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তথাপি আল্লাহ পাক-এর সাথে কোন ব্যাপারে কাউকে শরীক করবে না।” (মিশকাত শরীফ)
পক্ষান্তরে কদমবুছী সুন্নতে ছাহাবা। সেই সুন্নতের মধ্যে আছে আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরম সন্তুষ্টি, নৈকট্য। কাজেই যারা কদমবুছীকে নাজায়িয ও হারাম বলবে, শিরক বলে ফতওয়া দিবে তারা শরীয়তের বিধানকে অস্বীকার, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হালালকে হারাম বলার কারণে কাট্টা কাফিরের অন্তর্ভূক্ত। কেননা হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ করা হয়েছে, “হযরত আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, নূরে মুজাস্‌সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যদি তোমরা তোমাদের নবী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নতকে (অবজ্ঞা বা অপছন্দ করে) তরক কর, তবে তোমরা নিঃসন্দেহে কুফরী করলে।” (আবূ দাউদ শরীফ)
এর উপর ভিত্তি করে আক্বাইদের কিতাবে উল্লেখ করা হয়, “সুন্নতকে ইহানত করা কুফরী।”
আর শরীয়তে ঈমান আনার পর কুফরী করলে অর্থাৎ মুরতাদ হলে, তার ফায়সালা হলো-
তার স্ত্রী তালাক হবে যদি বিয়ে করে থাকে এবং এক্ষেত্রে পুনরায় তওবা না করে বিয়ে না দোহরানো ব্যতীত তার স্ত্রী সাথে বসবাস করা বৈধ হবে না। আর অবৈধ অবস্থায় সন্তান হলে সে সন্তানও অবৈধ হবে। হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে যদি হজ্জ করে থাকে। সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। তার ওয়ারিশ স্বত্ত্ব বাতিল হবে। তাকে ৩ দিন সময় দেয়া হবে তওবা করার জন্য এবং যদি তওবা করে তবে ক্ষমা হবে। অন্যথায় তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কেননা হাদীস শরীফে রয়েছে, তিন কারণে মৃত্যুদন্ড দেয়া জায়িয। যথাঃ (১) ঈমান আনার পর কুফরী করলে অর্থাৎ মুরতাদ হলে, (২) ঐ যিনাকার বা যিনাকারিণী যারা বিবাহিত বা বিবাহিতা, (৩) যে অন্যায়ভাবে কাউকে ক্বতল করে। (তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ, মসনদে শাফিয়ী, মসনদে বাজ্জার, মুস্তাদরিকে হাকিম)
আর মুরতাদ মারা যাওয়ার পর যারা জানাযার নামাজ পড়ে বা পড়ায় বা জানাযার নামাজে সাহায্য-সহযোগীতা করে, তাদের সকলের উপরই মুরতাদের হুকুম বর্তাবে এবং এ সকল মুরতাদ মরলে বা নিহত হলে তাকে মুসলমানদের কবরস্তানে দাফন করা যাবে না। বরং তাকে কুকুরের ন্যায় একটি গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখতে হবে।
কুরআন শরীফ-এ আল্লাহ্‌ পাক ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই যারা কাফির এবং কুফরী অবস্থায় মারা গিয়েছে, তারা যদি পৃথিবী পরিমাণ স্বর্ণ তার ফিদিয়া বা (কুফরীর পরিবর্তে) কাফ্‌ফারা বাবদ দেয় (আমার থেকে বাঁচার জন্য), তা কখনো গ্রহণ করা হবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি বা আযাব এবং তাদের জন্য কস্মিনকালেও সাহায্যকারী নেই।” (সূরা আল ইমরান ৯১)

0 Comments: