ইসলামের নামে গণতন্ত্র ও নির্বাচন করা, পদপ্রার্থী হওয়া, ভোট চাওয়া ও দেয়া হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া -পব-৩
“ইসলামের নামে গণতন্ত্র ও নির্বাচন
করা, পদপ্রার্থী হওয়া,
ভোট চাওয়া ও দেয়া হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” পেশ করতে
পারায় আল্লাহ পাক-এর দরবারে বেশুমার শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
উল্লেখ্য, হিজরী পঞ্চদশ
শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ও ইমাম,
মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, ইমাম রাজারবাগ
শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর প্রতিষ্ঠিত ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত
যামানার তাজদীদী মুখপত্র ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত। এ পত্রিকায় এ যাবৎ যত লিখা বা ফতওয়া প্রকাশ বা পত্রস্থ করা
হয়েছে, হচ্ছে ও হবে তার একমাত্র উদ্দেশ্য মানুষের ঈমান-আক্বীদা ও আমল পরিশুদ্ধ করা। এ
জন্যেই মূলতঃ যুগে যুগে প্রেরিত হয়েছেন এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ
হাজার নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম। এবং সর্বশেষ নবী-রসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন নবীদের
নবী, রসূলদের রসূল,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অতঃপর
প্রত্যেক শতাব্দীর মাঝে প্রেরিত হয়ে আসছেন তাঁর খাছ নায়িব বা ওয়ারিছ তথা যামানার মুজাদ্দিদগণ।
কাজেই, বান্দা ও
উম্মত যদি দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
দীদার ও সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, রহমত ও নাজাত পেতে চায়, হাক্বীক্বী বান্দা ও হাক্বীক্বী উম্মত
হতে চায়, প্রকৃত মু’মিন, মুসলমান ও মুত্তাক্বী হতে চায় তাহলে তার জন্য যামানার মুজাদ্দিদের অনুসারী হওয়া
ব্যতীত বিকল্প কোন পথ নেই। সেটা কাছে থেকে হোক কিংবা দূরে থেকে হোক। কারণ আল্লাহ পাক
তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
واتبع
سبيل من اناب الى.
অর্থঃ- “ঐ ব্যক্তির
পথ অনুসরণ করে চলো যিনি আমার দিকে রুজু রয়েছেন।” (সূরা লুক্বমান-১৫)
স্মরণীয় যে, আজকে মুসলমানরা
তাদের আদর্শ-ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে বিধর্মী-বিজাতীয়দের তর্জ-তরীক্বা, আচার-আচরণ
গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের এই নাজুক অবস্থা কাটিয়ে ইসলামী আদর্শে আদর্শবান হিসেবে
গড়ে তোলার জন্য আহবান করছেন যামানার মহান মুজাদ্দিদ মুদ্দা জিল্লুহুল আলী। সুতরাং তাঁর
মুবারক আহবানে সাড়া দেয়ার সময় এখনই। এ লক্ষ্যে ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ পত্রিকার
পাঠক, গ্রাহক, শুভাকাঙ্খী ও শুভানুধ্যায়ীগণ ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত”-এর আকর্ষণীয়
ও উল্লেখযোগ্য বিভাগ “সুওয়াল-জাওয়াব”
ও “ফতওয়া” বিভাগে ইসলামের নামে গণতন্ত্র ও নির্বাচন করা, পদপ্রার্থী হওয়া, ভোট চাওয়া
ও দেয়া হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে শরীয়তের সঠিক ফায়ছালা জানার জন্য অসংখ্য
সুওয়াল প্রেরণ করেন। যেহেতু আল্লাহ পাক রাব্বুল আ’লামীন কালামে পাকে ইরশাদ করেন,
فسئلوا
اهل الذ كر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থঃ- “যদি তোমরা
না জান, তবে আহ্লে যিকির বা আল্লাহওয়ালাগণকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।” (সূরা নহল-৪৩
ও সূরা আম্বিয়া-৭)
তাই প্রেরিত সুওয়ালসমূহের প্রেক্ষিতে
“ইসলামের নামে গণতন্ত্র,
নির্বাচন, ভোট ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” ইসলামের দলীল- কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের
দৃষ্টিতে পেশ করা হলো।
প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়
মূলতঃ আমাদের সাথে কারো যেরূপ
বন্ধুত্ব নেই, তদ্রুপ নেই বিদ্বেষ। অর্থাৎ যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তসম্মত, তাদের সাথে
আমাদের কোন প্রকার বিদ্বেষ নেই। আর যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খিলাফ বা বিপরীত, তাদের সাথে
আমাদের কোন প্রকার বন্ধুত্ব নেই। কারণ মুসলমানের বন্ধুত্ব বা বিদ্বেষ একমাত্র আল্লাহ্
পাক-এর জন্যেই হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ
হয়েছে যে,
عن
ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من احب لله
وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থঃ- “হযরত আবু
হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-এর (সন্তুষ্টি লাভের) জন্যে মহব্বত বা
বন্ধুত্ব করে, বিদ্বেষ পোষণ করে,
আদেশ করে, নিষেধ করে, তার ঈমান পরিপূর্ণ।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী)
বস্তুতঃ মাসিক আল বাইয়্যিনাত
পত্রিকার প্রতিটি লিখা,
বক্তব্য, সুওয়াল-জাওয়াব, ফতওয়া, প্রতিবাদ, প্রতিবেদন, মতামত ইত্যাদি
উপরোক্ত হাদীছ শরীফের মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
কাজেই “মাসিক আল
বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় “ইসলামের নামে গণতন্ত্র,
নির্বাচন, ভোট ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” দেয়ার মূল
লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো সত্যান্বেষী বা হক্ব তালাশী মুসলমানগণের নিকট সঠিক বা হক্ব
বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা। যার মাধ্যমে প্রত্যেকেই তাদের ঈমান-আক্বীদা ও আমল হিফাযতের মাধ্যমে
ইহ্লৌকিক ও পারলৌকিক ইত্মিনান ও নাযাত লাভ করতে পারে।
মূলতঃ মানুষ মাত্রই ভুল হওয়া
স্বাভাবিক, তাই এক মু’মিন অপর মু’মিনের ভুল ধরিয়ে বা শুধরিয়ে দেয়া ঈমানী দায়িত্ব। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে যে,
عن
ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم المؤ من مرأة
المؤمن اذا رأى فيه عيبا اصلحه.
অর্থঃ- “হযরত আবু
হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, এক মু’মিন অপর মু’মিনের জন্যে আয়না। যখন সে তার মধ্যে
কোন দোষত্রুটি দেখবে তখন সে তাকে সংশোধন করে দিবে।” (বুখারী, আবূ দাউদ, মিশকাত)
উপরোক্ত হাদীছ শরীফের আলোকে
অসংখ্য, অগণিত পাঠকগণের পূণঃপূণঃ অনুরোধের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের আক্বীদা ও আমল হিফাযতের
লক্ষ্যে ইসলামের নামে গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোট ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রদান করা হলো। যাতে
করে সত্যান্বেষী,
মুসলমানগণ এ সম্পর্কে আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের সঠিক শরয়ী ফায়সালা
অবগত হন, যার ফলশ্রুতিতে সকলেই উক্ত আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ থেকে নিজেদের ঈমান ও
আমলের হিফাযত করে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ সন্তুষ্টি
হাছিল করতে পারেন।
সুওয়ালকারীদের নাম-ঠিকানা
সাইয়্যিদ মুহম্মদ আলমগীর হুসাইন, ঢাকা
মুহম্মদ আনোয়ার হুসাইন, মুহম্মদপুর, ঢাকা
মুহম্মদ ছিদ্দীকুল আলম, চান্দিনা, কুমিল্লা
মুহম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, শালিখা, মাগুরা
মুহম্মদ আফতাবুদ্দীন, কোনাবাড়ী, গাজিপুর
মুহম্মদ মুহসিনুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
মুহম্মদ হারুনূর রশীদ, মাহিগঞ্জ, রংপুর
শাফিয়ী আহমদ, রাজারহাট, কুড়িগ্রাম
মুহম্মদ সদরুল আমীন গোলাপগঞ্জ, সিলেট
মুহম্মদ আশাদুজ্জামান, পলাশবাড়ী, গাইবান্ধা
মুহম্মদ আশফাকুর রহমান, সিংড়া, নাটোর
মুহম্মদ ইছহাকুর রহমান, কসবা, বি.বাড়িয়া
মুহম্মদ শফিকুছ্ ছালেহীন, মতলব, চাঁদপুর
মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান, প্রভাকরদী, এন.গঞ্জ
মুহম্মদ হারিছুর রহমান, রাজপাড়া, রাজশাহী
মুহম্মদ কাওছার হুসাইন, বানারীপাড়া, বরিশাল
মুহম্মদ হাদীউল ইসলাম, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম
মুহম্মদ কামরুজ্জামান, কুটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ
মুহম্মদ আবুল কাশেম, আক্কেলপুর, জয়পুরহাট
মুহম্মদ হাবীবুল্লাহ, কালীহাতি, টাঙ্গাইল
সুওয়াল
বর্তমান ২০০৭ সালে পুনরায় “সংসদ নির্বাচন” অনুষ্ঠিত
হতে যাচ্ছে। যাতে অন্যান্য দলগুলোর মতো নামধারী ইসলামী দলগুলোও সক্রিয়ভাবে উক্ত নির্বাচনে
অংশ গ্রহণ করবে তথা প্রার্থী দিবে। ইসলামের নামে যারা নির্বাচনে অংশ নেয় তারা সাধারণতঃ
প্রচার করে থাকে যে,
গণতন্ত্র আর ইসলাম একই বিষয় এবং তারা যে গণতন্ত্র করছে, সেটা হচ্ছে
ইসলামী গণতন্ত্র। তারা গণতন্ত্রের ভিত্তি ভোটকে আমানত, শুপারিশ, উকিল নিয়োগ, স্বাক্ষ্য
ইত্যাদি বলে প্রচার করে থাকে।
কেউ কেউ আবার ইসলামী দলকে ভোট
দেয়া ফরয-ওয়াজিব বলে থাকে। আরো বলে থাকে যে, ইসলামী দলের প্রার্থীকে ভোট দিলে জান্নাতের টিকেট পাওয়া যাবে।
যেমন জামাত নেতারা কিছুদিন পূর্বে একটি দৈনিক পত্রিকার সাক্ষাতকারে বলেছে, ইসলাম ও গণতন্ত্র
একই বিষয়।
বায়তুল মুকাররমের খতীব ওবায়দুল
হক বলেছে, “ভোট দেয়া আল্লাহ পাক-এর নির্দেশ অর্থাৎ ফরয। আল্লাহ পাক বলেন, ভোট একটি
আমানত। আল্লাহ পাক-এর হাবীব বলেছেন, সৎ লোককে ভোট দিতে হবে।” (দৈনিক সংগ্রাম
১লা জুলাই-২০০৬)
মাহিউদ্দিন খান তার মাসিক মদীনা
ডিসেম্বর/৯৯ সংখ্যায় নির্বাচন ভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট দান সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের উত্তরে লিখেছে, (ক) ছহীহ্
অর্থে মুসলমানদের প্রকৃত শাসক হচ্ছে পবিত্র কুরআন এবং রসূলের সুন্নাহ্। (খ) প্রচলিত
যে কোন শাসন ব্যবস্থায় যদি কুরআন-সুন্নাহ্র প্রাধান্য মেনে নেয়া হয় তবে তা মুসলিম জনগণ
বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারেন। (গ) ভোটের মাধ্যমে নেতা বা শাসক নির্বাচনের বর্তমান
যে পদ্ধতি এটা অংকুরিত হয়েছে, ইসলামী শুরা পদ্ধতির মধ্য থেকে। সুতরাং এই পদ্ধতিতে ভোটের রাজনীতি
ইসলামে বৈধ নয় এ কথা বলা যাবে না। (ঘ) এ যুগের ভোট প্রদান বাইয়াতের বিকল্প বিবেচিত
হতে পারে।
অনুরূপ হাটহাজারী খারেজী মাদ্রাসার মুখপত্র মাসিক মুহীনুল ইসলামের সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর’ ০৬ সংখ্যায়ও
ভোট-নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছে, (ক) গণতন্ত্র
বা নির্বাচন দুই প্রকার। (১) পাশ্চত্য গণতন্ত্র বা নির্বাচন। (২) ইসলামী গণতন্ত্র বা
নির্বাচন। (খ) খুলাফায়ে রাশেদীন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিলেন (গ) পদপ্রার্থী হওয়া
জায়িয। (ঘ) কুরআন সুন্নাহয় ভোটকে স্বাক্ষী, আমানত, সুপারিশ ও
প্রতিনিধি নিয়োগ বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইত্যাদি অনেক ভুল তথ্য তারা উল্লেখ্য করেছে।
পটিয়া খারেজী মাদ্রাসার মুখপত্র “আত্ তাওহীদ” ...... সংখ্যায় ভোট বেচা-কেনা করাকেও জায়িয
ফতওয়া দিয়েছে।
আর উল্লিখিত বিষয়ে তাদের নিকট
দলীল তলব করলে তারা সাধারণতঃ মুফতী শফীর মা’য়ারিফুল কুরআন ও ভোটের ইসলামী শরয়ী
বিধান এবং শামসুল হক ফরীদপুরী ছাহেবের বক্তব্য তুলে ধরে বলে থাকে যে, তারা ভোটকে
জায়িয বলেছেন।
এখন আমাদের জানার বিষয় হলোঃ
১। ইসলাম আর গণতন্ত্র কি একই বিষয়? উভয়ের মধ্যে
কি কোন পার্থক্য নেই?
এ সম্পর্কে জামাত নেতার এ বক্তব্য কতটুকু শরীয়তসম্মত?
২। নির্বাচন ও ভোট প্রথার উৎপত্তি কোথায় এবং কবে? কোন নবী-রসূল, ছাহাবী, তাবিয়ী, তাবে তাবিয়ীন
ভোট ও নির্বাচন করেছেন কি?
৩। ইসলাম বা শরীয়তের দৃষ্টিতে পদপ্রার্থী হওয়া বা ভোট চাওয়া জায়িয কিনা?
৪। ভোট একটি আমানত, স্বাক্ষ্য ও উকিল নিয়োগ মুফতী শফী
ও শামছুল হক ফরীদপুরী ছাহেব ও তার অনুসারীদের উক্ত বক্তব্য কতটুকু সঠিক ও দলীল ভিত্তিক।
৫। ভোট দেয়া আল্লাহর নির্দেশ তথা ফরয-ওয়াজিব। আল্লাহ
বলেন, ‘ভোট একটি আমানত’। আল্লাহ পাক-এর হাবীব বলেছেন, ‘সৎ লোককে ভোট দিতে হবে।’ বায়তুল মুকাররম
মসজিদের খতীবের একথা কতটুকু শরীয়ত ও দলীল সম্মত?
৬। (ক) ছহীহ্ অর্থে মুসলমানদের প্রকৃত শাসক হচ্ছে
পবিত্র কুরআন এবং রসূলের সুন্নাহ্। (খ) প্রচলিত যে কোন শাসন ব্যবস্থায় যদি কুরআন-সুন্নাহ্র
প্রাধান্য মেনে নেয়া হয় তবে তা মুসলিম জনগণ বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারেন। (গ) ভোটের
মাধ্যমে নেতা বা শাসক নির্বাচনের বর্তমান যে পদ্ধতি এটা অংকুরিত হয়েছে- ইসলামী শুরা
পদ্ধতির মধ্য থেকে। সুতরাং এই পদ্ধতিতে ভোটের রাজনীতি ইসলামে বৈধ নয় এ কথা বলা যাবে
না। (ঘ) এ যুগের ভোট প্রদান বাইয়াতের বিকল্প বিবেচিত হতে পারে।
মাহিউদ্দীনের উপরোক্ত বক্তব্য
কতটুকু সত্য ও দলীলসম্মত?
৭। খুলাফায়ে রাশিদীন কি পদপ্রার্থী হয়েছিলেন?
৮। একটি পদের জন্য কি একাধিক প্রার্থী ছিলেন? এবং তাঁদের
কি কোন মার্কা ছিল?
৯। খলীফাগণ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন, না খিলাফত?
১০। খলীফাগণ মানবরচিত বিধানে, না শরয়ী বিধানে
খিলাফত পরিচালনা করেছেন?
১১। খলীফা নিয়োগদান পদ্ধতি নির্বাচন, না মনোনয়ন?
১২। গণতান্ত্রিক বহুদলীয় নির্বাচনে প্রার্থীকে ভোট দেয়া
ওয়াজিব কিনা?
১৩। (ক) গণতন্ত্র বা নির্বাচন
দু’প্রকার পাশ্চত্য গণতন্ত্র, বা নির্বাচন ও ইসলাম গণতন্ত্র বা নির্বাচন। (খ) খুলাফায়ে রাশেদীন
ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছে। (গ) পদপ্রার্থী হওয়া জায়িয। ((ঘ) কুরআন-সুন্নাহয় ভোটকে
স্বাক্ষী, আমানত সুপারিশ ও প্রতিনিধি নিয়োগ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হাট হাজারী খারেজী মৌলবী ছাহেবদের
উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু সত্য ও দলীলসম্মত?
ভোট বেচাকেনাকে জায়িয ও তাওহীদ
পত্রিকার এ বক্তব্য কতটুকু কুরআন-সুন্নাহ সম্মত?
১৫। যদি ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র, ভোট, নির্বাচন
নাজায়িয হয় তবে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে কিভাবে? এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আইন
প্রতিষ্ঠিত হবে কিভাবে?
আমরা জানি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করা ফরযে
আইন। তবে কি সশস্ত্র বিপ্লব বা বোমাবাজি, জিহাদ বা জঙ্গী কার্যকলাপের মাধ্যমে
ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা যাবে?
১৬। আজকাল নামধারী প্রতিটি
ইসলামী দলকেই দেখা যায় বিভিন্ন দলের সাথে ভোট বা চুক্তি করে থাকে। তাদেরকে এ ব্যাপারে
প্রশ্ন করলে তারা এটাকে হুদায়বিয়ার সন্ধির সাথে তুলনা করে থাকে। হুদায়বিয়ার সন্ধির
সাথে তাদের উক্ত জোট বা চুক্তিকে তুলনা করা সঠিক ও শরীয়তসম্মত কিনা?
১৭। যে সকল কথিত মাওলানা, মুফতী, মুহাদ্দিছ, শাইখুল হাদীছ, খতীব, পীর, আমীর ইসলামের
নামে গণতন্ত্র, ভোট, নির্বাচন করছে,
ভোটকে আমানত, স্বাক্ষ্য ফরয-ওয়াজিব বলছে এবং ক্ষমতার
লোভে বাতিলের সাথে আতাত করছে তারা হক্কানী
আলিম কিনা?
তাদের পিছনে নামায পড়া জায়িয কিনা? তাদের ব্যাপারে
শরীয়তের ফায়ছালা কি?
উপরোক্ত প্রতিটি বিষয় দলীলভিত্তিক
বিস্তারিত জাওয়াব দিয়ে আমাদের ঈমান-আক্বীদা ও আমল হিফাযত করবেন বলে আমরা আশাবাদি।
জাওয়াবঃ
ইসলামের নামে বা ইসলামের দোহাই
দিয়ে গণতন্ত্র, ভোট, নিবার্চন করা,
পদপ্রার্থী হওয়া, ভোট চাওয়া, নিজ দলকে
ভোট দেয়া ওয়াজিব ও জান্নাতের টিকেট লাভের কারণ বলা এবং ভোটকে আমানত, সুপারিশ, স্বাক্ষ্য
ইত্যাদি বলা সম্পূর্ণ হারাম ও কুফরী। এটাই কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস
তথা শরীয়তের চুড়ান্ত,
ছহীহ ও গ্রহণযোগ্য ফতওয়া।
অতএব, বলার অপেক্ষা
রাখে না যে, গণতন্ত্র, ভোট, নির্বাচন ও পদপ্রার্থী হওয়া সম্পর্কিত তথাকথিত খতীব উবায়দুল হক, নিজামী, আহমদ শফী, মাহিউদ্দীন, আমিনী ও আযীযূল
হক- ওহাবী, দেওবন্দী ও জামাতীগংদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের
খিলাফ বিধায় তা ভুল,
অশুদ্ধ, জিহালতপূর্ণ দলীলবিহীন ও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
নিম্নে সুওয়ালে উল্লেখিত তাদের প্রতিটি বক্তব্যের
খণ্ডনমূলক জাওয়াব প্রদান করা হলো।
(ধারাবাহিক)
মাসিক মদীনা ডিসেম্বর/৯৯ সংখ্যা
নির্বাচন ভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটদান সম্পর্কিত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে যে
সকল প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তার জাওয়াব-
(৭)
খুলাফায়ে রাশিদীন কি
পদপ্রার্থী হয়েছিলেন?
মাসিক মদীনা সম্পাদক মাহিউদ্দিন
তার বক্তব্য দ্বারা এটাই বুঝাতে চাচ্ছে যে, হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণ পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। অথচ ছহীহ এবং গ্রহণযোগ্য
ফতওয়া হলো, হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন কস্মিনকালেও পদপ্রার্থী হন নাই। “খূলাফায়ে
রাশিদীন পদপ্রার্থী ছিলেন”
একথা বলার অর্থ হলো, উনাদের প্রতি মিথ্যারোপ করা ও তোহমত
দেয়া যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কারণ ইসলামী শরীয়তে পদপ্রার্থী হওয়া বা পদের আকাঙ্খা
করা সম্পূর্ণ হারাম।
তাই যারা পদপার্থী হয় বা পদের
আকাংখা করে, তাদেরকে আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পদ দেননি।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে,
عن
ابى موسى رضى الله تعالى عنه قال دخلت على النبى صلى الله عليه وسلم انا ورجلان من
مبنى عمى فقال احدهما يا رسول الله امر نا على بعض ما ولاك الله و قال الا خر مثل
ذلك فقال انا والله لا نولى على هذا العمل احدا ساله ولا احدا حرص عليه وفى رواية
قال لا نستعمل على عملنا من اراده.
অর্থঃ- হযরত আবূ মুসা রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি ও আমার দু’জন চাচাত
ভাই হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট গেলাম। সে দু’জনের একজন
বললো, হে আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আল্লাহ পাক আপনাকে যে সকল
কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন,
আপনি আমাদেরকে ওটার মধ্য হতে কোন একটির শাসক নিযুক্ত করুন এবং
দ্বিতীয়জনও অনুরূপই বললো। উত্তরে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আল্লাহ পাক-এর
কসম! আমরা এ কাজে (শাসক পদে) এমন কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করিনা, যে ওটার প্রার্থী
হয় এবং ঐ ব্যক্তিকেও নিয়োগ করিনা, যে ওটার লোভ বা আকাঙ্খা করে।” (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)
শুধু তাই নয়, আখিরী রসূল
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফে পদপ্রার্থী হতে
বা পদের আকাঙ্খা করতে সরাসরি নিষেধ করেছেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ ইরশাদ হয়েছে,
عن
عبد الر حمن بن سمرة رضى الله تعالى عنه قال قال لى رسول الله صلى الله عليه وسلم
لا تسال الامارة فانك ان اعطيتها عن مسئلة وكلت اليها وان اعطيتها عن غير مسئلة
اعنت عليها.
অর্থঃ- হযরত আব্দুর রহ্মান
বিন সামুরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ্ পাক-এর
রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, “(হে সামুরা!) তুমি নেতৃত্ব বা
পদ চেওনা। কেননা,
যদি তোমাকে ওটা চাওয়ার কারণে দেয়া হয়, তবে ওটা তোমার
উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। আর যদি ওটা তোমাকে চাওয়া ব্যতীত দেয়া হয়, তাহলে এ ব্যাপারে
তোমাকে সাহায্য করা হবে।”
(মুয়াত্তা শরীফ)
মূলতঃ যারা দুনিয়ালোভী বা নিকৃষ্ট
তারাই পদপ্রার্থী হয় বা পদের আকাঙ্খা করে। উত্তম বা নেক্কার লোক কখনোই পদপ্রার্থী হয়
না। তাই হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن
ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم تجد ون من خير
الناس اشدهم كرا هية لهذا الامر حتى يقع فيه.
অর্থঃ- “হযরত আবূ
হুরায়রা রদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“এই শাসনভারকে যারা কঠোরভাবে ঘৃণা করে, তাদেরকে তোমরা
উত্তম লোক হিসেবে পাবে,
যে পর্যন্ত তারা তাতে লিপ্ত না হয়।” (মুয়াত্তা
শরীফ)
উপরোক্ত ছহীহ বর্ণনাসমূহ দ্বারা
দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, স্বয়ং আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পদপ্রার্থী হতে বা পদের আকাঙ্ঘা করতে নিষেধ
করেছেন এবং যারা পদপ্রার্থী হয় বা পদের আকাঙ্খা করে তাদেরকে তিরষ্কার করেছেন। তাই ইসলামী
শরীয়তের দৃষ্টিতে পদপ্রার্থী হওয়া বা পদের আকাঙ্খা করা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়িয।
এখন কথা হলো যদি বলা হয় যে, “খুলাফায়ে রাশিদীন পদপ্রার্থী ছিলেন,” তবে কি এটাই
প্রমাণিত হয় না যে,
খুলাফায়ে রাশিদীন তথা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণ হাদীছ শরীফ অস্বীকার ও অমান্য করেছেন, তাঁরা রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ পালন করেননি। তাঁরা দুনিয়া লোভী বা পদ লোভী ও নিকৃষ্ট ছিলেন।
নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক এটা খুলাফায়ে রাশিদীন তথা ছাহাবায়ে কিরামগণের প্রতি সুস্পষ্ট
মিথ্যারোপ, তোহমত ও বিদ্বেষ নয় কি?
আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, হযরত ছাহাবায়ে
কিরামগণের প্রতি মিথ্যারোপ করা, তোহমত দেয়া ও বিদ্বেষ পোষণ করা কাট্টা কুফরী। যারা এরূপ বলবে
বা করবে তারা কাট্টা কাফিরের অন্তর্ভুক্ত। কেননা, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
আনহুমগণ বেমেছাল মর্যাদার অধিকারী। কারণ তাঁদের মর্যাদার উৎসই হচ্ছে আল্লাহ পাক-এর
হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোহবত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে
তাঁদের সততা, বিশ্বস্ততা, শরাফত, আত্মত্যাগ, সদাচার, আল্লাহভীতি, তাক্বওয়া, ইহসান, সহানূভূতি, বীরত্ব, সাহসিকতা ইত্যাদি সবই ছিল নজীর বিহীন। তাঁরা ছিলেন নিস্কলুষ ও পূত-পবিত্র চরিত্রের
অধিকারী। কথায়, কাজে, নছীহতে, উঠা-বসায়, চলা-ফেরায়, ব্যবহারে, এক কথায় যাবতীয় কাজে হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পূণ্যতম
আদর্শ তাঁদের জীবন মুবারকে প্রতিফলিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁরা ছিলেন হযরত রসূলে পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাস্তব অনুকরণ ও অনুসরণকারী ব্যক্তিত্ব।
তাই তাঁরা সর্বকালের, সর্বযুগের
সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মানব এবং হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদর্শের
বাস্তব নমুনা। এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, ছাহাবীগণের সমমর্যাদা পূর্ববর্তী ও
পরবর্তী যুগের কোন উম্মতই লাভ করতে পারবেনা। কেননা ছাহাবীগণ স্বয়ং হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট কালামুল্লাহ শরীফ অধ্যায়ন করেন। তাঁরা আল্লাহ পাক ও তাঁর
রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক পরবর্তী উম্মতের জন্য মনোনীত
এবং ঘোষিত হয়েছেন আদর্শ পথপ্রদর্শক এবং সত্যের মানদণ্ডরূপে। হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতের তাঁরাই প্রথম সূত্র। পরবর্তী উম্মত কুরআন শরীফ ও হাদীছ
শরীফের ব্যাখ্যা,
ভাষ্য, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিচয়, শিক্ষা, পবিত্র জীবনাদর্শ
তাঁদেরই মাধ্যমে লাভ করেছেন। সুতরাং, প্রতিষ্ঠিত ঐকমত্য উপেক্ষা করা বা
এর স্বকীয়তা বিনষ্ট করার অর্থই হলো ঈমান ও ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া।
আল্লাহ পাক স্বীয় কালাম পাকে
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ফযীলত, মর্যাদা-মর্তবা
সম্পর্কে ইশরাদ করেন,
محمد
رسول الله والذين معه اشداء على الكفار رحماء بينهم تر هم ركعا سجدا يبتغون فضلا
من الله ور ضوانا سيما هم فى وجوههم من اثر السجود ذلك مثلهم فى التورة ومثلهم فى
الا نجيل كزرع اخرج شطأه فازره فاستغلظ فاستوى على سوقه يعجب الزراع ليغيظ بهم
الكفار وعد الله الذين امنوأ وعملوا الصلحت منهم مغفرة واجرا عظيما.
অর্থঃ- “হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ পাক-এর রসূল এবং তাঁর সাথী বা ছাহাবীগণ
কাফিরদের প্রতি কঠোর,
নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহ পাক-এর অনুগ্রহ ও
সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাঁদেরকে রুকূ ও সিজদাবনত দেখবেন। তাঁদের মুখমণ্ডলে রয়েছে সিজদার
চিহ্ন। তাঁদের এরূপ অবস্থা তাওরাত শরীফে বর্ণিত রয়েছে। আর ইনজীল শরীফে তাঁদের অবস্থা
এরূপ বর্ণিত রয়েছে,
যেমন একটি চারা গাছ, যা থেকে নির্গত হয় ডাল-পালা। অতঃপর
তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং দৃঢ়ভাবে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায়, কৃষককে আনন্দে অভিভূত করে। অর্থাৎ, ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সংখ্যা চারা গাছের অনুরূপ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
যেমন তাঁরা শুরুতে অল্প সংখ্যক হবেন, এরপর তাঁদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং
শক্তি অর্জিত হবে,
যাতে তাঁদের দ্বারা কাফিরদের অর্ন্তজ্বালা বা হিংসার সৃষ্টি
হয়। যারা ঈমান আনয়ন করে এবং নেক আমল করে আল্লাহ পাক তাঁদেরকে ক্ষমা ও মহা পুরুস্কারের
ওয়াদা দিয়েছেন। অর্থাৎ সমস্ত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণকে ক্ষমা ও মহা পুরুস্কারের
ওয়াদা দেয়া হয়েছে।”
(সূরা ফাতহ্-২৯)
উল্লিখিত আয়াত শরীফে والذ
ين معه থেকে আয়াত শরীফের শেষ পর্যন্ত
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণের গুণাবলী, শ্রেষ্ঠত্ব
ও বিশেষ লক্ষণাদি বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও নুযূল
খাছ তবে হুকুম হচ্ছে আম অর্থাৎ এতে সকল ছাহাবায়ে কিরামগণই দাখিল রয়েছেন।
অর্থাৎ সমস্ত ছাহাবায়ে কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ছিলেন পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল আর কাফিরদের
প্রতি কঠোর। আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই আক্বাইদ, ইবাদত, মুয়ামিলাত, মুয়াশারাত
ও তাছাউফ ইত্যাদি সবই করেছেন। তাই হাদীছ শরীফে হযরত ছাহাবা আজমাঈন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণের অনুসরণ ও অনুকরণ এবং ফাযায়িল-ফযীলত, মর্যাদা-মর্তবা সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে,
عن
عبد الله بن مسعود رضى الله تعالى عنه قال من كان مستنا فليستن بمن قدمات فان الحى
لا تؤ من عليه الفتنة اولئك اصحاب محمد صلى الله عليه وسلم كا نوا افضل هذه الامة
ابرها قلوبا واعمقها علما واقلها تكلفا اختارهم الله لصحبة نبيه ولاقامة دينه فاعر
فوالهم فضلهم واتبعوا على اثر هم وتمسكوا
بما استطعتم من اخلا قهم وسير هم فانهم كا نوا على الهدى المستقيم.
অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে
মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। “যে ব্যক্তি শরীয়তের সঠিক তরীক্বা অনুসরণ
করতে চায়, তার উচিত যারা অতীত হয়েছেন, তাঁদেরকে অর্থাৎ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রিয় ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের অনুসরণ
করা। তাঁরা উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম। আত্মার দিক দিয়ে তাঁরা অধিক পবিত্র। ইল্মের দিক
দিয়ে গভীর। তাঁরা লোক দেখানো আমল করা হতে মুক্ত। আল্লাহ পাক তাঁদেরকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার
জন্যে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথী হিসেবে মনোনীত করেছেন। সুতরাং, তাঁদের মর্যাদা-মর্তবা, ফাযায়িল-ফযীলত, শান-শওকত
সম্পর্কে অবগত হও এবং তাঁদের কথা ও কাজের অনুসরণ কর এবং যথাসম্ভব তাঁদের সিরত-ছূরত
তথা মুবারক জীবনাদর্শকে গ্রহণ কর, কারণ তাঁরা হিদায়েত ও “ছিরাতুল মুস্তাক্বীম”-এর উপর দৃঢ়ভাবে
প্রতিষ্ঠিত।” (মিশকাত শরীফ পৃঃ ৩২)
আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন,
والسبقون
الاولون من المهجرين والانصار والذ ين اتبعوهم باحسان رضى الله عنهم ورضوا عنه واعد
لهم جنت تجرى تحتها الانهر خلد ين فيها ابدا ذلك الفوز العظيم
অর্থঃ- “মুহাজির ও
আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগগণ, যাঁরা ঈমান
আনয়নে অগ্রবর্তী মধ্যে অগ্রগণ্য, তাঁরা এবং তাঁদেরকে যাঁরা (ক্বিয়ামত পর্যন্ত) উত্তমভাবে অনুসরণ
করবে, তাঁদের উপর আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহ পাক-এর উপর সন্তুষ্ট। তাঁদের
জন্য আল্লাহ পাক এরূপ বেহেশ্ত নির্ধারণ করে রেখেছেন, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত হতে
থাকবে, তাঁরা সর্বদা সে বেহেশ্তে অবস্থান করবেন, এটা তাঁদের বিরাট সফলতা।” (সূরা তওবা-১০০)
আর আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যাখ্যায় ইরশাদ করেন,
عن
عمر بن الخطاب رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم سأ لت ربى عن
اختلاف اصحا بى من بعدى فاوحى الى يا محمد ان اصحا بك عندى بمنز لة النجوم بعضها
اقوى من بعض لكل نور فمن اخذ بشيئ مماهم عليه من اختلا فهم فهو عندى على هدى فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم اصحا بى
كالنجوم فبا يهم اقتد يتم اهتد يتم.
অর্থঃ- হযরত উমর ইবনুল খত্তাব
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমার বেছাল শরীফের পরে আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণের ইখতিলাফ (মতবিরোধ) সম্পর্কে আমি আল্লাহ পাককে জিজ্ঞাসা করেছি।” আল্লাহ পাক আমাকে জানালেন, “হে হাবীব
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! নিশ্চয়ই আপনার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণ
আমার নিকট তারকা সমতুল্য। কারো আলোর চেয়ে কারো আলো বেশী, তবে প্রত্যেকেরই
আলো আছে। সুতরাং,
তাঁদের যে কোন ইখতিলাফকে যারা আঁকড়ে ধরবে, তারা হিদায়েত
পেয়ে যাবে। কারণ তাঁদের ইখতিলাফগুলো আমার নিকট হিদায়েত হিসেবে গণ্য।” অতঃপর আল্লাহ
পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমার ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ প্রত্যেকেই তারকা সাদৃশ্য। তাঁদের যে কাউকে তোমরা
অনুসরণ করবে, হিদায়াত প্রাপ্ত হবে।”
(মিশকাত, মাছাবীহুস্ সুন্নাহ, মিরকাত)
অর্থাৎ তাঁদের যে কাউকে, যে কোন ব্যক্তি, যে কোন বিষয়ে
অনুসরণ করবে, সে ব্যক্তি সে বিষয়েই হিদায়েত লাভ করবে বা হিদায়েতের উপর থাকবে।
অতএব, হযরত ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ, যাঁদের প্রতি আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট
এবং তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সন্তুষ্ট, যাঁদেরকে
আল্লাহ পাক জান্নাতী বলে কুরআন শরীফে ঘোষণা করেছেন, যাঁদের পথ ও মত অনুসরণকারীরাও নাজাতপ্রাপ্ত, যাঁদেরকে
আল্লাহ পাক অগাধ জ্ঞানের অধিকারী করেছেন, যাঁদের যুগকে সর্বোত্তম যুগ হিসেবে
ঘোষণা দেওয়া হয়েছে,
যাঁদের অকল্পনীয় ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে পরবর্তী উম্মত সহজেই
পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলাম পেয়েছে। (সুবহানাল্লাহ)
সেই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণের মর্যাদা-মর্তবা সম্পর্কে অনেকেই বেখবর। অনেকেই আবার তাঁদের সমালোচনায়
মুখর। তারা তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে, তাঁদেরকে সত্যের মাপকাঠি মেনে নিতে
অস্বীকৃতি জানায়। উপরন্তু তাঁদেরকে নাক্বিছ ও অপূর্ণ বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকে এরা
সকলেই লা’নতগ্রস্ত বা মালউন। (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক)
কারণ হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
আনহুমগণের প্রতি মুহব্বত রাখা, তাঁদের প্রতি সুধারণা পোষণ করা হচ্ছে ঈমানের অঙ্গ। তাঁদের ইত্তিবা
বা অনুসরণ করা ফরয-ওয়াজিব। আর তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা, তাঁদেরকে
কষ্ট দেয়া, সমালোচনা করা,
নাক্বিছ বা অপূর্ণ বলা সম্পূর্ণই কুফরী। এটাই আহ্লে সুন্নাত
ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা বা বিশ্বাস। এর বিপরীত আক্বীদা পোষণ করা কুফরী ও গোম্রাহীর
নামান্তর।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ
করেন,
ليغيظ
بهم الكفار.
অর্থঃ- “একমাত্র কাফিররাই
তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে।” (সূরা ফাতহ্-২৯)
এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن
مالك بن انس رحمة الله عليه قال قال رسول
الله صلى الله عليه وسلم من غاظ اصحاب محمد صلى الله عليه وسلم فهو كافر.
অর্থঃ- “হযরত মালিক
ইবনে আনাস রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম-ইরশাদ করেন,
যে ব্যক্তি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের
প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে,
সে কাফির।” (নাসীমুর রিয়ায ফী শরহে শিফা লি ক্বাযী আয়ায)
অতএব, প্রত্যেককেই
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণের প্রতি সুধারণা পোষণ করতে হবে, তাঁদেরকে
মুহব্বত ও যথাযথ তা’যীম-তাক্রীম করতে হবে এবং তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা যাবেনা, তাঁদের কোনরূপ
সমালোচনা ও তাঁদেরকে নাক্বিছ বা অপূর্ণ বলা যাবেনা।
যদি তাই হয়ে থাকে তবে একথা
বলা কি করে জায়িয বা শরীয়ত সম্মত হতে পারে যে, খুলাফায়ে রাশিদীন বা হযরত ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আখিরী রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর নির্দেশ অমান্য করে পদপ্রার্থী হয়েেিলন (নাউযুবিল্লাহ)। এর
দ্বারা কি এটাই বুঝা যায়না যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সর্বক্ষেত্রে
বা সব বিষয়ে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করেন নাই। (নাউযুবিল্লাহ)
অথচ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ
প্রমাণ করে যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আখিরী রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বক্ষেত্রে এবং সব বিষয়ে সুক্ষ্মাতি সুক্ষ্ম
ও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ অনুকরণ করেছেন।
উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি ঘটনা
নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে, একদিন আল্লাহ
পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম না’লাইন শরীফসহ
মসজিদে নামায পড়ছিলেন,
এমন সময় হযরত জিব্রীল আলাইহিস্ সালাম এসে বললেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার না’লাইন শরীফে নাপাকি রয়েছে।” তখন হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম না’লাইন শরীফ খুলে ফেললেন। সাথে সাথে
উপস্থিত সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণও না’লাইন খুলে
ফেললেন। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “এ হুকুম তোমাদের
জন্য নয়, এটা আমার জন্যে খাছ।”
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, রসূল পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যা করতে দেখতেন, ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুগণও তাই করতেন। আর যা বর্জন করতেন, তাঁরা বর্জন করতেন,, কখনো কি ও
কেন প্রশ্ন করতেন না। যেমন,
হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আব্দুল্লাহ্
ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ইমামুল মুরসালীন
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি স্বর্ণের আংটি ব্যবহার করতেন, ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণও স্বর্ণের আংটি বানিয়ে ব্যবহার করা শুরু করলেন।
যখন স্বর্ণ ব্যবহার পুরুষের জন্য সম্পূর্ণ হারাম হওয়ার কারণে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম আংটিটি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং বললেন, “আমি আর কখনও
এটা ব্যবহার করবো না।”
তখন ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ সকলেই তাঁদের
আঁংটিগুলো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। এটাই ছিল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণের নমুনা। এ রকম হাজারো লাখো ঘটনার
দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ সর্ব ব্যাপারে
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ-অনুকরণ করেছেন। কেবলমাত্র যেসব
ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে তা ব্যতীত। তবে ঐ নিষেধ মানাও অনুসরণ-অনুকরণের অন্তর্ভুক্ত।
কাজেই, মাহিউদ্দীনগং কি একটি ঘটনাও দেখাতে পারবে, যেখানে নিষেধাজ্ঞা ব্যতীত ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ-অনুকরণ
করেননি?
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণকে হুকুম না দেয়া সত্বেও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
অনুসরণের লক্ষ্যে সকলেই না’লাইন শরীফ ও আংটি মুবারক খুলে ফেললেন। এটাই যদি হতে পারে, তবে যেখানে
হাদীছ শরীফে পদপ্রার্থী হতে সরাসরি নিষেধ করা হয়েছে, সে নিষেধ অমান্য করে হযরত ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ কি করে পদপ্রার্থী হতে পারেন?
হযরক ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে কতটুকু অনুসরণ-অনুকরণ
করতেন, সে সম্পর্কে যাদের মোটেও ইল্ম নেই এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণের মান-মর্যাদা সম্পর্কে যারা নেহায়েত অজ্ঞ ও মূর্খ, তারাই শুধু
এরূপ মনে করতে পারে।
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে সর্বক্ষত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ অনুকরণ করতেন, নিম্নে তার
আরো কিছু প্রমাণ পেশ করা হলো-
(১) রোম সম্রাট একবার তার এক দূতকে
পাঠালেন মদীনা শরীফে আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
সাথে সাক্ষাত করার জন্য। দূত সাক্ষাত করে ফিরে গিয়ে বললেন, হে সম্রাট!
তাঁরা এমন এক জাতি,
যাঁদের সাথে যুদ্ধ করে কখনো জয়লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ তাঁরা
তাঁদের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কল্পণাতীতভাবে অনুসরণ-অনুকরণ, তা’যীম-তাকরীম
করেন। তাঁদেরকে যদি বলা হয় আগুণে ঝাপ দেওয়ার জন্যে, তাঁরা তৎক্ষণাৎ আগুণে ঝাপ দেয়ার জন্য
প্রস্তুত। তাঁদের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুখ মুবারক থেকে থুথু ফেলার
সাথে সাথে তাঁরা সেটা ধরে খেয়ে ফেলেন। ওযুর কুলি করা পানি মাটিতে পড়ার পূর্বেই সেটাকে
শরীরে মেখে ফেলেন। (সুবহানাল্লাহ)
(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাত
মুবারকের পর একদিন এক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে হঠাৎ করে মাথাটী নিচু করে দিলেন।
উনার সঙ্গী-সাথীগণ বললেন,
হুযূর! আপনি মাথা নিচু করলেন কেন? এখানে মাথা
নিচু করার তো কোন কারণ দেখছিনা। তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু বললেন, “আমি আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে এ রাস্তা
দিয়ে একদিন সফরে যাচ্ছিলাম। সফরে যাওয়ার পথে ঠিক এ জায়গায় একটি গাছ ছিল, গাছের একটি
ডালা নিচু হয়ে রাস্তার উপর দিয়ে গিয়েছিল। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
মাথা মুরকের সাথে ডালাটি লাগার সম্ভাবনা থাকায়, তিনি মাথা মুবারক নিচু করে ডালাটি
অতিক্রম করেছিলেন। যদিও এখন সেই ডালাটি নেই, তথাপি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণের লক্ষ্যে আমি আমার মাথা নিচু করে দিলাম। (সুব্হানাল্লাহ্)।
(৩) হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু প্রথমে কদু খাওয়া পছন্দ করতেন না। একদিন তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম-এর সাথে এক দর্জি ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বাড়ীতে দাওয়াত খেতে
গেলেন। সেখানে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মুখে এক পেয়ালা কদু
মিশ্রিত গোশ্তের তরকারী দেয়া হলো। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে পেয়ালা
হতে কদুর টুকরোগুলো বেছে বেছে খাচ্ছিলেন। হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এভাবে কদু খেতে দেখে, তখন হতে কদুর
প্রতি আমার মুহব্বত পয়দা হয়ে গেল। আমি জীবনে যতদিন হায়াত পেয়েছি, সবসময় কদু খাওয়ার চেষ্টা করতাম। (বুখারী শরীফ)
উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ দ্বারা
সুস্পষ্টভাবেই ছাবিত হয় যে,
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সর্বক্ষেত্রে
এবং সব বিষয়েই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা কুরআন ও সুন্নাহকে পরিপূর্ণরূপে
অনুসরণ ও অনুকরণ করেছেন। অতএব, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, খুলাফায়ে রাশিদীন তথা হযরত ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ কস্মিনকালেও পদপ্রার্থী হন নাই। আর যেহেতু হাদীছ
শরীফে পদপ্রার্থী হতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সেহেতু বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, হযরত ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ হাদীছ শরীফের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ গুরুত্ব সহকারে
পরিপূর্ণভাবে পালন করেছেন। আর এ কারণেই খুলাফায়ে রাশিদীনসহ সকল ছাহাবায়ে কিরামগণ উম্মতের
জন্য অনুসরনীয়-অনুকরনীয় অর্থাৎ হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে
অনুসরণ-অনুকরণ করা উম্মতের জন্য ফরয ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ
শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن
عرباض بن سارية رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم عليكم
بسنتى وسنة الخلفاء الرا شدين المهديين تمسكوا بها وعضوا عليها بالنوا جذ.
অর্থঃ- হযরত ইরবায বিন সারিয়া
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীবহুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “তোমাদের জন্য আমার সুন্নত এবং আমার খুলাফায়ে রাশিদীন (হিদায়েতপ্রাপ্ত
ছাহাবায়ে কিরাম) রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সুন্নত পালন করা অপরিহার্য। তোমরা
তা মাড়ির দাঁত দিয়ে শক্তভাবে আঁকড়ে ধর।” (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ্, মিশকাত, মাছাবহীস্ সুন্নাহ, মিরকাত)
মূলকথা হলো, হযরত ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্
নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বরকতময় ছোহ্বতে ধন্য হয়ে তাঁর অনুসরণ
-অনুকরণের মাধ্যমে আল্লাহ পাক-এর এমন সন্তুষ্টি হাছিল করেছেন যে, তাঁরা আল্লাহ
পাক-এর পক্ষ থেকে মাহ্ফূয (সংরক্ষিত) এবং সর্ব প্রকার সমালোচনার ঊর্ধ্বে এবং চূড়ান্ত
পর্যায়ের অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। কারণ তাঁদের অনুসরণ স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং স্বয়ং আল্লাহ পাক-এরই অনুসরণের শামিল।
উপরোক্ত বিস্তারিত ও দলীলভিত্তিক
আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, “খুলাফায়ে
রাশিদীনগণ কস্মিনকালেও পদপ্রার্থী ছিলেন না।” কারণ পদপ্রার্থী হওয়া ইসলামী শরীয়তে
সম্পূর্ণরূপে হারাম। কাজেই “খুলাফায়ে রাশিদীন পদপ্রার্থী ছিলেন” মাহিউদ্দীনগংদের
একথা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
(৮)
একটি পদের জন্য একাধিক ছাহাবী
প্রার্থী ছিলেন কি?
একটি পদের জন্য একাধিক ছাহাবী
প্রার্থী হয়েছিলেন,
একথা বলা ও বিশ্বাস করাও কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কারণ হাদীছ
শরীফ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, পদপ্রার্থী হওয়া বা পদ তালাশ করা সম্পূর্ণরূপে
হারাম ও নাজায়িয। যদি তাই হয়ে থাকে তবে একথা বলা কি করে জায়িয হতে পারে যে, “একটি পদের
জন্য একাধিক ছাহাবী প্রার্থী হয়েছিলেন।” (নাউযুবিল্লাহ)
তাদের উক্ত বক্তব্য দ্বারা
কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে,
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ অমান্য করে হারাম ও নাজায়িয কাজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করেছেন তথা পদ বা ক্ষমতালোভী ছিলেন। (নাউযুবিল্লাহ)
মূলতঃ কেউ যদি বলে ও বিশ্বাস
করে যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণ হারাম ও নাজায়িয কাজ করেছেন তারা পদ বা ক্ষমতালোভী ছিলেন তাহলে সে কাট্টা কাফির
হয়ে যাবে। কারণ এরূপ বলা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি
সুস্পষ্ট মিথ্যারোপ,
দোষারোপ, তোহমত ও গালি দেয়ার নামান্তর। অথচ কুরআন শরীফে ও হাদীছ শরীফে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণকে দোষারোপ করতে, তোহমত ও গালি দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে
কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক বলেন,
والذ
ين جاء ومن بعدهم يقولون ربنا اغفر لنا
ولاخوا ننا الذ ين سبقو نا بالا يمان ولا
تجعل فى قلو بنا غلا للذ ين امنوا ر بنا انك رئوف رحيم.
অর্থঃ “আর যারা তাুঁদের
পরে এসেছেন। তারা বলবেন,
হে আমাদের রব! আমাদেরকে এবং ঈমান আনয়নে অগ্রগামী আমাদের ভাইদের
(ছাহাবীগণের) ক্ষমা করুন। এবং ঈমানদার তথা ছাহাবাীগণের ব্যপারে আমাদের অন্তরে কোন প্রকার
বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! আপনি দয়ালু ও পরম করুণাময়।” (সূরা হাশর-১০)
অর্থাৎ পরবর্তী উম্মতী মুহম্মদ
সদা সবর্দা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি হুসনে যন বা
সুধারণা রাখবে এবং দুয়া করবে। এমনকি উম্মতী মুহম্মদ কোন অবস্থাতেই বিরূপ ধারণা বা বিদ্বেষ
পোষণ করবেনা। শুধু তাই নয় বরং কস্মিনকালেও যেন অন্তরের মধ্যেও বিরূপ ধারণা ও বিদ্বেষভাব
পয়দা না হয় সেজন্য সদা সর্বদা অর্থাৎ দায়িমীভাবে দুয়া চাইবে আল্লাহ পাক-এর কাছে। কারণ
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের যে মর্যাদা ও নৈকট্য রয়েছে তা পরবর্তী
উম্মতী মুহম্মদ কল্পনাও করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে ও এর ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফে ইরশাদ
হয়েছে,
عن
ابى سعيد الخدرى رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا
تسبوا اصحا بى فلو ان احد كم انفق مثل احد ذهبا ما بلغ مد احد هم ولا نصيفه.
অর্থঃ- “হযরত আবূ
সাঈদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা আমার
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণকে গালি দিওনা। কেননা যদি তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড়
পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ পাক-এর রাস্তায় দান করে, তবুও ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
আনহুমগণের এক মূদ (১৪ ছটাক) বা অর্ধ মূদ (৭ ছটাক) গম দান করার ফযীলতের সমপরিমাণ ফযীলতও
অর্জন করতে পারবে না।”
(বুখারী শরীফ)
শুধু তাই নয় আরো বর্ণিত রয়েছে
যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সম্পর্কে খারাপ ধারণা বা খারাপ
বক্তব্য পেশ করলে,
সমালোচনা করলে কঠিন আযাব-গযব ও লা’নতগ্রস্ত
হতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن
ابن عمر رضى الله تعا لى عنه قال قال رسول الله
صلى الله عليه وسلم اذا رأ يتم الذين يسبون اصحا بى فقولوا لعنة الله على
شر كم.
অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ
ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ইরশাদ করেন, যখন তোমরা কাউকে আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণকে
গালি দিতে দেখবে,
তখন তোমরা বলো, এ নিকৃষ্ট কাজের জন্য তোমাদের প্রতি
আল্লাহ পাক-এর লা’নত বর্ষিত হোক। অর্থাৎ তুমি মালউন।” (তিরমিযী শরীফ)
কাজেই, “একটি পদের
জন্য একাধিক ছাহাবী প্রার্থী ছিলেন” একথা বলা ও বিশ্বাস করা নিঃসন্দেহে
কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। কারণ এ কথার দ্বারা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণ হারাম-নাজায়িয কাজ করেছেন বলে দোষারোপ করা হয় এবং পদ বা ক্ষমতালোভী ছিলেন বলে
তোহমত বা গালি দেয়া হয়।
মূল কথা হলো, একটি পদের
জন্য একাধিক প্রার্থী হওয়া তো দূরের কথা, খলীফাগণ কেউই কখনো পদপ্রার্থীই হননি।
এটাই ছহীহ ও গ্রহনযোগ্য ফতওয়া।
কোন কোন জাহিল, আমীরুল মু’মিনীন হযরত
উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কর্তৃক ছয় জনের নাম ঘোষণাকেই একাধিক প্রার্থী
হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। অথচ এর সাথে প্রার্থী হওয়ার কোন সম্পর্কই নেই। আমীরুল মু’মিনীন হযরত
উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছয় জনের নাম এজন্য ঘোষণা করেছেন যে, উল্লিখিত
ছয়জনের যে কোন একজন পরবর্তী খলীফা মনোনীত হবেন। উল্লিখিত ছয় জনের একজনও কখনো একথা বলেননি
যে, আমাকে খলীফা বানানো হোক বা আমি খলীফা পদ চাই। তাহলে একথা কি করে সত্য হতে পারে
যে খলীফাগণ পদপ্রার্থী ছিলেন?
মূলতঃ জাহিলরা এ সম্পর্কিত
সঠিক ইতিহাস না জানার কারণেই ছয় জনের নাম ঘোষণাকে পদপ্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।
তাই নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে এ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য তুলে ধরা হলো-
আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল
মুসলিমীন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদিয়াল্লাহু আনহুকে শাহাদতের পূর্বে অর্থাৎ তিনি আহত থাকা
অবস্থায় হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরজ করলেন, হে আমীরুল
মু’মিনীন! আপনার পরবর্তী খলীফা কে হবেন? তখন তিনি বললেন, আজকে যদি
হযরত আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জীবিত থাকতেন তাহলে তাঁকেই
আমি খলীফা হিসেবে মনোনীত করতাম। তাঁর অনুপস্থিতিতে ছয় জনের নাম ঘোষণা করে যাচ্ছি। এদের
মধ্য হতে যে কোন একজন খলীফা মনোনীত হবেন।
উল্লিখিত ছয়জন হচ্ছেন- হযরত
উছমান যুন্ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ত্বালহা
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা তায়ালা আনহু, হযরত যুবাইর রদি¦য়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত সা’দ ইবনে আবি
ওয়াক্কাছ রদি¦য়াল্লাহু
তায়ালা আনহু ও হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
স্মরণীয় যে, উপরোক্ত ছয়জনই
ছিলেন “আশারায়ে মুবাশ্শারার”
অন্তর্ভূক্ত।
উল্লিখিত ছয় জনের নাম ঘোষণা
করে হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুকে দায়িত্ব দিলেন, তিনদিনের মধ্যে যে কোন একজনকে মনোনীত করার জন্য। হযরত আব্দুর
রহমান ইবনে আওফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উল্লিখিত পাঁচজনের সাথে পরামর্শ করে হযরত
উছমান যুননূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে খলীফা হিসেবে মনোনীত করেন। আর দ্বিতীয়
ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনোনীত হন হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। যার ফলশ্রুতিতে হযরত
উসমান রদিয়াল্লাহু আনহু-এর শাহাদতের পর হযরত আলী রদিয়াল্লাহু আনহু খলীফা হিসেবে খিলাফত
লাভ করেন।
স্মর্তব্য যে, উল্লেখিত
ছয় জনের মধ্যে কেউই খলীফা পদের অথবা খিলাফতের জন্য পদপ্রার্থী হননি। বরং হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু তাঁদের নাম ঘোষণা করার কারণে তাঁরা পরস্পর পরামর্শ করেই একজনকে খলীফা হিসেবে
মনোনীত করেছেন।
অতএব প্রমাণিত হলো, খুলাফায়ে
রাশিদীনের কোন খলীফাই কখনো পদপ্রার্থী হননি। আর যদি কেউই পদপ্রার্থী না হন তাহলে একাধিক
পদপ্রার্থীর প্রশ্নই অবান্তর। সুতরাং একটি পদের জন্য একাধিক ছাহাবী পদপ্রার্থী হয়েছিলেন
একথা বলা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
(৯)
খলীফাগণ খলীফা মনোনীত হওয়ার
পর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন? না খিলাফত পরিচালনা করেছিলেন?
খলীফাগণ খলীফা হওয়ার পর খিলাফত
পরিচালনা না করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন একথা বলা সুস্পষ্ট কুফরী। কারণ “খলীফাগণ রাষ্ট্র
পরিচালনা করেছেন”
এ কথার দ্বারা সুক্ষ্মভাবে এটাই বুঝানো হচ্ছে যে, খুলাফায়ে
রাশিদীন অর্থাৎ ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাফরমানী করেছেন। (নাঊযুবিল্লাহ) এর দ্বারা ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি তিরস্কার ও কুফরী তোহমত দেয়া হয়েছে যা
উনাদের মানহানী ও কষ্টের কারণ।
এ প্রসঙ্গে কালামুল্লাহ শরীফে
ইরশাদ হয়েছে,
ان
الذ ين يؤ ذون الله ورسوله لعنهم الله فى الد نيا والاخرة واعد لهم عذ ا با مهينا.
অর্থঃ- “নিশ্চয় যারা
আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়,
দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের প্রতি আল্লাহ পাক-এর অভিসম্পাত এবং তাদের
জন্য নির্ধারিত রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (সূরা আহ্যাব-৫৭)
এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় হাদীছ
শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن
عبد الله بن مغفل رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الله
الله فى اصحا بى لا تتخذ و هم غرضا من م بعدى فمن احبهم فبحبى احبهم ومن ابغضهم
فببغضى ابغضهم ومن اذا هم فقد اذا نى ومن اذا نى فقد اذى الله ومن اذى الله فيو شك
ان يأ خذه.
অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ
ইবনে মুগাফ্ফাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
আনহুমগণ সম্পর্কে আল্লাহ পাককে ভয় কর, আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
আনহুমগণ সম্পর্কে আল্লাহ পাককে ভয় কর। আমার বিছাল শরীফের পরে তাঁদেরকে তোমরা তিরস্কারের
লক্ষ্যস্থল করোনা। যে ব্যক্তি তাঁদেরকে মুহব্বত করলো, সে আমাকে
মুহব্বত করার কারণেই মুহব্বত করলো, আর যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ
পোষণ করলো, সে আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার কারণেই তা করলো। যে ব্যক্তি তাঁদেরকে কষ্ট দিল, সে মুলতঃ
আমাকেই কষ্ট দিল,
আর যে আমাকে কষ্ট দিল, সে মূলতঃ আল্লাহ পাককেই কষ্ট দিল, আর যে আল্লাহ
পাককে কষ্ট দিল, আল্লাহ পাক তাকে শীঘ্রই পাকড়াও করবেন।” (তিরমিযী শরীফ)
“খুলাফায়ে রাশিদীন রাষ্ট্র পরিচালনা
করেছেন” মাহিউদ্দীনের এ বক্তব্য দ্বারা আরো বুঝা যাচ্ছে যে, খলীফাগণ প্রচলিত
রাষ্ট্র মানতেন। কিন্তু আসলে খলীফাগণ প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামো মানতেন না। তাঁরা খিলাফত
পরিচালনা করতেন। যে কারণে খিলাফতের বিস্তার
ঘটতে ঘটতে তা প্রায় অর্ধ-পৃথিবী পৌঁছেছিল।
উল্লেখ্য, প্রচলিত রাষ্ট্রীয়
ধারণা ইহুদী-নাছারা তথা বেদ্বীন-বদদ্বীনদেরই উদ্ভাবিত মতবাদ। তাই খুলাফায়ে রাশিদীন
কর্তৃক ‘রাষ্ট্র’ পরিচালনা করার প্রশ্নই উঠেনা। তারা যদি সত্যিই রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন তাদেরকে
কখনো খলীফা বলা হতো না। যে রাষ্ট্র পরিচালনা করে সে কখনো খলীফা হতে পারেনা। হয় সে প্রধানমন্ত্রী
বা প্রাইম মিনিস্টার হবে অথবা রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রেসিডেন্ট হবে। আর খলীফা এবং রাষ্ট্র
প্রধান হওয়ার শর্ত শারায়িতের মধ্যেও অনেক পার্থক্য রয়েছে। যেমন খলীফা হতে হলে- (১)
মুসলমান হওয়া, (২) আক্বেল হওয়া,
(৩) বালেগ হওয়া, (৪) পুরুষ হওয়া, (৫)স্বাধীন
হওয়া, (৬) বাকশক্তি সম্পন্ন হওয়া, (৭) শ্রবণ শক্তি সম্পন্ন হওয়া, (৮) দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন হওয়া, (৯) সাহসী
ও শক্তি সম্পন্ন হওয়া,
(১০) আদেল বা পরহেযগার হওয়া, (১১) মুজতাহিদ হওয়া, (১২) কুরাঈশ
হওয়া ইত্যাদি শর্ত পুরা হওয়া আবশ্যক। কেননা হাদীছ শরীফ ইরশাদ হয়েছে,
الائمة
من قريش
অর্থাৎ খলীফা হবেন কুরাঈশ বংশীয়।
(মিশকাত)
আর রাষ্ট্র প্রধানের জন্য উপরোল্লেখিত
শর্ত-শারায়িতের কোন প্রয়োজন নেই।
উল্লেখ্য, খলীফা হওয়ার
জন্য যে শর্ত শারায়িত নির্ধারণ বা ধার্য্য করা হয়েছে, তা কুরআন-সুন্নাহর
ভিত্তিতে। আর রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার জন্য যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা মানব রচিত আইনের
ভিত্তিতে। তাই পুরুষ-মহিলা,
ফাসিক-ফুজ্জার, কাফির-মুশরিক, মুর্খ-জাহিল
ইত্যাদি যে কেউ রাষ্ট্র প্রধান হতে পারে। কারণ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা আলাদা রয়েছে। যা গণতান্ত্রিক
রাজনীতিতেও বিশেষভাবে গ্রহণ করা হয়। রাষ্ট্রের সংজ্ঞা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলে
থাকে, রাষ্ট্রের কয়েকটি উপাদান থাকা আবশ্যক। (১) সার্বভৌমত্ব (২) জন সমষ্টি, (৩) নির্দিষ্ট
ভৌগলিক সীমারেখা,
(৪) সরকার ইত্যাদি।
অথচ ইসলাম উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যধারী
কোন রাষ্ট্রকে সমর্থন করে না। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনা করলে তা হবে হয় রাজতন্ত্র, নয় গণতন্ত্র
অথবা মানব রচিত অন্য কিছু। যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তাই ইসলাম সমর্থন করে
“খিলাফত আলা মিন্হাজিন নুবুওওয়াহ” অর্থাৎ নুবুওওয়াতের দৃষ্টিতে খিলাফতকে।
যা নির্দিষ্ট কোন ভূ-খন্ডের জন্য নয় বরং সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্রজোয্য।
স্মর্তব্য, খিলাফত পরিচালককেই
খলীফা বলে। আর রাষ্ট্র পরিচালককে প্রাইম মিনিস্টার বা প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্ট
বা রাষ্ট্রপ্রধান ইত্যাদি বলে।
সুতরাং খলীফাগণ কর্তৃক রাষ্ট্র
পরিচালনা করা হয়নি বরং খিলাফত পরিচালনা করা হয়েছে। “খলীফাগণ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন” একথা বলা
নিঃসন্দেহে কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
(১০)
খলীফাগণ মানব রচিত বিধানে, না শরয়ী বিধানে
খিলাফত পরিচালনা করেছেন?
খলীফাগণ শরয়ী বিধানে নির্দিষ্ট
পদ্ধতিতে খিলাফত পরিচালনা করেছেন। মানব রচিত কোন আইনের দ্বারা খলীফাগণ খিলাফত পরিচালনা
করেননি। তাঁরা মানব রচিত আইনে পরিচালনা করেছেন এ চিন্তা করাটাও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত।
কোন ব্যক্তি যদি মানব রচিত কোন আইনে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে তাহলে সেটা খিলাফত
হবে না। বরং সেটা রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্রের মত একটি তন্ত্রেরই অন্তর্ভূক্ত
হয়ে যাবে। যা করা মুসলমানদের জন্য কস্মিন কালেও জায়িয নেই। আল্লাহ পাক কালামে পাকে
ইরশাদ করেন,
من
لم يحكم يما انزل الله فاولئك هم الكفرون.
অর্থঃ- “আল্লাহ পাক
যা নাযিল করেছেন সে মুতাবিক যারা আদেশ-নির্দেশ করেনা তারা কাফির।” (সূরা মায়িদা-
৪৪)
من
لم يحكم بما انزل الله فاولئك هم الظلمون.
অর্থঃ- “আল্লাহ পাক
যা নাযিল করেছেন সে মুতাবিক যারা আদেশ-নির্দেশ করেনা তারা যালিম।” (সূরা মায়িদা-
৪৫)
من
لم يحكم بما انزل الله فاولئك هم الفسقون.
অর্থঃ- “আল্লাহ পাক
যা নাযিল করেছেন সে মুতাবিক যারা আদেশ-নির্দেশ করেনা তারা ফাসিক।” (সূরা মায়িদা-
৪৭) অর্থাৎ আল্লাহ পাক-এর নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত যারা আইন প্রণয়ন ও পরিচালনা করবে
তারা কাফির, যালিম ও ফাসিকের অন্তর্ভূক্ত হবে।
কাজেই, খলীফাগণ কি
করে খিলাফত তথা ইসলাম বাদ দিয়ে মানব রচিত মতবাদ অনুযায়ী খিলাফত পরিচালনা করতে পারেন? তাহলে কি
খুলাফায়ে রাশিদীন জানতেন না যে ইসলাম ব্যতীত সকল দ্বীন ও মানব রচিত মতবাদকে বাতিল ঘোষণা
করা হয়েছে এবং ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন নিয়ম-নীতি অনুসরন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে? অবশ্যই জানতেন।
কেননা কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ
হয়েছে,
هو
الذى ارسل رسوله بالهدى. ودين الحق ليظهره على الد ين كله وكفى بالله شهيدا. محمد
رسول الله.
অর্থঃ- “তিনি (আল্লাহ
পাক) তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হিদায়েত এবং সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন
সকল দ্বীনের উপর প্রাধান্য দিয়ে অর্থাৎ সমস্ত দ্বীনকে বাতিল ঘোষণা করে তা ওহী দ্বারা
নাযিলকৃত হোক অথবা মানব রচিত হোক আর তা পূর্বে
হোক অথবা পরে হোক এবং এ বিষয়ে আল্লাহ পাক-এর স্বাক্ষ্যই যথেষ্ট। (যার সাক্ষী আল্লাহ
পাক) আর রসূল হচ্ছেন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।” (সূরা ফাতহ্-২৮, ২৯)
অর্থাৎ আল্লাহ পাক অন্যান্য
সমস্ত দ্বীন-ধর্ম অর্থাৎ পূর্বের সমস্ত আসমানী কিতাব যা ওহী দ্বারা নাযিলকৃত ১০০ খানা
ছহীফা ও ৩ খানা কিতাব তাওরাত শরীফ, যাবুর শরীফ ও ইনজীল শরীফ এবং পূর্বের
ও পরের মানব রচিত সমস্ত মতবাদ যেমন- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র
ইত্যাদি বাতিল করে দিয়ে একমাত্র দ্বীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাঁর হাবীবকে পাঠিয়েছেন।
আর এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে
আরো সুস্পষ্টভাবে ইরশাদ হয়েছে,
عن
جا بر رضى الله تعالى عنه ان عمر بن
الخطاب رضى الله تعالى عنه اتى رسول الله صلى الله عليه وسلم بنسخة من التورة فقال
يا رسول الله صلى الله عليه وسلم هذه نسخة من التورة فسكت فجعل يقرأ ووجه رسول
الله صلى الله عليه وسلم يتغير فقال ابو بكر رضى الله تعالى عنه ثكلتك الثواكل ما
ترى ما بوجه رسول الله صلى الله عليه وسلم فنظر عمر رضى الله تعاى عنه الى وجه
رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال اعوذ بالله من غضب الله وغضب رسوله صلى الله
عليه وسلم رضينا بالله ربا وبالا سلام دينا وبمحمد صلى الله عليه وسلم نبيا فقال
رسول الله صلى الله عليه وسلم والذى نفس محمد صلى الله عليه وسلم بيده لو بدا لكم
موسى عليه السلام فا تبعتموه وتر كتمونى لضللتم عن سواء السبيل ولو كان حيا وادرك
نبوتى لاتبعنى.
অর্থঃ- “হযরত জাবির
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, একদিন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট
তাওরাত শরীফের একটি কপি এনে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম! এটি তাওরাত শরীফের একটি কপি। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ রইলেন। হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তা পড়তে আরম্ভ করলেন।
আর এদিকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেহারা মুবারক লাল হতে লাগলো।
অর্থাৎ অসন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠলো। এটা দেখে হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু বললেন,
হে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আপনার জন্য আফসুস! আপনি কি
দেখছেন না যে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেহারা মুবারক
কি রূপ ধারণ করছে। তখন হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম-এর চেহারা মুবারকের দিকে তাকালেন এবং অসন্তুষ্টির ভাব লক্ষ্য করে বললেন, আমি আল্লাহ
পাক-এর অসন্তুষ্টি থেকে এবং তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসন্তুষ্টি
থেকে আল্লাহ পাক-এর নিকট পানাহ চাচ্ছি। এবং আমরা আল্লাহ পাককে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন
হিসেবে ও আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসেবে
পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছি। তখন রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সেই আল্লাহ
পাক-এর কসম! যার অধিকারে আমার প্রাণ মুবারক রয়েছে, এ সময় যদি তোমাদের নিকট হযরত মূসা
আলাইহিস্ সালাম (যার উপর তাওরাত শরীফ নাযিল হয়েছে) যাহির বা প্রকাশ হতেন আর তোমরা আমাকে
ছেড়ে তাঁর অনুসরণ করতে তবুও তোমরা সরল পথ থেকে অবশ্যই বিচ্যুত অর্থাৎ গোমরাহ হয়ে যেতে।
এমনকি তিনি যদি এখন হায়াতে থাকতেন আর আমাকে পেতেন তাহলে তিনিও নিশ্চয়ই আমার অনুসরণ
করতেন।” (দারিমী, মিশকাত, মিরকাত)
অতএব, প্রমাণিত
হলো যে, খলীফাগণ শরয়ী বিধান মুতাবিক খিলাফত পরিচালনা করেছেন। খলীফাগণ মানব রচিত বিধানে
খিলাফত পরিচালনা করেছেন একথা বলা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত।
(১১)
খলীফা নিয়োগদান পদ্ধতিটি
নির্বাচন, না মনোনয়ন?
খলীফা নিয়োগ মনোনয়ন পদ্ধতিতে
হতে পারে তবে তা কস্মিনকালেও নির্বাচন নয়। কারণ সাধারণভাবে নির্বাচন বলতে বুঝায়, একাধিক পদপ্রার্থী
থেকে ভোটদানের মাধ্যমে একজনকে নির্বাচিত করা। অথচ ইসলামের নামে ভোট চাওয়া বা পদপ্রার্থী
হওয়া সম্পূর্ণ হারাম। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن
ابى موسى رضى الله تعالى عنه قال دخلت على النبى صلى الله عليه وسلم انا ورجلان من
بنى عمى فقال احدهما يا رسول الله امر نا على بعض ما ولاك الله وقال الا خر مثل
ذلك فقال انا والله لا نولى على هذا العمل احدا ساله ولا احدا حر ص عليه وفى رواية
قال لا نستعمل على عملنا من اراده.
অর্থঃ- হযরত আবূ মুসা রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি ও আমার দু’জন চাচাত
ভাই হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট গেলাম। সে দু’জনের একজন
বললো, হে আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আল্লাহ পাক আপনাকে যে সকল
কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন,
আপনি আমাদেরকে ওটার মধ্য হতে কোন একটির শাসক নিযুক্ত করুন এবং
দ্বিতীয়জনও অনুরূপই বললো। উত্তরে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আল্লাহ পাক-এর
কসম! আমরা এ কাজে (শাসক পদে) এমন কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করিনা, যে ওটার প্রার্থী
হয় এবং ঐ ব্যক্তিকেও নিয়োগ করিনা, যে ওটার লোভ বা আকাঙ্খা করে।” (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)
শুধু তাই নয় আখিরী রসূল হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফে পদপ্রার্থী হতে বা পদের আকাঙ্খা
করতে সরাসরি নিষেধ করেছেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ ইরশাদ হয়েছে,
عن
عبد الر حمن بن سمرة رضى الله تعالى عنه قال قال لى رسول الله صلى الله عليه وسلم
لا تسال الا مارة فا نك ان اعطيتها عن مسئلة وكلت اليها وان اعطيتها عن غير مسئلة
اعنت عليها.
অর্থঃ- হযরত আব্দুর রহ্মান
বিন সামুরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ্ পাক-এর
রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, “(হে সামুরা!) তুমি নেতৃত্ব বা
পদ চেওনা। কেননা,
যদি তোমাকে ওটা চাওয়ার কারণে দেয়া হয়, তবে ওটা তোমার
উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। আর যদি ওটা তোমাকে চাওয়া ব্যতীত দেয়া হয়, তাহলে এ ব্যাপারে
তোমাকে সাহায্য করা হবে।”
(মুয়াত্তা শরীফ)
মূলতঃ যারা দুনিয়ালোভী বা নিকৃষ্ট
তারাই পদপ্রার্থী হয় বা পদের আকাঙ্খা করে উত্তম বা নেক্কার লোক কখনোই পদপ্রার্থী হয়
না। তাই হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن
ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم تجد ون من خير
الناس اشدهم كر ا هية لهذا الامر حتى يقع فيه.
অর্থঃ- “হযরত আবূ
হুরায়রা রদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“এই শাসনভারকে যারা কঠোরভাবে ঘৃণা করে, তাদেরকে তোমরা
উত্তম লোক হিসেবে পাবে,
যে পর্যন্ত তারা তাতে লিপ্ত না হয়।” (মুয়াত্তা)
স্মর্তব্য, মনোনয়ন ও
নির্বাচনের মধ্যে শাব্দিক পার্থক্য রয়েছে। যে পদের মুখাপেক্ষী নয় কিন্তু তাঁকে পদ দিলে
সে সুষ্ঠভাবে উক্ত দায়িত্ব পালন করতে পারবে সেই লক্ষ্যে তাকে যখন পদ দেয়া হয় সেটা নির্বাচন
নয় সেটা হচ্ছে মনোনয়ন। মনোনীত ব্যক্তিত্ব ইচ্ছা করলে সেটা গ্রহণ করতেও পারেন অথবা ফিরিয়েও
দিতে পারেন।
আর নির্বাচন হচ্ছে- যে বা যারা
পদের মুখাপেক্ষী তারা তাদের পদের জন্য মানুষের নিকট তাদের মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করে থাকে। তখন মানুষ
যাকে তাদের বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করে তাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। এক কথায় মনোনীত
ব্যক্তি পদের মুখাপেক্ষী নয় বরং পদ মনোনীত ব্যক্তির মুখাপেক্ষী। আর নির্বাচিত ব্যক্তি
পদের মুখাপেক্ষী,
পদ নির্বাচিত ব্যক্তির মুখাপেক্ষী নয়।
কাজেই, হযরত খুলাফায়ে
রাশিদীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে নির্বাচিত বললে তাঁদেরকে ইহানত করা হবে যা
কুফরীরই অন্তর্ভূক্ত। তাই তাঁদেরকে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত না বলে খলীফা বা তাঁর প্রতিনিধি
দ্বারা মনোনীত বলতে হবে।
(অসমাপ্ত)
0 Comments:
Post a Comment