গনতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমানাধিকার, বৈষম্যহীনতার ফাঁকা বুলি
আমেরিকা প্রায় বাংলাদেশকে বলে, “মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ নাকি পিছিয়ে আছে। ”
বাংলাদেশে কোন মুসলিম নির্যাতিত বা নিপীড়িত হলে সেটা সে বলে না, বরং তাদের মতাদর্শী, কিংবা ইসলামবিদ্বেষী কিংবা অন্যধর্মের লোক হলে বলে। একইভাবে, গাজায় যখন ইহুদীবাদী ইসরাইল মুসলমান মারে, তখন সেই আমেরিকা সেখানে সমর্থন দেয়, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। ইসরাইলের পক্ষে ওকালতি করে সারা বিশ্বের কাছে বলে, ইসরাইলের আত্মরক্ষার নামে মানুষ মারার অধিকার আছে। এ কারণে ইসরাইল ২০-২৫ হাজার বেসামরিক মুসলমান মেরে ফেললে, শরনার্থী শিবিরে বিমান হামলা কিংবা হাসপাতালগুলো উড়িয়ে দিলেও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না, কারণ যারা মারা যাচ্ছে তারা তো মুসলমান। আর মুসলমান মারলে তো আর আমেরিকার ভাষায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না।
কয়েকদিন আগে, ভারতের উত্তর প্রদেশে বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে নির্মাণ করা হলো রাম মন্দির। প্রায় ৫শ’ বছরের পুরাতন মসজিদ ধ্বংস করে সে স্থানেই তৈরী হলো মন্দির। হিন্দুত্ববাদীদের দাবী, ঐখানে নাকি রামের জন্মস্থান ছিলো, সেখানেই নাকি সম্রাট বাবর মসজিদ তৈরী করেছিলো। সুতরাং ভাঙ্গতে হবে মসজিদ। ভারত আদালত সেই দাবীর পক্ষেই রায় দিলো। উল্লেখ্য, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রামের স্ত্রী সীতা নিয়েও বেশ কিছু বিশ্বাস আছে। যেমন, বর্তমানে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডকে হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় স্থান বলে দাবী করছে। তাদের কেউ কেউ সেখানে গরু জবাই নিষিদ্ধের দাবী তুলেছে। মুসলমানদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করতে বলছে। কারণ তাদের দাবী, রামের স্ত্রী সেখানে একটি পুকুরে গোসল করতো। সেই নাম অনুসারেই নাকি হয়েছে সীতাকুণ্ড। সুতরাং সীতাকুণ্ড এলাকাকে হিন্দুদের ধর্মীয় এলাকা ঘোষণা করে মুসলমান প্রবেশ নিষিদ্ধ করার দাবী তুলেছে তাদের কিছু মহল। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আরো বিশ্বাস হচ্ছে, রামের স্ত্রী সীতা আত্মহত্যা করার পর তার দেহ ৫১টি টুকরা হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই স্থানগুলোকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শক্তিপীঠ বা তীর্থস্থান বলে মনে করে এবং সেখানে বড় বড় মন্দির বানায়। তাদের দাবী, সীতার শরীরের ৫১ টুকরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে, যেমন- সীতার গলা পরেছে কাম্মীরের শ্রীনগরে, বাম হাত পরেছে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে, হৃদপিণ্ড ঝাড়খণ্ডে, ডান পায়ের নুপুর শ্রীলঙ্কার জাফনায় যেখানে তৈরী হয়েছে মন্দির, চোখ পড়েছে পাকিস্তানের করাচীতে, নাক পড়েছে বরিশালের উজিরপুরে, ডানহাত চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পর্বতে যেখানে চন্দ্রনাথ মন্দির তৈরী হয়েছে, লজ্জাস্থান পড়েছে আসামের গৌহাটিতে যেখানে কামগিরি কামাক্ষা মন্দির নির্মিত হয়, বাম পায়ের হাটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পড়েছে সিলেটের বাউরভাগ গ্রামে, কানের দুল পরে ভারতের উত্তর প্রদেশে, গলা পড়েছে সিলেটের জৈনপুর গ্রামে, বাম পায়ের নুপুর পড়েছে বাংলাদেশের বগুড়ার শেরপুরে, হাতের তালু পড়েছে বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগরে। এই প্রতিটি স্থানেই হিন্দু মন্দির অবস্থিত এবং সেখানে বৃহৎ আকারে মন্দির ও ধর্মীয় কার্যক্রম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কাজ কাজ করছে।
সম্প্রতি, বারবী মসজিদের স্থানে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠান বেশ ঘটা করে করেছে মোদি সরকার। অথচ ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। ৪৭ এ দেশ ভাগের সময় পাকিস্তান মুসলিমদের ভূমি হিসেবে যায়গা পায়। অপরদিকে ভারত কিন্তু শুধু হিন্দুদের ভূমি হিসেবে যায়গায় পায়নি, বরং সকল ধর্মের লোকের ভূমি হিসেবে যায়গা পায়। এজন্য পাকিস্তানের তুলনায় ভারত বিশাল আয়তন লাভ করে। কিন্তু ভারত সকল ধর্মের লোকের নিরাপদ আবাসস্থল হয়নি। এক বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে ১৯৯২ সালে ভয়াবহ মুসলিম নিধনে দাঙ্গা হয়, ভারত জুড়ে হত্যা করা হয় অসংখ্য মুসলমানকে। সেই হত্যাযজ্ঞের বিচার পায়নি মুসলমানরা। আদালতে খুনিরা বেখসুর খালাস পেয়েছে। বাবরী মসজিদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস থেকে শুরু করে হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার সবার অবস্থান ছিলো একই। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এরপরও ভারতকে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠার অবহেলার কথা শুনতে হয়নি। বরং সারা বিশ্ব বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান প্রাণভরে উপভোগ করেছে।
গাজাবাসী আর ভারতের কথা কি বলবো ! মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের অবস্থাই তো ভালো না। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী বোরকা পরার কারণে ভাইভা নেয়নি শিক্ষকরা। ঐ ছাত্রী পর্দানশীন। সে শিক্ষিকার সামনে চেহারা খুলতে চান, কিন্তু শিক্ষকদের সামনে চেহারা খুলতে না চাওয়ায় ভাইভা নিতে অস্বীকৃতি জানায় ভাইভা বোর্ড। (তথ্যসূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২২ জানুয়ারি ২০২৪/ সময় জার্নাল ২৪ জানুয়ারী ২০২৪)
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক-শিক্ষিকার বোরকার বিরুদ্ধে অবস্থান এই প্রথম নয়, এর আগেও বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নামের সাথে ‘ইসলামী’ শব্দ সংযুক্ত থাকার পরও মুসলমানরা সেখানে দ্বীনি অধিকার পাচ্ছে না। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২রা জুন বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বোরকা পরাকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, সাংবিধানিক অধিকার থাকার পরও মুসলমানরা সেই অধিকার লাভ করতে পারছে না।
বাংলাদেশের পর্দানশীন মহিলাদের আসলে কষ্টের শেষ নেই। যারা শরীয়ত মেনে পর্দা করতে চায়, তারা নানা ভাবে বাধা ও কষ্টের সম্মুক্ষীণ হন প্রতিনিয়ত। যেমন- ২০২৩ সালের ১৯ জুন একদল পর্দানশীন মহিলা রাজধানীর রিপোর্টাস ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, জাতীয় পরিচয়পত্রে মুখচ্ছবি বাধ্যতামূলক করায়, তারা জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে পর্দানশীন মহিলারা ২২ ধরনের মৌলিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার হারাচ্ছেন। এই সকল পর্দানশীন মহিলারা মুখচ্ছবির পরিবর্তে আঙুলের ছাপ দিয়ে পরিচয় নিবন্ধনের দাবী জানান। তারা বলেন, মুখচ্ছবি দিয়ে পরিচয় যাচাইয়ের মধ্যে দুর্নীতি সুযোগ থাকে। কিন্তু আঙুলের ছাপ দিয়ে নির্ভুল ও দ্রুততার সাথে পরিচয় যাচাই করা যায়, এতে দুর্নীতির কোন সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশ এখন স্ম্যার্ট বাংলাদেশ, কিন্তু পরিচয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এখনও তা পরে আছে দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিয়ে পরিচয় যাচাইয়ের মত পদ্ধতিতে। অথচ ছবি দিয়ে পরিচয় যাচাই একটা ত্রুটিযুক্ত ও দুর্নীতিবান্ধব পদ্ধতি। (যমুনা নিউজ, ১৯ জুন, ২০২৩)
লক্ষ্য করে দেখবেন, কোন মহিলা যদি পর্দা করতে চায়, তবে সাথে সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা দলিল নিয়ে আসবে। বলবে, অমুক দেশের নারীরা তো মুখ খুলে, আপনাদের খুলতে সমস্যা কোথায়? অর্থাৎ মুসলমানদের একদলের দলিল অন্য দলের জন্য ব্যবহার করে। অপরদিকে, খ্রিষ্টানদের প্রটেস্টান্ট দলের একটি উপদল সেভেন্থ ডে অ্যাডভেনটিস্ট অনুসারিরা সকাল বেলা পরীক্ষা দিতে না চাওয়ায় তাদের জন্য রাতের বেলায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করে শিক্ষাবোর্ড। (তথ্যসূত্র: ঢাকা টাইমস, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২। শিরোনাম- শনিবার সকালের পরীক্ষা রাতে দিচ্ছে আলবার্ট!) তখন কিন্তু রাষ্ট্র ঐ ছেলেটিকে বলে না, খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক বা অর্থডক্সরা তো দিনের বেলায় পরীক্ষা দেয়, তোমরা দিতে সমস্যা কোথায়?
কিন্তু খ্রিস্টানদের বেলায় রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখে, তাদের ফেরকাবাজির মধ্যে ঢুকে না। কিন্তু মুসলমানদের বেলায় আচরণ করে ভিন্ন, রাষ্ট্র তখন ভিন্ন ভিন্ন ফতওয়ার মত-পার্থক্য গ্রহণ করে এবং একদলের ফতওয়াকে অন্যদলের উপর ব্যবহার করে। অথচ তারা যদি সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ হতো, তবে তাদের উচিত ছিলো ফতওয়ার মধ্যে না ঢুকে সকলের দ্বীনি অধিকার নিশ্চিত করা, যে জিনিসটা তারা খ্রিস্টানদের বেলায় করেছে, অর্থাৎ ১ জন হলেও পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু মুসলমানদের বেলায় সেটা হচ্ছে না, বরং অসংখ্য পর্দানশীন মহিলাকে বাধ্য করা হচ্ছে দ্বীন ভঙ্গ করে মুখচ্ছবি তুলতে। নয়ত বঞ্চিত করা হচ্ছে মৌলিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে, যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।
আসলে বাংলাদেশের সাংবিধানিক রাষ্ট্রদ্বীন হচ্ছে ইসলাম। তাই বাংলাদেশের আইন ও বিধিগুলো রাষ্ট্রদ্বীনের সাথে সামঞ্জস্য হওয়া প্রয়োজন, কোনভাবেই সাংঘর্ষিক গ্রহণযোগ্য না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অনেক আইন ও বিধি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যা রাষ্ট্রদ্বীন ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশে যদি সত্যিই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হয়, জনগণকে সাংবিধানিক অধিকার দিতে হয়, তবে রাষ্ট্রের কোন আইন বা বিধি দ্বীন ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া চলবে না। কিন্তু সেটা মোটেও হচ্ছে না। আবার বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হচ্ছে মুসলমান। গণতন্ত্র অনুসারে হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা। কিন্তু সেটাও হয় না মোটে।
তাই যারাই গনতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমানাধিকার, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তারা শুধু সেগুলো মুসলমানদের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করে, কিন্তু মুসলমানের বেলায় সেগুলো ভুলে যায়। আচরণ করে তালগাছবাদী। ফলে তাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমানাধিকার, বৈষম্যহীনতাসহ বিভিন্ন ফাকা বুলির প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে দ্রুত।
0 Comments:
Post a Comment