১০০টি চমৎকার ঘটনা - পর্ব-৩২ ( প্রকৃত প্রেমিকের নিদর্শন )



প্রকৃত প্রেমিকের নিদর্শন-পর্ব-৩২

পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রাথমিক অবস্থায় কেউ দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করলে যথা সম্ভব সেটাকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হতো। কাফিরদের পক্ষ থেকে কোনো নির্যাতন আসে কিনা, এজন্য স্বয়ং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও গোপন রাখার জন্য পরামর্শ দিতেন।

মুসলমানদের সংখ্যা যখন ঊনচল্লিশে দাঁড়ায়, তখন হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। প্রথমে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি অনুমতি মুবারক দেননি। কিন্তু পরে হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম উনার বারংবার অনুরোধে সম্মত হন। দ্বীন ইসলামে নব দীক্ষিত সবাইকে নিয়ে পবিত্র কা'বা শরীফে হাযির হলেন। হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি দাওয়াতী খুৎবা আরম্ভ করেন। পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার উপর এটাই ছিল প্রথম ভাষণ। সেইদিন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চাচা হযরত হামযা আলাইহিস সালাম এবং এর তিনদিন পর হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম উনারা পবিত দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন।

কিন্তু খুৎবা শুরু হতেই চতুর্দিক থেকে কাফিররা মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। পবিত্র মক্কা শরীফে হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি যথেষ্ট প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও কাফিররা উনাকে এমন বেদম মারধর করে যে, উনার চেহারা এবং নাক, কান মুবারক সবকিছু রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। বিভিন্ন রকমের আঘাতের কারণে তিনি একদম বেহুঁশ হয়ে পড়েন।

এই খবর শুনে বনী তাইমের লোক এসে হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম উনাকে নিয়ে গেলেন। কারো ধারণা ছিল না যে, তিনি আর বাঁচতে পারবেন। বনী তাইম হারাম শরীফ উনার মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন যে, 'এই দুর্ঘটনায় হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি যদি ইন্তিকাল করেন, তবে আমরা এর প্রতিশোধ স্বরূপ উতবা ইবনে রাবিয়াকে হত্যা করবো। যেহেতু মারধরের ব্যাপারে উতবার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশী। সন্ধ্যা পর্যন্ত হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি অচেতন অবস্থায় ছিলেন। সন্ধ্যার সময় জ্ঞান ফেরার পর উনার সর্বপ্রথম কথা ছিল যে, 'আমার প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কি অবস্থায় আছেন?' উপস্থিত লোকজন উনাকে এই বলে ভাল-মন্দ বলতে লাগলো যে, 'যার দরুন আপনার এই করুণ অবস্থা। সারাদিন মৃত্যুর মুখে থেকে যখন জ্ঞানশক্তি আসলো তখন আবার সেই নবীর নাম!' হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম উনার আম্মা উম্মুল খায়ের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা কিছু খাবার তৈরি করে আনলেন এবং উনাকে তা খেতে বললেন। কিন্তু হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মুখে শুধু একই আওয়াজ, 'আমার প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কি অবস্থা? তিনি কেমন আছেন? তিনি কি ভাল আছেন?' উনার মা বললেন, 'বাবা আমি জানি না তিনি কি অবস্থায় আছেন?' তিনি বললেন, 'হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম উনার ভগ্নী উম্মে জামীল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার নিকট গিয়ে জেনে আসুন।'

মা ছেলের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে উম্মে জামীল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার নিকট গিয়ে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হালত বা অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন। উম্মে জামীল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা সাধারণ নিয়মানুসারে নিজের ঈমানকে কঠোরভাবে গোপন রেখে বললেন, 'আমি কি জানি কে মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আর কে আবু বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম! তবে আপনার ছেলের মারধরের কথা শুনে আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। উনাকে দেখার জন্য আমাকে নিয়ে চলুন।' তিনি উম্মুল খায়ের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার সাথে আসলেন। এসে যখন হযরত ছিদ্দীক্কে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মর্মান্তিক অবস্থা দেখলেন, কান্নায় ভেংগে পড়লেন তিনি। কাফিররা উনাকে কিরূপ আঘাত করেছে! মহান আল্লাহ পাক তিনি তাদেরকে এর শাস্তি প্রদান করুন।

হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, 'বলেন তো, আমার মাহবুব উনার অবস্থা কি? তিনি কেমন আছেন?' উম্মে জামীল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার মায়ের দিকে ইশারা করে বললেন, 'আপনার মা শুনে ফেলতে পারেন।' হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, 'উনার বিষয়ে কোনো ভয় করবেন না।' উম্মে জামীল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, 'হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ভালো আছেন এবং হযরত আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ঘরে আছেন।' হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, 'মহান আল্লাহ পাক উনার কছম! আমি ঐ পর্যন্ত কিছুই খাবো না, পানও করবো না, যেই পর্যন্ত হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাক্ষাৎ মুবারক না হবে।' কসম শুনে উম্মুল খায়ের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আরও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। লোকে দেখে ফেলে কিনা, এই ভয়ে রাত্রি গভীর হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলেন। যখন লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো তখন তিনি হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম উনাকে নিয়ে হযরত আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ঘরে পৌঁছলেন।

প্রিয় নবী নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখে হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি জড়িয়ে ধরলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন এবং সকল মুসলমানগণ কাঁদতে লাগলেন। হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম বললেন, 'ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ইনি আমার মা। আমার মাকে ঈমানের দাওয়াত দিন

এবং হিদায়াতের জন্য দোয়া করুন।' হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ঈমানের দাওয়াত দিলেন ও দোয়া করলেন সঙ্গে সঙ্গে হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম উনার আম্মা ঈমান কবুল করে মুসলমান হলেন। সুবহানাল্লাহ!

বস্তুতঃ এটাই হলো প্রকৃত প্রেমিকের নিদর্শন। সুখ, শান্তি ও আরাম আয়েশের সময় মুহাব্বতের দাবীদার শত-সহস্র দেখা যায়। অথচ বিপদে ও মুছীবতের সময় যা বাকি থাকে সেটাই প্রকৃত মুহাব্বত। আমরাও যদি সত্যিকারেই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মুহাব্বত করে থাকি তবে আমাদেরকে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের পথকে অনুসরণ করতে হবে।

0 Comments: