কাদিয়ানি রদ - ৮


মির্জ্জা গোলাম আহমদ সাহেব প্রতিশ্রুত মাহদী হইতে পারেন কিনা?
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
          পক্ষান্তরে খৃষ্টান সৈন্যদল তাঁহাদের সম্মুখে উপস্থিত হইবে। হজরত এমামের সৈন্যদল তিন দল হইবে, একদল খৃষ্টানদিগের ভয়ে পলায়ন করিবে এবং এমাম ছাহেবের দল হইতে বিচ্ছিন্ন হইবে, খোদাতায়ালা ইহাদের তওবা কবুল করিবেন না। একদল শহিদ হইয়া ওহোদবদরেরশহিদগণের দরজা প্রাপ্ত হইবেন, অবশিষ্টদল যুদ্ধে জয়ী হইবেন।         তিনি চারি দিবস যুদ্ধ করিবেন, প্রথম তিন দিবসে বহু সৈন্য শহিদ হইবেন, চতুর্থ দিবসে আল্লাহ তাঁহাদিগকে সম্পূর্ণ জয়ী করিবেন। খৃষ্টানদিগের এত সৈন্য নিহত হইবে যে, তাহাদের মস্তিস্কে বাদশাহী করার ধারণা থাকিবে না, অবশিষ্ট সৈন্যরা লাঞ্জিত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পলায়ন করিবে, মুসলমানেরা তাহাদের পশ্চাৎধাবিত হইয়া তাহাদের অধিকাংশকে নিহত করিবেন।   তিনি এই যুদ্ধে জয়ী হইয়া বীর-যোদ্ধাদিগকে বহু পুরস্কার প্রদান করিবেন, কিন্তু লোকেরা বহু বংশের শত লোকের মধ্যে একজন জীবিত আছে দেখিয়া উক্ত পুরস্কারে সন্তুষ্ট হইতে পারিবেন না। হজরত এমাম ইছলাম রাজ্যগুলির সুব্যবস্থা করিয়া কনষ্টান্টিনোপল অধিকারের জন্য ধাবিত হইবেন। তিনি- বনু ইছহাক সম্প্রদায়ের ৭০ সহস্র লোককে উক্ত শহর অধিকারের জন্য নিয়োজিত করিবেন, তাঁহারা আল্লাহো আকবর শব্দ উচ্চারণ করিলে, সম্মুখের প্রাচীর খসিয়া পড়িবে। তখন তাঁহারা শহরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া শত্রু সৈন্যদিগের নিপাত সাধন করিবেন। তৎপরে তিনি দেশে সুবিচার ও শান্তি স্থাপনে মনোনিবেশ করিবেন। হজরত এমাম মাহ্দীর বয়য়ত হইতে এই সময় পর্য্যন্ত ছয় বৎসর গত হইবে, এমতাবস্থায় এই সংবাদ প্রচারিত হইবে যে, দাজ্জাল বাহির হইয়া আরব বংশের লোকদের উপর ফাছাদ ও অত্যাচার আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। তিনি এই সংবাদ শ্রবণে প্রথমে ৯ জন লোককে ইহার অনুসন্ধানে প্রেরণ করিবেন এবং নিজেও শামের দিকে রওয়ানা হইবেন। অনুসন্ধানে উক্ত সংবাদ মিথ্যা বলিয়া প্রমানিত হইবে। কিছু দিবস পরে প্রকৃতপক্ষে দাজ্জাল বাহির হইয়া পড়িবে। এমাম মাহদী দাজ্জালের দেমাশ্কের নিকট উপস্থিত হওয়ার সংবাদ শুনিয়া তথায় যুদ্ধের আয়োজন করিতে থাকিবেন, নামাজের আজানের পরে হজরত ইছা আলাইহিস সালাম দুইজন ফেরেশতার স্কন্ধে টেক লাগাইয়া আছমান হইতে জামে মছজিদের পূর্ব্বমিনারায় নামিয়া আসিবেন।        
পাঠক, মির্জ্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি ছাহেব আরবের, বরং দুনইয়ার বাদশাহ ছিলেন না, তিনি হজরতের বংশধর ছিলেন না, এমাম মাহদীর নাম মোহাম্মদ ও তাঁহার পিতার নাম আবদুল্লাহ হইবে, আর মির্জ্জা সাহেব মোগল বংশধর ছিলেন, ইহার নাম গোলাম আহমদ এবং ইহার পিতার নাম গোলাম মোরতজা। এমাম মাহদী মদিনাবাসী হইবেন, লোকে মক্কা শরিফে তাঁহার নিকট বয়য়ত করিবেন, তাঁহার মস্তকের উপরিস্থ একখন্ড মেঘ হইতে একজন ফেরেশতা ঘোষণা করিয়া বলিবেন যে, ইনি খোদার খলিফা মাহদী, ইহার তাবেদারি কর। মির্জ্জা সাহেব মক্কা ও মদিনায় গমন করেন নাই, তিনি মদিনাবাসি নহেন। এমাম মাহদী তোৎলা হইবেন, কিন্তু মির্জ্জা সাহেব তোৎলা ছিলেন না। তাঁহার প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব্বে তুরস্ক রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে, মদিনা শরিফ বিরান (উৎসন্ন) প্রায় হইয়া যাইবে, খয়বর অবধি মুছলমানদিগের অধিকারভূক্ত থাকিবে, তাঁহার খেলাফত বিঘোষিত হইলে, শামদেশ হইতে তাঁহার বিরুদ্ধে দুইদল সৈন্য প্রেরিত হইবে, একদল যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া যাইবে, অন্যদল বয়দানামক স্থানে বিধ্বস্ত হইয়া যাইবে। তিনি খৃষ্টানদিগের সহিত ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করিয়া জয়ী হইবেন, শাম ও কনষ্টান্টিনোপল অধিকার করিবেন।
মির্জ্জা সাহেবের সময় এই সমস্ত কিছুই সংঘটিত হয় নাই, বরং তিনি জেহাদের ভয়ে আত্মহারা হইয়া কত কিছু মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন। এমাম মাহদীর সময়ে বহু পৌত্তলিক, য়িহুদী ও খৃষ্টান মুছলমান হইয়া যাইবে এমন কি যেন দুনইয়া ইছলামে পূর্ণ হইয়া যাইবে। মির্জ্জা সাহেবের সময়ে অধিকাংশ বিধর্মী মুছলমান হয় নাই, বরং তিনি নিজের সামান্য সংখ্যক জামায়াত ভিন্ন প্রায় ৪০ কোটি মুসলমানের উপর কাফেরি ফৎওয়া দিয়াছেন। এমাম মাহদীর সময়ে অর্থের এত আধিক্য হইবে যে, লোকে উহা বহন করিয়া লইয়া যাইতে কষ্ট অনুভব করিবে, পক্ষান্তরে মির্জ্জা সাহেবের সময়ে অর্থের এত অভাব ছিল যে, তিনি অনবরত লোকের নিকট হইতে চাঁদা সংগ্রহ করিতেন, এমন কি অর্থশালী হইয়াও জাকাতের টাকা গ্রহণ করিতেন।     
উপরোক্ত কারণে বেশ বুঝা যাইতেছে যে, এমাম মাহদী প্রকাশিত হওয়ার সময় এখনও উপস্থিত হয় নাই আর এমাম মাহদীর একটী চিহ্নও মির্জ্জা সাহেবের মধ্যে পাওয়া যায় না, কাজেই তিনি এমাম মাহদী হইতে পারেন না। মির্জ্জা সাহেব যখন দেখিলেন যে, এমাম মাহদীর চিহ্নগুলি তাহার মধ্যে নাই, তখন নিরাশ হইয়া এমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদীছগুলি জইফ ও বাতীল বলিয়া ফেলিলেন। তিনি ১৩০৮ হিজরির মুদ্রিত এজালাতোল আওহামের ২৬৬ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন।
.......................... 
কিন্তু সূক্ষাতত্ত্ববিদ বিদ্বান্গণের মতে (এমাম) মাহদীর আগমন বিশ্বাসযোগ্য বিষয় নহে।
          তিনি আরও হকিকাতোল মাহদীর ২০ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন;
ان الاحاديث التى جائت فى المهدى الغازري المحارب من نسل الفاطمة الزهراء كلها ضعيفة مجروحة بل اكشرها موضوة ومن قسم الافتراء ولاجل ذالك تر كها الامام البخاري والمسلم والامام الهمام صاحب الموطا.
 “(হজরত) ফাতেমা জোহরার বংশধর গাজি যোদ্ধা মাহদীর সম্বন্ধে যে হাদিছগুলি আসিয়াছে, সমস্তই জইফ, দোষান্বিত, বরং উহার অধিকাংশ জাল, অমূলক, এই হেতু এমাম বোখারী, মোছলেম ও মাননীয় এমাম মোয়াত্তা প্রণেতা উক্ত হাদিছগুলি উল্লেখ করেন নাই।   
পাঠক, এমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদিছগুলি জইফ কিম্বা বাতীল নহে, মির্জ্জাজী বাতীল ধারণার বশবর্ত্তী হইয়া এইরূপ অন্যায় দাবি করিয়াছেন।     
কাজি সওকালি তওজিহ কিতাবে লিখিয়াছেন;
وجميع كت سبقناه بالغ حدالتواتر كما لا يخعيى عليى من له فضل اطلاع فتقرربجميغ ما سبقناء فيى هذا الجراب ان الاحاديث الواردة فيى المهديى المنتظر متواترة.
  আমি যে সমস্ত হাদিছ উল্লেখ করিয়াছি, উহা তওয়াতোরএর দরজায় পৌঁছিয়াছে, যে ব্যক্তি অধিক অবগত হইয়াছেন, তাহার পক্ষে অস্পষ্ট থাকিবেনা। এই জওয়াবে যে সমস্ত হাদিছ উল্লেখ করিয়াছি, ইহাতে প্রমানিত হইল যে, মাহদী মোন্তাজের সম্বন্ধে যে হাদিছগুলি আসিয়াছে উহা এত অধিক যে, তৎসমস্ত মিথ্যা হওয়া অসম্ভব, ইহাকে মোতাওয়াতেরবলা হয়।এই মোহাদ্দেছ প্রবর আল্লামা আবদুল হক দেহলবী আশেয়াতোল লাময়াতের ৪/৩৪২ পৃষ্ঠায়ও মোজাদ্দেদে আলফেছানি মকতুবাতের ২য় খন্ডে (১৩২ পৃষ্ঠায়) উক্ত হাদিছগুলিকে মোতাওয়াতের বলিয়াছেন, আর মোতাওয়াতের হাদিছ অকাট্য সত্য হইয়া থাকে।
          পাঠক, মির্জ্জা গোলাম আহমদ ছাহেব নিজে হাদিছ উল্লিখিত মাহদী হওয়া অসম্ভব ধারণা করিয়া যেরূপ উক্ত মোতাওয়াতের হাদিছগুলি জইফ ও অমূলক হওয়ার দাবি করিয়াছেন, সেইরূপ নেচারিদল মছিহএর আগমন সংক্রান্ত হাদিছগুলি ভ্রান্তিমূলক হওয়ার দাবি করিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছেন। মির্জ্জা সাহেব নিজের মছিহহওয়া বাতীল হওয়ার ধারণায় উহার কিরূপ উত্তর দিয়াছেন, তাহা পাঠকদিগের গোচরীভূত করিতেছি।      
তিনি এজালায় আওহামের দ্বিতীয় ভাগের ৩০৯/৩১০ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন; বর্ত্তমানের নেচারিদল যাহাদের অন্তরে আল্লাহ ও রাছুলের কথার গুরুত্ব বাকি নাই, অমূলক ধারণা পেশ করিয়া বলিয়া থাকেন যে, মরয়েমের পুত্র মছিহের যে হাদিছগুলি ছেহাহ (ছয় খণ্ড সহিহ হাদিছের) কেতাবে আছে তৎসমুদয় ভ্রান্তিমূলক,  বোধ হয় তাহাদের কথার উদ্দেশ্য এই যে, আমার দাবিকে অবজ্ঞা করিয়া বাতীল প্রতিপন্ন করা হইবে, কিন্তু তাহারা এত সংখ্যক মোতাওয়াতের হাদিছকে এনকার করিয়া নিজেদের ইমানকে বিপন্ন করিয়া তুলিতেছেন। ইহা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, তওয়াতোর অন্যান্য জাতির ইতিহাসে পাওয়া গেলে আমাদিগকে উহা মান্য করিয়া লইতে হয়। রামচন্দ্র ও কৃষ্ণ প্রভৃতি হিন্দুদের মানিত লোকদিগের কথা তাওয়াতোরভাবে ইতিহাস পুস্তকাদিতে উল্লিখিত হইয়াছে বলিয়া আমাদিগকে তাহাদের অস্তিত্ব মানিয়া লইতে হইতেছে, আমরা এইরূপ বলিতে পারিনা যে, রাজা রামচন্দ্র ও রাজা কৃষ্ণ কতকগুলি অমূলক নাম এখন বুঝিতে হইবে যে, যদিও এজমালিভাবে কোর॥আন সমধিক পূর্ণ কেতাব, কিন্তু দীনের অধিক পরিমাণ, এবাদত ইত্যাদির বিস্তারিত নিয়ম আমরা হাদিছ হইতে গ্রহণ করিয়াছি। যদি আমরা সমস্ত হাদিছকে অগ্রাহ্য ধারণা করি, তবে হজরত নবি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম॥এর চারি খলিফার অস্তিত্ব ও ছাহাবা হওয়া প্রমাণ কষ্টকর হইবে, কেননা  কোর॥আন শরিফে তাঁহাদের নাম নাই। সমস্ত হাদিছকে অগ্রাহ্য ধারণা করা, মোতাওয়াতের ভবিষ্যদ্বানীগুলিকে যাহা ছাহাবা, তাবেয়ি ও তাবেয়িদিগের সময়েই সমস্ত ইছলাম রাজ্যে পরিব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল এবং সর্ব্ববাদিসম্মত মত বলিয়া গৃহীত হইয়াছিল জাল হাদিছগুলির মধ্যে দাখিল করা নিতান্ত দুরাদৃষ্ট ও ভ্রম হইবে। ইহা অব্যক্ত নহে যে, মছিহ বেনে মরয়েমের আগমনসূচক ভবিষ্যদ্বানী প্রথম শ্রেনীর ভবিষ্যদ্বানী, ইহা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। এত প্রমাণকে অগ্রাহ্য করা এবং সমস্ত হাদিছকে জাল বলা উহাদের কার্য্য॥ যাহাদিগকে খোদা দীন ও সত্য বুঝিবার একটু জ্ঞান প্রদান করেন নাই।এক্ষণে আমরা কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের পীর মির্জ্জা ছাহেব মাহদী সংক্রান্ত মোতাওয়াতের হাদিছগুলিকে জাল বলিয়াছেন, তাহার দীন ও সত্য প্রাপ্তির জ্ঞান আছে কি? এমাম মাহদীর মোতাওয়াতের ভবিষ্যদ্বানী ছাহাবা, তাবেয়ি, তাবা-তাবেয়িদিগের সময়েই সমস্ত ইছলাম রাজ্যে পরিব্যপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল এবং তাঁহাদের সর্বাদিসম্মত মত বলিয়া গৃহীত হইয়াছে, নচেৎ নানা দেশে নানা সময়ে মাহদী হওয়ার দাবিদারগণের সৃষ্টি হইত না, মির্জ্জা সাহেব এইরূপ ভবিষ্যদ্বানীকে জাল দাবি করিয়া ভ্রান্তি ও দুরাদৃষ্টির নিম্নস্তরে উপস্থিত হইয়াছেন কিনা? মির্জ্জা ছাহেব দাবি করিয়াছেন যে, মাহদী সংক্রান্ত হাদিছগুলি ছহিহ বোখারি ও মোছলেমে নাই, এই হেতু তৎসমস্ত জইফ কিংবা জাল, ইহা তাঁহার বাতীল দাবি।
                                      ( অসমাপ্ত )

0 Comments: