হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জীবনের প্রধান অংশ খাদিজা আলাইহাস সালাম উনার সাথে কাটানোর পর, উনার বয়স যখন পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে, তখন তিনি আরও কয়েকটি বিয়ে করেন। এই বিবাহগুলির মধ্যেও পাওয়া যায় উনার দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের সুবিধা এবং সামাজিক ও গোত্রীয় বিষয়াদির বিবেচনা। উনার স্ত্রীদের মধ্যে এমনই একজন ছিলেন উনারই ফুফাতো বোন হযরত হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশ আলাইহাস সালাম।
এই বিয়েটি নিয়ে ইসলাম-বিদ্বেষী মহলের অনেকে ভ্রু-কুঞ্চন করে থাকে। তারা যুগ যুগ ধরে কিছু পরিকল্পিত প্রেক্ষাপট তৈরি করে নানা ধরণের মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খুঁত সন্ধানীরা এই ঘটনাকে উনার অনৈতিক বলে প্রচারণা করে।
যায়নাব বিনত জাহাশ আলাইহাস সালাম (জন্ম – ৫৮৮ খৃঃ) ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের বিখ্যাত বনি হাশেম গোত্রের জাহাশ পরিবারের মেয়ে।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আপন ফুফু, উমাইমাহ বিনত আব্দ আল মোতালিবের মেয়ে ছিলেন। কাজেই তিনি রক্তের সম্পর্কে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আপন ফুফাতো বোন ছিলেন । ইসলামি বিধি মোতাবেক ফুফাতো বোনের সাথে বিয়ে কোন অনৈতিক কিছু নয়। কিন্তু যারা হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খুঁত ধরার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত তারা কখনো পাঠকদের কাছে এই সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে না। বরং মোটা হেডিং-এ হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আপন ছেলের বধূ হিসাবে প্রচার চালানো হয়। এই অভিযোগ জঘণ্য মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়।
হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আপনজন যারা মক্কা থেকে মদিনায় বাধ্য হয়ে এসেছিলেন, যায়নাব আলাইহাস সালাম তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। তবে সেই সময় যায়নাব আলাইহাস বিধবা ও নিঃসঙ্গ ছিলেন। হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য একজন সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি উনার পালিত পুত্র যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব দেন।
অধিকন্তু এই বিয়ের মাধ্যমে কোরাইশ বংশের সামাজিক উঁচু-নীচু মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন মূল্যবোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মানে আন্তবর্ণের বিয়ে ঘটিয়ে যুগ যুগ ধরে চলে বর্ণ বিদ্বেষী প্রথা উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। যায়নাব আলাইহাস সালাম উনার নিজ আত্মীয় বিধায় উনার ধারণা ছিল যে এ কাজটি তার জন্য সহজ হবে। কিন্তু যায়নাব আলাইহাস সালাম উনার পরিবারের কেউই এ বিয়েতে সম্মতি দেন নাই। অবশেষে কোরানের এই আয়াত নাজিল হয়:-
আল্লাহ ও উনার রসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট তায় পতিত হয়। (৩৩:৩৬)
আর এই আয়াত নাজিলের পর ৬২৬ খৃঃ যায়নাব আলাইহাস সালাম রাজি হয়েছিলেন শুধু আল্লাহ-রসূলের প্রতি উনাদের আনুগত্যের কারণে। এ বিয়ের কারণে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব খুশি হয়েছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় উনাদের বিয়েতে উনি প্রচুর উপহার সামগ্রী দান করেছিলেন।
বিয়ের পর স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া বা ভালবাসার যে বন্ধন থাকে তা উনাদের মধ্যে আসে নাই। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে অসুখী বিবাহ বন্ধন টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা অপেক্ষা সেই বন্ধন ছিন্ন করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই বন্ধন ছিন্ন করতে হবে উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা করে, যাতে কোন পক্ষ ক্ষতির সম্মুখীন না হয়।
যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রথম ও একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না যায়নাব আলাইহাস সালাম। বারাকা নামের হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার এক মুক্ত দাসীও উনার স্ত্রী ছিলেন। সেই বারাকার গর্ভে এক ছেলে (ওসামা) ও এক মেয়েও (নাম অজ্ঞাত) ছিল।
যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু ও যায়নাব আলাইহাস সালাম উনাদের বিয়ে ভেঙ্গে গেলেও ঐ বিয়ে দ্বারা যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি বৈষম্যমূলক প্রথার দেয়ালে পেরেক টুকে দেয়া হয়েছিল।
একদিকে যেমন যুগে যুগে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার আশরাফদের মিথ্যা আভিজাত্যের মূলে কুঠারাঘাত, অন্যদিকে যুগ যুগ থেকে হতবঞ্চিত দাসদের মধ্যে বুঝিয়ে দেওয়া হল যে- তারাও মানুষ, তাদেরও আছে সমাজের অন্যান্য মানুষের মতো সমাধিকার। আজকের মানুষের পক্ষে এই বিয়ে যে কত বড় বিপ্লব ছিল- তা বুঝার ক্ষমতা হয়তো অনেকের হবেনা। এই নতুন প্রথাকে অবশ্য কায়েমি স্বার্থবাদিরা (মুনাফিক) সহজে মেনে নিতে রাজি ছিলনা।
যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বারংবার উনার সাথে যায়নাব আলাইহাস সালাম উনার বিয়ে ভেঙ্গে দিতে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অনুরোধ করে যাচ্ছিলেন আর হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা শুনে যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে এই বিয়ে ভাংতে নিষেধ করেছিলেন এই বলে যে, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো। কিন্তু এরপরও যখন তিনি তালাক দিয়ে দেন তখন সেই ঘটনার উপরে কোরআনের এই আয়াত নাজিল হয়:-
সুরা আহযাব-আয়াতঃ ৩৭.) হে নবী!
[১] স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ এবং আপনি যার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন
[২] তাকে আপনি বলছিলেন, “তোমার স্ত্রীকে ত্যাগ করো না এবং আল্লাহকে ভয় করো।”
[৩] সে সময় আপনি আপনার মনের মধ্যে যে কথা গোপন করছিলেন আল্লাহ তা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন, আপনি লোকভয় করছিলেন, অথচ আল্লাহ এর বেশী হকদার যে, আপনি উনাকে ভয় করবেন।
[৪] তারপর তখন তার ওপর থেকে যায়েদের সকল প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল
[৫] তখন আমি সেই (তালাকপ্রাপ্তা মহিলার) বিয়ে আপনার সাথে দিয়ে দিলাম,
[৬] যাতে মু’মিনদের জন্য তাদের পালক পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে কোন প্রকার সংকীর্ণতা না থাকে যখন তাদের ওপর থেকে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
[৭] আর আল্লাহর হুকুম তো কার্যকর হয়েই থাকে।
টিকাঃ ( উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা )
[১] হে নবী! এখান থেকে ৪৮ আয়াত পর্যন্তকার বিষয়বস্তু এমন সময় নাযিল হয় যখন হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত যয়নবকে আলাইহাস সালাম উনাকে বিয়ে করে ফেলেছিলেন এবং একে ভিত্তি করে মুনাফিক, ইহুদী ও মুশরিকরা রসূলের বিরুদ্ধে তুমূল অপপ্রচার শুরু করে দিয়েছিল। এ আয়াতগুলো অধ্যয়ন করার সময়একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে শত্রুরা হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরুদ্ধে ইচ্ছা করেই দুর্নাম রটাবার এবং নিজেদের অন্তর্জ্বালা মিটাবার জন্য মিথ্যা, অপবাদ, গালমন্দ ও নিন্দাবাদের অভিযান চালাচ্ছিল তাদেরকে বুঝাবার উদ্দেশ্যে এগুলো বলা হয়নি।
বরং এর আসল উদ্দেশ্য ছিল তাদের এ অভিযানের প্রভাব থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করা এবং ছাড়ানো সন্দেহ-সংশয় থেকে তাদেরকে সংরক্ষিত রাখা।
[২] “স্মরণ করো, যখন আল্লাহ এবং আপনি যার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন” –
এখানে যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর কথা বলা হয়েছে। সামনের দিকে কথাটি সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করা হয়েছে।
যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা ছিলেন বনি কালব/মাখদুম গোত্রের যুদ্ধবন্দী দাস। যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শৈশব কালে জাহেলিয়াত যুগে ঘটনাচক্রে দাস হিসাবে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে নীত হন। পরবর্তীতে উনার পিতা,চাচা যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহকে মুক্তিপণের মাধ্যমে মুক্ত করতে চাইলে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর পিতা কে বলেন ‘মুক্তিপণ লাগবে না। আমি বিনা মুক্তিপণেই যায়েদ কে স্বাধীন করে দিলাম’। কিন্তু যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ছেড়ে আর তার পরিবারের কাছে যাননি। হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে খুব ভালবাসতেন। জাহেলিয়াতের যুগে যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালক পুত্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং যায়েদ কে ডাকা হত যায়েদ ইবনে মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
এ অবস্থার প্রতিই মহান আল্লাহ তাঁর “যার প্রতি আল্লাহ ও তুমি অনুগ্রহ করেছিল” বাক্যাংশের মধ্যে ইশারা করেছেন।
[ ৩] তাকে আপনি বলছিলেন, “তোমার স্ত্রীকে ত্যাগ করো না এবং আল্লাহকে ভয় করোঃ
এটা সে সময়ের কথা যখন হযরত যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম সম্পর্ক তিক্ততার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং তিনি বারবার অভিযোগ করার পর শেষ পর্যন্ত হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে নিবেদন করেন, আমি তাকে তালাক দিতে চাই।
[৪] “সে সময় আপনি আপনার মনের মধ্যে যে কথা গোপন করছিলেন আল্লাহ তা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন, আপনি লোকভয় করছিলেন, অথচ আল্লাহ এর বেশী হকদার যে, আপনি উনাকে ভয় করবেন”-
কেউ কেউ এ বাক্যটির উল্টা অর্থ গ্রহণ করেছেন এভাবে, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম উনাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং উনার মন চচ্ছিল হযরত যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে তালাক দিয়ে দিক। কিন্তু যখন যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এসে বললেন, আমি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাই তখন তিনি আসল কথা মনের মধ্যে চেপে রেখে কেবলমাত্র মুখেই তাঁকে নিষেধ করলেন। নাউযুবিল্লাহ। এ কথায় আল্লাহ বলছেন, “আপনি আপনার মনের মধ্যে যে কথা লুকিয়ে রাখছিলেন আল্লাহ তা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন।”
অথচ আসল ব্যাপারটা এর সম্পূর্ণ উল্টো। যদি এ সূরার ১, ২, ৩ ও ৭ আয়াতের সাথে এ বাক্যটি মিলিয়ে পড়া হয়, তাহলে পরিষ্কার অনুভূত হবে যে, হযরত যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও তাঁর স্ত্রীর মধ্যে যে সময় তিক্ততা বেড়ে যাচ্ছিল সে সময়ই আল্লাহ হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এ মর্মে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, যায়েদ যখন তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেবে তখন আপনাকে তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু যেহেতু আরবের সে সমাজে পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করার অর্থ কি তা হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন এবং তাও এমন এক অবস্থায় যখন মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক মুসলমান ছাড়া বাকি সমগ্র আরব দেশ উনার বিরুদ্ধে ধনুকভাঙা পণ করে বসেছিল-এ অবস্থায় তিনি এ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে ইতস্তত করছিলেন।
এ কারণে হযরত যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন স্ত্রীকে তালাক দেবার সংকল্প প্রকাশ করেন তখন হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বলেন আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ো না। উনার উদ্দেশ্য ছিল, যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যদি তালাক না দেন, তাহলে তিনি এ বিপদের মুখোমুখী হওয়া থেকে বেঁচে যাবেন। নয়তো তালাক দিলেই উনাকে হুকুম পালন করতে হবে এবং তারপর উনার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ভয়াবহ তুফান সৃষ্টি করা হবে।
ইমাম যয়নুল আবেদীন আলাইহিস সালাম হযরত আলী ইবনে হোসাইন আলাইহাস সালাম এ আয়াতের ব্যাখ্যায় এ কথাই বলেছেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই মর্মে খবর দিয়েছিলেন যে,যয়নব আলাইহাস সালাম আপনার স্ত্রীদের মধ্যে শামিল হতে যাচ্ছেন। কিন্তু যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন এসে উনার কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন তখন তিনি বললেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজের স্ত্রী ত্যাগ করো না। এ কথায় আল্লাহ বললেন, আমি আপনাকে পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিলাম,আমি আপনাকে যয়নব আলাইহাস সালামের সাথে বিয়ে দিচ্ছি অথচ আপনি যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাথে কথা বলার সময় আল্লাহ যে কথা প্রকাশ করতে চান তা গোপন করছিলেন। (ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর ইবনে আবী হাতেমের বরাত দিয়ে)
যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সাথে বিয়ের আগেও যায়নাব আলাইহাস সালাম উনার বিয়ে হয়েছিল। তিনি বিধবা ছিলেন এবং সারা জীবন শুকনো রোগাক্রান্ত শরীরের অধিকারী ছিলেন। কাজেই এই বয়সী মহিলাকে দেখে সাধারণ পুরুষেরই চিত্ত বৈকল্য হবার কথা নয়, সেখানে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিত্ত বৈকল্য হয়ে গিয়েছিল বলা স্রেফ অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু ছিলনা। যদি হত তাহলে যখন যায়নাব আলাইহাস সালাম যৌবনে ছিলেন তখন তাকে বিয়ে করতে পারতেন।
[৫] “তারপর তখন তার ওপর থেকে যায়েদের সকল প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল”-
অর্থাৎ যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন এবং তাঁর ইদ্দত পুরা হয়ে গেলো।“প্রয়োজন পূর্ণ করলো” শব্দ গুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে একথাই প্রকাশ করে যে, তাঁর কাছে যায়েদের আর কোন প্রয়োজন থাকলো না। কেবলমাত্র তালাক দিলেই এ অবস্থাটির সৃষ্টি হয়না। কারণ স্বামীর আর কোন আকর্ষণ থেকে গেলে ইদ্দতের মাঝখানে তাকে ফিরিয়ে নিতে পারে। আর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়া বা না হওয়ার কথা জানতে পারার মধ্যেও স্বামীর প্রয়োজন থেকে যায়। তাই যখন ইদ্দত খতম হয়ে যায় একমাত্র তখনই তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর মধ্যে স্বামীর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
[৬] “তখন আমি সেই (তালাকপ্রাপ্তা মহিলার) বিয়ে আপনার সাথে দিয়ে দিলাম”-
হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই নিজের ইচ্ছায় এ বিয়ে করেননি বরং আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে করেন, এ ব্যাপারে এ শব্দগুলো একবারেই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন।
[৭] “যাতে মু’মিনদের জন্য তাদের পালক পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে কোন প্রকার সংকীর্ণতা না থাকে যখন তাদের ওপর থেকে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়”-
এ শব্দগুলো একথা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে যে, আল্লাহ এ কাজ হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে এমন একটি প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য করিয়েছিলেন যা এ পদ্ধতিতে ছাড়া অন্য কোনভাবে সম্পাদিত হতে পারতোনা। আরবে পালক পুত্রদের সম্পর্কিত আত্মীয়তার ব্যাপারে যে সমস্ত ভ্রান্ত রসম-রেওয়াজের প্রচলন হয়ে গিয়েছিল আল্লাহর রসূল নিজে অগ্রসর হয়ে না ভাঙলে সেগুলো ভেঙে ফেলার ও উচ্ছেদ করার আর কোন পথ ছিল না। কাজেই আল্লাহ নিছক হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গৃহে আর একজন স্ত্রী বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে নয় বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য এ বিয়ে করিয়েছিলেন।
একজন দাসের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী হিসাবে ও বয়স্ক নারী হিসাবে কেউই তখন যয়নব আলাইহাস সালামকে বিয়ে করতে চায়নি। পরবর্তীতে যয়নব আলাইহাস সালামের একান্ত ইচ্ছায় এবং পালক পুত্র যে নিজের পুত্র নয়, শুধু এটা বুঝানোর জন্যই আল্লাহ সুবহানাতায়ালার নির্দেশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যয়নব আলাইহাস সালামকে বিয়ে করেছিলেন।
আল্লাহ পাক বলেন -
“তোমাদের স্ত্রীগণ যাদের সাথে তোমরা যিহার কর, তাদেরকে তোমাদের জননী করেননি এবং তোমাদের পোষ্যপুত্রদেরকে তোমাদের পুত্র করেননি। এগুলো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। (৩৩:৬)
যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু স্ত্রী যয়নব আলাইহাস সালাম কখনই আমাদের হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুত্র বধু ছিল না বরং তিনি ছিলেন একজন দাসের স্ত্রী। তাই হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনই উনার পুত্র বধু কে বিয়ে করেননি বরং উনার আযাদকৃত দাস যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যয়নব আলাইহাস সালামকে বিয়ে করেছিলেন।
এই ঐতিহাসিক ঘটনার পর থেকে- ইসলামে পালক সন্তানের অবস্থান বদল হয়ে যায়। কোন শিশুকে পালক সন্তান নিলেও সেই সন্তান পালক পিতার পরিচয়ে পরিচিত হবার প্রথা বাতিল হয়ে যায়। যিনি লালন পালন করেন না কেন সে শিশু তার জন্ম দাতা পিতার পরিচয়ে নিয়ে থাকতে হবে। সাথে সাথে পালক সন্তান পালক পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রাপ্তির পথও রহিত হয়ে যায়। পালক পিতা যদি ইচ্ছা করেন যে, এই সন্তানকে তিনি কিছু সহায় সম্পত্তি দিয়ে যাবেন তাহলে তার জীবিত অবস্থায় তা দিয়ে যেতে হবে। নতুবা পালক পিতার মৃত্যুর পর পালক সন্তান মৃত ব্যক্তির কিছুই পাবেনা।
জাহেলিয়াত যুগের অনেক প্রথাই হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের দ্বারা প্রথম রহিত করেছিলেন। যেমন খুনের বদলে খুন এই রীতি টা হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রহিত করেছিলেন উনার বংশের ইবন রবীয়া ইবন হারিছের রক্তের বদলা বাতিল ঘোষনা করে, সুদ প্রথা প্রথম বাতিল ঘোষনা করেছিলেন হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দাদা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের সুদের দাবী মাফ করে । ঠিক তেমনি পালক পুত্র সম্পর্কে যেইসকল অনৈসলামি আক্বীদা ছিল আরব সমাজে তা হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যয়নব আলাইহাস সালামকে বিয়ে করার মাধ্যমে দূর করেছিলেন। জাহেলিয়াতের যুগে পালক পুত্র সম্পত্তির অংশীধার হত এবং পালক পুত্র কে নিজের পুত্র হিসাবেই গন্য করা হত। কিন্তু এখন ইসলামি আইনে পালক পুত্র কন্যা বলতে কিছু নাই। পালক পুত্র কন্যার মাধ্যমে পর্দা প্রথা নষ্ট হয়।
ইসলাম বিদ্বেষীরা যুক্তি দিয়ে থাকেন, যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন যয়নাব আলাইহাস সালামকে বিয়ে করেছিলেন, তখন যয়নাব আলাইহাস সালাম হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আব্বা’ ডাকতেন। আরবীয় কালচারে সেরকম ডাকার কোন অবকাশ নেই। তাছাড়া যয়নাব আলাইহাস সালাম ছিলেন হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফুফাতো বোন। হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জমানার সবাই ‘রাসুলুল্লাহ’ বলেই ডাকতেন। আব্বা হুজুর, শ্বশুর হুজুর ডাকার প্রচলন সেযুগেও ছিল না, এ যুগেও নেই।
যয়নাব আলাইহাস সালাম ও হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বিয়ে নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষীরা নানা চটকদার গল্প ফেঁদেছে এবং এখনো তা অব্যাহত রেখেছে। তাদের গল্পের সাথে মিলিয়ে কোরআনের আয়াত এবং হাদিসের রেফারেন্স কোড করে মুসলমানদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করে আসছে। তারা যে দু’টি মুখরোচক গল্প বানিয়েছে তা হলো,
এক, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক সময় ‘বিনা অনুমতিতে’ যয়নাব আলাইহাস সালাম উনার ঘরে ঢুকে তাকে অন্যরকম অবস্থায় দেখতে পেয়ে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোভ জেগে উঠে।নাউযুবিল্লাহ। উনার এই মনোভাব যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বুঝতে পেরে স্ত্রীকে তালাক দিতে চান। হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে তালাকের অনুমতি চান। জবাবে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তালাক দিও না, আল্লাহকে ভয় কর। হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভয়ে বাধ্য হয়ে যায়েদ যয়নাব আলাইহাস সালামকে তালাক দেন। সাথে সাথে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিয়ে করে ফেলেন।
দুই, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ের প্রস্তাব দেবার জন্যে যয়নাব আলাইহাস সালামের ঘরে প্রবেশ করেন, যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অনুপস্থিত ছিলেন। বাতাসে পর্দা উড়ে যাওয়াতে যয়নাবের পা দেখা যাচ্ছিল, তা হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজর কাড়ে। উভয়েই বিয়ের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেন। কিন্তু পালকপুত্রের বিবাহিত স্ত্রী হওয়ায় ম হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনের ভেতর তা গোপন রাখেন। যা আল্লাহ নিজে ফাঁস করে দেন। [কায়দামত এখানে কোরআনের “আপনি যা নিজ অন্তরে গোপন রাখছেন আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেবেন” আয়াতটা ফিট করে দেয়।]
জবাবঃ
এ ব্যাপারে হাদিসে উল্লেখ হয়েছে,ইমাম বায়হাকী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু.. হাম্মাদ ইবনে যায়দ.. আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, যাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহ যয়নাব আলাইহাস সালামের এর ব্যাপারে অভিযোগ নিয়ে এলে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমার স্ত্রীর সাথে বিবাহ সম্পর্ক বজায় রাখ। আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদৌ কোন কিছু গোপন করে থাকলে অবশ্যই তিনি এই আয়াতটি (যায়েদের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং তার সাথে যয়নাব এর বিবাহ হবে) গোপন করতেন। যয়নাব আলাইহাস সালাম তো অন্যান্য স্ত্রীদের উপর গৌরব করে বলতেন, তোমাদের অভিভাবকরা তোমাদের সাথে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিবাহ প্রদান করেছেন, আর মহান আল্লাহ স্বয়ং সপ্ত আসমানের উপর থেকে আমার সাথে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিবাহ প্রদান করেছেন। [বুখারী: ৪৭৮৭/৭৪২০, মুসলিম: ৮৩, ১৪২৮, তিরমীযী: ৩২১২, ৩২১৭-৩২১৯]
কাজেই বোঝা গেলো, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্তরে যা গোপন করেছিলেন, তা ওহির জ্ঞান।মহান আল্লাহ তাকে বলছেন, “আপনি মানুষকে ভয় পাচ্ছেন, অথচ মহান আল্লাহই হচ্ছেন সবচেয়ে উপযুক্ত সত্তা যাকে আপনার ভয় করা উচিত।” [সুরা আহযাব: ৩৭]
সেই যুগে নারী ছিল খুবই সহজলভ্য। আর যয়নাব ৩৭ বছর বয়স্কা একজন সাধারণ নারী ছিলেন, ইতিপূর্বে আরো দুজন পুরুষের সাথে তার সংসার জীবন কেটেছে। তিনি হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফুফাতো বোন ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে দেখে এসেছেন। কাজেই তাকে বিয়ে করার জন্যে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাগল হয়ে উঠার নাস্তিকীয় কেচ্ছাকাহিনী যুক্তির কষ্টিপাথরেই ধোপে টেকে না।
আবার এমনও নয় যে, যায়েদের সাথে বিচ্ছেদের সাথে সাথেই হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিয়ে করে ফেলেছেন। তার ইদ্দতকাল অতিবাহিত হবার পরই হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর ইচ্ছায় তাকে বিয়ে করেছিলেন। পাঠক বুঝতেই পারছেন, ইসলাম বিদ্বেষীদের ‘বিনা অনুমতিতে’ যয়নাবের ঘরে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবেশ ও যয়নাবকে বিবস্ত্র অবস্থা দেখে লোভী হওয়ার চটকদার গল্প তাদের নিজেদের বানানো। এইসব জঘন্য মিথ্যাচার থেকে আল্লাহপাক আমাদের হেফাজত করুন।
ইসলামের দুশমনরা আগের ঘটনার সাথে পরের ঘটনায় গোঁজামিল মিশিয়ে তাদের অপপ্রচারের ‘ঐতিহাসিক নাটক’ তৈরি করে। হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম , যায়নাব আলাইহাস সালাম উনাকেতা চুল খোলা অবস্থায় দেখার ঘটনা, যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কর্তৃক শুধুমাত্র তালাকের পর পর নয় এবং তার ইদ্দতেরও (তিন মাস) পরের। ঘটনাটি এভাবে:-
ইদ্দত শেষ হবার পর হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মাধ্যমে যায়নাব আলাইহাস সালাম উনার সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রস্তাব পেশ করলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত আমি কিছুই করতে যাবনা।’ (বাহা/আনাস/মুসলিম) অতঃপর তিনি আবার তার নামাজের স্থানে দাঁড়িয়ে যান। বাইরূতঃ দার আল কুতুব আল আলামিয়্যাহ, আদ্দিমাশকী, ২০০২, পৃঃ ১৭৫ । আর এর পরই এব্যাপারে কোরানের (৩৩:৩৭) আয়াত নাজিল হয়। আয়াতটি মসজিদে পঠিত হয়।
পরের ঘটনা যায়নাব আলাইহাস সালাম নিজেই বলছেন, আমাকে যায়েদ তালাক দেন। তারপর আমার ইদ্দত শেষ হয়। তারপর [অর্থাৎ উপরোক্ত বর্ণনাদির পর] হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার গৃহে আসেন, আর আমি বুঝতে পারি যে তিনি আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে এসেছেন। সে সময় (অর্থাৎ তিনি যখন আমার ঘরে আসেন তখন) আমার মাথার চুল খোলা ছিল। বাইরূতঃ দার আল কুতুব আল আলামিয়্যাহ, আদ্দিমাশকী, ২০০২, পৃঃ ১৭২-৮০
হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিটি বিয়েতেই কোন না কোন হেকমত ছিল। নাস্তিক এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের মিথ্যা সমালোচনার ও কল্প কাহিনী বানানোর অনেক খোরাক এতে থাকলেও, বিশ্বাসীদের জন্যে রয়েছে ঈমানের পরীক্ষা।
হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্যে আল্লাহ যা হালাল করেছেন তিনি কেবল তা-ই করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, “হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি,যাদেরকে আল্লাহ আপনার করায়ত্ব করে দেন এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি আপনার চাচাতো ভগ্নি, ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি, খালাতো ভগ্নিকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে। কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পন করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য-অন্য মুমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশে। মুমিনগণের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারিত করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল,দয়ালু। [সূরা আহযাব ৩৩: ৫০]
হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীলোভী হলে পঁচিশ বছরের টগবগে যৌবনকালে চল্লিশ বছরের বৃদ্ধা (তৎকালের প্রেক্ষাপটে) মহিলা হযরত খাদিজা আলাইহাস সালামকে বিয়ে করতেন না এবং ভরা যৌবনের শেষাব্ধি তার সাথেই অতিবাহিত করতেন না। অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে এটাই যে, তিনি পঁচিশ বছর বয়সে চল্লিশ বছরের বৃদ্ধা হযরত খাদিজা আলাইহাস সালামকে বিয়ে করে তার সাথে যৌবনের মূল সময় তথা পঞ্চাশতম বছর পর্যন্ত অতিবাহিত করেছিলেন। এরপর একান্নতম বছর থেকে শুরু করে জীবনের অন্তিম মুহুর্ত পর্যন্ত তথা তেষট্টিতম বছর পর্যন্ত সময়ে (মোট তের বছর) বাকি স্ত্রীদেরকে বিয়ে করেছিলেন নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে। তারা আবার একজন তথা্ হযরত আয়েশা আলাইহাস সালাম ছাড়া সকলেই ছিলেন বিধবা। অনেকে ছিলেন বৃদ্ধা।
এটাই ঐতিহাসিক সত্য যে, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাধিক বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন পবিত্র জীবনের পঞ্চাশটি বছরকেটে যাওয়ার পর। তাহলে কি তিনি যৌবনের মূল সময় তথা পঞ্চাশতম বছর পর্যন্ত ছিলেন চরিত্রবান, আর জীবনের শেষ বয়সে এসে হয়ে গেলেন চরিত্রহীন? এটা কি কোন বিবেক প্রসূত কথা? অথচ তিনি চাইলে সে সময় মক্কার শ্রেষ্ট সুন্দরী আর ধনী কুমারীদের বিয়ে করতে পারতেন। অনেকেই তাকে এমন উপটৌকনও দিতে চেয়েছেন। যেমন-মক্কী জীবনে কাফিররা হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বহুবারই বলেছিলো যে, ‘আপনি চাইলে আরবের সবচেয়ে সুন্দরী নারীদেরকে আপনার সামনে নিয়ে এসে হাজির করি’। তখন হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন,- আমার এক হাতে সূর্য আর অপর হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি ইসলাম প্রচার থেকে একটুও পিছপা হবো না (ইনশাআল্লাহ)।
সুন্দরী নারীদের প্রতি যদি হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোভই থাকত (নাউযু বিল্লাহ), তাহলে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ সময় মক্কার কাফিরদের কথা মেনে নিয়ে সুন্দরী নারীদের হস্তগত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে দিকে চোখ তুলেই তাকাননি; বরং নিজ দায়িত্বেই ছিলেন অটল্। এ থেকে কি প্রমানিত হয়?
ইসলাম ম্যানুয়ালী প্রসার লাভ করেছে, কোন ভেল্কিবাজি বা তন্ত্র মন্ত্রের মাধ্যমে নয়। হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বহু বিবাহ করা দ্বারা অনৈতিকতা হয়েছে বলে যারা মনে করে, তারা সাদা চোখে সেটা বিশ্লেষন করে না বা সেই সময়টাকেও বুঝতে চায় না। কাজেই তাদের নৈতিকতা আর ইসলামের নৈতিকতা এক করে চিন্তা করাটা বোকামী বৈ আর কিছু নয়।
আল্লাহপাক তার বানী প্রচারের জন্যে যাকে বেছে নিয়েছেন, তার জন্যে নিয়ম বা শরিয়ত অবশ্যই কিছুটা ব্যতিক্রমী নির্ধারন করেছেন। সেই যুগে তিনি শত শত বছরের ঐতিহ্য ভেঙ্গে দিলেও ঈমানদাররা তাকে আঁকড়ে ছিলেন, বিভ্রান্ত হননি। কাজেই ইসলাম বিদ্বেষীরা প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে রং চং দিয়ে নানা কল্পকাহিনী ফেঁদে অন-লাইন ও প্রচার জগতে বগল দাবালেও, ঈমানদাররা বিভ্রান্ত হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
0 Comments:
Post a Comment