হুযুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র জীবনী মুবারক । (পর্ব- ৯২৫-১০৬৯) (ঝ)


উল্লেখ্য যে, পবিত্র আযান উনার পরে হাত তুলে মুনাজাত করা অশেষ ফযীলত ও মর্যাদার কারণ। অন্যদিকে এটি সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। অনেক ধর্মব্যবসায়ী দুনিয়ালোভী মাওলানা মুফতীরা বলে থাকে পবিত্র আযান উনার পর হাত তুলে মুনাজাত করা বিদয়াত। নাউযুবিল্লাহ! তাদের এ কথা সম্পূর্ণ মনগড়া ও জিহালতীমূলক। কারণ উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মাধ্যমে জেনেছি পবিত্র আযান উনার পর হাত তুলে দোয়া করা অশেষ ফযীলত ও পবিত্র সুন্নত উনার অন্তর্ভুক্ত। সুবহানাল্লাহ!
স্মরণীয় যে, পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের কোথাও পবিত্র আযান উনার পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করতে নিষেধ করা হয়নি। বরং হাত উঠিয়ে দোয়া ও মুনাজাত করা সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের ব্যাখ্যায় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার শরাহগুলোতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, “পবিত্র নামায উনার বাইরে যে কোন দোয়া ও মুনাজাতে হাত উঠানো সুন্নত।” আর সম্মানিত সুন্নত উনাকে অবজ্ঞা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
لَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ
অর্থঃ- “যদি তোমরা তোমাদের নবী নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত সুন্নত উনাকে তরক (অস্বীকার) কর তাহলে অবশ্যই তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।” (বুখারী শরীফ, শরহুস সুন্নাহ)
আকাঈদের কিতাবে উল্লেখ আছে,
اهانة السنة كفر.
অর্থঃ- “সম্মানিত সুন্নত উনাকে ইহানত বা অবজ্ঞা করা কুফরী।”
        যদি তাই হয়, তাহলে সম্মানিত সুন্নত উনাকে নাজায়িয বলার অর্থ হলো হালালকে হারাম বলা। আর হালালকে হারাম বলা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র আযান উনার পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব সুন্নত। যা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস তথা সম্মানিত শরীয়ত দ্বারা ছাবেত বা প্রমাণীত। 
যেমন, এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত কিতাব ‘মিশকাত শরীফ’ উনার শরাহ ‘মিরকাত শরীফ’ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে-
استفيد من هذا الحديث والذى قبله انه يسن رفع اليدين الى السماء فى كل دعاء.
অর্থ: “(দোয়ায় হাত উঠানো সম্পর্কিত) পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, (পবিত্র নামায উনার বাইরে) সকল দোয়াতেই হাত উঠানো সুন্নত।”
ফতওয়ায়ে শামীতে” উল্লেখ আছে,
يَرْفَعُهُمَا لِمُطْلَقِ الدُّعَاءِ فِي سَائِرِ الْأَمْكِنَةِ وَالْأَزْمِنَةِ عَلَى طِبْقِ مَا وَرَدَتْ بِهِ السُّنَّةُ.
অর্থ: “পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনা মতে সর্বস্থানে, সকল সময়, সমস্ত দোয়াতে হাত উঠানো প্রমাণিত হয়।”
ফতহুল ক্বাদীর” কিতাবে উল্লেখ আছে,
ووجهه عموم دليل الرفع للدعاء ويجاب بأنه مخصوص بما ليس في الصلاة للإجماع على أنه لا رفع في دعاء التشهد.
অর্থ: “পবিত্র দোয়ার মধ্যে হাত উঠানোর দলীল কোনো দোয়ার জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট নয়। সকল দোয়াতেই হাত উঠানো জায়িয। তবে নামাযের মধ্যস্থিত দোয়ায় হাত উঠানো বিধেয় নয়, কেননা সর্বসম্মত মত হলো তাশাহুদের দোয়াতে হাত উঠানো জায়িয নয়।”
উল্লেখ্য, যারা বদ মাযহাব খারিজী, রাফিযী বাতিল ফিরকা, দেওবন্দী সিলসিলা তাদের কিতাবগুলোতেই উল্লেখ আছে যে, “আযানের পর হাত উঠিয়ে দোয়া ও মুনাজাত করা সুন্নত।”

ইমদাদুল ফতওয়া’ কিতাবের ১ম জিঃ, ১০২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
سوال. کیا فرماتے ھیں علماء دین و خلفاء شرع متین اس مسئلہ میں کہ دعا مانگنا ھاتھ اٹھاکر بعد اذان کے کیسا ھے؟
সুওয়াল: “আযানের পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা সম্পর্কে উলামায়ে দ্বীনের রায় কি?”
جواب. ... مگر مطلقا دعا میں ھاتھ اٹھانا احادیث قولیۃ، فعلیۃ، مر فوعۃ موقوفۃ کثیرہ شھیدہ سے ثابت ھے من غیر تخصیص بدعاء دون دعاء پس دعاء اذان میں بھی ھاتھ اٹھانا سنت ھوگا لاطلاق الد لائل.
জাওয়াব: “... তবে সাধারণভাবে (যে কোনো) মুনাজাতের সময় হাত উঠানো সম্পর্কে বহু ক্বওলী, ফে’লী, মরফূ, মওকূফ ও বহু প্রসিদ্ধ পবিত্র হাদীছ শরীফ বিদ্যমান রয়েছে। কোনো দোয়াকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। সুতরাং পবিত্র আযান উনার পর হাত উঠিয়ে পবিত্র মুনাজাত করাও সুন্নত প্রমাণিত হয়। কেননা এতদসম্পর্কিত দলীলসমূহ ব্যাপক।”
ফতওয়ায়ে দেওবন্দ’ কিতাবে উল্লেখ আছে,
سوال. اذان کی دعا میں ھاتھ اٹھا کر دعا پرھے مسنون کیا ھے؟
সুওয়াল: “পবিত্র আযান উনার পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করবে কি? সুন্নত তরীক্বা কোনটি?
جواب. ھر طرح درست ھے.
জাওয়াব: “প্রত্যেক অবস্থায় জায়িয আছে। অর্থাৎ হাত উঠানো এবং না উঠানো উভয়ই জায়িয।” (তবে হাত উঠানোই উত্তম, কেননা দোয়ায় হাত উঠানো মুস্তাহাব ও আদবের অন্তর্ভুক্ত)।

  ফতওয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ’ কিতাবের ২য় জিঃ ১১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
سوال. بعد اذان رفع یدین کرکے مناجات کرنا ثابت ھے یا نھیں؟
সুওয়াল: পবিত্র আযান উনার পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা প্রমাণিত আছে কি?
جواب. ... اگرچہ عموما دعاءمیں رفع یدین کا مستحب ھونا  اسکے استحباب کو مقتضی ھے.
জাওয়াব: “.... তবে সাধারণভাবে যেহেতু মুনাজাতের মধ্যে হাত উঠানো মুস্তাহাব, তাই পবিত্র আযান উনার পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব হওয়ার প্রমাণই বহন করে। সুতরাং পবিত্র আযান উনার দোয়াতেও হাত উঠানো জায়িয ও সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
ফতওয়ায়ে রহীমিয়া’ কিতাবের ৩য় জিঃ ১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
اذان کے بعد کی دعا میں ھاتھ اٹھانا مںقول نھیں ھے ویسے مطلقا دعا میں ھاتھ اٹھانا قولی اور فعلی (حدیث) سے ثابت ھے لھذا دعائے اذان  مین ھاتھ اٹھانے کو سنت کی خلاف ورزی نھیں کھا جائیگا.
অর্থ: “পবিত্র আযান উনার পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা (আমল দ্বারা) বর্ণিত নেই। তবে সাধারণভাবে মুনাজাতে হাত উঠানো ক্বওলী এবং ফে’লী উভয় প্রকার পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে। তাই আযানের পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করাকে সুন্নতের  খিলাফ বলা যাবে না।” (চলবে ইনশাআল্লাহ)
কিফায়াতুল মুফতী’ কিতাবের ৩য় জিঃ ৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
سوال. اذان کے بعد ھاتھ اٹھاکر مناجات کرناکیسا ھے ....؟
সুওয়াল: পবিত্র আযান উনার পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা কিরূপ?’
جواب. اذان کے بعد جو الفاظ ادا کیئے جاتے ھیں وہ دعا کے الفاظ ھیں اور رفع یدین اداب دعا میں سے ھے. اس لئے ھاتھ اٹھانے میں مضائقہ نھیں.
জাওয়াব: “পবিত্র আযান উনার পর যে সকল শব্দসমূহ পড়া হয়, সেগুলো দোয়ার শব্দ। আর দোয়ার সময় উভয় হাত উঠানো আদবের অন্তর্ভুক্ত। তাই হাত উঠিয়ে মুনাজাত করাতে কোন ক্ষতি নেই।”
উল্লেখ্য, কিতাবে বর্ণিত আছে-
الادب خير من الذهب والفضة.
অর্থ: “আদব স্বর্ণ-রৌপ্যের চেয়েও উত্তম।” কিতাবে আরো উল্লেখ আছে-
بے ادب محروم گشت از لطف رب.
অর্থ: “বেয়াদব মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত থেকে বঞ্চিত।”
ফতওয়ায়ে মাহমুদিয়া’ কিতাবের ২য় জিঃ ৩২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
سوال. اذان کے بعد مناجات کیسی ھے؟ جواب. اذان کے بعد دعاء وسیلہ مستحب ھے. کذ ا فی در مختار ج صفہ ৪১২.
সুওয়াল: পবিত্র আযান উনার পর মুনাজাত করা কি?
 জাওয়াব: “পবিত্র আযান উনার পর দোয়ায়ে উছীলা পড়া (অর্থাৎ মুনাজাত করা) মুস্তাহাব।”
অনুরূপ ‘দুররুল মুখতার’ ১ম জিঃ ৪১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।”

কুতুবুল ইরশাদ, হাফিযে হাদীছ, বাহরুল উলূম, ফক্বীহুল উম্মত, সাইয়্যিদুল মুনাজিরীন, রঈসুল মুহাদ্দিসীন, তাজুল মুফাস্সিরীন, শায়খুল মাশায়িখ, আমীরুশ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত, শাহ ছূফী, শায়েখ, হযরতুল আল্লামা মুহম্মদ রুহুল আমীন বশীরহাটী রহমতুল্লাহি আলাইহি (খলীফায়ে ফুরফুরা শরীফ) উনার লিখিত “জরুরী মাসায়েল” কিতাবে উল্লেখ করেন, “আযানের পর হাত উঠিয়ে দোয়া করা জায়িয।”
পবিত্র আযান উনার পর মুয়াজ্জিন ও শ্রোতাদের হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব। শুধু পবিত্র আযান উনার পর নয়, পবিত্র নামায উনার মধ্যস্থিত (দোয়া কুনূত, দোয়ায়ে মাছূরা ইত্যাদি) দোয়া ব্যতীত সমস্ত দোয়ার জন্য হাত উঠানো এবং উক্ত হাত মুখম-লে মাসেহ করাও মুস্তাহাব। (ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া/১৪৫)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এসেছে-
حضرت مَالِكُ بْنُ الْحُوَيْرِثِ رَضِىَ اللَّهُ تعالى عَنْهُ قَالَ قَالَ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِى أُصَلِّى، فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ، وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ
অর্থ: হযরত মালিক ইবনে হুওয়াইরিছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদেরকে বলেছেন, তোমরা নামায পড় যেরূপ আমাকে নামায মুবারক আদায় করতে দেখো। যখন পবিত্র ছলাত বা নামায উনার সময় উপস্থিত হবে, তখন তোমাদের মধ্যে একজন যেন পবিত্র আযান দেয়, অতঃপর তোমাদের মধ্যে যিনি বড় তিনি যেন ইমামতি করেন। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)
সীরাতুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ গ্রন্থের ২য় খ- ১৭৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, “হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, হযরত মুহম্মদ ইবনে জা’ফর ইবনে জুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সূত্রে বনূ নাজ্জারের এক মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি আমার নিকট বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, পবিত্র মসজিদুন নববী শরীফ উনার নিকট আমার ঘরটিই ছিলো দীর্ঘতম ঘর। হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি প্রতিদিন পবিত্র ফজর উনার সময় এ ঘর থেকেই পবিত্র আযান দিতেন। তিনি পবিত্র ফজর উনার পূর্বে সাহরীর সময়ই চলে আসতেন এবং পবিত্র ফজর উনার (সময়ের) অপেক্ষায় এ ঘরের ছাদে বসে থাকতেন। তারপর যখন দেখতেন সময় হয়েছে তখন শরীর মুবারক মোচড় মুবারক দিয়ে উঠতেন, তারপর এ দোয়া মুবারক পড়তেন,
اللهم إني أحمدك و أستعينك وأستعديك على قريش أن يقيموا دينك.
হে মহান আল্লাহ পাক! আমি আপনারই প্রশংসা করি এবং কুরাইশ কাফিরদের মোকাবিলায় আপনারই সাহয্য কামনা করি, যেন তারা আপনার সম্মানিত দ্বীন উনার মধ্যে প্রবেশ করে।
উক্ত মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! তিনি একটি রাতের জন্যও এ দোয়া পড়া বাদ দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।”
পরিশেষে বলতে পারি পবিত্র আযান উনার সূচনা হয়েছে পবিত্র হিজরত মুবারক উনার পর। যা অহীয়ে গায়রে মাতলু বা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দ্বারা ছাবিত হয়েছে। আর পবিত্র আযান ও ইক্বামত উনাদের লফয বা শব্দ মুবারক দ্বারা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সুমহান মর্যাদা-মর্তবা সহজেই প্রকাশ করা যায়। সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদেরকে পবিত্র আযানে ও ইক্বামত উনাদের হাক্বীক্বত উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)


0 Comments: