হুযুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র জীবনী মুবারক । (পর্ব- ৯২৫-১০৬৯) (ড)

পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মাঝে অবস্থানকলীন সময় সম্মানিত জিহাদ ও অভিযানসমূহ:
খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন-
وجاهدوا فى الله حق جهاده
অর্থ: “তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত, সেভাবে জিহাদ করো।” (পবিত্র সূরাতুল হজ্জ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৭৮)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ভিত্তিতে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনারা উনাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জিহাদ করে গেছেন।
কাফির, মুশরিক, মুনাফিক, ইহুদী, নাছারা তথা পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন:
غزوة গাযওয়াহ, سرية সারিয়াহ, جيش জাইশ ও بعث বা’ছ  ইত্যাদি।
এগুলোর মধ্যে غزوة গাযওয়াহ এখানে আলোচ্য বিষয়।
সারিয়ার سرية সংজ্ঞা: যে সমস্ত জিহাদে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সরাসরি অংশ গ্রহণ করেননি সে সমস্ত জিহাদকে সারিয়া বলে।
غزوة গাযওয়াহ উনার সংজ্ঞা: “সাইয়্যিদুনা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে সমস্ত বড় জিহাদে অংশগ্রহণ করে জিহাদ পরিচালনা করেছেন সে সমস্ত জিহাদকে ‘গাযওয়াহ’ বলা হয়।”
সমস্ত গাযওয়াহতেই মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেছিলেন। সেগুলো হচ্ছে:
১. غزوة العشيرة গাযওয়াতুল উশাইরাহ: যা সংঘটিত হয়েছিল ২য় হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে। কারো কারো মতে জুমাদাল উখরা মাসে। তবে প্রথম মতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। (সীরাতুদ দিমইয়াত্বী, আল ইমতা’)
২. سفوان غزوة গাযওয়াতু সাফওয়ান: এ গাযওয়াহ উনাকে ‘গাযওয়াহতু বদরিল ঊলা’ও বলা হয়। গাযওয়াতুল উশাইরাহ উনার কয়েকদিন তথা প্রায় ১০ দিন পর এ জিহাদ সংঘটিত হয়। (সীরাতুশ শামী, সীরাতুদ দিমইয়াত্বী)
৩. غزوة بدر الكبرى গাযওয়াতু বদরিল কুবরা: এ গাযওয়াহ উনাকে ‘বদরুল উযমা, বদরুল ক্বিতাল ও বদরুল ফুরকানও বলা হয়। কেননা, মহান আল্লাহ তায়ালা তিনি তিনি এ জিহাদের মাধ্যমে হক্ব ও বাত্বিলের পার্থক্য সৃষ্টি করে দেন। ২য় হিজরী উনার ১৭ই পবিত্র রমাদ্বান শরীফে পবিত্র মদীনা শরীফ থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক স্থানে কুরাঈশ কাফিরদের বিরুদ্ধে এ জিহাদ সংঘটিত হয়। মুসলমান উনাদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ মতান্তরে ৩১৪ বা ৩১৫ জন। কাফিরদের সংখ্যা ছিল ১০০০ জন। তুমুল জিহাদের পর মুসলমানগণ জয়লাভ করেন আর কাফিররা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। জিহাদে মুসলমানগণের ১৪ জন শহীদ হন। আর কাফিরদের ১১ জন নেতাসহ ৭০ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্ধী হয়। (দিমইয়াত্বী, ইবনে আসাকির, ইবনে হিশাম)
৪. غزوة بنى سليم গাযওয়াতু বনী সালীম: গাযওয়াতুল্ বদর উনার ৭ দিন পর এ জিহাদ সংঘটিত হয়। (আবূ দাঊদ শরীফ)
৫. غزوة بنى قينقاع গাযওয়াতু বনী কাইনুক্বা: এ জিহাদ ইহুদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল।
৬. غزوة قرقرة القدر গাযওয়াতু ক্বরক্বরাতিল্ ক্বদর: এ গাযওয়াহ উনাকে ‘ক্বরীরাতুল ক্বদর ও ক্বরাক্বির’ও বলা হয়।
৭. غزوة ذى امر গাযওয়াহ যী আমার: এ গাযওয়াহ উনাকে ‘গাযওয়াহতু আনমার ও গাযাওয়াাতু গাতফান’ও বলা হয়। এ জিহাদ ৩য় হিজরী উনার মাহে রবীউল আউওয়াল শরীফ-এ সংঘটিত হয়।
৮. غزوة نجران بالحجاز গাযওয়াহতু নাজরান বিল হিজায: এ গাযওয়াহ উনাকে ‘গাযওয়াতু বাহরান’ও বলা হয়। ৩য় হিজরী উনার জুমাদাল ঊলা মাসে এ জিহাদ সংঘটিত হয়।
৯. غزوة احد গাযওয়াহ উহুদ: উহুদ মদীনা শরীফ উনার একটি পাহাড়ের নাম। জমহুর উলামায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের মতে, ৩য় হিজরী উনার শাওয়াল মাসে এ জিহাদ সংঘটিত হয়। এতে মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেন। আর কাফিররা পরাজিত হয়। এ জিহাদেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একখানা দাঁত মুবারক শহীদ হয় এবং ৭০ জন ছাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। (দিমইয়াত্বী, ইবনে হিশাম, বুখারী শরীফ, তিরমিযী শরীফ)
১০. غزوة حمراء الأسد গাযওয়াতু হামরায়িল আসাদ।
১১. غزوة بنى النضير গাযওয়াহ বনী নদ্বীর: বনী নদ্বীর ছিল মদীনা শরীফ উনার ইহুদী সম্প্রদায়। এদের বিরুদ্ধে এ জিহাদ হয়েছিল। ৪র্থ হিজরী উনার রবীউল আউওয়াল শরীফ মাসে এ জিহাদ সংঘটিত হয়। (বুখারী শরীফ, ইবনু কাছীর, ইবনু ইসহাক্ব)
১২. غزوة ذات الرقاع গাযওয়াহ যাতির রিক্বা: এ গাযওয়াহ উনাকে “গাযওয়াতু মাহারিব, গাযওয়াতুল্ আয়াজীব, গাযওয়াতু তাগলাবাহ, গাযওয়াতু ছা’লাবাহ ও গাযওয়াতু বনী আনমার”ও বলা হয়। এ জিহাদ ৪র্থ হিজরী উনার মাহে রবীউল আউওয়াল শরীফ, মতান্তরে: রবীউছ ছানী, মতান্তরে: জুমাদাল উলা মাসে সংঘটিত হয়েছিল। (ইবনে ইসহাক, দিমইয়াত্বী, ইবনে কাছীর)
১৩. غزوة بدر الاخرى গাযওয়াতু বদরিল উখরা: এ গাযওয়াহ উনাকে ‘গাযওয়াহতু বদরিল মাওয়াদ’ ও বলা হয়। ৪র্থ হিজরী উনার শা’বান মাসে সংঘটিত হয়।
১৪. غزوة دومة الجندل গাযওয়াতু দূমাতিল জানদাল: ৪র্থ হিজরী উনার শেষের দিকে, আবার কারো মতে, ৫ম হিজরী উনার মাহে রবীউল আউওয়াল শরীফ মাসে এ জিহাদ সংঘটিত হয়।
১৫. غزوة بنى المصطلق গাযওয়াতু বনিল্ মুছতালিক: এ গাযওয়াহ উনাকে “গাযওয়াতুল  মুরাইসী, গাযওয়াতু মহারিব ও গাযওয়াহতুল আয়াজীব’ ও বলা হয়।
১৬. غزوة الخندق গাযওয়াতুল্ খন্দক: যাকে ‘গাযওয়াতুল আহযাব’ও বলা হয়। ৫ম হিজরীতে এ জিহাদ সংঘটিত হয়।
১৭. غزوة بنى قريظة গাযওয়াহতু বনী কুরাইযাহঃ মদীনা শরীফ উনার ইহুদীদের সাথে এ যুদ্ধ হয়েছিল।
১৮. غزوة بنى لحيان গাযওয়াহ বনী লিহইয়ান: এটি হুযাইল গোত্রের একটি ক্ববীলাহ। বনী কুরাইযাহ উনার ৬ মাস পর এ জিহাদ সংঘটিত হয়।
১৯. غزوة ذى قرد গাযওআতু যী ক্বারাদ: এ জিহাদকে ‘গাযওয়াতুল গাবাহ’ও বলা হয়। ‘বনী লিহইয়ান জিহাদের কয়েকদিন পর এ জিহাদ সংঘটিত হয়।
২০. غزوة الحديبية গাযওয়াহতুল হুদাইবিয়াহ: ৬ষ্ঠ হিজরীতে যুল হিজ্জাহ মাসে সংঘটিত হয়।
২১. غزوة خيبر গাযওয়াহতু খাইবার: জমহুর উলামায়ে কিরামের মতে, ৭ম হিজরীর মুর্হরম মাসের শুরুর দিকে এ জিহাদ হয়। কারো মতে, ৬ষ্ঠ হিজরীতে। আবার কারো মতে, ৫ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধের পর খাইবার যুদ্ধ হয়।
২২. غزوة وادى القرى গাযওয়াতু ওয়াদিল কুরা: এ জিহাদও ইহুদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়। খাইবার থেকে ফিরার পর পরই এ জিহাদ হয়।
২৩. غزوة عمرة القاضى গাযওয়াতু উমরাতিল ক্বাদা: এ গাযওয়াহ উনাকে “উমরাতুল ক্বাদ্বিয়াহ, উমরাতুছ ছুলহ, উমরাতুল ক্বছাছ”ও বলা হয়। ৭ম হিজরী উনার যুল কা’দাহ মাসে এ জিহাদ সংঘটিত হয়।
২৪. غزوة فتح مكة গাযওয়াতু ফাতহি মক্কাঃ যা ৮ম হিজরীতে সংঘটিত হয়।
২৫. غزوة حنين গাযওয়াতু হুসাইন।
২৬.غزوة الطائف  গাযওয়াতুত ত্বায়িফ।
২৭. غزوة تبوك গাযওয়াতু তাবূক।
উল্লিখিত ২৭টি গাযওয়াহ উনার মধ্যে ৯টি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সরাসরি পরিচালনা করেছেন। সে ৯টি গাযওয়াহ হচ্ছেঃ ১. বদর ২. উহুদ ৩. আহযাব বা খন্দক ৪. বনী কুরাইযাহ ৫. বনী মুছ্তালিক ৬. খাইবার ৭. ফাতহি মক্কাহ ৮. হুনাইন ৯. তাবুক (ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, হাশিয়ায়ে বুখারী ২য় খ- ৫৬৩ পৃষ্ঠা)
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে নিজেই সশস্ত্র জিহাদ করেছেন এবং উম্মতকে জিহাদ করতেও বলেছেন। সাধারণভাবে জিহাদ করা ফরযে কিফায়াহ। তেমনিভাবে দায়িমী জিহাদ তথা নফসের সাথে জিহাদ করতেও নির্দেশ মুবারক করেছেন।
তাফসীরে বাগবীতে পবিত্র হাদীছ শরীফ উল্লেখ রয়েছে। হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে যে, তাবূকের জিহাদ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন,
رجعنا من الجهاد الاصغر الى الجهاد الاكبر
অর্থ: “আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম।”
জিজ্ঞাসা করা হলো, জিহাদে আকবর বা বড় জিহাদ কি? তিনি বললেন, নফ্স বা প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ করা। (বাইহাক্বী শরীফ)
অতএব, প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর উপর ফরয-ওয়াজিব হক্কানী-রব্বানী আউলিয়া কিরাম উনাদের ছোহবত মুবারক অর্জনের মাধ্যমে যিকির-ফিকির করে নফসকে ইছলাহ করার লক্ষ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের উভয়ের সন্তুষ্টি বা রিযামন্দী মুবারক অজর্নের জন্য জিহাদ  করা। ইনশাআল্লাহ! আমরা পর্যায়ক্রমে সারিয়া ও গাযওয়া সম্পর্কে আলোচনা করবো।

আবওয়ার জিহাদ:
ইহা ছিলো মুসলমান উনাদের প্রথম জিহাদ, এই জিহাদে স্বয়ং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বশরীর মুবারক-এ অংশগ্রহণ করেছিলেন, দ্বিতীয় হিজরী সনের ছফর মাস উনার প্রারম্ভে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ৬০জন হযরত মুহাজির ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সঙ্গে নিয়ে যাতে কোন হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা উপস্থিত ছিলেন না, কুরাইশ কাফির কাফেলা এবং বনী যামরার প্রতি আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে আবওয়ার দিকে ছফর করেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার প্রতিনিধিত্ব হিসেবে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে হযরত সা’দ ইবনে উবাদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে রেখে যান। এ জিহাদের পতাকা ছিলো হযরত হামযা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হাত মুবারকে। যখন তিনি আবওয়া নামক স্থানে পৌঁছেন ততক্ষণে কুরাইশ কাফির কাফেলা যেখান থেকে চলে গিয়েছিলো। কাজেই তিনি বনী যামরার সরদার মাখশী ইবনে আমরের সাথে সন্ধি করে ফিরে আসেন। সন্ধির শর্তবলী এই ছিলো যে, বনী যামরা মুসলমান উনাদের সাথে জিহাদ করবে না এবং মুসলমান উনাদের কোন শত্রুকেও সাহায্য করবে না এবং মুসলমান উনাদের সাথে প্রতারনাও করবে না; বরং প্রয়োজনে মুসলমান উনাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ, সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ জিহাদকে ওয়াদ্দানের জিহাদও বলা হয়। আবওয়া এবং ওয়াদ্দান দু’টি সন্মিকটবর্তী স্থান, উভয়ের দূরত্ব মাত্র ছয় মাইল। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ১৫ দিন পর কোন রক্তপাত ছাড়াই এ জিহাদ থেকে পবিত্র মদীনা শরীফ প্রত্যাবর্তন করেন। এতে কোন জিহাদ করার প্রয়োজন হয়নি। (উযূনুল আসার, ফতহুল বারী) 

বুওয়াত্বের জিহাদ:
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সৃষ্টির শুরু থেকে অনন্তকাল কি ঘটেছে ও ঘটবে তার সবকিছুই অবগত হোক তা দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান। অর্থাৎ তিনি পরিপূর্ণভাবে ইলমে গায়িব উনার অধিকারী।
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি অবগত যে, কুরাইশ কাফিরদের একটি বাণিজ্য কাফেলা পবিত্র মক্কা শরীফ উনার দিকে যাচ্ছে। ফলে তিনি দ্বিতীয় হিজরী উনার পবিত্র রবীউল আউওয়াল শরীফ মাসে দু’শ মুজাহিদ ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের নিয়ে কুরাইশ কাফির মুশরিকদের ধরার উদ্দেশ্যে বুয়াতের দিকে ছফর করেন। এ সময় তিনি প্রথমদিকের মুসলমান এবং আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী ছাহাবী হযরত সায়িব ইবনে উছমান ইবনে মাযউন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন।
কুরাইশ কাফিরদের ঐ কাফেলায় আড়াই হাজার উট ছিলো। আর হযরত উমাইয়া ইবনে খালফসহ এতে লোক সংখ্যা ছিলো একশত। বুওয়াত্ব পৌঁছে জানা গেলো যে, কুরাইশ কাফিরদের কাফেলা চলে গেছে। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই পবিত্র মদীনা শরীফ প্রত্যাবর্তন করেন। (যারকানী, সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আশ শিফা, আল মাগাযী লিল ওয়াক্বীদী, জাওয়ামিউল কালাম, গাযওয়াতুর রসূল ওয়া সারিয়া, আল ওয়াফা লিল ওয়াফায়িয়াত )। 

উশাইরার জিহাদ:
ইবনে হিশাম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন,
واستعمل على المدينة حضرت أبا سلمة بن عبد الاسد رضى الله تعالى عنه.
অর্থ: “এ ছফরে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত আবূ সালামা ইবনে আব্দুল আসাদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার গর্ভনর নিয়োগ করে যান।”
হযরত ওয়াকীদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন,
كان لواؤه مع حضرت حمزة بن عبد المطلب رضى الله تعالى عنه. قال وخرج عليه السلام يتعرض لعيرات قريش ذاهبة إلى الشام.
অর্থ: “নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পতাকাবাহী ছিলেন হযরত হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন সিরিয়াগামী কুরাইশ কাফির বণিক দলকে আটকানোর জন্য নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এই অভিযানে বের হন।”
قال حضرت ابن إسحاق رحمة الله عليه فسلك على نقب بني دينار، ثم على فيفاء الخيار، فنزل تحت شجرة ببطحاء ابن أزهر يقال لها: ذات الساق فصلى عندها فثم مسجده، فصنع له عندها طعام فأكل منه وأكل الناس معه، فرسوم أثافي البرمة معلوم هناك،

অর্থ: “হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বনূ দীনারের গিরি পথ দিয়ে চলেন। এরপর ফাইফা আল খিয়ার এর উঁচু ভূমির দিকে যান এবং ইবনে আযহার এর বাতহা প্রান্তরে একটা বৃক্ষের নীচে অবতরণ করেন। এ স্থানকে বলা হতো যাতুস সাক। সেখানে তিনি পবিত্র নামায মুবারক আদায় করেন। পরে সেখানে একটা মসজিদ নির্মাণ করা হয়। সেখানে উনার জন্য খাবার মুবারক উনার ব্যবস্থা করা হয় তিনি সেই খাদ্য মুবারক খান এবং উনার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও তা আহার করেন। এখানে রান্না-বান্নার জন্য যে চুলা নির্মিত হয়েছিলো, সে স্থান মুবারকই এখনও পরিচিত।

واستسقى له من ماء يقال له المشيرب ثم ارتحل فترك الخلائق بيسار وسلك شعبة عبد الله، ثم صب للشاد  حتى هبط ملل ، فنزل بمجتمعه ومجتمع الضبوعة ثم سلك فرش ملل حتى لقي الطريق بصخيرات اليمام،، ثم اعتدل به الطريق حتى نزل العشيرة من بطن ينبع فأقام بها جمادى الاولى وليال من جمادى الآخرة ووادع فيها بني مدلج وحلفاءهم من بني ضمرة ثم رجع إلى المدينة ولم يلق كيدا.

মুশায়রিব নামক কুয়ো থেকে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য পানি আনা হয়। অতপর তিনি রওয়ানা হন খালায়িক স্থানটি বায়ে রেখে এবং আব্দুল্লাহ গিরি সঙ্কটের পথ ধরে গমন করেন। অতপর সাব্বুশ শাদ হয়ে ‘মিলাল’ নামক স্থানে অবতরণ করেন। তিনি সেখানে মুজতামাউয যাবুআ নামক স্থানে অবস্থান নেন। এরপর ফারশা মিলাল হয়ে বাখীরাতুল ইয়ামাম-এর পথ ধরে চলেন। তারপর সেখান থেকে পথের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে বাতনে ইয়াম্বু-এর আশীরা নামক স্থানে অবস্থান নেন এবং জুমাদাল উলা ও জুমাদাল উখরা মাস উনার কিছু দিন কাটান। সেখানে তিনি বনী মুদলাজ এবং বনী মুদলাজের মিত্রদের সঙ্গে সমঝোতা করে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। এ ক্ষেত্রে ও কোন সংঘর্ষ হয়নি।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
عن حضرت أبي إسحاق رحمة الله عليه  قال كنت إلى جنب  حضرت زيد بن أرقم فقيل له كم غزا رسول الله صلى الله عليه رضى الله تعالى عنه وسلم من غزوة ؟ قال: تسع عشرة. قلت كم غزوت أنت معه ؟ قال سبع عشرة غزوة، قلت فأيهن كان أول ؟ قال العشير - أو العسير - فذكرت لقتادة فقال: العشير. وهذا الحديث ظاهر في أن أول الغزوات العشيرة، ويقال بالسين وبهما مع حذف التاء، وبهما مع المد اللهم إلا أن يكون المراد غزاة شهدها مع النبي صلى الله عليه وسلم زيد بن أرقم العشيرة وحينئذ لا ينفي أن يكون قبلها غيرها لم يشهدها زيد بن أرقم
অর্থ: “হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমি যায়িদ ইবনে আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পাশে ছিলাম। উনাকে জিজ্ঞেস করা হলো, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কতটি জিহাদে সশরীর মুবারক-এ অংশ গ্রহণ করেছেন? তিনি বললেন ১৯টি জিহাদে। আমি বললাম আপনি উনার সঙ্গে কতটি জিহাদে শরীক ছিলেন? তিনি বললেন, আল-আশারী বা আল আসীর। বিষয়টি আমি হযরত কাতাদা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি বললেন, আল আশীর। এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উনার থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রথম গাযওয়া ছিলো আল আশীরা। এটাকে আশীরা, আসীরা, আশীর এবং আশীরাও বলা হয়ে থাকে। তবে এর অর্থ হয় যে সব গাযওয়া, যাতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বয়ং অংশ গ্রহণ করেছেন, তবে উনার প্রথমটা হলে আল আশীরা। এ জিহাদে হযরত যায়িদ ইবনে আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি অংশ গ্রহণ করেন।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
عن حضرت  عمار بن ياسر رضى الله تعالى عنه. قال كنت أنا و حضرت علي بن أبي طالب عليه السلام رفيقين في غزوة العشيرة من بطن ينبع، فلما نزلها رسول الله صلى الله عليه وسلم أقامبها شهرا فصالح بها بني مدلج وحلفاءهم من بني ضمرة فوادعهم، فقال لي حضرت علي بن أبي طالب عليه السلام : هل لك يا أبا اليقظان أن نأتي هؤلاء النفر - من بني مدلج يعملون في عين لهم - ننظر كيف يعملون ؟ فأتيناهم فنظرنا إليهم ساعة فغشينا النوم فعمدنا إلى صور من النخل في دقعاء من الارض فنمنا فيه.
অর্থ: “হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এ দিন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনাকে লক্ষ্য করে যা বলার বলেছিলেন! হযরত ইয়াযীদ ইবনে মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সূত্রে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত হয়েছে এভাবে যে, হযরত আম্মার রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, বাতনে ইয়াম্বু-এর গাযওয়া আল আশীরায় আমি হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনার ছফর সঙ্গি ছিলাম। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেখানে অবতরণ করে এক মাস অবস্থান করেন। সেখানে তিনি বনী মুদলাজ এবং তাদের মিত্র গোত্র বনী যামরার সঙ্গে সন্ধি করেন। তখন হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি আমাকে বলেন, বনী মুদলাজের যেসব লোক একটা কুয়োর কাছে কাজ করছে, হে আবুল ইয়াকায! আমরা কি তাদের কাছে যেতে পারি না? সেখানে তারা কেমন কাজ করছেন আমরা তা প্রত্যক্ষ করবো। আমরা তাদের কাছে গেলাম এবং কিছু সময় তাদের কাজ প্রত্যক্ষ করলাম। এখানে নিন্দ্রা আমাদের আচ্ছন করে এবং আমরা মাটিতে শুয়ে পড়ি। সেখানে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
 فوالله ما أهبنا إلا ورسول الله صلى الله عليه وسلم يحركنا بقدمه فجلسنا وقد تتربنا من تلك الدقعاء فيومئذ قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لعلي: " يا أبا تراب " لما عليه من التراب، فأخبرناه بما كان من أمرنا فقال: " ألا أخبركم بأشقى الناس رجلين ؟ " قلنا بلى يا رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال: " أحيمر  ثمود الذي عقر الناقة والذي يضربك يا علي على هذه - ووضع رسول الله صلى الله عليه وسلم يده على رأسه - حتى تبل منها هذه - ووضع يده على لحيته - " وهذا حديث غريب من هذا الوجه له شاهد من وجه آخر في تسمية علي أبا تراب كما في صحيح البخاري أن عليا خرج مغاضبا فاطمة، فجاء المسجد فنام فيه فدخل رسول الله صلى الله عليه وسلم فسألها عنه فقالت خرج مغاضبا فجاء إلى المسجد فأيقظه وجعل يمسح التراب عنه ويقول: " قم أبا تراب قم أبا تراب "
মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার পুত-পবিত্র পা মুবারক দিয়ে আমাদেরকে নাড়া দিলে আমরা জাগ্রত হই। আমাদের গায়ে মাটি লেগেছিলো। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনাকে বললেন, হে আবু তুরাব! কারণ উনার গা মুবারক উনার মধ্যে মাটি লেগেছিলো। আমরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে উনাকে জানালাম। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন- আমি কি সে হতভাগা দু’জন লোক সম্পর্কে আপনাদেরকে জানাবো? আমরা বললাম, নিশ্চয়ই ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন ছামুদ গোত্রের উহায়মির, যে উষ্ট্রী বধ করেছিলো, আর সে ব্যক্তি যে আপনার চেহারা মুবারকে আঘাত করবে। হে কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম একথা বলতে গিয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজাহাহু আলাইহিস সালাম উনার মাথা মুবারক উনার মধ্যে হাত মুবারক রাখলেন। অবশেষে এটা রক্তে রঞ্জিত হবে। এ কথা বলে তিনি দাড়িয়ে উনার উপর পবিত্র হাত মুবারক স্থাপন করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, সীরাতুল নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সীরাতুন মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম মাদারিজুন নুবুওওয়াত, মুখতাসারু তারীখে দামেশক)

0 Comments: