পবিত্র কুরআন শরীফ এবং পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত ঈমানী কুওয়্যত বৃদ্ধিকারী মুবারক মু’জিযা ও নিদর্শনসমূহ-২

 

পবিত্র কুরআন শরীফ এবং পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত ঈমানী কুওয়্যত বৃদ্ধিকারী মুবারক মু’জিযা ও নিদর্শনসমূহ (০২)

-সাইয়্যিদুনা হযরত শাফিউল উমাম আলাইহিস সালাম

 যিনি খালিক যিনি মালিক যিনি রব মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন।

وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ ﴿  إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ ﴿

অর্থ : তিনি ওহী ব্যতীত নিজ থেকে কোন কথা বলেন না। (পবিত্র সূরা নজম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩-৪)। তাই নূরে মুজাসসাম,হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত হাদীছ শরীফ উনার মধ্যেও রয়েছে অসংখ্য নিদর্শন মুবারক।

নূরে মুজাসসাম,হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি

ওয়া সাল্লাম উনার মু’জিযা শরীফ:

ইয়েমেনের মসজিদে ছানাআ উনার ক্বিবলা নির্ধারণ

 খালিক মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন, وَلِكُلٍّ وِجْهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَا “প্রত্যেকটা বিষয়ের একটা ক্বিবলা আছে, যে দিকে সে মুখ করে (ইবাদত করবে)।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪৮)

পবিত্র ক্বিবলা উনার প্রকার: সম্মানিত হানাফী মাযহাব উনার ফতওয়ায়ে শামী, দুররুল মুখতার, আইনুল ইয়াক্বীন কিতাবে পাঁচ প্রকার ক্বিবলা বর্ণনা করা হয়েছে যেমন:- 

১. পবিত্র নামায উনার ক্বিবলা হচ্ছে- পবিত্র কা’বা শরীফ 

২. দোয়া বা মুনাজাতের ক্বিবলা হচ্ছে- আসমান। 

৩. সমস্ত মাখলুকাতের ক্বিবলা হচ্ছেন- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। 

৪. সমস্ত ক্বিবলা উনাদেরকে বিলীনকারী ক্বিবলা হচ্ছেন- “স্বয়ং খালিক মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি। 

৫. ক্বিবলায়ে কুলূব বা ক্বলবের ক্বিবলা হচ্ছেন- “পীর ছাহেব ক্বিবলা।”

নামায উনার ক্বিবলা: প্রাথমিক অবস্থায় বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ ছিল ক্বিবলা। ২য় হিজরীতে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,

قَدْ نَرٰى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ فَلَـنُوَلِّيَنَّكَ قِـبْلَةً تَرْضَاهَـا فَوَلِّ وَجْـهَكَ شَطْرَ الْـمَسْـجِدِ الْحَـرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوْا وُجُوِهَكُمْ شَطْرَه

 “নিশ্চয়ই আমি আপনার চেহারা মুবারক বার বার আকাশের দিকে উঠাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সেই ক্বিবলা উনার দিকেই ঘুরিয়ে দিব, যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনার চেহারা মুবারক (নামাযে) মসজিদে হারামাইন শরীফ উনার দিকে ফিরিয়ে নিন, আর আপনারা (মুসলমানগণ) যেখানেই থাকুন না কেনো স্বীয় চেহারা ঐদিকেই ফিরিয়ে নিন।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ  : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪৪)

 তখন থেকেই নামায উনার ক্বিবলা হচ্ছে “মক্কাতুল মুকাররমা” উনার মধ্যে অবস্থিত ‘পবিত্র কা’বা শরীফ’।

 ক্বিবলামুখী হওয়া: ২ ভাবে হতে পারে:

(১) ‘আইনি ক্বিবলা: সরাসরি পবিত্র কা’বা শরীফ উনাকে সামনে দেখে নামায আদায় করা।

(২) জিহাতি ক্বিবলা: যদি পবিত্র কা’বা শরীফ উনাকে দেখা না যায় তাহলে পবিত্র কা’বা শরীফ উনার অবস্থানের দিকে মুখ করে পবিত্র নামায আদায় করা। মসজিদের ৪ দেয়ালের মধ্যে ক্বিবলামুখী দেয়ালকে মক্কা শরীফ শহর বা আরব দেশের দিকে মুখ রেখে জেহাতি ক্বিবলা ঠিক করা হয়।

ইয়েমেনে পবিত্র দ্বীন ইসলাম: অষ্টম হিজরীতে পবিত্র মক্কা শরীফ বিজয়ের পর দলে দলে সবাই যখন পবিত্র দ্বীন ইসলামে দাখিল হলেন, ইয়েমেনবাসীরাও মুসলমান হলেন। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাদেরকে (মুসলমানগণকে) পবিত্র দ্বীন ইসলাম শিক্ষা দিতে হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনাকে ইয়েমেনের হামদান, হযরত মু’আয বিন জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে ইয়েমেনের জানাদ এবং অপর কয়েকজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে ছানাআতে প্রেরণ করেন। এর মধ্যে হযরত ওয়াবর ইবনে ইউহান্নাস আল খুজায়ি রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে ‘ওয়ালী’ হিসেবে ছানাআতে প্রেরণ করেন।

ছানাআতে মসজিদ নির্মাণ: এ প্রসঙ্গে “আল মু’জাম আত্ব তাবারানী আল-আওসাত” গ্রন্থে বর্ণিত আছে, 

 قال وبر بن عيسى الخزاعي قال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا بنيت مسجد صنعاء فاجعله عن يمين جبل يقال له ضين  

“হযরত ওয়াবর ইবনে ইউহান্নাস আল খুজায়ি রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,  নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাকে নছীহত মুবারক করেন, যখন ছানাআতে মসজিদ নির্মাণ করবেন, তখন এমনভাবে করবেন যেন দ্বীন নামক পর্বতের ডান দিকে হয়।”

অপর এক বর্ণনায় আল হাফেজ আল রাজী “তারীখু ছানাআ” কিতাবে উল্লেখ করেন-

عبد الرزاق قال حماد بن سعيد بن رمانة قال أخبرني بعض أشياخي أن رسول الله صلى الله عليه و سلم أمر وبر بن يوحنس الأنصاري حين أرسله الى صنعاء واليا عليها فقال –"ادعهم إلى الإيمان،فإن أطاعوا لك به فاشرع الصلاة، فإذا أطاعوا لك بها ،فمر ببناء المسجد لهم في بستان باذان من الصخرة التي في أصل غمدان واستقبل به الجبل الذي يقال له ضين

 নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি  হযরত ওয়াবর ইবনে ইউহান্নাস আল আনসারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে  ছানাআর ওয়ালী (শাসনকর্তা) হিসেবে প্রেরণ করার সময় ইরশাদ মুবারক করেন, “তাদেরকে (ছানাআ-বাসী) ঈমান আনার জন্য আহবান করবেন। যদি তারা মেনে নেয়, তাহলে নামায প্রতিষ্ঠা করবেন। যদি তারা মেনে নেয় তাহলে “বুস্তানে বাজান” স্থানে যেখানে গামদান প্রাসাদের ১টি পাথর আছে সেখানে পবিত্র মসজিদ নির্মাণ করবেন এবং এর ক্বিবলা স্থাপন করবেন দ্বীন নামক পর্বতের দিকে।”

হাফিজ আর রাজী আরও বর্ণনা করেন,

فكتب إلى وبر يبني حائط باذان مسجدا و يجعله من الصخرة إلى موضع جدره، و يستقبل بقبلته ضين

নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ওয়াবর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে লিখিত নির্দেশ মুবারক করেন, ”মসজিদের ‘বুস্তানে বাজান’ সংলগ্ন দেয়ালটি গামদান প্রাসাদের পাথরের গোড়ায় “দ্বীন পর্বত” এর দিকে মুখ রেখে ক্বিবলা নির্ধারণ করবেন।”

বর্তমানে সম্মানিত ছানাআ মসজিদ: ১৪০০ বছর  একাধিকবার সংস্কারের পরও বর্তমানে পবিত্র মসজিদটি  সানাআতে অবস্থিত যা ‘জামে’উল কাবীর’ নামে পরিচিত। যেখানে রয়েছে ‘ছখরাতুল মুলামলামাহ’ পাথর  (صَخْرَةُ اْلمُلَمْلَمَة) যার সম্বন্ধে হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। একপাশে আদি স্তম্ভ মাসমূরাহ (دعامة المسمورة ), অন্যপাশে পরবর্তী স্তম্ভ মানক্বুরাহ ( منقورة  دعامة) এবং মাঝখানে ক্বিবলামুখী মেহরাব শরীফ।

সম্মানিত মসজিদ উনার পবিত্র ক্বিবলা পর্যবেক্ষণ: পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ছানাআ মসজিদ থেকে ’দ্বীন পর্বত’ এর দিকে লাইন টেনে বর্ধিত করলে ’রুকনে ইয়ামেনী’ ও ’হাজরে আসওয়াদ’ উনাদের মাঝ বরাবর ঠিক পবিত্র কা’বা শরীফ উনার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছে। সুবহানাল্লাহ!

সূর্য-তারা-নক্ষত্রের অবস্থান থেকে পথ চলার প্রাচীন রীতি ছিল, সেক্ষেত্রে এক অঞ্চল থেকে আর এক দেশ বা শহর বা অঞ্চলের দিক সম্বন্ধে ধারণা করা যেত। কিন্তু কোন দেশ বা শহর বা অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত কোন ঘর বরাবর দিক নির্ণয় করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।  প্রাচীন মিশরীয়, আসরীয়, মায়ান স্থাপত্যকাজে সূর্য-তারা-নক্ষত্রের ব্যবহার করে পরিমাপ ঠিক রাখা হতো কিন্তু এই স্থাপত্যগুলি ছিল একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থির অথচ এক স্থানে (মদীনা শরীফ) অবস্থান করে অন্য আর একটি স্থানে (সানাআ) অবস্থিত ১ টি মসজিদের দিক প্রায় ৮১৬.৩ কি.মি দূরে অবস্থিত তৃতীয় একটি শহর (মক্কা শরীফস্থ কা’বা শরীফ) ঘর বরাবর দিক বলে দেয়া কোন মানুষের পক্ষে কল্পনাতীত।

বর্তমানে কিছু উচ্চমাত্রার সূক্ষতাসম্পন্ন (যরময ৎবংড়ষঁঃরড়হ) ডিজিটাল মিলিটারী ম্যাপ আছে যা দিয়ে একটা অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানের কোন বিল্ডিং এর দিকে লক্ষ্য (ঃধৎমবঃ) স্থির করা হয় কিন্তু সেটাও অত্যন্ত কঠিন। আর পূর্বেকার সময়ের যে ত্রুটিপূর্ণ, ভুলে ভরা ম্যাপগুলি ছিল সেগুলি দিয়ে এরকম দিক নির্ধারণ সম্পূর্ণ অসম্ভব।

আরও উল্লেখযোগ্য, কাছের ক্বিবলা নির্ধারক লক্ষ্য সামান্য সরে গেলে দূরে অবস্থিত প্রকৃত লক্ষ্য কা’বা শরীফ থেকে ক্বিবলা শত শত কি.মি. সরে যেতে পারে। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নির্দেশিত পবিত্র ক্বিবলা ঠিক পবিত্র কা’বা শরীফ উনার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছে- ঠিক যেন ‘আইনি ক্বিবলা (সুবহানাল্লাহ)!

 নিঃসন্দেহে বিষয়টি উনার একটি নগণ্য মু’যিজা শরীফ কারণ তিনি হাজির-নাযির, সমস্ত কিছু সরাসরি দেখে থাকেন, তিনি মু’তালা আলাল গ¦ইব। হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ হয়েছে:  اُعْطِيْتُ بِـجَوَامِعِ الْكَـلـِمِ- ‘আমাকে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ইলম মুবারক হাদিয়া করা হয়েছে।” সুবহানাল্লাহ! পবিত্র লওহে মাহফুজের ইলম নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র ইলম মুবারক উনার এক কাতরা (অংশ) মাত্র (সুবহানাল্লাহ)।

 

0 Comments: