সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের ফযীলত মুবারক-২য় অংশ-পর্ব-৬.২
মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ মুবারক করেন,
قُلْ لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى وَمَنْ يَقْتَرِفْ حَسَنَةً نزِدْ لَه فِيهَا حُسْنًا إِنَّ اللهَ غَفُورٌ شَكُورٌ (۲۳) سورة الشورى
(হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলে দিন, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাচ্ছি না, নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন (আমার হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম) উনাদেরকে মুহাব্বত মুবারক করা ব্যতীত। আর যে ব্যক্তি (এই) নেক কাজ করবে আমি (মহান আল্লাহ পাক) তার নেকীগুলো দ্বিগুণ পরিমাণে বাড়িয়ে দিবো। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি ক্ষমাশীল এবং নেক কাজে প্রতিদান দানকারী। [সূরা শূরা শরীফ: ২৩]
উপরোক্ত আয়াত শরীফে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পক্ষ থেকে যে বিনিময় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে এই বিনিময় চাওয়ার বিষয়টি মূলত স্বাভাবিক নয়, চাইলে তা দেয়া কুল কায়িনাতের কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে যেহেতু সমস্ত মুসলমানদেরকে মহান আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সন্তুষ্টি-রেযামন্দি মুবারক হাছিল করতে হবে তাই সকলের দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বিনিময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মুহাব্বত, তা'যীম-তাকরীম করার জন্য পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি বান্দাদেরকে আদেশ মুবারক করেছেন তেমনিভাবে পবিত্র হাদীছ শরীফেও উনাদেরকে যারা মুহাব্বত করবেন, অনুসরণ করবেন, তা'যীম-তাকরীম করবেন উনাদেরকে অনেক ফযীলত, মর্যাদা-মর্তবা হাছিলের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحِبُّوا اللهَ لِمَا يَغْلُوكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ وَأَحِبُّوْنِي لِحُبِّ اللَّهِ وَأَحِبُّوا أَهْلَ بَيْتِي لِحْتِي. رواه ترمذى والحاكم والطبراني والبيهقى وجامع الاحاديث وجمع الجوامع للسيوتي وكنز العمال والجامع الاصول من احاديث الرسول وفضائل الصحابة واحمد ابن حنبل)
হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনাকে মুহাব্বত করো যেহেতু তিনি স্বীয় অনুগ্রহে তোমাদেরকে রিযিক দান করেন এবং তোমরা আমাকে মুহাব্বত করো মহান আল্লাহ পাক উনাকে মুহাব্বত করার জন্য এবং আমার আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মুহাব্বত করো আমাকে মুহাব্বত করার জন্য।
[তিরমিযী, ত্ববারানী, বাইহাক্বী শরীফ ইত্যাদি)
তাহলে দেখা যাচ্ছে, হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মুহাব্বত করলে স্বয়ং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মুহাব্বত করা হয় আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মুহাব্বত করা হলে মহান আল্লাহ পাক উনাকে মুহাব্বত করা হয়। আর মহান আল্লাহ পাক উনাকে মুহাব্বত করা হলে ইহকাল ও পরকালে কামিয়াবী লাভ করা সম্ভব হবে। সুবহানাল্লাহ।
হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বতকারীদের সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে,
عَنْ حَضْرَتْ عَلَي عَلَيْهِ السَّلَامُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اتَّبَتُكُمْ عَلَى الصِّرَاطِ أَشَدُّكُمْ حُبًّا لِأَهْلِ بَيْنِي وَلِأَصْحَابِي. ابن عدى والديلمي والصواعق المحرقة وكنز العمال)
হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণিত। নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, তোমাদের মধ্যে তারাই সঠিক পথের উপর দৃঢ় থাকতে পারবে, যারা আমার হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম এবং আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনাদেরকে সর্বাধিক মুহাব্বত করবে। সুবহানাল্লাহ! [দায়লামী ও কানযুল উম্মাল শরীফ ইত্যাদি]
পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عَنْ حَضْرَتْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي مِنْ بَعْدِي. (مشكوة)
হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে ব্যক্তি আমার পরে আমার হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের নিকট সর্বোত্তম। সুবহানাল্লাহ। [মিশকাত শরীফ, মুস্তাদরাকে হাকিম শরীফ ৩/৩৫২, মাজমাউয যাওয়ায়িদ শরীফ ৯/১৭৪ ইত্যাদি)
পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عن حَضْرَتْ عَلَى عَلَيْهِ السَّلامُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَرْبَعَةٌ أَنَا لَهُمْ شَفِيعٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُكْرِمُ لِذُرِّيَتِي وَالْقَاضِي لَهُمْ حَوَائِجَهُمْ وَالسَّاعِى لَهُمْ فِي أُمُورِهِمْ عِنْدَ مَا اضْطَرُّوا إِلَيْهِ وَالْمُحِبُّ لَهُمْ بِقَلْبِهِ وَلِسَانِهِ.
হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমি কিয়ামতের দিন চার শ্রেণীর লোকদের জন্য সুপারিশ করবো। এক, যারা আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে সম্মান করবে। দুই, যারা আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মালী তথা আর্থিকভাবে খিদমতের আনজাম দিবে। তিন, যারা আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে জান দিয়ে তথা শারীরিকভাবে খিদমতের আনজাম দিবে। চার, যারা আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে অন্তরে মুহাব্বত করবে এবং জবানে উনাদের ছানা-ছিফত মুবারক বর্ণনা করবে। [জামিউল আহাদীছ ৪/২২৯, জামউল জাওয়ামি, সুবুলুল হুদা ওয়ার রশাদ ৭/১১, দায়লামী শরীফ]
অর্থাৎ হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে যারা সর্বদিক থেকে মুহাব্বত করবেন উনারা দুনিয়াতে সঠিক পথে থাকতে পারবেন এবং কিয়ামতের দিন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শাফায়াত বা সুপারিশ মুবারক লাভ করবেন। সুবহানাল্লাহ!
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
عن حضرت ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ الله تعالى عنه قال قال النبي صل اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حُبُّ آل محمد صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا خَيْرٌ مِّنْ عبادة سنةٍ وَمَنْ مَاتَ عَلَيْهِ دخل الجنَّة، (مفتاح النجاة)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, একদিন সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মুহাব্বত করা সারা বছর ইবাদত-বন্দেগী করার চেয়েও উত্তম। আর যে উনাদের পবিত্র মুহাব্বত মুবারক উনার উপর ইন্তেকাল করলো, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সুবহানাল্লাহ। [মিফতাহুন নাজাহ]
পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে-
عن حضرت جرير بن عبد الله البجَلِي رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ الله صلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ مَاتَ على حب آل مُحَمَّدٍ صلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَاتَ شَهِيدًا، أَلا وَمَنْ مَاتَ عَلَى حُبِّ ال مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَاتَ مَغْفُورًا له. أَلا وَمَنْ مَاتَ عَلَى حب آل مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَاتَ ثَالِبًا، أَلَا وَمَنْ مَاتَ عَلَى حب آلِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَاتَ مُؤْمِنًا مُسْتَكْمِل الْإِيْمَانِ. أَلا وَمَنْ مَاتَ عَلَى حُبِّ آلِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
ومن مات بشره ملك الموت بالجنة ثم منكر ونكير الا. الجنة كما ترف الْعَرُوسُ إلى بيت زوجها الا وَمَنْ مَاتَ على حب آل محمد صلى الله عليه وسلم فتح الله له في قبره نابين إلى الجنَّة، ألا ومن مات على حب الى محمد صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَعَلَ اللَّهُ قَبْرَهُ مَزَارَ ملائِكَةِ الرَّحْمَةِ، أَلا وَمَنْ مَاتَ عَلى حُبِّ آلِ مُحَمَّدٍ صلى الله . بعض ال وَمَنْ مَاتَ على ومسلم مات على السنة والجماعة الا و م جاء يوم الْقِيَامَةِ مَكْتُوبًا بَيْنَ عَيْنَيْهِ أَيسَ عليه وسلم . مُحَمَّدٍ صلى الله من رَحْمَةِ اللَّهِ أَلا وَمَنْ مَاتَ عَلَى بَعْضٍ آلِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَاتَ كَافِرًا أَلَا وَمَنْ مَاتَ عَلَى بُعْضٍ آلِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَشْمُ رَائِحَةِ الْجَنَّةِ.
হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ বাজালী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যিনি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন, তিনি শহীদ হিসাবে ইন্তেকাল করবেন। সাবধান। যিনি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন, তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে ইন্তেকাল করবেন। সাবধান। যিনি হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন, তিনি তওবাকারী হিসেবে ইন্তেকাল করবেন। সাবধান। যিনি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন, তিনি পরিপূর্ণ ঈমানদার হিসেবে ইন্তেকাল করবেন। সাবধান। যিনি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন,
উনাকে মালাকুল মউত আলাইহিস সালাম, হযরত মুনকার ও নকীর আলাইহিমাস সালাম উনারা সম্মানিত বেহেশতের সুসংবাদ মুবারক দিবেন। সাবধান! যিনি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন, উনাকে এমনভাবে সুসজ্জিত করে জান্নাতে নেয়া হবে, যেমনভাবে নববধূকে সাজিয়ে তার স্বামীর ঘরে নেয়া হয়। সাবধান! যিনি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন, উনার কবরে সম্মানিত জান্নাতের দিকে দু'টি দরজা খুলে দেয়া হবে। সাবধান! যিনি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি তার কবরকে সম্মানিত রহমতের ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের যিয়ারতের স্থান বানাবেন। সাবধান। যিনি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন, তিনি আহলু সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্কাঈদের উপর ইন্তেকাল করবেন। সুবহানাল্লাহ! সাবধান! আর যে ব্যক্তি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ উনাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে মারা যাবে, কিয়ামতের দিন তার দুই চোখের মাঝখানে লিখা থাকবে যে, সে মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র রহমত থেকে বঞ্চিত। নাউযুবিল্লাহ! সাবধান! যে ব্যক্তি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে মারা যাবে, সে কাফির অবস্থায় মারা যাবে। নাউযুবিল্লাহ! সাবধান! যে ব্যক্তি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে মারা যাবে, সে সম্মানিত জান্নাত উনার ঘ্রাণ পর্যন্ত পাবে না। নাউযুবিল্লাহ! [তাফসীরে কুরতুবী ১৬/২৩, তাফসীরে কবীর ২৭/৫৯৫, তাফসীরে হাক্কী ১৩/৭৯, তাফসীরে রুহুল বয়ান ৮/২৩৯, তাখরীজু আহাদীছুল কাশশাফ ৩/২৩৮, নুজহাতুল মাজালিস ১/৩৬৫]
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করবেন,
• তিনি শহীদী মৃত্যু পাবেন।
• তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে ইন্তেকাল করবেন।
• তিনি তওবাকারী হিসেবে ইন্তেকাল করবেন।
• তিনি পরিপূর্ণ ঈমানদার হিসেবে ইন্তেকাল করবেন।
• উনাকে মালাকুল মউত আলাইহিস সালাম, হযরত মুনকার ও নকীর আলাইহিমাস সালাম উনারা সম্মানিত বেহেশতের সুসংবাদ মুবারক দিবেন।
• উনাকে নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত করে জান্নাতে নেয়া হবে
• উনার কবরে সম্মানিত জান্নাত উনার দিক থেকে দু'টি দরজা খুলে দেয়া হবে।
• মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার কবরকে সম্মানিত রহমতের ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের যিয়ারতের স্থান বানাবেন।
• তিনি সম্মানিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত উনার আক্বাইদের উপরই ইন্তেকাল করবেন। সুবহানাল্লাহ।
হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারকে ইন্তেকাল করলে উপরোক্ত নিয়ামতসমূহ লাভ করা যায়; কেউ যদি জীবিত অবস্থায় হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মুহাব্বত না করে, উনাদের খিদমত মুবারকের আনজাম না দেয়, তাহলে সে কি ইন্তেকালের সময় উনাদের মুহাব্বত অন্তরে রাখতে পারবে? কখনোই নয়। হ্যাঁ, যদি জীবিত অবস্থায় হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মুহাব্বত করে, উনাদের খিদমত মুবারকের আনজাম দেয়, তাহলে তার জন্য উভয়কালেই কামিয়াবী থাকবে। সে ইন্তেকালের সময়ও উনাদের মুহাব্বত অন্তরে রাখতে পারবে। ইনশাআল্লাহ।
আর যারা হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সুমহান মর্যাদা-সম্মান মুবারক রক্ষা করবে না, উনাদেরকে মুহাব্বত করবে না বরং উনাদের প্রতি অসম্মান বা বেয়াদবীমূলক আচরণ করবে, উনাদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করবে; তাদের পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। তারা মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত থেকে বঞ্চিত হবে, ঈমানহারা হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে এবং পরকালে তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। নাউযুবিল্লাহ।
পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عَنْ أَبِي سَعِيدِدِ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَبْغَضَنَا أَهْلَ الْبَيْتِ فَهُوَ مُنَافِقٌ.
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যারা আমার হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের বিরোধিতা করে, উনাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, তারা মুনাফিক।
[দুররুল মানছুর ১৩/১৫১, ফাযায়িলু ছাহাবা লিআহমদ ইবনে হাম্বল ২/৬৬১, আর রিয়াদুন নাম্বরা ১/৩৬২, যখায়েরুল উকবা ১/১৮]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
لَوْ أَنَّ رَجُلًا صَعِدَ بَيْنَ الرَّكْنِ وَالْمَقَامِ فَصَلَّى وَصَامَ ثُمَّ مَاتَ وَهُوَ مبْغِضُ لِأَهْلِ بَيْتِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَخَلَ النَّارَ.
যদি কোনো ব্যক্তি সম্মানিত রুকনে ইয়ামিন ও পবিত্র মাক্কামে ইবরাহীমে আরোহণ করে অতঃপর সে নামায পড়ে এবং রোযা রাখে কিন্তু সে সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করে, চু-চেরা কীল-কাল করে তবে সে নিশ্চিত জাহান্নামে প্রবেশ করবে। নাউযুবিল্লাহ!
[তাফসীরে রুহুল বয়ান]
উপরোক্ত বর্ণনাগুলো থেকে বুঝা যায় যে, হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার পরিণাম কতো ভয়াবহ!
অতএব, সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য ফরযে আইন হচ্ছে সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের প্রতি ঈমান আনা, উনাদেরকে মুহাব্বত করা, তা'যীম-তাকরীম করা, উনাদের সম্মানিত খিদমত মুবারকের আনজাম দেয়া। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সবাইকে ছহীহ সমঝ দান করুন এবং হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের আদর্শ মুতাবিক জীবন গড়ে হাক্বীক্বী মুসলমান হওয়ার তাওফীক দান করুন। (আমীন)
ঐশ্বর্যে লালিত আরাবী দুলাল -পর্ব-৫৪
হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, পিতা-মাতার পরম আদর আর ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত মক্কা শরীফের অন্যতম সুদর্শন যুবক ছিলেন তিনি। মা সম্পদশালী হওয়ার কারণে অত্যন্ত ভোগ বিলাসের মধ্যে উনাকে প্রতিপালন করে। তখনকার যুগে মক্কা শরীফের যত রকমের চমৎকার পোশাক ও উৎকৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সামনে কোনভাবে উনার প্রসঙ্গ উঠলে বলতেন, "মক্কা শরীফে মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোশাকধারী আর কেউ ছিল না।” ঐতিহাসিকরা বলেছেন, "তিনি ছিলেন মক্কা শরীফের সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারকারী।”
মক্কার অলিতে গলিতে কুরাইশগণের আড্ডায়, পরামর্শ সভায় তখন একই আলোচনা- আল আমীন মুহাম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উনার নতুন দ্বীন আল ইসলাম। কুরাইশগণের এই আদুরে দুলাল এসব আলোচনা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনতেন। অল্প বয়সী হওয়া সত্ত্বেও তিনি হতেন কুরাইশগণের সকল বৈঠক ও মজলিসের শোভা ও মধ্যমণি। তাদের প্রতিটি বৈঠকে সবার কাম্য হতো উনার উপস্থিতি। তীক্ষ্ম মেধা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্ব ছিল উনার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর এ বৈশিষ্ট্য উনার হৃদয়ের সকল দ্বার, সকল অর্গল উন্মুক্ত করে দেয়।
তিনি শুনতে পেলেন, রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উনার প্রতি বিশ্বাসীরা কুরাইশদের সকল অর্থহীন কাজ ও তাদের যুলুম অত্যাচার থেকে দূরে থাকার উদ্দেশ্যে সেই সাফা পাহাড়ের পাদদেশে আল আরকাম ইবনে আবিল আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বাড়িতে সমবেত হন। সব দ্বিধা, সব দ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে একদিন সন্ধ্যায় তিনি হাযির হলেন দারুল আরকামে। রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই দিনগুলোতে সেখানে উনার সাথীদের সঙ্গে মিলিত হতেন, উনাদেরকে কুরআন শরীফ শিক্ষা দিতেন এবং উনাদের সাথে নামায আদায় করতেন।
মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দারুল আরকামে বসতে না বসতেই আয়াত শরীফ নাযিল হলো। রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যবান মুবারক থেকে নিঃসৃত সেই আয়াত শরীফ যেন সকল শ্রোতার কর্ণকুহরে ও হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে লাগলো। সেই বরকতময় সন্ধ্যায় ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও হয়ে গেলেন এক বিশ্বাসী অন্তঃকরণের অধিকারী। খুশি ও আনন্দে তিনি আত্মহারা হয়ে পড়লেন।
রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একটি পবিত্র হাত মুবারক বাড়িয়ে দিলেন মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বুকের ওপর। দারুণ এক প্রশান্তিতে বিভোর হয়ে পড়েন মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। মূহুর্তে তিনি উনার বয়সের তুলনায় বহুগুণ বেশি হিকমত ও জ্ঞান লাভ করলেন এবং এমন দৃঢ়তা অর্জন করলেন যে, হাজারো বিপদ মুছীবত উনাকে কোনদিন বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি।
হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আম্মা খুনাস বিনতু মালিক ছিল এক প্রচন্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। তিনি উনার আম্মাকে খুব ভয় করতেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ধরাপৃষ্ঠে একমাত্র উনার মা ছাড়া আর কাউকে ভয় পেতেন না। কুরাইশ ও তাদের দেব-দেবী সহ সকল শক্তি উনার কাছে ছিল তুচ্ছ। কিন্তু মায়ের ভয় দূর হচ্ছিলো না। তাই মহান আল্লাহ পাক উনার চূড়ান্ত ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণের সংবাদটি চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
দারুল আরকামে যাতায়াত চলতে লাগলো। তিনি রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মজলিসে বসতে লাগলেন। কিন্তু উনার মা কিছুই জানতে পারলো না।
একদিন গোপনে তিনি দারুল আরকামে প্রবেশ করছেন, সে সময় উসমান ইবনে তালহা তা দেখে ফেললো। আরেক দিন তিনি হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মতো নামায পড়ছেন। সেদিনও তা উসমানের চোখে পড়ে যায়। বাতাসের আগে খবরটি মক্কা শরীফের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লো। উনার মায়ের কানেও খবরটি পৌঁছে গেল।
উনার মা, বংশের লোকজন ও মক্কা শরীফের নেতৃবৃন্দের সামনে উনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালো। তিনি অত্যন্ত স্থির বিশ্বাস ও প্রশান্ত চিত্তে তাদেরকে পাঠ করে শুনাতে লাগলেন পবিত্র কুরআন শরীফের সেই মহাবাণী যার ওপর তিনি ঈমান এনেছেন। উনার মা উনাকে চপেটাঘাত করে চুপ করিয়ে দিতে চাইলো। বকাঝকা, মারপিট চললো। তারপর উনাকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হলো।
তিনি বন্দী অবস্থায় দিন কাটাতে লাগলেন। রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা উনাকে পাহারা দেয়া হতো। এর মধ্যে তিনি খবর পেলেন উনারই মত কিছু মযলুম মু'মিন মুসলমান হাবশায় হিজরত করছেন। তিনি মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে সেই দলটির সাথে হাবশায় চলে গেলেন।
কিছুদিন হাবশায় থাকার পর তিনি পবিত্র মক্কা শরীফে ফিরে এলেন। তারপর রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নির্দেশে আরেকটি দলকে সঙ্গে করে হাবশায় চলে যান। কিন্তু হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি পবিত্র মক্কা শরীফে কিংবা হাবশায় যেখানেই থাকুন না কেন জীবন উনার নতুন রূপ ধারণ করেছে। উনার একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ হচ্ছেন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং একমাত্র কাম্য মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি মুবারক।
একদিন মুসলমানদের একটি দল রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করতে উৎসাহিত করছেন, তিনি তাদের উপাস্য দেব দেবীকে গালাগালও করছেন। এসব ভেবে রেগে আগুন হয়ে উনাকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে আসলেন, উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার এ রণমূর্তি দেখে হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পাশে বসা লোকেরা ভয় পেয়ে গেলেন।
কিন্তু না, হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি তো উনাকে ভয় পেলেনই না বরং সহাস্যে উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে স্বাগতম জানালেন। হাসতে হাসতে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তখন উনাকে ও আসআদ ইবনে যারারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনারা আমাদের গোত্রীয় এলাকায় এসে এভাবে আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাচ্ছেন কেন? যদি আপনাদের মারা যাওয়ার শখ না থাকে তাহলে আমাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে যান।
একথা শুনে হাসতে হাসতে মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে বললেন, "আপনি কি একটু বসে আমার কথা শুনবেন না? আমার কথা শুনুন। ভালো লাগলে মানবেন, ভালো না লাগলে আমরা চলে যাবো।"
উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন একজন বুদ্ধিমান লোক। এই কথাটা উনার মনে লাগলো। এ তো বুদ্ধিমানের কথা! শুনতে আপত্তি কিসের! তিনি অস্ত্র ফেলে মাটিতে বসে কান লাগিয়ে হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কথা শুনতে লাগলেন।
হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে পবিত্র দ্বীন নিয়ে এসেছেন সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা করছেন, আর এদিকে উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মুখমন্ডল একটু একটু করে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠছে। হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বক্তব্য এখনও শেষ করতে পারেননি, এর মধ্যে উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও তার সঙ্গী লোকটি বলে বসলো, এ তো খুব চমৎকার ও সত্য কথা। আপনাদের দ্বীনে প্রবেশ করতে গেলে কি করতে হয়? হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, শরীর ও পোশাক পবিত্র করে "লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম" এই সাক্ষ্য দিতে হয়।
উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উঠে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে এলেন তখন উনার মাথার চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, "আশহাদু আল্লাহ ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসূলুহু।"
এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো, সাদ ইবনে মুয়াজ ও সাদ ইবনে উবাদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা ছুটে এলেন হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে। উনারা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এসব নেতৃবৃন্দের ইসলাম গ্রহণের পর সাধারণ মদীনাবাসী বলাবলি করতে লাগলেন, আমরা পেছনে পড়ে থাকবো কেন! চলো, মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে যাই, পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করি। এভাবেই হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি মহান আল্লাহ পাক প্রদত্ত বুদ্ধি, মেধা ও মহৎ চরিত্রের সাহায্যে মদীনাবাসীদের হৃদয়ের সাথে সংলাপ করেন। ফলে উনারা দলে দলে মহান আল্লাহ পাক উনার দ্বীনে প্রবেশ করেন।
হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পবিত্র মদীনা শরীফে আসার পূর্বে সেখান থেকে মাত্র বারো জন লোক আকাবায় এসে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি পবিত্র মদীনা শরীফে আসার পর কয়েক মাস যেতে না যেতেই বহু মানুষ উনার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী হজ্জ মওসুমে মদীনাবাসী মুসলমানদের বাহাত্তর জনের একটি প্রতিনিধি দল, উনাদের যিনি ধর্মীয় শিক্ষক ও নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রেরিত দূত হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সাথে পবিত্র মক্কা শরীফে এসে আকাবায় রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে মিলিত হন।
যখন ওহুদ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। তখন হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হাত মুবারকে ছিল ইসলামের পতাকা। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর প্রচন্ড আঘাতে উনার ডান হাত কেটে যায়। এরপর তিনি বাম হাত দিয়ে ইসলামের পতাকা উড্ডীন রাখেন। একটু পরে বাম হাতও কাটা যায়। দু'হাত কাটা যাওয়ার পর দুই হাতের অবশিষ্টাংশ দিয়ে ইসলামের পতাকা বুকে ধরে রাখলেন তিনি। যতক্ষণ প্রাণ ছিল ইসলামের ঝান্ডা মাটিতে পড়তে দেননি। অবশেষে শত্রু পক্ষের তীরের আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। সুবহানাল্লাহ!
তিনি উনার দুনিয়াবী যিন্দেগীর আরাম, আয়েশ, সুখ, প্রভাব-প্রতিপত্তি সব অকাতরে ত্যাগ করেছেন শুধু মহান আল্লাহ পাক ও উনার প্রিয়তম হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুহাব্বতে। দ্বীন ইসলাম উনার ঝান্ডা বুলন্দ করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত কুরবান করে দিয়ে গিয়েছেন। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা এভাবেই উনাদের শত সহস্র ত্যাগের বিনিময়ে, বুকের তাজা খুন ঝরিয়ে আমাদের জন্য দ্বীনের পথকে মসৃণ করে এক স্বর্ণালী যুগ রচনা করে দিয়ে গিয়েছিলেন।