১০০টি চমৎকার ঘটনা - পর্ব-২৭ ( সূক্ষ্মদর্শী ইমাম )

সূক্ষ্মদর্শী ইমাম-পর্ব-২৭

আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের বারোজন ইমামের মাঝে হযরত ইমাম মুহম্মদ তক্কী আলাইহিস সালাম তিনি ছিলেন নবম, তাই উনাকে হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম বলা হয়। সকলের মাঝে তিনি হযরত ইমাম মুহম্মদ জাওয়াদ আলাইহিস সালাম হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তবে উনার আসল নাম সাইয়্যিদুনা হযরত মুহম্মদ আলাইহিস সালাম।

একদিন, তিনি বাগদাদের এক গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন কিছু বালক সেখানে খেলাধূলা করছিল। হঠাৎ তৎকালীন খলীফা মামুনুর রশীদ সে পথ দিয়ে গমন করলো, তখন সকল বালকরা (মামুনুর রশীদকে দেখে ভয়ে পথ ছেড়ে) পালিয়ে গেলো। কিন্তু হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনি স্বস্থানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন উনার বয়স ছিল ৯ বছর অথবা ১৪ বছর। যাহোক, ছোট্ট এক বালক উনার এভাবে অবিচল ও নির্ভিক চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে খলীফা মামুনুর রশীদ বালক ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনার কাছে আসলো। খালিক মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি মামুনুর রশীদের অন্তরে হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনার প্রতি মুহাব্বত ঢেলে দিলেন। তখন মামুনুর রশীদ বললো, হে বালক! কোন জিনিস আপনাকে চলে যেতে নিষেধ করলো? অর্থাৎ আমাকে দেখার সাথে সাথে অন্য সকল বালকরা দৌড়ে পালালো অথচ আপনি স্বস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তার কারণ কি? হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনি সাথে সাথে অতি দ্রুত জাওয়াব দিলেন, "হে আমীরুল মু'মিনীন! পথ সংকীর্ণ নয় যে, আমি সরে গিয়ে আপনার পথ প্রশস্ত করে দিবো। আর আমি কোনো অপরাধও করিনি যে আপনাকে ভয় পাবো। আপনার প্রতি আমার সুধারণা রয়েছে যে, আপনি বিনা অপরাধে কাউকে শাস্তি দেন না।" উনার কথা-বার্তা এবং উনার সুন্দর চেহারা মামুনুর রশীদকে অভিভূত করলো। তখন মামুনুর রশীদ হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনার নাম কি? আপনার পিতার নাম কি?

তিনি বললেন, "আমি হচ্ছি মুহম্মদ ইবনে আলী রিযা আলাইহিস সালাম"। অর্থাৎ হযরত ইমাম আলী রিযা আলাইহিস সালাম উনার ছেলে মুহম্মদ তক্কী (আলাইহিস সালাম)। খলীফা উনার নাম শুনে বুঝে ফেললো যে উনার পিতা হচ্ছেন, আহলু বাইত শরীফ উনাদের অষ্টম ইমাম, হযরত আলী রিযা আলাইহিস সালাম; যিনি হযরত ইমামুছ ছামিন আলাইহিস সালাম হিসেবে সকলের নিকট সুপরিচিত। তখন মামুনুর রশীদ উনার আব্বাজান আলাইহিস সালাম উনার ব্যাপারে সহানুভূতি প্রকাশ করলো এবং উনার বদান্যতার বিষয় বর্ণনা করলো।

খলীফা মামুনুর রশীদের নিকট অনেক শিকারী বাজপাখি ছিল। যখন সে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনার কাছ থেকে চলে গেলো তখন তার একটি বাজ পাখিকে শিকারের জন্য ছেড়ে দিলো। বাজ পাখিটি অদৃশ্য হয়ে গেলো। অতঃপর বাজ পাখিটি তার চঞ্চুতে করে (থাবায় করে) সমুদ্র থেকে একটি অর্ধ জীবিত ছোট মাছ নিয়ে ফিরে আসলো। মামুনুর রশীদ এটা নিয়ে পূর্বের জায়গায় প্রত্যাবর্তন করলো। সে এসে দেখলো, বালকগুলো তখনও আগের অবস্থায়ই আছে এবং সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনিও তখন পর্যন্ত তাদের কাছেই অবস্থান করছেন। (মামুনুর রশীদকে দেখে) বালকগুলো আবার ভয়ে পালিয়ে গেলো। কিন্তু ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনি একইভাবে স্বস্থানে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন মামুনুর রশীদ হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনার নিকটবর্তী হলো এবং উনাকে উদ্দেশ্য করে বললো, (বলুন তো) আমার হাতে কি? জবাবে তিনি বললেন, হে আমীরুল মু'মিনীন! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার কুদরতে সমুদ্রে এক প্রকার ছোট মাছ সৃষ্টি করেছেন। যেই মাছগুলো রাজা-বাদশাহ ও খলীফাদের বাজপাখীরা শিকার করে থাকে আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সদস্যগণ উনারা সে বিষয়ে সংবাদ দিয়ে থাকেন। সুবহানাল্লাহ! তখন মামুনুর রশীদ বললো যে, আপনি সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছামিন আলাইহিস সালাম উনার যোগ্যতম আওলাদ। সুবহানাল্লাহ! তারপর মামুনুর রশীদ হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে নিয়ে গেলো, উনার সাথে অনেক উত্তম ব্যবহার করলো এবং উনাকে অনেক তা'যীম-তাকরীম করলো। কখনও উনার প্রতি তার উত্তম ব্যবহারে ত্রুটি ঘটেনি।

সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনার বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও যখন উনার শান-মান, ফাযায়িল-ফযীলত, বুযুর্গী-সম্মান, সম্মানিত ইলম মুবারকের পরিপূর্ণ আযমত বা শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণসমূহ ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেলো, তখন মামুনুর রশীদ তার আওলাদ হযরত উম্মুল ফযল আলাইহাস সালাম উনাকে হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনার সাথে শাদী বা সম্মানিত নিসবতে আযীম শরীফ দেয়ার জন্য সংকল্প করলো এবং এ বিষয়ে দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করলো।

তখন আব্বাসীয়রা খলীফা মামুনুর রশীদকে বাধা দিলো। মামুনুর রশীদ যখন তাদের সাথে আলোচনা করলো যে, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনাকে সে এজন্য পছন্দ করেছে যে, উনার সম্মানিত বয়স মুবারক অল্প হওয়া সত্ত্বেও তিনি সম্মানিত ইলম মুবারক, সম্মানিত মা'রিফাত মুবারক, বিচক্ষণতা ও ধৈর্য্যশীলতার দিক থেকে পরিপূর্ণ মর্যাদার অধিকারী। সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনি যে এই সকল সম্মানিত ছিফত মুবারক বা বৈশিষ্ট্য মুবারক উনাদের অধিকারী এ বিষয়ে তারা বিরোধীতা করলো। তখন তারা পরষ্পর ওয়াদা করলো যে, তারা এমন এক ব্যক্তিকে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনার নিকট প্রেরণ করবে, যে উনাকে পরীক্ষা করবে। তাই তারা হযরত ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনাকে প্রেরণ করলো। আর তারা উনাকে অনেক বিষয়ের প্রতিশ্রুতি দিলো এইজন্য যে, যেন তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনাকে কথা দিয়ে আটকিয়ে দিতে পারেন। তারপর আব্বাসীয়রা হযরত ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং খিলাফতের বিশেষ ব্যক্তিদেরসহ মামুনুর রশীদের নিকট উপস্থিত হলো।

তখন মামুনুর রশীদ সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনার জন্য একখানা বিছানা বা আসনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলো। সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনি সেখানে সম্মানিত তাশরীফ মুবারক নিলেন। তারপর হযরত ইয়াহইয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনাকে অনেক মাসয়ালা-মাসায়িল জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি অতি উত্তমভাবে সে সকল মাসয়ালা-মাসায়িলের জবাব দিলেন এবং সেগুলো ব্যাখ্যা করে হযরত ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বুঝিয়ে দিলেন।

হযরত ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, হে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম। সম্মানিত ও পবিত্র হজ্জ মুবারক উনার সময় পশু শিকার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সেই ইহরামকারীর ব্যাপারে আপনার কি বক্তব্য, যে ব্যক্তি কোনো শিকার হত্যা করেছে তথা পশু শিকার করেছে?

সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, শিকারটিকে হেরেম শরীফের (কাবা শরীফের চারপাশের নিষিদ্ধ সীমার) বাইরে হত্যা করেছে নাকি মধ্যে? সে মাসয়ালা জানতো নাকি অজ্ঞ ছিল? ইচ্ছাকৃত হত্যা করেছে নাকি ভুলবশত? সেই ইহরামকারী গোলাম ছিল নাকি আযাদ (মুক্ত) ছিল? ছোট (নাবালেগ) ছিল নাকি বড় (বালেগ) ছিল? এটা তার প্রথম শিকার ছিল নাকি ইতিপূর্বেও সে শিকার করেছিল? শিকারটি কি পাখী ছিল নাকি অন্য কিছু? ছোট পাখী ছিল নাকি বড় পাখী? ইহরামকারী কি পুনরায় শিকার করার জেদ পোষণ করে নাকি অনুতপ্ত? এ শিকার রাতের বেলায় পাখীদের বাসা থেকে ছিল নাকি দিনের আলোয় প্রকাশ্যে? ইহরাম হজ্জের জন্যে বেঁধে ছিল নাকি উমরার জন্যে?

উনার এসব প্রশ্ন শুনে হযরত ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি এমনভাবে হতভম্ব হয়ে গেলেন যে, উনার চেহারার মধ্যে অপারগতা ও অক্ষমতার ভাব পরিপূর্ণরূপে ফুটে উঠলো ফলে মজলিসের

উপস্থিত সবাই ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার পরাজয়ের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলো। সুবহানাল্লাহ!

তখন মামুনুর রশীদ হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনাকে বললো, আপনি অতি উত্তম জবাব মুবারক দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ। আপনি যদি ইচ্ছা মুবারক করেন, তাহলে ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করুন। উনাকে অন্তত একটি মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করুন। তখন সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনি হযরত ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বললেন, আপনি এমন ব্যক্তির ব্যাপারে কি বলেন, যে ব্যক্তি দিবসের প্রথমভাগে এক মহিলার দিকে অবৈধ দৃষ্টি দিলো। তারপর দ্বিপ্রহরের সময় উক্ত মহিলা তার জন্য হালাল হয়ে গেলো।

অতঃপর যুহরের সময় উক্ত মহিলা তার জন্য হারাম হয়ে গেলো। তারপর আছরের সময় তার জন্য সে মহিলা হালাল হয়ে গেলো। অতঃপর মাগরিবের সময় তার জন্য হারাম হয়ে গেলো। তারপর ঈশার সময় তার জন্য হালাল হয়ে গেলো। অতঃপর মধ্যরাতে তার জন্য হারাম হয়ে গেলো। তারপর ফজরের সময় তার জন্য হালাল হয়ে গেলো। জবাবে হযরত ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, আমি জানি না। তখন সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনি হযরত ইয়াহইয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সেই মহিলা হচ্ছে দাসী।

একজন অপরিচিত ব্যক্তি শাহাওয়াতের সাথে তার দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল, এটা তার জন্য হারাম। তারপর এ ব্যক্তি উক্ত দাসীকে দ্বিপ্রহরের সময় ক্রয় করলো, (তখন তার জন্য হালাল হয়ে গেলো) যুহরের সময় আযাদ করে দিলো, (তখন তার জন্য হারাম হয়ে গেলো) আছরের সময় তাকে বিবাহ করলো, (তখন তার জন্য হালাল হয়ে গেলো) আর মাগরিবের সময় তার সাথে জিহার করলো, (তখন তার জন্য হারাম হয়ে গেলো) ঈশার সময় কাফফারা আদায় করলো, (তখন তার জন্য হালাল হয়ে গেলো) আর মধ্যরাতে তাকে রেজ'য়ী তালাক দিলো (তখন তার জন্য হারাম হয়ে গেলো) এবং ফজরের সময় রজা'য়াত করলো তথা ফিরিয়ে নিলো। (তখন আবার হালাল হয়ে গেলো) সুবহানাল্লাহ! সেই মুহূর্তে মামুনুর রশীদ আব্বাসীয়দেরকে বললো, তোমরা যে বিষয়ে অবজ্ঞা করেছিলে, তোমরা কি তা বুঝতে পেরেছো? তারপর মামুনুর রশীদ ঐ মজলিসেই সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম উনাকে বলে, আমি আমার মহাসম্মানিতা বানাত সাইয়্যিদাতুনা হযরত উম্মুল ফযল আলাইহাস সালাম উনাকে আপনার নিকট সম্মানিত নিসবতে আযীম শরীফ দিতে চাই, আপনি দয়া করে কবুল করুন! সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' আলাইহিস সালাম তিনি সম্মানিত সম্মতি মুবারক প্রকাশ করেন। সুবহানাল্লাহ! তারপর ঐ মজলিসেই সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুত তাসি' মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সাইয়্যিদাতুনা হযরত উম্মুল ফষল আলাইহাস সালাম উনার সম্মানিত নিসবতে আযীম শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। সুবহানাল্লাহ!

0 Comments: