সুওয়াল : আমাদের খুলনা এলাকায় একটি মহিলা মসজিদ হওয়ার কথা ছিলো। যার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর সৌজন্যে গবেষণা কেন্দ্র, মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ-এর তরফ হতে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিলো, যা আমরাও পেয়েছিলাম। অবশ্য এ হ্যান্ডবিলের কারণে অনেক মহিলা জামায়াতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং অনেক জায়গায় মহিলা জামায়াত অনুষ্ঠিত হতো, সে জামায়াতও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এখন আমাদের আরজু হচ্ছে, আপনারা যদি সেই হ্যান্ডবিলটি আপনাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ-এ হুবহু ছাপিয়ে দিতেন, তাহলে আমরা জরুরতে সেখান থেকে নিয়ে হুবহু ছাপিয়ে প্রচার করতে পারতাম এ উদ্দেশ্যে যে, যাতে এলাকার মা-বোনেরা এবং দেশ-বিদেশের নারী সমাজ মাকরূহ তাহরীমী ও হারাম গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারেন।
জাওয়াব : আমরা আমাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর সৌজন্যে গবেষনা কেন্দ্র, মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ-এর তরফ হতে ‘মহিলাদের জামায়াতের জন্য মসজিদে যাওয়া মাকরূহ তাহরীমী’- এ শিরোনামে যে হ্যান্ডবিলটি প্রকাশ করেছিলাম, তা শুধু কোনো এলাকা বিশেষের জন্য নয়। বরং সমগ্র বিশ্বের মুসলিম নারীদেরকে মাকরূহ তাহরীমী গুনাহ থেকে এবং মসজিদে যাওয়ার কারণে যে বেপর্দা হয়, সে হারাম গুনাহ থেকে হিফাজতের জন্য। আর মহিলাদের জন্য পৃথক মসজিদে তৈরী করা বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ, এ গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকার জন্য উক্ত হ্যান্ডবিলটি দেশ বিদেশে বিলি করেছিলাম। শুধু তাই নয়, এরপরেও আমরা আমাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ-এর ১১তম সংখ্যায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত ফতওয়া প্রদান করেছি। এখন আপনাদের আরজু মোতাবেক উক্ত হ্যান্ডবিলটি হুবহু নিম্নে ছাপিয়ে দিলাম-
নারায়ে তাকবীর ৭৮৬ আল্লাহু আকবার
মহিলাদের জামায়াতের জন্য মসজিদে যাওয়া মাকরূহ তাহরীমী
(পাঁচ ওয়াক্ত, জুমুয়া ও ঈদের নামায)
মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ-এর গবেষনা কেন্দ্রের তরফ থেকে এ লিফলেট/হ্যান্ডবিল প্রকাশ করতে পারায় মহান আল্লাহ পাক উনার দরবার শরীফ-এ অসংখ্য শুকরিয়া। এর পূর্বেও আমরা অনুরূপভাবে ‘তাহাজ্জুদের নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ’ সম্বন্ধে লিফলেট প্রকাশ করেছিলাম। তা ছাড়া আমাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ পত্রিকার মাধ্যমে সব সময় ইখতেলাফী বিষয়ের উপর ফতওয়া, মাসয়ালা-মাসায়িল প্রকাশ করে থাকি। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই অর্থাৎ এর দ্বারা সমস্ত ইখতিলাফের অবসানের মাধ্যমে সকলে শরীয়তী ফায়সালা অবগত হোক এবং সাথে সাথে সমস্ত বিদয়াত, বেশরা, হারাম তথা নাজায়িয কাজের মূলোৎপাটনের দ্বারা দ্বীনে হক্ব জিন্দা হোক।
আজকাল আমাদের দেশের কোনো কোনো স্থানে মহিলাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযসহ ঈদ ও জুমুয়ার নামায মসজিদে গিয়ে জামায়াতের সাথে আদায় করতে দেখা যায়। অথচ তা আমাদের হানাফী মাযহাব মোতাবিক মাকরূহ তাহরীমী।
মহিলারা যদিও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম উনার সময় মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়তেন, তা ছিলো প্রথম যুগের ইসলামের বিশেষ ব্যবস্থা।
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিই বলেছেন, যা হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ রয়েছে যে, মহিলাদের মসজিদে জামায়াতে নামায পড়ার চেয়ে ঘরে একাকি নামায পড়া সর্বোত্তম।
আর মহিলাদের জামায়াতে নামায পড়া ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদা কোনটাই নয়। অথচ মহিলাদের জন্য পর্দা করা ফরযে আইন।
মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশের (পর্দার) ও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাদীছ শরীফ (মহিলাদের একাকি নামায পড়ার উৎসাহ)Ñএর হাদীছ শরীফ (মহিলাদের একাকী নামায পড়ার উৎসাহ)-এর প্রতি লক্ষ্য করে আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম ইজতিহাদ করত মহিলাদেরকে মসজিদে এসে জামায়াতে নামায পড়তে নিষেধ করেন। তখন কিছু সংখ্যক মহিলা উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার নিকট এসে বললেন, হে উম্মুল মু’মিনীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম মহিলাদেরকে মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন।
তখন হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম তিনি বলেন,
*
অর্থ:- “হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি মহিলাদেরকে বর্তমান অবস্থান দেখতেন, তাহলে অবশ্যই তিনি (মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে) নিষেধ করতেন।” (বুখারী শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ)
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাব ‘দুররুল মুখতার’-এর শরাহ ‘গায়াতুল আওতার’-এ বর্ণনা নিম্নরুপ :
*
অর্থ:- “মহিলাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামায, জুমুয়া ও ঈদের নামাযের জামায়াতের উপস্থিত হওয়া মাকরূহ তাহরীমী, যদিও প্রাপ্তা বয়স্কা ও বৃদ্ধা হোক, ফিতনা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায়। তাই পরবর্তী ফক্বীহগণ ফতওয়া দেন যে, মহিলাদের জামায়াতের জন্য বের হওয়া মাকরূহ তাহরীমী। অনুরূপভাবে তাহতাবী কিতাবেও উল্লেখ রয়েছে।” (গায়াতুল আওতার ১ম জি:, ২৬৩ পৃষ্ঠা।)
তদ্রƒপ ‘ফতওয়ায়ে রহিমীয়া’ কিতাবে বিশ্ববিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য ফিক্বাহর কিতাব ‘দুররুল মুখতার’-এর বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়-
*
অর্থা:- “ফক্বীহগণ ফতওয়া দিয়েছেন যে, মহিলাদের জামায়াতের জন্য মসজিদে যাওয়া মাকরূহ তাহরীমী। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামায়াত হোক অথবা ঈদ ও জুমুয়ার নামাযের জামায়াত হোক। ( যেমন, দুররুল মুখতার কিতাবে উল্লেখ রয়েছে) মহিলাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাযসহ ঈদ ও জুমুয়ার নামাযের জামায়াতে উপস্থিত হওয়া মাকরূহ তাহরীমী।” (দুররুল মুখতার, ১ম জি:, পৃষ্ঠা ৩৮৩)
ফতওয়ার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে মাত্র কয়েকটি কিতাবের ইবারত পেশ করা হলো, এগুলো ছাড়াও নিম্নোক্ত সমস্ত কিতাবসমূহে মহিলাদেরকে জামায়াতের জন্য মসজিদে যাওয়া মাকরূহ তাহরীমী বলে উল্লেখ আছে।
যেমন,
(১) উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী শরীফ,
(২) ফায়জুল বারী শরহে বুখারী শরীফ,
(৩) ফাতহুল মুলহিম শরহে মুসলিম,
(৪) বযলুল মাযহুদ শরহে আবূ দাউদ,
(৫) মিরকাত শরহে মিশকাত,
(৬) আশয়াতুল লুময়াত,
(৭) মোহাযেরে হক্ব,
(৮) দরসে তিরমীযী,
(৯) মায়ারিফে মাদানিয়া,
(১০) ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া,
(১১) তাতারখানিয়া,
(১২) বাদায়েউস সানায়ে,
(১৩) বাহরুর রায়েক,
(১৪) আল জাওহারাতুন নাইয়্যারাহ,
(১৫) আইনী শরহে হিদায়া,
(১৬) শামী,
(১৭) রদ্দুল মোহতার,
(১৮) মারাকিউল ফালাহ,
(১৯) খোলাছাতুল ফতওয়া,
(২০) শরহে বেকায়া,
(২১) ইলাউস সুনান,
(২২) হিদায়া,
(২৩) আইনুল হিদায়া,
(২৪) কুদুরী,
(২৫) ফতওয়ায়ে দেওবন্দ,
(২৬) আহসানুল ফতওয়া,
(২৭) মাদানুল হাকায়েক,
(২৮) আহসানুল মাসায়েল,
(২৯) কিফায়াতুল মুফতী,
(৩০) ফতওয়ায়ে রহীমীয়া,
৩১) ইমদাদুল আহকাম,
(৩২) মাশারিকুল আনওয়ার,
(৩৩) ফতওয়ায়ে নঈমিয়া ইত্যাদি।
শুধু এতটুকুই নয়, বরং এর উপর সমস্ত ইমাম মুজতাহিদগণ একমত হয়েছেন। যেমন, ‘ইমদাদুল আহকাম’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
*
অর্থ:- “মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতের সাথে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমী হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” (ইমদাদুল আহকাম ১ম জি:, পৃষ্ঠা ৪২৫)
হাদীছ শরীফ-এ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন,
*
অর্থ:- “তোমাদের জন্য আমার সুন্নত এবং হিদায়েত প্রাপ্ত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের সুন্নত অবশ্যই পালনীয়।” (মিশকাত শরীফ)
সুতরাং যেখানে আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার ইজতিহাদ এবং হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার সমর্থন রয়েছে এবং যার উপর সমস্ত উলামায়ে মুতাআখখিরীনগণ উনাদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, জুমুয়া ও ঈদের নামায (ঈদগাহে হলেও) পড়া মাকরূহ তাহরীমী। সেখানে মহিলাদের মসজিদে জামায়াতে নামায পড়া জায়িয বলা বা কার্যত: উৎসাহ প্রদান কর সম্পূর্ণ জিহালত, বিভ্রান্তিকর, বানোয়াট ও নফসানিয়াত, যা সম্পূর্ণই শরীয়ত বিরোধী কাজ।
যেখানে জামায়াতে জাওয়াই মাকরূহ তাহরীমী সেখানে মহিলাদের জন্য আলাদাভাবে মসজিদ তৈরি করা জায়িয হয় কি করে? মূলত মহিলাদের জন্য আলাদা বা পৃথক কোনো মসজিদ তৈরি করাও সম্পূর্ণ বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। কেননা, খাইরুল কুরুনে অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, হযরত তাবিয়ীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ এমনকি তৎপরবর্তী সময়েও মহিলাদের জন্য আলাদা বা পৃথক কোনো মসজিদ তৈরি হয়েছে বলে কোনো দলীল কেউ পেশ করতে পারবে না। কাজেই মহিলাদের জন্য আলাদা বা পৃথক মসজিদ তৈরি করা সম্পূর্ণ নাজায়িয ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফ-এ এসেছে,
*
অর্থ:- “প্রত্যেক বিদয়াতই (সাইয়্যিয়াহ) গুমরাহী ও প্রত্যেক গুমরাহ লোক জাহান্নামে যাবে।” (মিশকাত শরীফ)
অনেকে বলে থাকেন যে, অতীতে বা বর্তমানে অনেক আলেম নামধারী ব্যক্তিবর্গ মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া জায়িয বলেন এবং কার্য়ত উৎসাহ প্রদান করে থাকেন তাদের ফায়ছালা কি?
এর জবাবে সংক্ষেপে এতটুকু বললেই চলে যে, ইসলামী শরীয়তে কোনো ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র বা অধিকাংশ লোককে দলীল বা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র বা অধিকাংশ লোক কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকবে। অর্থাৎ যে কেউ ইসলামের খিদমত করলেই যে সে ইসলামের আদর্শ বা দলীল হবে তা নয়, বরং যে বিষয়ে ফতওয়া দিবে সে বিষয়ে তাকে দলীল পেশ করতে হেব। কেননা, মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন,
*
অর্থ:- “যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে দলীল পেশ করো।”
মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের প্রত্যেককে সকল শরীয়ত বিরোধী ও বিদয়াত কাজ থেকে হিফাযত করুন এবং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের উপর পরিপূর্ণ কায়িম থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন!
(বি: দ্র: ফতওয়ার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় সংক্ষিপ্ত করা হলো। প্রয়োজনে আরো বিস্তারিতভাবে ও অধিক দলীল প্রমাণসহ ফতওয়া দেয়ার সামর্থ আমরা রাখি ইনশাআল্লাহ!)
[এ প্রসঙ্গে মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ-এর ১১তম সংখ্যায় অসংখ্য ও অকাট্য দলীল দ্বারা বিস্তারিত ফতওয়া প্রকাশ করা হয়েছে।] আবা-২৯
0 Comments:
Post a Comment