( পূর্ব
প্রকাশিতের পর )
গবেষণা
কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আ’লামীন উনার এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম শরীফ মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব,
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি। মহান আল্লাহ পাক উনার রহমতে গবেষণা
কেন্দ্র,
মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ উনার ফতওয়া বিভাগ উনার তরফ থেকে “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় যথাক্রমে টুপি, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার
নামায ফরজে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের
মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে
পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ্ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া
প্রকাশ করার পর নবম ফতওয়া হিসাবে “ফরজ নামাযের পর মুনাজাত ও তার
সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” প্রকাশ করতে পারায় মহান আল্লাহ
পাক উনার দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।
আমাদের ‘মাসিক আল
বাইয়্যিনাত’ পত্রিকায় ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত ও
তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া গত দু’সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে ছাপা
হচ্ছে। গত সংখ্যায় ফতওয়ার যে অংশটুকু ছাপা হয়েছিল, বর্তমান
সংখ্যায় তার পরবর্তী অংশ ছাপা হচ্ছে। সুতরাং সম্পূর্ণ ফতওয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে
ছাপা সবগুলো সংখ্যা জরুরী।
ক্বাওলী হাদীছ শরীফ ফে’লী হাদীছ শরীফ উনার উপর অগ্রগণ্য:
মুনাজাত বিরোধীরা বলে থাকে যে, ‘ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার পক্ষে কোন সহীহ্ ফে’লী হাদীছ শরীফ নেই।’
অথচ আমরা প্রমাণ করলাম যে, ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার পক্ষে ফে’লী হাদীছ শরীফ রয়েছে। যদিও উক্ত হাদীছ শরীফখানা জঈফ। তবে কোন আমলকে মুস্তাহাব
প্রমাণ করার জন্য জঈফ হাদীছ শরীফই যে যথেষ্ট তাও প্রমাণ করা হয়েছে। যেমন ইবনে
হুমাম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতহুল
ক্বাদীর কিতাবে উল্লেখ করেন,
الاستحباب يثيت بالضعيف غير الموضوع.
অর্থঃ- “জঈফ হাদীছ শরীফ যা মওজূ নয়, তদ্বারা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়।”
তাছাড়া যদিও সম্মিলিতভাবে মুনাজাতের পক্ষে
সহীহ্ ফে’লী হাদীছ শরীফ নেই। কিন্তু সম্মিলিতভাবে মুনাজাতের পক্ষে অসংখ্য সহীহ্ ক্বাওলী
হাদীছ শরীফতো রয়েছে। আর হাদীছ শরীফ উনার উসূল মোতাবেক ক্বাওলী হাদীছ শরীফ, ফে’লী হাদীছ শরীফ উনার উপর অগ্রগণ্য।
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ করা হয় যে,
لان
المقرر عند هم ان قوله عليه السلام مقدم على فعله عليه السلام. ورجح الاول بائه
قول وهذا فعل والقول اولى لان الفعل محتمل الخصوصية والعذر وغير ذلك. (ردالمحتار ج ১ صفه ৩১৬)
অর্থঃ- কেননা উনাদের উসুল
নির্দিষ্ট রয়েছে যে, নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ক্বওল
(বাক্য) উনার ফে’ল (কর্ম) অপেক্ষা অগ্রগণ্য। আউয়ালকে অগ্রাধিকার দেয়া হলো।
কেননা তা হচ্ছে ক্বাওল (বাক্য) এবং দ্বিতীয়টা হচ্ছে ফে’ল
(কর্ম)। এবং ক্বাওল হচ্ছে উত্তম ও শক্তিশালী। কারণ ফে’ল-এর
মধ্যে অনেক প্রকার গুন্জায়েশ থাকে। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য খাছ হওয়ার বা ওজর থাকার বা অপর কোন হেতু
থাকার গুন্জায়েশ থাকে। (রদ্দুল মুহতার ১ম জিঃ পৃঃ ৩১৬)
মোটকথা হলো এই যে, ক্বওল
অর্থাৎ বাক্যের শক্তি অধিক। আর ইমাম আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনার ও ছাহেবাইনগণ উনাদের মত হলো- “যদি কখনো
ক্বওলী হাদীছ শরীফ ও ফে’লী হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে
বিপরীত মত পাওয়া যায় বা আমলের কোন ব্যাপারে ফে’লী হাদীছ
শরীফ উনার বর্ণনা না পাওয়া যায়, তবে হুকুম সাবেত হবে ক্বাওলী
হাদীছ শরীফ উনার ভিত্তিতে।” এদিক দিয়েও ফরজ নামাযের পর হাত
উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। যদিও ফরজ নামাযের পর সহীহ্
হাদীছ শরীফ দ্বারা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার ফে’ল অর্থাৎ তাসবীহ-তাহ্লীল করেছেন বলে সাবেত রয়েছে, তথাপিও ফে’ল-এর উপর ক্বওল প্রাধান্য পাবে বিধায় ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে
মুনাজাত অগ্রগণ্য। কাজেই তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করা যেমন মুস্তাহাব, তদ্রুপ ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করাও মুস্তাহাব। কারণ
এর স্বপক্ষে অসংখ্য সহীহ্ ক্বওলী হাদীছ শরীফ বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই এটাকে বিদয়াত বলা গোম্রাহী ছাড়া কিছুই নয়।
মুস্তাহাব
সর্বদা গুরুত্বের সাথে আমল
করলেও
বিদয়াত বা ফরজ হয় না
মুনাজাত বিরোধীরা বলে থাকে যে, ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা যদি মুস্তাহাব ধরে নেয়াও
হয়, তথাপি যেহেতু এটা নিয়ে ইসরার (বাড়াবাড়ি) হচ্ছে এবং জরুরী মনে করে দায়েমীভাবে
আমল করা হচ্ছে,
সেহেতু এটা বিদয়াত।
কেননা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
সুদীর্ঘ পবিত্র হায়াত মুবারকে মাত্র একবার করেছেন বলে প্রমাণিত হয়। তাই সব সময় এটা
আমল করা যাবে না। কেননা মুস্তাহাবের ভিতর কোন প্রকার বিদয়াত প্রবেশ করলে মুস্তাহাবকে তরক করা জরুরী।
মুনাজাত বিরোধীদের উক্তরূপ বক্তব্য মোটেও
গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, তারা এমন কোন প্রমাণ দেখাতে পারবে
না যে,
মুস্তাহাব সর্বদা আমল করলে তা ফরজ হয়ে যায় বা মুস্তাহাবকে
জরুরী মনে করা নাজায়েয। তবে কেউ যদি মুস্তাহাবকে ফরজ মনে করে, তবে সেটা নাজায়েয হতে পারে। এমন অনেক মুস্তাহাব রয়েছে, যা আমরা, এমনকি মুনাজাত বিরোধীরাও সর্বদা গুরুত্বের সাথে আমল করে থাকি।
‘জামিউর রুমুজ’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বিশ বৎসর যাবৎ ওযুতে
পায়ের অঙ্গুলীর উপর দিয়ে খিলাল করে নামায পড়েছিলেন। পরে যখন জানতে পারলেন যে, পায়ের আঙ্গুলের নীচে দিয়ে খিলাল করা মুস্তাহাব, তখন তিনি
বিশ বৎসরের নামায দোহরায়ে পড়েছেন। অথচ নামাযের মধ্যে কোন মুস্তাহাব তরক হলে নামায
দোহরানোর আদেশ ইসলামী শরীয়ত উনার মধ্যে নেই। তথাপিও মুস্তাহাবের গুরুত্ব বুঝাতে
গিয়ে তিনি এরূপ করেছিলেন। তবে মুস্তাহাবকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বা জরুরী মনে করে, উনি কি নাজায়েয কাজ করেছেন? কখনও নয়। এমনিভাবে মুস্তাহাবকে
সর্বদা আমল করলেও তা যেমন ফরজ হয়না, তদ্রুপ বিদয়াতও হয়না। কেননা কিতাবে উল্লেখ রয়েছে-
(১) ওযুতে গর্দান মসেহ্ করা মুস্তাহাব। সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানগণই ওযুতে
গর্দান মসেহ্ করে থাকেন। তাহলে এর দ্বারা কি গর্দান মসেহ্ করা ফরজ বুঝায়?
(২) নামাযের শাব্দিক নিয়ত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিল না। হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুম উনাদের যুগেও নয়, পরে হয়েছে। ইমামগণ এটাকে
মুস্তাহাব বলেন। আর সর্বদাই করা হয়, তাহলে এটাও কি ফরজ হয়ে যাবে? (আলমগীরী)
(৩) খুতবাতে খোলাফা-ই-রাশেদার নাম উল্লেখ করা মুস্তাহাব। আলেমগণ সব সময় তা করে
আসছেন,
তাহলে এটা কি ফরজ হয়ে যাবে?
(৪) কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করা মুস্তাহাব, সকলেই তা
গুরুত্বের সাথে আমল করে থাকেন। তবে এটাও কি ফরজ হয়ে গেল?
(৫) আওয়াবিন,
ইশরাক, চাশত, দুখুলুল
মসজিদ,
তাহিয়্যাতুল ওযু, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি নামাযসমূহ
মোস্তাহাবের অন্তর্ভূক্ত এবং অনেকে তা সর্বদাই আমল করে থাকেন। তবে কি এগুলোও
বিদয়াত?
এমনিভাবে এমন অনেক মুস্তাহাবই রয়েছে, যা আমরা সর্বদা গুরুত্বের সাথে আমল করে থাকি। সেগুলোকে তো কেউ নাজায়েয, বিদয়াত ফতওয়া দেয়নি। মূলকথা হলো- মুস্তাহাবকে যদি ফরজ মনে করা না হয় এবং তা
সর্বদা আমল করা হয়, তবে তা কখনো নাজায়েয হতে পারে না। কাজেই মুনাজাতকে কেউই
ফরজ-ওয়াজিব মনে করে না এবং কেউ বলেওনি যে, মুনাজাত
করা ফরজ। সকলেই মুনাজাতকে সুন্নত বা মুস্তাহাব বলে থাকেন। আর তাই দেখা যায়, ফরজ নামাযের পর মুনাজাতের পূর্বে অনেকেই চলে যায়। অথচ তাদেরকে বাঁধা দেওয়া হয়
না এবং মুনাজাত তরক করার কারণে তাদেরকে দোষারোপও করা হয় না। কারণ, সকলেই জানে যে, মুস্তাহাব আমল করলে সাওয়াব রয়েছে, আর না
করলে সাওয়াব নেই। কাজেই মুনাজাত নিয়ে ইসরার বা বাড়াবাড়ী কোথায়?
আর কোন আমল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একবার করলেই যে তা সব সময় আমল করা যাবেনা, এ কথার দলীল কোথায়? চামড়ার মোজাহ তো নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জীবনে মাত্র এক জোড়া, তাও কয়েকবার ব্যবহার করেছেন। অথচ অনেকে সব সময়ই তা ব্যবহার করে থাকেন। অনুরূপ
তারাবীহ নামায নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তিনি জীবনে চার (৪) দিন জামায়াতে আদায় করেছেন। অথচ আমরা সব সময় তা
জামায়াতে আদায় করে থাকি।
সুতরাং কোন বিষয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হতে যদি একবারও সাবেত থাকে, তবে সেটাই সুন্নত ও মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত আর তা ফযীলত অর্জনের লক্ষ্যে
মুস্তাহাব বা সুন্নতের নিয়তে সব সময় আমল করলেও নাজায়েয বা বিদয়াত হবে না।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত
হয় যে,
মুস্তাহাবকে সর্বদা গুরুত্বের সাথে আমল করলে তা যেমন
ফরজ-ওয়াজিব হয় না, তদ্রুপ নাজায়েয ও বিদয়াত হয় না। তবে মুস্তাহাবকে ফরজ-ওয়াজিব মনে
করা অবশ্যই নাজায়েয ও হারাম। সুতরাং উক্ত মুনাজাতকেও যদি কেউ মুস্তাহাব জেনেই
সর্বদা আমল করে,
তবে সেটা কখনো নাজায়েয ও বিদয়াত নয়। আর যদি কেউ উক্ত
মুনাজাতকে ফরজ মনে করেই, অথবা কোন প্রকার বিদয়াত প্রবেশ করেই, তবে যে
ব্যক্তি মুনাজাতকে ফরজ মনে করে, তার আক্বীদাকে সংশোধন করতে হবে এবং
মোস্তাহাবের মধ্যে প্রবেশকৃত বিদয়াতকে দুরিভূত করতে হবে। মুস্তাহাবকে তরক করা যাবে
না। কারণ আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য উসূল হলো মোস্তাহাবের মধ্যে কোন বিদয়াত বা
নাজায়েয কাজ প্রবেশ করলে, বিদয়াত বা নাজায়েয কাজকে ছেড়ে দিতে হবে, মুস্তাহাবকে তরক করা যাবে না। এর দলীল হলো- আশুরার রোজা। প্রথমতঃ আশুরার রোজা
১০ই মহররম একটি রাখার নিয়ম ছিল, কিন্তু যখন ছাহাবা-ই-কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা বললেন যে, ইহুদীরাও
১০ই মহররম একটি রোজা রেখে থাকে, তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন,
صوموا
يوم عاشورأ رخلفوا فيه اليهود وصومو اقبله يوما اوبعده يوما.
অর্থঃ- “তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ এবং তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন রোজা রেখে
ইয়াহুদীদের খেলাফ কর।”
এখানে বিদয়াত তো দূরের কথা, তাশাব্বুহ
বা হারাম হওয়া সত্বেও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম তিনি আশুরার রোজাকে বাদ দিলেন না, বরং মূল
আমলকে ঠিক রেখে তা তাশাব্বুহ দূর করে দিলেন, আরেকটি
রোজা রাখার নির্দেশ মুবারক দিয়ে। সুতরাং উক্ত মত পোষণকারীদের ক্বিয়াস দলীল
বহির্ভূত এবং বাতিল ক্বিয়াস হিসেবে পরিগণিত।
মুস্তাহাব আমল সর্বদা করার ব্যাপারে মহান আল্লাহ
পাক তিনি কালাম পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
وهم على صلو تهم ذائمون.
অর্থঃ- “তারা সর্বদা তাদের (নফল) নামায আদায় করতো।”
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় তাফসীরে
সিরাজুম মুনীর কিতাবে উল্লেখ রয়েছে,
هم الذين يكشرون
فعل التطوع.
অর্থঃ- “যারা অধিক নফল ইবাদত করেন, তারাই উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার
মধ্যে বর্ণিত মুসল্লী।”
আর মিশকাত শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত
রয়েছে,
احب الا عمال الى الله ادو مها وان قل.
অর্থঃ- “পরিমানে কম হলেও নেক কার্য (নফল) সর্বদা করা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট অধিক
প্রিয়।”
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عن
عائشة رضى الله عنها- ان رسول الله صلى الله عليه وسلم سئل- اى الا عمال احب الى
الله قال- ادومه وان قل- (رواه مسلم)
অর্থঃ- “হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার হতে বর্ণিত- নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জিজ্ঞাসা করা হলো-
কোন আমল মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট অধিক পছন্দনীয়? নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, পরিমাণে অল্প হলেও (মোস্তাহাব) নেক কার্য সর্বদা আমল করা।” (মুসলিম শরীফ)
শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ
পাক তিনি হাদীছে কুদসী শরীফ উনার মধ্যে মুস্তাহাব আমল সর্বদা করার জন্য উৎসাহিত
করেছেন। ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
لا
يزال العبد بتقرب الى بالنوافل حتى احبه فاذا احببته كنت بصره الذى يبصربه كنت
سمعه الذى يسمع به كنت لسائه الذى ينطق به كنت يده التى يبطش بها كنت رجله التى
يمشى بها. (مشكوة شريف)
অর্থঃ- “আমার বান্দাগণ সর্বদা নফল (মুস্তাহাব) আমলের দ্বারা আমার এতটুকু নৈকট্য হাসিল
করে যে,
আমি তাদেরকে মুহব্বত করি। আর আমি যখন তাদেরকে মুহব্বত করি, তখন আমি তার চোখ হয়ে যাই, সে আমার চোখে দেখে। আমি তার কান
হয়ে যাই,
সে আমার কানে শোনে। আমি তার যবান হয়ে যাই, সে আমার যবানে কথা বলে। আমি তার হাত হয়ে যাই, সে আমার
হাতে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, সে আমার পায়ে হাঁটে।” (মিশকাত শরীফ)
অর্থাৎ বান্দা মুস্তাহাব আমল সর্বদা করতে করতে
আল্লাহ পাক উনার পূর্ণ অনুগত হয়ে যায়।
সুতরাং যারা বলে মোস্তাহাবের ভিতর বিদয়াত প্রবেশ করলে মুস্তাহাব ছেড়ে দিতে হবে, তাদের একথা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, মুনাজাত
বিরোধীরা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ থেকে একটি দলীলও পেশ করতে পারবে
না যে,
মোস্তাহাবের ভিতরে বিদয়াত প্রবেশ করলে মুস্তাহাবকে ছেড়ে দিতে হবে।
বরং পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ হয়েছে,
من احدث فى امرنا هذا ماليس منه فهورد.
অর্থঃ- “যে এ দ্বীনে কোন বিদয়াতের প্রবর্তন করবে, তা
অবশ্যই পরিত্যাজ্য।”
অতএব, মোস্তাহাবের ভিতর বিদয়াত প্রবেশ করলে বিদয়াত দূর করে দিতে হবে, মুস্তাহাবকে তার স্থানে বহাল রাখতে হবে।
মোস্তাহাবের জন্যে
একত্রিত হওয়ার হুকুম:
মুনাজাত বিরোধীরা আরো বলে যে, মুনাজাত মুস্তাহাব ও নফলের অন্তর্ভূক্ত। আর নফল বা মোস্তাহাবের মধ্যে ‘তাদায়ী’-এর সাথে একত্রে আমল করা বিদয়াত। সরাসরি ডেকে একত্র করা হলো “হাক্বীকী তাদায়ী।” আর বিনা ডাকায় একত্র হয়ে যাওয়া “হুকমী
তাদায়ী”
উভয়টাই বিদয়াত।
মুনাজাত বিরোধীদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই
কাল্পনিক। কারণ নফল ইবাদত ঘোষণা দিয়ে জামায়াতে আদায় করা বিদয়াত, এটা
সর্বক্ষেত্রে নয়, কেননা আমাদের হানাফী মাযহাব মতে তারাবীহ্, ইস্তেস্কা,
কূছূফ নামায ব্যতীত সকল নফল নামায ঘোষণা দিয়ে জামায়াতে আদায়
করা বিদয়াত। যেমন তাহাজ্জুদ নামায, পবিত্র শব-ই-ক্বদর উনার নামায ইত্যাদি জামায়াতে আদায় করা বিদয়াত। কাজেই আমভাবে
যদি বলা হয় যে,
নফল মুস্তাহাব ইবাদত তাদায়ীর সাথে জামায়াতে আদায় করা বিদয়াত।
তবে তারাবীহ্ নামাযও এর অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। রমযান মাসে বিত্র নামায জামায়াতে পড়া
মুস্তাহাব,
অথচ উক্ত মুস্তাহাব ঘোষণা সহকারে জামায়াতে আদায় করা হয়।
তাহলে এটাও কি আপনাদের নিকট বিদয়াত?
তাছাড়া একত্রিত হয়ে দোয়া বা মুনাজাত করলে তা
কবুল হয় বলে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে। আর উক্ত হাদীছ শরীফ
অনুযায়ী আমল করার লক্ষ্যে একত্রিত হয়ে যদি দোয়া বা মুনাজাত করে, তবেকি সেটা বিদয়াত হবে? বিদয়াতই যদি হবে, তবে নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একত্র হয়ে
দোয়া করার কথা বললেন কেন?
এতে প্রমাণিত হয় যে, মুনাজাত
বিরোধীদের বক্তব্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনারও বিপরীত। এছাড়া আরো বহু পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে মুস্তাহাব বা নফল ইবাদত একত্রিত হয়ে করার মধ্যে ফযীলত রয়েছে বলে
বর্ণিত রয়েছে।
যেমন
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
ما
اجتمع قوم فى بيت من بيوت الله يتلون كتاب الله .... الا نزلت عليهم السكينة- الخ-
(مشكوة)
অর্থঃ- “যখন কোন গোত্রের লোক মহান আল্লাহ পাক উনার কিতাব তিলাওয়াত করার জন্য, মহান
আল্লাহ পাক উনার কোন ঘরে একত্রিত হয় ..... তখন তাদের উপর
শান্তি বর্ষিত হয়।” (মিশকাত শরীফ)
এটা সকলেরই জানা যে, পবিত্র কুরআন
শরীফ তিলাওয়াত নফল বা মুস্তাহাবের অন্তর্ভূক্ত। তবে পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের জন্যও কি একত্রিত হওয়া বিদয়াত?
পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
لايقعد
قوم يذكرون الله الا حفتهم الملائكة وغشيتهم الرحمة ونزلت عليهم السكينة. (مسلم-
ترمذى- ابن ماجه)
অর্থঃ- “যখন কোন সম্প্রদায় একত্রে বসে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির করে, সমগ্র হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তাদেরকে বেষ্টন করেন, আল্লাহ তায়ালা উনার রহমত তাদেরকে আবৃত করে ফেলে এবং তাদের উপর শান্তি বর্ষিত
হতে থাকে।”
(মুসলিম শরীফ, তিরমীযী শরীফ, ইবনে মাযাহ্)
অনুরূপভাবে একত্রে বসে দরূদ শরীফ পাঠের মজলিস
সম্বন্ধেও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তিনি বলেছেন,
ما
جلس قوم مجلسا لم يذكروا الله فيه فلم يصلوا على نبيهم الا كان عليهم ترة فان شاء
عذبهم و ان شاء غفر لهم. (تر مذى- مشكوة صفه ১৯৮ )
অর্থঃ- “কোন সম্প্রদায় যখন এরূপ কোন মজলিসে সমবেত হয়, যেখানে
তারা মহান আল্লাহ পাক উনাকে স্মরণ করেনা ও নিজেদের নবী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) উনার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করে না, তখন ঐ
মজলিস তাদের জন্য অনিষ্ট ও অমঙ্গলের কারণ হয়ে থাকে। অতঃপর মহান আল্লাহ পাক তিনি
ইচ্ছে করলে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন অথবা ইচ্ছে করলে ক্ষমা করবেন।” (তিরমীযী শরীফ, মিশ্কাত শরীফ পৃঃ ১৯৮)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
اذ
امررتم برباض الجنة فارتعرا- قالوا وما رياض الجنة قال حلق الذكر- (مشكوة شريف)
অর্থঃ- “তোমরা যখন বেহেশতের বাগানে বিচরণ করবে, তখন
সেখান থেকে কিছু ফল খেয়ে নিও। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ
উনারা বললেন,
বেহেশতের বাগান কোনটি? নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, যিকিরের সমাবেশ।” (মিশকাত শরীফ)
হযরত ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কিতাবুল
আযকার উনার ৮ম পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
اعلم انه كما يستحب الذ كر يستحب
الجلوس فى خلق اهله. (كتاب الاذكار صفه ৮)
অর্থঃ- “জেনে রাখুন,
যিকির করা যেমন মুস্তাহাব, তেমনি
যিকিরকারীগণ উনাদের মজলিসে বসাও মুস্তাহাব।”
অতএব, ফরজ
নামাযের পর দোয়া বা জিকিরের জন্য একত্রিত হওয়া মুস্তাহাব।
সুতরাং উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই
প্রমাণিত হয় যে,
সকল মুস্তাহাব বা নফল ইবাদত ঘোষণা দিয়ে বা ঘোষণা ব্যতীত
জামায়াতে আদায় করা বিদয়াত নয়। যে নফল
ইবাদত জামায়াতে আদায় করা বিদয়াত তা আমাদের ইমাম- মুজতাহিদগণ বর্ণনা করে গিয়েছেন।
নতুন করে হুকুম জারী করার দুঃসাহস মুনাজাত বিরোধীদের কে দিল?
মুনাজাত বিরোধীরা কি পারবে, এমন একখানা দলীল পেশ করতে, যেখানে উল্লেখ রয়েছে, দোয়া বা মুনাজাতের জন্য একত্রিত হওয়া বিদয়াত? মহান আল্লাহ
পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
هاتوا برهانكم انكنتم صادقين.
অর্থঃ- “তোমরা দলীল পেশ কর, যদি সত্যবাদী হয়ে থাক।”
সুতরাং দলীল না দিয়ে শুধু মনগড়া ক্বিয়াসের
মাধ্যমে কথা বললে ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। মুনাজাত বিরোধীদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই
হয়েছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল হয়েছে। মোটকথা হলো- মুনাজাতের
জন্য একত্রিত হওয়া কখনো বিদয়াত নয়। বরং
সুন্নত ও ফযীলতের কারণ এবং জায়েযতো বটেই।
খলফগণ
উনাদের আমলও অনুসরণীয়:
মুনাজাত বিরোধীরা আরো বলে থাকে যে, “কুরুনে সালাসা”-এর পরের কারো আমল দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। মুনাজাত
বিরোধীরা এটাও বলে যে, ফরজ নামাযের পর ‘ইজতেমায়ী’ দোয়া হযরত
ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনগণ তথা সলফে সালেহীনগণ উনাদের হতে সাবেত নেই। বরং এর পরবর্তী
আলেমগণের আমল,
তাই এ আমলকে তরক করা জরুরী।
মুনাজাত বিরোধীদের উক্ত বক্তব্যের জবাবে
প্রথমেই বলতে হয় যে, যেখানে ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত
স্বয়ং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
ক্বাওল ও ফে’ল দ্বারা মুস্তাহাব প্রমাণিত, সেখানে সলফে সালেহীনগণ উনাদের আমল
তার বিপরীত,
এটা কি করে মেনে নেয়া যায়? সলফে
সালেহীনগণ ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করেননি, একথার দলীল পেশ করতে পারবেন কি? অথবা তাদের কেউ উক্ত মুনাজাতকে বিদয়াতে
সাইয়্যিয়াহ্ বলেছেন, এরূপ কোন দলীল আপনাদের নিকট রয়েছে কি? মোটেও নয়। সলফে সালেহীনগণ উনাদের আমল ইসলামী শরীয়ত উনার অকাট্য দলীল এবং তারা
অনুসরণীয়,
এটা অবশ্যই সর্বজন স্বীকৃত। তবে সলফে সালেহীনগণ উনাদের পরের
কারোর আমল ইসলামী শরীয়ত উনার দলীল নয় এবং উনারা অনুসরণীয় নয়, একথা মোটেও শুদ্ধ নয়। কেননা ফিক্বাহ্ শাস্ত্রের নিয়ম মোতাবেক সপ্তম তবকার
মধ্যে ষষ্ঠ তবকা পর্যন্ত প্রত্যেক ফক্বীহ ও মুজতাহিদগণ উনাদের আমল ইসলামী শরীয়ত
উনার দলীল এবং প্রত্যেকেই অনুসরণীয়। যেমন সপ্তম তবকা সম্পর্কে কিতাবে উল্লেখ
রয়েছে-
১। প্রথম তবকা মুজতাহিদ ফিদ দ্বীন: উনারাই সর্বোচ্চস্তরের ফুক্বাহা।
উনারা স্বাধীনভাবে ইজতিহাদ করেছেন। কারোও কোন নির্ধারিত নীতি-শৃঙ্খলা দ্বারা উনারা
আবদ্ধ ছিলেন না। উনারা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকে সামনে রেখে ইজতিহাদ
করেছেন এবং প্রয়োজনমাফিক পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ হতে ইজতিহাদের
নীতি নির্ধারণ করেছেন। অন্যান্য ফক্বীহগণ উনাদের নির্ধারিত নীতি অনুসরণ করে ইজতিহাদ
করেছেন। উনাদের মুজতাহিদে মুতলাকও বলা হয়। ইমাম আ’যম হযরত আবু হানীফা রহমতুল্লাহি
আলাইহি,
ইমাম মালিক
রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম শাফী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ উনারা এই তবকার অন্তর্ভূক্ত
ছিলেন।
২। দ্বিতীয় তবকা মুজতাহিদ
ফীল মাযহাব : উনারাও মুজতাহিদে মুতলাক বা
মাযহাবের প্রবর্তক ইমাম উনাদের ন্যায় ইজতিহাদে পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন। উনারা অবশ্য মাযহাবের প্রবর্তক ইমামদের নির্ধারিত নীতি
অনুসরণ করে ইজতিহাদ করতেন, তবে রায় দানে সম্পূর্ণ স্বাধীন
ছিলেন। সেখানে তাদের তাক্লীদের অস্তিত্ব ছিল না। শুধু যোগাযোগের সম্পর্ক ছিল, অর্থাৎ মুজতাহিদ ফীল মাযহাব তবকার ফক্বীহগণ ইজতিহাদে মাযহাবের ইমামগণ উনাদের নীতি অনুসরণ
করতেন এবং স্বাধীন মতবাদ পোষণ করতেন। অতএব মাসয়ালার বিশ্লেষণে ও ব্যাখ্যায় উনারা
অনেক ক্ষেত্রে মাযহাবের প্রবর্তক ইমামগণ
উনাদের সাথে মতভেদ করলেও মাসয়ালা ইস্তিনবাতের নীতিতে উনারা একমত ছিলেন। যেমন
হানাফী মাযহাবে হযরত ইমাম আবু ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম
যুফার রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম মুহাম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি
ও তাদের সমসাময়িক ফক্বীহগণ।
৩। তৃতীয় তবকা মুজতাহিদ
ফীল মাসায়েল: মুজতাহিদ ফিদ দ্বীন ইমামগণ
কর্তৃক ইস্তিনবাতকৃত আহকামে ইমামগণ যে সকল নীতি ইখতিয়ার করেছেন, সেই সকল নীতি বর্ণনার ব্যাপারে যাঁরা ইজতিহাদ করতেন এবং সেই আলোকে
মাসয়ালাসমূহকে শাখা-প্রশাখায় বিন্যস্ত করতেন, উনাদেরকে
মুজতাহিদ ফীল মাসায়েল বলা হতো। উনারা ইমামগণের নীতি বর্ণনার ব্যাপারে ইজতিহাদ করতেন।
কিন্তু কোন বিশেষ মাসয়ালায় বা বিশেষ কোন ক্ষেত্রে ইমামগণ যদি কোন নীতি নির্দেশ না
দিয়ে থাকতেন,
তবে সেখানে উনারা স্বাধীনভাবে প্রত্যক্ষ ইজতিহাদ করতেন।
ইমাম আবু বকর খাসসাফ রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম তাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম
আবুল হাসান কারখী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম শামসুল আইম্মা সারাখসী
রহমতুল্লাহি আলাইহি, শামসুল আইম্মা হালুয়ায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম ফখরুদ্দীন কাযীখান রহমতুল্লাহি আলাইহি ও উনাদের সমকক্ষ ফক্বীহ্গণ এই তবকার
অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।
৪। চতুর্থ তবকা আসহাবে
তাখরীজ : মাযহাবের প্রবর্তক ইমামগণ
শরীয়তের এমন কোন মাসয়ালা বা নির্দেশ ইস্তিনবাত করেছেন, যার ****
অর্থাৎ কারণ ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে যাননি। দ্বিতীয় যুগে এমন কিছু আলেম ছিলেন, যাঁরা উনাদের ইমামগণের সেই সমুদয়
আহ্কামের আলোচনা পর্যালোচনা করে উহাদের **** অর্থাৎ কারণ ও উদ্দেশ্য ***** তাখ্রীজ
(বের) করেছেন। এই আলেমগণকেই আইম্মা-ই-তাখ্রীজ বা আসহাবে আসহাবে তাখ্রীজ বলে। এই
ফক্বীহ্গণ উনাদের মাযহাবের ইমামের নির্ধারিত নীতিসমূহে পূর্ণ দক্ষ ছিলেন। উনারা
মৌলিক ও সংক্ষিপ্ত উক্তির ব্যাখ্যা ও তার উপমা দিয়ে বিস্তারিত বর্ণনাদানে সক্ষম
ছিলেন এবং উক্ত নীতি প্রয়োগ করে যুক্তি দ্বারা মাসয়ালা রচনা করার দক্ষতাও উনাদের ছিল। যেমন হানাফী মাযহাবে আবু বকর জাসসাস
রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আবুল হাসান কুদুরী
রহমতুল্লাহি আলাইহি ও উনাদের সমকক্ষ
অন্যান্য ফক্বীহ্গণ।
৫। পঞ্চম তবকা আসহাবে
তারজীহ : এই তবকার ফক্বীহগণ রেওয়ায়েত, দেরায়েত, বর্ণনা, যুক্তি ও ক্বিয়াস দ্বারা এক হুকুমকে অন্য হুকুমের উপর বা এক রেওয়ায়েতকে অন্য
রেওয়ায়েতের উপর তরজী অর্থাৎ প্রাধান্য দিতে পারতেন। সাহেবে হেদায়া বুরহানুদ্দীন
আবুল হাসান আলী ফারগনানী মুরগেনীয়ানী
রহমতুল্লাহি আলাইহি, আসাবীজাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও
অন্যান্যগণ এই তবকার অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।
৬। ষষ্ঠ তবকা আসহাবে তমীয
: এই তবকার ফক্বীহগণ উত্তম, মধ্যম, অধম, প্রকাশ্য মাযহাব, প্রকাশ্য রেওয়ায়েত ও বিরল রেওয়ায়েতসমূহের মধ্যে পার্থক্য
নির্ণয় করতে পারতেন। সাহেবে কাঞ্জে-দাকায়েক, সাহেবে
বেকায়া,
সাহেবে মুখ্তাসার, সাহেবে মাজ্মা ও উনাদের সমকক্ষগণ
এই তবকার অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। উনারা উনাদের কিতাবে শুধু ঐ সমস্ত মাসয়ালা ও মতবাদ
লিপিবদ্ধ করেছেন, যা পূর্ববর্তী ফক্বীহ্গণ সঠিক বলে নির্দেশ করে গিয়েছেন। কোন
মাসয়ালাকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষমতা ও দক্ষতা উনাদের ছিল না।
৭। সপ্তম তবকা : সপ্তম তবকা
সম্পর্কে দুররূল মুখতার কিতাবে উল্লেখ করা হয়,
وما
نحن فعلينا الا تباع ما رجحوه وما صححوه.
অর্থঃ- “আমাদের সপ্তম স্তরের ওলামাগণের পক্ষে পূর্বতন ওলামাগণ যা পছন্দ করেছেন এবং যা
সহীহ্ করে গিয়েছেন, তারই অনুসরণ করতে হবে। তাদের উর্দ্ধতন তবকাসমূহের আলেমগণের
বিপরীত কিছু করবার ক্ষমতা নেই।”
হযরত হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম
মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহ্লভী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরতুল আল্লামা বদরুদ্দীন আ’ইনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা
প্রত্যেকেই সপ্তম তবকার অন্তর্ভূক্ত।
অতএব, আমাদের
মুহাক্কিক ও মুদাক্কিক উলামাগণ উনাদের রায় হলো- “কুরুণে
সালাসা”
অর্থাৎ হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, তাবেঈন,
তাবে তাবেঈন উনারা “সলফে
সালেহীন”,
উনাদের কথা ও আমলই গ্রহণযোগ্য, এতে কোন
সন্দেহ নেই। অনুরূপ “কুরুনে সালাসা”-এর পরে যারা আসবে তাদের মধ্যে
যারা উলিল আমর,
সালেহীন, সাদেক্বীন উনাদের আমল ও ক্বিয়াস
গ্রহণযোগ্য। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
قل
اطيعوا الله واطيعوا الرسول واولى الامر منكم.
অর্থঃ- “হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি বলুন, তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুসরণ করো এবং উলিল আমর উনাদেরও।”
এখানে উলিল
আমর বলতে সলফ ও খলফ প্রত্যেককেই বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র
কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক ফরমান,
ومن
يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبغ غير سبيل المؤمنين نوله ما تولى. الخ.
অর্থঃ- “যদি কারো নিকট হিদায়েত প্রকাশ হবার পর হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার বিরুদ্ধাচরণ করে, আর মু’মিনদের
পথ রেখে ভিন্ন পথের অনুসরণ করে, তবে আমি তাকে সেদিকেই ফিরাবো, যেদিকে সে ফিরেছে।”
শায়খ আহমদ ইবনে আবু সাঈদ মোল্লা জিয়ূন
রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার
তাফসীর মুবারক উল্লেখ করেন,
فجعلت
مخا لفة المؤمنين مثل مخالفة الرسول. (نورالانوار)
অর্থঃ- এ পবিত্র আয়াত শরীফ
উনার মধ্যে মু’মিনদের বিরোধীতাকে হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
বিরোধিতা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (নুরুল আনোয়ার)
এবং পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
السمع والطاعة ولوكان عبدا حبشيا. (مشكوة)
অর্থঃ- “তোমরা তোমাদের নেতার অনুসরণ কর, যদি তিনি হাবশী কৃতদাস হোন না
কেন।”
(মিশকাত শরীফ)
অর্থাৎ যদি কেউ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ
শরীফ মোতাবেক তোমাদের হুকুম করে, তবে তোমরা উনার হুকুমের তাবেদারী করো।
আনুগত্যতা বা অনুসরণের ক্ষেত্রে “কুরুনে সালাসা” সীমাবদ্ধ নয়। “কুরুনে সালাসা”কে উত্তম যুগ বলা হয়েছে। এর
দ্বারা প্রমাণ হয় না যে, এরপর কোন উত্তম সময় আসবে না। পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে, “খিলাফত ত্রিশ বৎসর থাকবে।”
এ পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনার অর্থ এই নয় যে, এরপর আর পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র
হাদীছ শরীফভিত্তিক প্রকৃত খিলাফত আসবে না। বরং খিলাফত আসবে, তবে তা খন্ডকালীন, ধারাবাহিক নয়। যেমন হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু প্রায় বিশ বৎসরকাল খিলাফত চালিয়ে ছিলেন। এবং দু’ ঘোর
অমানিশার মাঝে উদয় হয়েছিল একটি চন্দ্র, আর তাহলো- হযরত উমর ইবনে আব্দুল
আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার খিলাফতকাল, যার বয়স ছিল ২ বছর ৫ মাস। এ সময়টায় এমনই
পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনার শাসন জারী ছিল যে, খলীফা হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে দ্বিতীয় ওমর বলা
হতো। এ সময়টা কি? মুনাজাত বিরোধীরা কি এটাকে জাহিলী খিলাফত বলবে? এবং সাইয়্যিদ আহমদ বেরেলবী
রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কিছুদিনের জন্য হলেও খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সর্বশেষে
হযরত ইমাম মাহদী আলাইহিস সালাম তিনি ও হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম উনার
সময়কালও হবে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের প্রকৃত খিলাফত। এ
সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যেই বর্ণনা রয়েছে। অথচ তা তো “কুরুনে সালাসা” দূরে থাক, এখনও যার সুভাগমণ হয়নি। উনাদের কি অনুসরণ করা যাবে না? উনারা কি সালেহীনগণের অন্তর্ভূক্ত নন? “খলফে সালেহীন” বলে কি উনাদের ইজতিহাদ অনুসরণ বর্জন করা হবে? মুনাজাত
বিরোধী বিদয়াতীরা তার জবাব দিবেন কি?
প্রকৃত
সত্য হলো অনুসরণের ক্ষেত্রে “সলফে সালেহীন, খলফে সালেহীন” কোন কথা নয়, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
ان
الله عزوجل يبعث لهذه الامة عنى كل مأة سنة من يجدد لها دينها. (ابودود شريف)
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি এ উম্মতের (হিদায়েতের) জন্য প্রত্যেক শতকের
শিরোভাগে এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি তাদের দ্বীনের তাজদীদ করবেন।” (আবূ দাউদ শরীফ)
আমাদের প্রশ্ন মহান আল্লাহ পাক প্রতি শতকে যে
একজন করে মুজাদ্দিদ পাঠাবেন, তা কেন? উনার কাজ
কি? মুজাদ্দিদ কি সালেহীন নন? “কুরুণে সালাসার” মধ্যে মুজাদ্দিদগণ অন্তর্ভূক্ত কি? এটা যদি না হয়ে থাকে, তাহলে এর অর্থ কি দাঁড়ায়? অর্থ হলো- প্রত্যেক শতকের লোকদের
জন্যই সে যুগের মুজাদ্দিদ উনাকে অনুসরণ করা উচিৎ। মহান আল্লাহ পাক তিনি কুরআনুল
করীম উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
يوم لد عوا كل اناس با مامهم.
অর্থঃ- “আজ প্রত্যেক দলকে ডাকা হবে তাদের ইমামসহ।” (পবিত্র বনি
ইসরাঈল, পবিত্র আয়াত শরীফ-৭১)
উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে কোন যুগকে
সীমাবদ্ধ করা হয়েছে কি? হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি
আলাইহি,
হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম আবু দাউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম
তিরমীযী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম নাসাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহি, মুহিউস্ সুন্নাহ্ হযরত বাগাবী
রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা প্রত্যেকেই স্বীয় যুগের ইমাম ছিলেন। উনারা তো “কুরুনে সালাসা”র অন্তর্ভূক্ত নন, তাহলে উনারা কি সালেহীন ছিলেন না? হযরত বড় পীর সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা একদিকে যেমন ছিলেন মুজাদ্দিদ, অপরদিকে মুফাররিহ্ও ছিলেন। উনারা কি সালেহীন নন? হযরত
শায়খ মুজাদ্দিদ আলফে ছানী রহমতুল্লাহি
আলাইহি,
হযরত মুল্লা আলী ক্বারী
রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি
আলাইহি,
হযরতুল আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা কি যুগের ইমাম
নন? উনারা কি সালেহীন উনাদের অন্তর্ভূক্ত নন? মহান আল্লাহ
পাক তিনি আমাদেরকে প্রতি ওয়াক্ত নামাযেই-
اهدنا
الصراط المستقيم صراط الذين انعمت عليهم.
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার
মধ্যে
الذين انعمت عليهم
বলার অর্থ কি? এ
নিয়ামতের লক্ষ্যস্থল কারা? এখানে কি সীমিত কোন স্থান, কাল,
ব্যক্তি রয়েছে? এ নিয়ামত মহান আল্লাহ পাক কাদেরকে
দিয়েছেন?
তাদের অনুসরণ করতে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেছেন কি? এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
من
يطع الله والرسول فاولئك مع الذين انعم الله عليهم من النبيين والصديقين واشهداء
والصالحين.
অর্থঃ- “আর যে কেউ আনুগত্যতা করবে, মহান আল্লাহ পাক উনার এবং অনুসরণ
করবে উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার। মূলতঃ তারা রয়েছেন তাদের সাথে, যাঁদেরকে
মহান আল্লাহ পাক তিনি নিয়ামত দিয়েছেন, উনারা হলেন- নবীগণ, সিদ্দীকগণ,
শহীদগণ ও সালেহীনগণ, আর
উনাদের সাহ্চার্যই হচ্ছে উত্তম।”
উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে হযরত নবী
আলাইহিস সালাম শরীফগণের ধারা শেষ হয়েছে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার পর আর কোন নবী আলাইহিস সালাম শরীফ আসবেন না, কিন্তু
যুগে যুগে সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহীনগণ থাকবেন, উনাদের
অনুসরণ করতে হবে। মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন,
وكونوا مع الصادقين.
অর্থঃ- “তোমরা সাদেক্বীন উনাদের সঙ্গী হও।”
সাদেক্বীন বলতে মহান আল্লাহ পাক কোন যুগকে
সীমাবদ্ধ করেছেন কি? না অবশ্যই নয়। বরং হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও হযরত ইমাম
মাহ্দী আলাইহিস সালাম এবং উনাদের পরবর্তী খোলাফাগণ পর্যন্ত উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ
উনার হুকুমের অন্তর্ভূক্ত। সঙ্গি হওয়ার অর্থ শুধু নিকটে থাকা নয় বরং প্রতি যুগের
সাধারণ লোকদের জন্য উচিৎ হবে, সাদেক্বীনগণ যেভাবে চলতে বলেন, সেভাবে চলা। আর সাদেক্বীনগণের অন্তর্ভূক্ত তিনিই হবেন, যিনি পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ
শরীফ অনুযায়ী নিজে চলেন এবং অপরকে পরিচালিত করেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন,
العلماء ورثة الانبياء
অর্থঃ- “(আমার উম্মতের) আলেমগণ হলো- নবীগণ উনাদের ওয়ারিশ।”
এখানে আলেমগণকে নবীগণ উনাদের ওয়ারিশ বলা হলো
কেন? অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, সত্য পথ দেখিয়েছেন, আলেমগণও ওয়ারিশ হিসেবে মানুষকে
দ্বীন সম্পর্কে বিভিন্ন সমস্যা হতে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনার
বিধান অনুযায়ী সমাধান দিবেন। যাঁরা এ কাজ করবেন, উনারাই
মুজতাহিদ,
উনাদের অনুসরণ করতে হবে। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার এ পবিত্র হাদীছ শরীফখানা কোন যুগের সাথে
বিশেষভাবে সম্পৃক্ত নয়, বরং সর্ব যুগের সাথেই
সম্পর্কযুক্ত।
কারণ নুবুওওয়াতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে
কিন্তু ইজতিহাদ উনার দরজা খোলা থাকবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত, মুজতাহিদের
আগমন ঘটবে যুগে যুগে। কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফ উনার
মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
هو الذى خلق لكم ما فى الارض حميعا.
অর্থঃ- তিনি সেই আল্লাহ
পাক, যিনি যমীনের সবকিছু তোমাদের ফায়দার জন্য সৃষ্টি করেছেন।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র
আয়াত শরীফ হতে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে, পৃথিবীতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত নিত্য
নতুন অনেক বিষয়ের উদ্ভব ঘটবে। এখন নতুন উদ্ভূত বিষয়ের কোনটি ইসলামী শরীয়ত উনার
দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য ও কোনটি পরিত্যাজ্য? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস
শরীফ উনার দৃষ্টিতে ইজতিহাদ করতঃ তার সঠিক ফায়সালা দিতে হবে। আর এই ইজতিহাদ
যিনি করবেন,
তিনিই মুজতাহিদ।
এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে।
যেমন- কোন লোকের হার্ট নষ্ট হয়ে গেল, এমতাবস্থায় বানরের হার্ট ব্যবহার
করলে লোকটি বেঁচে যাবে, অন্যথায় বাঁচার কোন পথ নেই। এখন
বানরের হার্ট তার জন্যে ব্যবহার করা জায়েয হবে কি? তার
ইজতিহাদি ফায়সালা হলো- উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার দৃষ্টিতে, জীবন রক্ষার জন্যে বানরের হার্ট ব্যবহার করা জায়েয হবে।
অনুরূপভাবে টেলিভিশন, ভিডিও
ইত্যাদি সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, এগুলো ইসলামী শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে
জায়েয কিনা,
যদি নাজায়েয হয়, তবে তার দলীল কি?
পবিত্র কুরআন
শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের কোথাও টেলিভিশনের কথা বলা হয়েছে কি?
তার
ফায়সালা হলো- পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের কোথায়ও
সরাসরী টেলিভিশন, ভিডিও ইত্যাদির কথা উল্লেখ নেই, তবে
মূর্তি বা ছবির ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলামী শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে
মূর্তি বা ছবি নির্মাণ সম্পূর্ণই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আর টেলিভিশন, ভিডিও ইত্যাদির মধ্যে যে দৃশ্যসমূহ দেখা যায়, তা ছবির
অন্তর্ভূক্ত বিধায় মুজতাহিদগণ ইজতিহাদ করতঃ ফতওয়া দেন যে, প্রাণীর
ছবি তোলা,
আঁকা, রাখা, বেচাকেনা
করা যেহেতু শরীয়তে সম্পূর্ণই হারাম, সেহেতু টেলিভিশন, ভিডিও ইত্যাদিও দেখা, রাখা বেচাকেনা করা সম্পূর্ণ
হারাম। কারণ তার মূলই হচ্ছে, প্রাণীর ছবি। তবে প্রাণীর ছবি না
থাকলে এবং ইসলামী শরীয়ত উনার খেলাফ কোন অনুষ্ঠান প্রচার না করলে (যেমন- গান, বাজনা,
নাচ, বেপর্দা ইত্যাদি) নাজায়েয নয়।
এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদে আ’যম রাজারবাগ শরীফ
উনার হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম তিনি ইজতিহাদকৃত সঠিক ফায়সালা মাসিক আল
বাইয়্যিনাত শরীফ উনার ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম সংখ্যায় বিস্তারিতভাবেই
উল্লেখ করা হয়েছে।
অতএব, মনে
রাখতে হবে যে,
ইজতিহাদের দরজা ক্বিয়ামত পর্যন্তই খোলা থাকবে। আর যুগে যুগে
মুজতাহিদ উনাদেরও আগমন ঘটবে। যেমন এর পূর্বে আগমন ঘটেছে- গাউছূল আ’যম,
বড় পীর হযরত আব্দুল ক্বাদীর জীলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত জালালুদ্দীন ছূয়ূতী রহমতুল্লাহি
আলাইহি,
হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শাহ্
ওয়ালী উল্লাহ্ মোহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আবূ
বকর সিদ্দীক ফুরফুরাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের। উনারা প্রত্যেকেই মুজতাহিদের
অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। এমনকি ক্বিয়ামতের পূর্বে হযরত ইমাম মেহদী আলাইহিস সালাম ও হযরত
ঈসা আলাইহিস সালাম আসবেন এবং প্রত্যেকেই ইজতিহাদ করবেন।
অথচ উক্ত মুজতাহিদগণ খলফে সালেহীনগণ উনাদের
অন্তর্ভূক্ত হওয়া সত্ত্বেও উনাদের অনুসরণ-অনুকরণ করা প্রতিটি মুসলমান পুরুষ-মহিলার
জন্য অবশ্যই কর্তব্য।
সুতরাং খলফে
সালেহীনদের আমল দ্বারাও যেখানে ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা
প্রমাণিত,
সেখানে উনাদের অনুসরণ না করে বিরোধিতা করা পবিত্র কুরআন
শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের বিরোধিতা করার নামান্তর নয় কি?
পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা শরীফের অনুসরণ প্রসঙ্গে:
মুনাজাত বিরোধী কোন কোন জাহিল ও বিদয়াতী লোকের
আরো একটি মূর্খসূচক মন্তব্য এই যে, “পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা
শরীফ হতে দ্বীন ইসলাম সম্বন্ধে যেভাবে আমল করার জন্য নির্দেশ মুবারক আছে এবং পবিত্র
মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা শরীফ উনাদের
মধ্যে যা এখনও চালু রয়েছে, তা প্রত্যেক মুসলমানেরই
অনূসরণ-অনুকরণ করা অবশ্য কর্তব্য। সূতরাং যে মুনাজাত পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা
শরীফ উনাদের মধ্যে প্রচলিত নেই, তা এদেশে আমল করার নামই বিদয়াত বা গোমরাহী ।
মুনাজাত বিরোধীদের উপরোক্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমাদের জিজ্ঞাসা- পবিত্র কুরআন শরীফ
ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের কোথাও সরাসরি পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা শরীফ
উনাদের অনুসরণ-অনুকরণ করতে বলা হয়েছে, এরূপ একটি দলীলও পেশ করতে পারবেন
কি? আর পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা শরীফ উনাদের মধ্যে যা প্রচলিত রয়েছে, তা অনুসরণ না করা যে, বিদয়াত ও গোমরাহী এর দলীল কোথায়? যদি তাই হয়,
তবে সে দেশে যে হারাম কাজগুলো যেমন- ভিডিও, টিভি,
গান-বাজনা ইত্যাদি প্রচলিত ও প্রচারিত রয়েছে, মুনাজাত বিরোধীরা কি সেগুলোও অনুসরণ করবে? এবং
এগুলোকে জায়েয বলবে?
মূলকথা হলো- কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে ততক্ষণ
পর্যন্ত অনুসরণ-অনুকরণ করা জায়েয হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে ব্যক্তি, রাষ্ট্র বা অধিকাংশ লোক পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ
শরীফ,
পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনাদের উপর
পরিপূর্ণ কায়েম না থাকবে।
আর তাই
মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
اطيعو الله واطيعو الرسول واولى الامر منكم.
অর্থঃ- “তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার অনুসরণ করো, নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুসরণ কর এবং উলিল আমর ( যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ অনুযায়ী
চলে) উনার অনুসরণ কর।”
সুতরাং যে ব্যক্তি, রাষ্ট্র
বা অধিকাংশ লোক উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আওতায় পড়বে, তাকে
অবশ্যই অনুসরণ ও অনুকরণ করা যাবে। আর যদি এর বিপরীত হয়, তবে তাদেরকে
অনুসরণ-অনুকরণ করা যাবেনা। এর উদাহরণ হলো- আওলাদে রসূল উনারা। অর্থাৎ যাঁরা আওলাদে
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক উনাদের
প্রত্যেককে মুহব্বত, তা’যীম, তাকরীম করতে
হবে, আর অনুসরণ-অনুকরণ শুধু ঐ সকল আওলাদে রসূলগণ উনাদেরকে করতে হবে, যাঁর আমল-আখলাক সুরত-সীরতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আমল মুবারকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থাৎ কায়িম-মক্বাম।
আর এ প্রসঙ্গেই হযরত ইমাম শাফী
রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আওলাদে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাকগণ উনারা হলেন- পবিত্র আয়াতে শরীফ
উনার ন্যায়,
অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে দু’প্রকার পবিত্র আয়াত শরীফ রয়েছে। প্রথম প্রকার পবিত্র আয়াত শরীফ হলো- যা
তিলাওয়াত এবং আমল উভয় করতে হয় ও তার যথাযথ মুহব্বত, তাযীম, তাকরীমও করতে হয়। দ্বিতীয় প্রকার পবিত্র
আয়াত শরীফ হলো- যা আমল করতে হয়না, যার আমল মানসূখ (রদ) অর্থাৎ
মাশরুহ্ (ব্যাখ্যা) হয়েছে। তবে উনার মুহব্বত, তা’যীম, তাকরীম ও তিলাওয়াত যথাযথ বহাল রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নিম্নে দু’টি
উদাহরণ পেশ করা হলো-
প্রথম উদাহরণ : মহান আল্লাহ পাক প্রথম এ পবিত্র আয়াত শরীফ
অবতীর্ণ করেন,
وان
تبدوا ما فى انفسكم او تخفوه يحاسبكم به الله. (بقرة- ২৮৪)
অর্থঃ- “তোমাদের অন্তরের গোপন ও প্রকাশ্য সব বিষয়ের হিসাবই মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট
দিতে হবে।”
(পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮৪)
উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফখানা অবতীর্ণ হওয়ার পর
হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ খুব চিন্তিত হয়ে গেলেন এবং বার
বার সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বলতে লাগলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যদি এটাই হয়ে থাকে, তবে আমাদের অবস্থা কি হবে? কারণ আমাদের অন্তরে তো অনেক কিছুই
উদয় হয়।”
তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি এ পবিত্র আয়াত শরীফখানা অবতীর্ণ
করেন,
لا
يكلف الله نفسا الا وسعها. (سورة بفرة- ২৮৬)
অর্থঃ- “কোন নফসকেই তার সামর্থের অতিরিক্ত কষ্ট দেয়া হবেনা।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮৬)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা উপরোক্ত আয়াত
শরীফের হুকুমকে মানছূখ (রদ) অর্থাৎ মাশরুহ্ (ব্যাখ্যা) করা হয়েছে।
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার হুকুম যদিও
মানছূখ অর্থাৎ মাশরুহ্ হয়েছে কিন্তু তার তা’যীম-তাকরীম
ঠিকই বহাল রয়েছে।
দ্বিতীয়
উদাহরণঃ মহান আল্লাহ পাক তিনি রোজা রাখার ব্যাপারে প্রথম নিম্নোক্ত পবিত্র আয়াত
শরীফ অবতীর্ণ করেন,
وعلى
الذين يطيقوئه قدية طعام مسكين. (سورة بقرة- ১৮৪)
অর্থঃ- “কোন সামর্থবান ব্যক্তি রোজা না রেখে ফিদ্ইয়া দিলেও চলবে।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ-১৮৪)
কিন্তু মহান আল্লাহ পাক পরবর্তীতে নিম্মোক্ত
আয়াত শরীফ অবতীর্ণ করে উপরোক্ত আয়াত শরীফের হুকুমকে মানসূখ (রদ) অর্থাৎ মাশরুহ্
(ব্যাখ্যা) করে দেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
فمن شهد منكم الشهر فا ليصمه. (بقرة-১৮৫)
অর্থঃ- “তোমাদের মধ্যে (সামর্থবান) যে কেউ রমযান মাস পাবে, তাকে
অবশ্যই রোজা রাখতে হবে।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা
শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১৮৫)
এখানে দ্বিতীয় পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা প্রথম পবিত্র
আয়াত শরীফ উনার হুকুমকে যদিও মানছূখ অর্থাৎ মাশরুহ্ করা হয়েছে কিন্তু তার তা’যীম- তাকরীম, ফাযায়েল-ফযীলত ঠিকই বহাল রয়েছে।
অনুরূপ আওলাদে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাকগণ প্রত্যেকেই তাযীম, তাকরীম ও মহব্বতের পাত্র। তবে উনাদের মধ্যে যাঁরা ইসলামী শরীয়ত উনার উপর
প্রতিষ্ঠিত থাকবেন, উনাদেরকে তাযীম-তাকরীমের
সাথে সাথে অনুসরণ-অনুকরণও করা যাবে। আর যাদের আমল ইসলামী শরীয়ত উনার খেলাফ, তাদেরকে আওলাদে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক হিসাবে তাযীম, তাকরীম করতে হবে, কিন্তু অনুসরণ-অনুকরণ করা যাবেনা।
তদ্রুপ যাঁরা মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ উনাদের
অধিবাসী,
উনারা সমষ্টিগতভাবে তা’যীম তাকরীমের পাত্র। যেহেতু উনারা
মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র ঘর মক্কা শরীফ ও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র রওজা শরীফ উনার প্রতিবেশী। কিন্তু অনুসরণ শুধু উনাদেরকেই করতে হবে, যাঁরা ইসলামী
শরীয়ত উনার অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র
ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনাদের উপর পরিপূর্ণ কায়েম
থাকবেন। আর যাদের আমল এর বিপরীত, তাদেরকে কখনো অনুসরণ-অনুকরণ করা
যাবে না। তবে তাদের মধ্যেও কেউ যদি ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক শাস্তির উপযুক্ত হন, (যেমন হদ, কিসাস)
তবে তাদের উপরও সে শাস্তি কার্যকর করাতে হবে।
যেমন- কাউয়ূমে আউয়াল, মাহ্বূবে সোবহানী, কুতুবে রাব্বনী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাকতুবাত
শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করেন, “যখন হযরত ইমাম মাহদী আলাইহিস সালাম
তিনি আসবেন এবং ইসলামী আইনকানুন চালু করবেন, তখন
মদীনা শরীফ উনার এক আলেম ইমাম মাহদী আলাইহিস সালাম উনাকে কাফির ফতওয়া দিবেন।” তখন হযরত ইমাম মাহদী আলাইহিস সালাম ঐ ব্যক্তিকে কতল করার নির্দেশ দিবেন।
মোটকথা হলো পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা শরীফবাসী যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী শরীয়ত
উনার উপর কায়েম থাকবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত উনাদের অনুসরণ করা
যাবে,
আর এর বিপরীত হলে তাকে কখনো অনুসরণ করা যাবে না।
সুতরাং ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে
মুনাজাত করা যেখানে অসংখ্য ক্বাওলী, ফে’লী, সহীহ্,
জঈফ হাদীছ শরীফ দ্বারা মুস্তাহাব প্রমাণিত, সেখানে পবিত্র মক্কা শরীফ, পবিত্র মদীনা শরীফবাসী করে না বলে এটাকে বিদয়াত বলা গোমরাহী ও চরম জিহালত ব্যতীত আর
কিছুই নয়। অতএব পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ
শরীফ,
পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনাদের বিপরীত কোন
ব্যক্তি,
রাষ্ট্র বা অধিকাংশ লোককে অনুসরণ-অনুকরণ করা সম্পূর্ণই
হারাম ও নাজায়েয।
ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা মুস্তাহাব কেন ?
ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে
মুনাজাতের মধ্যে যে সকল বিষয়বস্তুগুলো রয়েছে, তার
কোনটা সহীহ্ ক্বাওলী হাদীছ শরীফ দ্বারা, আর কোনটা ফে’লী হাদীছ শরীফ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত বিধায় ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে
সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা মুস্তাহাব।
এখন তার বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা হবে। প্রথমত-
আমাদের বুঝতে হবে আমরা মুনাজাত কেন করবো এবং মুনাজাত করার আদেশ মুবারক ইসলামী
শরীয়ত উনার মধ্যে রয়েছে কিনা? এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফ উনার অসংখ্য স্থানে মহান আল্লাহ পাক তিনি
বান্দাকে দোয়া বা মুনাজাত করার আদেশ মুবারক করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি
ইরশাদ মুবারক করেন,
ادعونى استجب لكم. (سورة مؤمن-৬০)
অর্থঃ- “তোমরা আমার নিকট দোয়া কর, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করবো।” (পবিত্র সুরা মু’মিন, পবিত্র আয়াত শরীফ ৬০)
এমনিভাবে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার অসংখ্য আরো
অনেক স্থানেই আমাদেরকে দোয়া করার জন্য বলেছেন। অতএব, প্রতিটি
বান্দার কর্তব্য মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট দোয়া করা। কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ
উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে,
من لم يسأل الله يغضب عليه.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট দোয়া করে না, মহান আল্লাহ
পাক তিনি তার উপর রাগাম্বিত হন।”
উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা এটাই বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহ পাক বান্দাকে মুনাজাত করার আদেশ মুবারক দিয়েছেন এবং মুনাজাতের
মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি মুবারক হাছিল হয়।
সুতরাং মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট বান্দার
দোয়া করা অবশ্যই কর্তব্য। আর তাই আমরা মুনাজাত করে থাকি, মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কান্নাকাটি করে থাকি।
দ্বিতীয়ত- দোয়া বা মুনাজাতের মধ্যে হাত উঠিয়ে
থাকি। স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া বা মুনাজাত করার সময়
হাত মুবারক উঠায়েছেন। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে,
وقال
ابو موسى- دعا النبى صلى الله عليه وسلم ثم رفغ يديه. (بخارى شريف)
অর্থঃ- “হযরত আবূ মুসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
দোয়া করলেন,
অতঃপর হস্তদ্বয় উত্তোলন করলেন।” (বুখারী শরীফ)
নামাযের
পর দোয়ার মধ্যে হাত উঠানো যে সুন্নত, তার আরো প্রমাণ হলো-
عن
سلمان قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان ربكم حبى كريم يستحيى من عبده اذا
رفغ يديه اليه ان يردهما صفرا.
অর্থঃ- হযরত সালমান ফার্সী
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “নিশ্চয়ই
তোমাদের রব অতিশয় দয়ালু। যদি কোন ব্যক্তি উনার নিকট হাত উঠায়, তবে তিনি তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।”
এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,
فيه دلالة على رفغ اليدين فى الدعاء.
অর্থঃ- “এ পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা দোয়ার মধ্যে হাত উঠানো সাব্যস্ত হয়।”
এটা ইলাউস্
সুনান কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। এ পবিত্র হাদীছ শরীফের ব্যাখ্যায় ফরজ, সুন্নত সমস্ত নামাযই অন্তর্ভূক্ত। ফরজ নামাযের পর হাত উঠানো যদি নিষেধই হতো, তাহলে বলা হতো-
فيه دلالة على رفغ اليدين فى الدعاء الا المفروضة.
অর্থঃ- “এর দ্বারা ফরজ নামায ব্যতীত সকল অবস্থায় দোয়ার মধ্যে হাত উঠানো প্রমাণিত হয়।”
কিন্তু তা যেহেতু বলা হয়নি, তাই সমস্ত নামাযই এটার অন্তর্ভূক্ত।
অনুরূপ আরো বহু হাদীছ শরীফ রয়েছে, যাতে উল্লেখ রয়েছে যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মুনাজাতে হাত মুবারক উঠায়েছেন। সুতরাং
মুনাজাতে হাত উঠানো পবিত্র সুন্নত মুবারক উনার অন্তর্ভূক্ত। আর তাই আমরা মুনাজাতে
হাত উঠায়ে থাকি। মুনাজাত বিরোধীরা এমন কোন দলীল পেশ করতে পারবে কি যেখানে মুনাজাতে
হাত উঠাতে নিষেধ করা হয়েছে?
তৃতীয়তঃ- ফরজ নামাযের পর আমরা বিশেষভাবে
মুনাজাত করে থাকি। কারণ হলো সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তিনি ইরশাদ করেছেন, “ফরজ নামাযের পর দোয়া কবুল হয়।” যেমন এ
প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
واخرج
ابوبكر بن ابيض ان رسول الله صلى الله
عليه وسلم قال من صلى فريضة فله دعوة مستجابة- (سهام الاصابه الجلال الدين السيرطى)
অর্থঃ- হযরত আবু বকর ইবনে
আবইয়াদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “যে ব্যক্তি ফরজ নামায আদায় করলো, তার একটি দোয়া মহান আল্লাহ পাক
উনার নিকট অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।” (সিহামুল ইছাবাহ লি জালালুদ্দীন
সুয়ূতী)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে,
عن
ابى موسى- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من كانت له الى الله حاجة فليدع بها
دبر صلوة مفروضة. (ابن عساكر فى ترجمة الحجاج)
অর্থঃ- হযরত আবু মুসা
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “যে
ব্যক্তির মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কোন কিছু চাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, সে যেন কোন ফরজ নামাযের পর তা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট চায়।” (ইবনে আসাকির ফি তরজমাতুল হুজাজ)
ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করা
সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ করা হয়,
عن
ايى امامة قال قيل يا رسول الله صلى الله عليه وسلم- اى الدعاء اسمع؟ قال جوف الليل الاخر وذبر الصلوات المكتوبات.
(ترمذى شريف)
অর্থঃ- হযরত আবু উমামা
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে, নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জিজ্ঞেস
করা হলো- কোন দোয়া মহান আল্লাহ পাক কবুল করেন। উত্তরে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “শেষ
রাতের দোয়া আর ফরজ নামাযের পরের দোয়া।” (তিরমিযী
শরীফ) এ পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার ব্যাখ্যায় ইলাউস্ সুনান কিতাবে উল্লেখ রয়েছে,
فيه اثبات الدعاء بعد الصلاة المفروضة.
অর্থঃ- “এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দ্বারা ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করা
সাব্যস্ত হলো।”
উল্লিখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা এটা
স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, ফরজ নামাযের পর দোয়া কবুল হয় এবং
সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ফরজ নামাযের পর দোয়া বা মুনাজাত করতে
বলেছেন।
সুতরাং ফরজ নামাযের পর দোয়া করা জায়েয ও
মুস্তাহাব। আর তাই আমরা ফরজ নামাযের পর দোয়া করে থাকি।
অথচ
আজকাল কিছু বিদয়াতী লোক বলে থাকে, ফরজ নামাযের পর দোয়া করার বিধান ইসলামী
শরীয়ত উনার মধ্যে নেই। আর দলীল হিসাবে তারা নিম্নোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা পেশ
করে থাকে,
عن
عائشة قالت- كان النبى صلى الله عليه وسلم اذا سلم لم بقعد الا مقدار ما يقول
اللهم انت السلام ومتك السلام تباركت ذا الجلال والاكرام.
অর্থঃ- হযরত ছিদ্দীকা
আলাইহাস সলাম উনার থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, “নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ‘আল্লাহুম্মা আন্তাস সালাম শরীফ ওয়া মিনকাস সালাম শরীফ- এই দোয়া পড়ার পরিমাণ
সময়ের অতিরিক্ত সময় নামাযের সালাম ফিরানোর পর বসতেন না।” এ পবিত্র
হাদীছ শরীফ ইবনে মাজাহ্, আবু দাউদ শরীফ ও মুসলীম শরীফে
উল্লেখ আছে।
এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় বলা হয়,
تمسك
بهذا الحديث من زعم ان الدعاء بعد الصلوة لا يشرع- والجواب ان المراد بالنفى المذ
كرر نفى استمراره جا لسا على هيئة قبل السسلمة الا بقدر ان يقول ماذكر- فقد ثبت
انه كان اذاصلى اقبل على اصحابه- فيحمل ماورد من الدعاء بعد الصلوة على انه كان
يقوله بعد ان يقبل بوجهة على الصحابه. (فتح المللهم شرح مسلم)
অর্থঃ- নামাযের পর দোয়া
নেই বলে যারা মনে করে, তারা উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকে দলীল হিসাবে পেশ করে।
তাদের এ বক্তব্যের উত্তর এই যে, হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার
থেকে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো- নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সালামের
পূর্বে মুসল্লী হিসাবে ক্বিবলামূখী হয়ে যে আকারে বসা ছিলেন, সালামের পর সে আকারে বসে থাকতেন না। অর্থাৎ নামাযীর সুরতে ক্বিবলামূখী হয়ে
আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম শরীফ- এই দোয়া পড়ার পরিমাণ সময়ের চেয়ে বেশী বসে থাকতেন
না। কারণ এটা প্রমাণিত রয়েছে যে, তিনি নামায শেষে স্বীয় হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনাদের দিকে ঘুরে সামনা-সামনি হয়ে বসতেন। অতএব, নামাযের পর তিনি যে দোয়া করেছেন বলে বর্ণিত রয়েছে, তা হযরত
ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাদের দিকে ঘুরে বসার পরই করেছেন। (ফতহুল
মুলহিম শরহে মুসলিম)
উক্ত পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় আল্লামা মানাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি আরো বলেন,
لم يقعد الا مقدار ما يقول الخ اى بين القرض والسنة.
এ পরিমাণ দোয়া পড়া পর্যন্ত
বসতেন। এর অর্থ হলো- এ দোয়া পড়তেন ফরজ ও সুন্নাতের মাঝে। এটা আজিজী ও এলাউস সুনান
কিতাবে উল্লেখ আছে।
সুতরাং উপরোল্লেখিত আলোচনা দ্বারা এটাই
প্রমাণিত হলো যে, ফরজ নামাযের পর দোয়া বা মুনাজাত করা শুধু জায়েযই নয় বরং
সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত এবং ফরজ নামাযের পর দোয়া কবুল হয় বিধায় প্রত্যেকেরই উচিৎ ফরজ
নামাযের পর দোয়া করা। কাজেই যারা বলে ফরজ নামাযের পর দোয়া করার বিধান ইসলামী শরীয়ত
উনার মধ্যে নেই,
তারা হয়তবা সুন্নত মুবারক উনার ঘোর বিরোধী নতুবা এ ব্যাপারে
তারা নিরেট মূর্খ। তাছাড়া মুনাজাত বিরোধীরা এমন কোন দলীল পেশ করতে পারবে না যে, ফরজ নামাযের পর মুনাজাত করতে নিষেধ করা হয়েছে।
চতুর্থত-
আমরা সম্মিলিতভাবে দোয়া করে থাকি। কারণ সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা অবশ্যই
শরীয়তসম্মত। যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়,
لايجتمع
ملاء فيد عو بعضهم ويؤمن بعضهم الااجابهم- (معارف السنن)
অর্থঃ- “সম্মিলিত দোয়ায় কিছু লোক দোয়া করলো, আর কিছু লোক আমিন বললো, মহান আল্লাহ পাক অবশ্যই তাদের এ দোয়া কবুল করবেন।” (মায়ারেফুস সুনান)
উল্লেখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ফরজ, নফল বা কোন সময়ের নির্ধারণ ছাড়াই সম্মিলিতভাবে দোয়া কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কাজেই এ পবিত্র হাদীছ শরীফ ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে দোয়া করা জায়েয
হওয়ারই প্রমাণ বহন করে। কেননা ফরজ নামায দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ সময় বা স্থান, যা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত
যে জায়েয ও শরীয়ত- সম্মত, নিন্মোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ
দ্বারাও তা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়-
عن
ثوبان قال- قال النبى صلى الله عليه وسلم لا يؤم قوما فيخص نفسه بدعوة دونهم فان
فعل فقد خائهم- (ترمذى ج ২ صفه ৪৭)
অর্থঃ- “কোন ইমাম সাহেব মুক্তাদীগণকে বাদ দিয়ে শুধু নিজের জন্য দোয়া করবে না। যদি সে
তা করে,
তবে সে মোক্তাদীগণের প্রতি খেয়ানতকারী হবে।” (তিরমীযী শরীফ ২য় জিঃ পৃঃ ৪৭)
আর তাই ফিক্বাহের কিতাবসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে, ইমাম সাহেব মোক্তাদীগণকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র নিজের জন্য দোয়া করা মাকরূহ্।
উল্লেখিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা ফরজ নামাযের
পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার প্রতিই ইঙ্গিত দেয়। কেননা এ হাদীছ শরীফে
সরাসরি ইমাম ও মোক্তাদীর কথা উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই
প্রমাণিত হয়,
যে কোন নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে দোয়া করা শুধু
শরীয়তসম্মত বা জায়েযই নয় বরং দোয়া কবুল হওয়ারও কারণ। আর তাই আমরা ফরজ নামাযের পর
সহ অন্যান্য সময় সম্মিলিতভাবে দোয়া করে থাকি। এখন মুনাজাত বিরোধীদের নিকট আমাদের
জিজ্ঞাসা আপনারা এরূপ একটি দলীলও কি দেখাতে পারবেন, যাতে ফরজ
নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করতে নিষেধ করা হয়েছে?
পঞ্চমত- আমরা দোয়া বা মুনাজাত শেষে হাত দ্বারা মুখমন্ডল মসেহ্ করে
থাকি। কেননা মুনাজাত শেষে উভয় হাত দ্বারা মুখমন্ডল মসেহ্ করা পবিত্র হাদীছ শরীফ
দ্বারা প্রমাণিত। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে,
عن
سائب بن يزيد عن ابيه- ان النبى صلى الله عليه وسلم كان اذا دعا فرفح يديه ومسح
وجهه بيديه. (بيهقى شريف، مشكوة شريف)
অর্থঃ- “সায়িব ইবনে ইয়াযীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তিনি যখন দোয়া করতেন, উভয় হাত মুবারক উত্তোলন করতেন এবং উভয় হাত মুবারক দ্বারা
মুখমন্ডল মসেহ্ করতেন।” (বায়হাক্বী শরীফ, মিশকাত শরীফ)
উল্লেখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা এটাই
প্রমাণিত হয় যে,
দোয়ার মধ্যে হাত উঠানো যেরূপ সুন্নত, তদ্রুপ দোয়া শেষে উভয় হাত দ্বারা মুখমন্ডল মসেহ্ করাও সুন্নত। আর তাই আমরা
দোয়া বা মুনাজাত শেষে হাত দ্বারা মুখমন্ডল মসেহ্ করে থাকি। মুনাজাত বিরোধীরা মুনাজাতের
সাথে সম্পৃক্ত কোন আমলকেই পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ্ শরীফ উনার দৃষ্টিতে
কখনো নাজায়েয বা বিদয়াত প্রমাণ করতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে মুনাজাত বিরোধীদের আরেকটি আজগুবী
দাবী হলো- বর্তমান প্রচলিত মুনাজাতে যে বিষয়বস্তুগুলো রয়েছে, যেমন- হাত উঠানো, সম্মিলিতভাবে দোয়া করা, ফরজ
নামাযের পর দোয়া করা এবং মুখমন্ডল মসেহ্ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো এক সাথে এক হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে বলে কেউ প্রমাণ করতে পারবেন কি?
মুনাজাত
বিরোধীদের এরূপ দাবী সম্পূর্ণই অযৌক্তিক, আজগুবী ও মূর্খতাসূচক।
কেননা
মুনাজাত বিরোধীগণ প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন না যে, নামাযের
আকার-আকৃতি,
বিভিন্ন ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত মুবারক উনাদের
সমন্বয় ঐ সকল বিষয়গুলোর বর্ণনা এক সঙ্গে এক হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে।
এমনিভাবে আযানের মধ্যে যে বিষয়গুলো রয়েছে, যেমন- ওযুর সাথে আযান দেয়া, আযান দেয়ার সময় কানের মধ্যে
অঙ্গুলী প্রবেশ করানো, হাইয়্যা আলাসসালা-হাইয়্যা আলালফালাহ্ বলার সময় চেহারা
ডানে-বায়ে ফিরানো ইত্যাদি বিষয়গুলো এক হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এক সাথে রয়েছে, এমন কোন প্রমাণ মুনাজাত বিরোধীরা দেখাতে পারবে কি? কখনো
সম্ভব নয়। তেমনিভাবে নামায কত ওয়াক্ত পড়তে হবে এবং কোন নামায কত রাকায়াত, আর কোন নামায ফরজ, কোন নামায ওয়াজিব ইত্যাদি বিষয়গুলোও পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এক সাথে এক
স্থানে বর্ণিত নেই। অনুরূপভাবে ইসলামী শরীয়ত উনার মধ্যে আরো অনেক আহকামই রয়েছে, যা এক সাথে এক পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত নেই। কাজেই শুধুমাত্র
মুনাজাত সম্পর্কে এরূপ কাল্পনিক ও অবান্তর বক্তব্য পেশ করা মুনাজাত বিরোধীদের
জিহালতীকে আরো সুস্পষ্ট করেই তুলে না বরং তারা যে আসলে ফেৎনাবাজ ও বিদয়াতী তাও প্রমাণিত
হয়।
সুতরাং উপরোল্লেখিত বিস্তারিত ও দীর্ঘ আলোচনা
দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, ফরজ নামাযের পর হাত উঠায়ে
সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা এবং মুনাজাত শেষে হাত দ্বারা মুখমন্ডল মসেহ্ করা
সম্পূর্ণ ইলামী শরীয়তসম্মত। পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ
শরীফ,
পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনার অকাট্য দলীল
দ্বারা প্রমাণিত ও সর্বোপরি সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
অন্তর্ভূক্ত। কাজেই এটাকে বিদয়াত ও
নাজায়েয বলা গোমরাহী ব্যতীত কিছুই নয়।
[বিঃ দ্রঃ- পরবর্তী সংখ্যায় মুনাজাতের ফযীলত ও দলীলসমূহ প্রকাশ করা হবে ইনশাআল্লাহ]
( অসমাপ্ত
)