কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে লাইলাতুন নিছফি মিন
শা’বান বা শবে বরাত ও তার সংশ্লিষ্ট
বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ
সুন্নতের পথিকৃত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, দ্বীন ইসলামের নির্ভীক সৈনিক, সারা জাহান থেকে কুফর, শিরক ও বিদয়াতের মুলোৎপাটনকারী, বাতিলের আতঙ্ক এবং আহ্লে সুন্নত
ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক তাজদীদী মুখপত্র- “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় এ যাবৎ যত লেখা বা ফতওয়াই প্রকাশ বা পত্রস্থ হয়েছে
এবং ইনশাআল্লাহ হবে তার প্রতিটিরই উদ্দেশ্য বা মাকছূদ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ “মাসিক আল বাইয়্যিনাত”-এ এমন সব লেখাই পত্রস্থ হয় যা মানুষের আক্বীদা ও আমলসমূহ পরিশুদ্ধ ও হিফাযতকরণে
বিশেষ সহায়ক।
উলামায়ে ‘ছূ’রা ‘শবে বরাত’ সম্পর্কে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। উলামায়ে ‘ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ীরা বলে ও প্রচার করে থাকে যে, শবে বরাত কুরআন শরীফ ও হাদীছ
শরীফ-এর কোথাও নেই, শবে বরাত পালন করা বিদয়াত, নাজায়িয ও হারাম। নাঊযুবিল্লাহ!
তাদের এ বক্তব্যের কারণে তারা নিজেরা যেরূপ ক্ষতিগ্রস্ত
হচ্ছে, তদ্রুপ তাদের উক্ত
কুফরীমূলক বক্তব্য ও বদ আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ই’তিক্বাদী বা আক্বীদাগত
ও আ’মালী বা আমলগত উভয় দিক থেকেই বিরাট ক্ষতির সম্মুক্ষীন হচ্ছে। কেননা হাদীছ শরীফে
শবে বরাতের অশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-
ان
الدعاء يستجاب فى خمس ليال اول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة القدر
المباركة وليلتا العيدين
অর্থ: “নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রিতে দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে থাকে। (১) রজব মাসের প্রথম
রাতে, (২) শবে বরাতের রাতে, (৩) ক্বদরের রাতে, (৪) ঈদুল ফিতরের রাতে, (৫) ঈদুল আযহার রাতে।”
হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে-
عن
على رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف
من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى
السماء الدنيا فيقول الامن مستغفر فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه
الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر.
অর্থ: “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যখন শা’বানের পনের তারিখ রাত্রি উপস্থিত
হবে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ
পাক উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, “কোন ক্ষমা প্র্রার্থনাকারী
আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করে
দিব।” “কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে রিযিক দান করব।” “কোন মুছিবতগ্রস্থ ব্যক্তি আছ
কি? আমি তার মুছিবত দূর
করে দিব।” এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ্, মিশকাত)
এ ধরনের আরো অসংখ্য হাদীছ শরীফ রয়েছে, যাতে শবে বরাত-এর ফযীলতের কথা
বলা হয়েছে অর্থাৎ যারা শবে বরাত পালন করবে তারা মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদের উভয়েরই খাছ রেযামন্দি বা সন্তুষ্টি লাভ
করবে।
অতএব, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, উলামায়ে “ছূ"দের উক্ত বক্তব্য ও বদ আমলের কারণে সাধারণ
মুসলমানগণ ‘শবে বরাত’ পালন থেকে বিরত থেকে অশেষ ফযীলত থেকে মাহরূম হবে। যা আমলের ক্ষেত্রে
বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
কাজেই যারা এ ধরনের কুফরী আক্বীদায় বিশ্বাসী ও
কুফরী বক্তব্য প্রদানকারী, তারা ও হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণ ঈমান ও আমলকে যেন হিফাযত
করতে পারে। অর্থাৎ শবে বরাতসহ সকল বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার ন্যায় আক্বীদা
পোষণ করতে পারে এবং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস মোতাবেক আমল করে আল্লাহ পাক-উনার রেজামন্দী হাছিল
করতে পারে। সে জন্যই কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান বা শবে বরাত’-এর আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত ফতওয়াটি প্রকাশ করা হলো।
অসংখ্য ছহীহ হাদীছ শরীফ দ্বারাও
শবে বরাত প্রমাণিত
পূর্ব প্রকাশিতের পর
(১১) ليلة الصك (লাইলাতুছ্ ছক্কি) ক্ষমার স্বীকৃতি
দানের রাত্রি।
(১২) ليلة الجائزات (লাইলাতুল জায়িযাতি)
পুরস্কারের রাত্রি।
(১৩) ليلة الرجحان (লাইলার্তু রুজহানি)
পরিপূর্ণ প্রতিদানের রাত্রি।
(১৪) ليلة التعظيم (লাইলাত্ত্ ুতা’যীমি) সম্মান হাছিলের রাত্রি।
(১৫) ليلة التقدير (লাইলাতুত্ তাক্বদীরি)
তক্বদীর নির্ধারণের রাত্রি।
(১৬) ليلة الغفران (লাইলাতুল গুফরানি)
ক্ষমাপ্রাপ্তির রাত্রি।
(১৭) ليلة العتق من النيران (লাইলাতুল ইত্ক্বি
মিনান্ নীরানি) জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার রাত্রি।
(১৮) ليلة العفو (লাইলাতুল আফবি)
অতিশয় ক্ষমা লাভের রাত্রি।
(১৯) ليلة الكرم (লাইলাতুল কারামি)
অনুগ্রহ হাছিলের রাত্রি।
(২০) ليلة التوبة (লাইলাতুত্ তাওবাতি)
তওবা কবুলের রাত্রি।
(২১) ليلة الندم (লাইলাতুন্ নাদামি)
কৃত গুনাহ স্মরণে লজ্জিত হওয়ার রাত্রি।
(২২) ليلة الذكر (লাইলাতুয্ যিকরি)
যিকির-আযকার করার রাত্রি।
(২৩) ليلة الصلوة (লাইলাতুছ্ ছলাতি)
নামায আদায়ের রাত্রি।
(২৪) ليلة الصدقات (লাইলাতুছ্ ছদাক্বাতি)
দানের রাত্রি।
(২৫) ليلة الخيرات (লাইলাতুল খইরাতি)
নেককাজ সম্পাদনের রাত্রি।
(২৬) ليلة انزال الرحمة (লাইলাতু ইনযালির
রহমাতি) রহমত নাযিলের রাত্রি।
(২৭) ليلة صلوة وسلام على سيد
المرسلين صلى الله عليه وسلم
(লাইলাতু ছলাতিন ওয়া সালামিন আলা সাইয়্যিদিল মুরসালীনা ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
প্রতি ছলাত ও সালাম পাঠের রাত্রি।
নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ ও দিনের বেলায়
রোযা পালন করা বিদয়াত
নয় বরং খাছ সুন্নত
নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ ও দিনের বেলায়
রোযা পালন করা বিদয়াত নয়। বরং তা সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ-সুন্নাহ শরীফ তথা শরীয়তসম্মত।
আর কুরআন শরীফ-সুন্নাহ শরীফসম্মত কোন বিষয়কে বিদয়াত
বলা প্রকাশ্য কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। মুসলমান হয়ে যে ব্যক্তি কুফরী করে সে ব্যক্তি মুরতাদ ও কাফিরে
পরিণত হয়।
প্রকাশ থাকে যে, কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর বর্ণনা মতে, ইবাদতগুলো মূলত দু’প্রকার। এক- ফরয, দুই- নফল। ওয়াজিব, সুন্নত (মুয়াক্কাদাহ ও যায়িদাহ), মুস্তাহাব ইত্যাদি নফলেরই প্রকার। তা’কীদ অনুসারে কোনটা ওয়াজিব, কোনটা সুন্নতে মুয়াক্কাদা, কোনটা সুন্নতে যায়িদাহ, কোনটা মুস্তাহাব হিসেবে ভাগ
করা হয়েছে।
নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করতে কালামুল্লাহ
শরীফ-এর একাধিক সূরার মধ্যে একাধিক আয়াত শরীফ-এ আদেশ-নির্দেশ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
(১৯৮)
يايها
المزمل قم الليل الا قليلا نصفه او انقص منه قليلا او زد عليه ورتل القران ترتيلا
انا سنلقى عليك قولا ثقيلا ان ناشئة الليل هى اشد وطا واقوم قيلا ان لك فى النهار
سبحا طويلا واذكر اسم ربك وتبتل اليه تبتيلا رب المشرق والمغرب لا اله الا هو
فاتخذوه وكيلا.
অর্থ: “হে কম্বল মুবারক আচ্ছাদিত রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!
রাত্রিতে দ-ায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম অথবা তদপেক্ষা বেশি এবং কুরআন
শরীফ তিলাওয়াত করুন সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে। আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি
গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয়ই রাত্রিতে উঠা একাত্মতা সৃষ্টিতে খুবই কার্যকর এবং স্পষ্ট
উচ্চারণের অনুকূল। নিশ্চয়ই দিবাভাগে রয়েছে আপনার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। আপনি আপনার রব তায়ালা
উনার নাম মুবারক-এর যিকির করুন এবং একাগ্রচিত্তে তাতে মগ্ন হোন। তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের
রব। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ
(মা’বূদ) নেই। অতএব, উনাকেই সবকিছুর জিম্মাদার হিসেবে গ্রহণ করুন।” (সূরা মুয্যাম্মিল : আয়াত শরীফ ১-৯)
উল্লিখিত আয়াতে কারীমাসমূহে রাত্রিবেলায় আল্লাহ
পাক উনার ইবাদতে মশগুল হওয়া তথা তাহাজ্জুদ নামায আদায় করা, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা, একাগ্রচিত্তে আল্লাহ পাক উনার
যিকির করা এবং সৃষ্টির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতঃ কেবলমাত্র আল্লাহ পাক উনার দিকে মনোনিবেশ
করার জন্য বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, তাহাজ্জুদ নামায, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত এবং যিকির
দ্বারা এখানে নফল ইবাদতকেই বুঝানো হয়েছে। আর হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-
(১৯৯-২০১)
عن
حضرت عبد الله بن سلام رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم
يايها الناس افشوا السلام واطعموا الطعام وصلوا الارحام وصلوا بالليل والناس نيام
تدخلوا الجنة بسلام.
অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে
বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক উনার রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, হে লোক সকল! তোমরা সালামের প্রচলন কর, মানুষকে খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা কর
এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়। তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিযী,
ইবনে
মাযাহ, দারিমী)। উপরোক্ত হাদীছ শরীফ-এ
وصلوا
بالليل والناس نيام
অর্থাৎ “মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়”- এটা দ্বারা রাতের বেলা নফল ইবাদত তথা বিশেষভাবে তাহাজ্জুদ নামাযের কথা বলা হয়েছে।
দিনের বেলায় (নফল) রোযা পালনের আদেশ-নির্দেশ সম্পর্কে
শত শত হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে।
যেমন ইরশাদ হয়েছে-
(২০২-২০৩)
عن
حضرت على رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة
النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس
الى السماء الدنيا فيقول الا من مستغفر فاغفر له الا مسترزق فارزقه الا مبتلى
فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر.
অর্থ: “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যখন শা’বানের পনের তারিখের
রাত্রি (শবে বরাত) উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা
রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন। অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল
করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, কোন ক্ষমা প্র্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছ
কি? আমি তাকে রিযিক দান
করব।
কোন মুছিবতগ্রস্ত
ব্যক্তি আছ কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিব। এভাবে ফজর বা ছুবহে ছাদিক পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাযাহ, মিশকাত) এ হাদীছ শরীফ-এ
(২০৪)
فقوموا
ليلها وصوموا يومها.
অর্থাৎ- “তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে (শবে বরাতে) নামায আদায়
করবে এবং দিনে রোযা রাখবে”- এর দ্বারা রাতের বেলা নফল ইবাদত
এবং দিনের বেলা নফল রোযার আদেশ করা হয়েছে।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ এবং দিনের বেলায় রোযা পালন
সরাসরি কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত।
আরো উল্লেখ্য যে, এমন কোন ফরয পাওয়া যাবেনা যার
মধ্যে নফল তথা ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব আমলের মিশ্রণ ঘটেনি। অর্থাৎ প্রতিটি ফরযের মধ্যেই নফলের মিশ্রণ রয়েছে
এবং বর্ণিত রয়েছে, ‘আল্লাহ পাক তিনি প্রতিটি ফরয আমলকে সুন্নত আমলের দ্বারা পূর্ণতা দান ও সৌন্দর্যম-িত
করেছেন।’ তাহলে ফরয ইবাদত করতে গেলেও তো নফল আমল বা ইবাদত করতে হচ্ছে।
সুতরাং একথা কি করে শুদ্ধ হতে পারে যে, ‘নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি
জাগরণ ও দিনের বেলায় রোযা পালন করা বিদয়াত?’ মূলত এ ধরনের উক্তি এমন সব লোকই করতে পারে, যারা হাক্বীক্বতে ইসলাম ও মুসলমান
থেকে খারিজ, প্রকৃত মুরতাদের অন্তর্ভুক্ত। যাদের পরিচয় খোদ আল্লাহ
পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হাদীছ শরীফ-এ পেশ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
(২০৫-২০৬)
عن
حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يكون فى
اخر الزمان دجالون كذابون يأتونكم من الاحاديث بما لم تسمعوا انتم ولا اباؤكم
فاياكم واياهم لا يضلونكم ولا يفتنونكم
অর্থ: “হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, আখিরী যামানায় কিছু সংখ্যক মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে, তারা তোমাদের নিকট এমন সব
(মিথ্যা-মনগড়া) কথা উপস্থাপন করবে, যা তোমরা কখনো শুননি এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও শুনেনি। সাবধান! তোমরা তাদের
থেকে দূরে থাকবে এবং তোমাদেরকে তাদের থেকে দূরে রাখবে। তবে তারা তোমাদেরকে গোমরাহ
করতে পারবে না এবং ফিৎনায় ফেলতে পারবে না।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)
এ হাদীছ শরীফ-এ ক্বিয়ামতের পূর্বে অনেক মিথ্যাবাদী
দাজ্জাল বের হবে সেটাই বলা হয়েছে। হাদীছ শরীফ-এর বর্ণনা মতে মূল দাজ্জাল একজনই হবে। তবে তার অনুসারী অর্থাৎ
দাজ্জালের চেলা হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ হবে।
প্রকৃত কথা হচ্ছে, মূল দাজ্জালের পূর্বে বহু সংখ্যক
মিথ্যাবাদী দাজ্জালের প্রকাশ ঘটবে। মূল দাজ্জালের যে কাজ সে কাজের তারা আঞ্জাম দিবে। তাহলো মানুষের আক্বীদা-আমল
নষ্ট করে কুফরীতে নিমজ্জিত করা। কাজেই তাদেরকে চিনে তাদের বদ ও গোমরাহী আমল আক্বীদা থেকে নিজের
আক্বীদা-আমল হিফাযত করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত। নচেৎ উক্ত দাজ্জালের
খপ্পরে বা ওয়াস্ওয়াসায় যারা পড়বে তাদের হাশর-নশর সে দাজ্জালের সাথেই হবে। আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সকলকে সেই দাজ্জালদের পরিচয় লাভ করার
এবং তাদের থেকে দূরে থেকে নিজেদের আক্বীদা-আমল হিফাযত করতঃ আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টি হাছিল করার তাওফীক দান করুন।
সূরা দুখানের ৩-৪নং আয়াত শরীফ-এ বর্ণিত ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্’ দ্বারা ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়েছে? না ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে?
সূরা দুখানের
৩নং আয়াত শরীফ-এ উল্লিখিত ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ দ্বারা ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়নি বরং ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘শবে বরাতকেই’ বুঝানো হয়েছে।
কেননা, ‘লাইলাতুল ক্বদর’-এর মর্তবা ও ফযীলত সম্পর্কে
মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘সূরা ক্বদর’ নামে আলাদা একটি সূরাই নাযিল করেছেন। যার শানে নুযূল এবং ব্যাখ্যাও
আলাদাভাবে বর্ণিত রয়েছে। উক্ত ‘সূরা ক্বদরে’ আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-
(২০৭)
انا
انزلنه فى ليلة القدرড় وما ادرك ما ليلة القدرড় ليلة القدر خير من الف شهرড় تنزل
الـملئكة والروح فيها باذن ربهم من كل امر سلمড় هى حتى مطلع الفجرড়
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি কুরআন শরীফ নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে। আপনি কি জানেন, ক্বদরের রাত্রি কি? অর্থাৎ আপনি তো জানেন ক্বদরের
রাত্রি সম্পর্কে। ক্বদরের রাত্রি হাজার মাস থেকেও উত্তম। উনাদের রব-উনার অনুমতিক্রমে রূহ (হযরত জিবরীল আলাইহিস
সালাম) ও ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা এ রাতে পৃথিবীতে অবতরণ করেন প্রত্যেক কাজে
বা হুকুমে। শান্তি নাযিল হয়। উহা (ক্বদর রাত্রি) ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত (বলবৎ থাকে)।”
শানে নুযূল: হযরত ইবনে আবী হাতিম রহমতুল্লাহি আলাইহি
উনার থেকে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একবার বনী ইসরাইলের
জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। যিনি এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকেন এবং কখনো
অস্ত্র সংবরণ করেননি। মুসলমানগণ একথা শুনে বিস্মিত হলে এ ‘সূরা ক্বদর’ অবতীর্ণ হয়। এতে উম্মতে হাবীবীর জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সেই মুজাহিদের
এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। সুবহানাল্লাহ! (তাফসীরে মাযহারী)
ক্বদরের অর্থ ও ব্যাখ্যা: ‘ক্বদরের’ অর্থ হচ্ছে মাহাত্ম্য ও সম্মান। এ রাত্রির মাহাত্ম্য ও সম্মানের
কারণে একে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ তথা ‘মহিমান্বিত রাত’ বলা হয়। এ রাত্রিকে ‘ক্বদর’ বলার কারণ সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, আমল না করার কারণে এর পূর্বে
যার কোনো সম্মান অর্জিত হয়না। যখন এ রাত্রিতে তওবা-ইস্তিগফার ও ইবাদত-বন্দিগী করা হয় তখনই
ফযীলত ও সম্মান হাছিল হয়।
কাজেই লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর ও লাইলাতুল
বরাত বা শবে বরাত একই রাত্রির নাম নয়। বরং উভয় রাত্রি দুটিই আলাদা এবং যার বর্ণনাও কুরআন
শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ আলাদাভাবেই বর্ণিত হয়েছে। ‘লাইলাতুল ক্বদরের’ কথা বর্ণিত রয়েছে সূরা
ক্বদরে। আর ‘লাইলাতুল বরাতের’ কথা বর্ণনা করা হয়েছে সূরা দুখানে ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ বা ‘বরকতময় রজনী’ হিসেবে।
সূরা দুখানে বর্ণিত ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ দ্বারা যে ‘লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে তা প্রায়
সকল বিশ্বখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থেই বর্ণিত রয়েছে।
যেমন, সূরা দুখানে উল্লিখিত ليلة (লাইলাতুম্ মুবারাকাহ)-এর
ব্যাখ্যায় বিশ্বখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে মাযহারী”-এর ৮ম খ-ের ৩৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ
আছে-
(২০৮)
قال
عكرمة هى ليلة النصف من شعبان يبرم فيه امر السنة
অর্থাৎ, বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি
বলেন, ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ হচ্ছে ‘শা’বানের মধ্য রাত্রি’ অর্থাৎ ‘বরাতের রাত্রি’। এ রাতে সারা বছরের কাজ-কর্মের
ফায়ছালা করা হয়।
উক্ত আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় রঈসুল মুফাস্সিরীন
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন-
(২০৯-২১০)
قد
اخبر الله سجانه عن هذه الليلة المباركة التى هى ليلة النصف من شعبان انه تعالى
يفرق فيها كل امر من اموره المحكمة.
অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্ অর্থাৎ বরকতময় রাত্রি বলতে
শা’বান মাসের মধ্য রাত অর্থাৎ শবে বরাতকে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ পাক তিনি এ
রাতে সকল প্রজ্ঞা সম্পন্ন বিষয়ের ফায়ছালা করে থাকেন।” (ছফওয়াতুত্ তাফাসীর)
বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে খাযিন”-এর ৪র্থ খ-ের ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(২১১)
(انا انزلناه فى ليلة مباركة) هى
ليلة النصف من شعبان.
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি এটা এক বরকতময় রাত্রিতে নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্’ হলো অর্ধ শা’বানের রাত তথা শবে বরাত।”
সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে বাগবী”-এর ৬ষ্ঠ খ-ের ১৪৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(২১২-২১৩)
(انا انزلناه فى ليلة مباركة)
وقال اخرون ليلة النصف من شعبان
অর্থাৎ- “নিশ্চয়ই আমি এটা এক বরকতময় রাত্রিতে নাযিল করার
সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অসংখ্য রাবীগণ বলেন, ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ তথা বরকতময় রাত্রি
হচ্ছে অর্ধ শা’বানের রাত অর্থাৎ শবে বরাত।”
“তাফসীরে নাযমুদ্ দুরার”-এর ৭ম খ-ের ৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
ليلة
مباركة
দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে-
ليلة
النصف من شعبان
অর্থাৎ “অর্ধ শাবানের রাত তথা বরাতের রাত।” তাফসীর জগতের সুবিখ্যাত
তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে কুরতুবী”-এর ৮ম খ-ের ১২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ
আছে-
(২১৪)
قال
عكرمة الليلة المباركة ههنا ليلة النصف من شعبان
অর্থ: “বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি
বলেন, লাইলাতুম্ মুবারাকাহ
দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত অর্থাৎ শবে বরাত।” বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে লুবাব”-এর ১৭তম খ-ের ৩১০ ও ৩১১ পৃষ্ঠায়
উল্লেখ আছে-
(২১৫)
(فيها) اى فى الليلة المباركة
(يفرق) يفصل (كل امر حكيم) وقال عكرمة هى ليلة النصف من شعبان يقوم فيها امر السنة.
অর্থ: “ওই বরকতময় রাত্রিতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ যাবতীয় বিষয়ের ফায়ছালা
করা হয়। বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত তথা শবে বরাত। এ রাতে আগামী এক বছরের
যাবতীয় বিষয়ের তালিকা প্রস্তুত করা হয়।” তাফসীর জগতের সুবিখ্যাত
ও সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর “তাফসীরে ইবনে কাছীর”-এর ৪র্থ খ-ের ২১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ
আছে-
(২১৬-২৪১)
ومن
قال انها ليلة النصف من شعبان كما روى عن عكرمة ...... والحديث الذى رواه عبد الله
بن صالح عن الليث عن عقيل عن الزهرى اخبرنى عثمان بن محمد بن المغيرة الاخنس قال
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال تعطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل
لينكح ويولد له وقد اخرج اسمه فى الموتى.
অর্থ: “যারা বলেন যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত
তথা শবে বরাত। যেমন, উনারা দলীল হিসেবে
পেশ করেন হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা। তাছাড়াও আরো হাদীছ
শরীফ রয়েছে যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ছালেহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হযরত লাইছ রহমতুল্লাহি আলাইহি
উনার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি হযরত আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে তিনি হযরত ইমাম যুহরী রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনার থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হযরত উছমান ইবনে মুহম্মদ ইবনে মুগীরা ইবনে আখনাস
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, এক শা’বান থেকে পরবর্তী শাবান পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ই শা’বান হতে পরবর্তী ১৫ই শা’বান পর্যন্ত যারা মারা
যাবে তালিকা প্রস্তুত করা হয়, এমনকি ব্যক্তির বিবাহ এবং সেই বৎসর তার কি সন্তান জন্মলাভ করবে
এবং সেই বৎসর কখন মৃত্যুবরণ করবে তার যাবতীয় তালিকাও প্রস্তুত করা হয় এই শবে বরাতে।”
উপরোক্ত বিশ্বখ্যাত, সুপ্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থসমূহ
ছাড়াও তাফসীরে আবী সউদ, বাইযাবী,
দুররে
মানছূর, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে কামালাইন, তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে গরায়িব, তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে রুহুল মায়ানী, তাফসীরে যাদুল মাছীর, তাফসীরে আল মুহাররারুল ওয়াজিয, তাফসীরে মাওয়াহিব, হাশিয়ায়ে শিহাব, তাফসীরে ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু,
তাফসীরে
দুররে মাছূন,
তাফসীরে
কাশ্শাফ, তাফসীরে দিয়াউল কুরআন, তাফসীরে আহকামুল কুরআন, তাফসীরে কাসীমী, তাফসীরে মিযান, তাফসীরে মাওয়ারদী, নূরুল ইরফান, তাফসীরে মুগনী, তাফসীরে বাহরে মাওয়াজ, তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন ইত্যাদি
তাফসীরগ্রন্থে ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ দ্বারা ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে।
৬. শবে বরাতে রিযিক বৃদ্ধি করা হয় এবং কতজন জন্মগ্রহণ
করবে ও কতজন মৃত্যুবরণ করবে তা ধার্য করা হয়। এটা কুরআন-সুন্নাহ সম্মত কি-না?
উপরোক্ত বক্তব্যের সঠিক জবাব হলো, হ্যাঁ, এটা অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ সম্মত। যেমন, এ প্রসঙ্গে কালামুল্লাহ শরীফে
“সূরা দুখান”-এর ৪নং আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
(২৪২)
فيها
يفرق كل امر حكيم
অর্থাৎ- “এটি (শবে বরাত) এমন এক রাত যে রাতে সমস্ত প্রজ্ঞাসম্পন্ন
বিষয়ের ফায়সালা করা হয়।” এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায়
হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
(২৪৩-২৪৪)
فيها
ان يكتب كل مولود من بنى ادم فى هذه السنة وفيها ان يكتب كل هالك من بنى ادم فى
هذه السنة وفيها ترفع اعمالهم وفيها تنزل ارزاقهم.
অর্থাৎ- “বরাতের রাতে ফায়সালা করা হয় কতজন সন্তান এক বৎসরে
জন্ম গ্রহণ করবে এবং কতজন সন্তান মৃত্য বরণ করবে। এ রাত্রিতে বান্দাদের আমল
(আল্লাহ পাক উনার নিকট) পেশ করা হয় এবং এ রাত্রিতে বান্দাদের রিযিকের ফায়সালা করা হয়।” (বাইহাক্বী, মিশকাত)
উক্ত আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় রঈসুল মুফাস্সিরীন
হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন-
(২৪৫)
قد
اخبر الله سجانه عن هذه الليلة المباركة التى هى ليلة النصف من شعبان انه تعالى
يفرق فيها كل امر من اموره المحكمة.
অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্ অর্থাৎ বরকতময় রাত্রি বলতে
শা’বান মাসের মধ্য রাত অর্থাৎ শবে বরাতকে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ পাক তিনি এ
রাতে সকল প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফায়ছালা করে থাকেন।” (ছফওয়াতুত্ তাফাসীর)
সুপ্রসিদ্ধ তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরে ইবনে কাছীর”-এর ৪র্থ খ-ের ২১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(২৪৬)
قال
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال تقطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل
لينكح ويولد له وقد اخرج اسمه فى الموتى.
অর্থ: “নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
ইরশাদ করেন, এক শা’বান থেকে পরবর্তী শাবান পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ই শা’বান হতে পরবর্তী ১৫ই শা’বান পর্যন্ত মৃত্যুদের
তালিকা প্রস্তুত করা হয়, এমনকি ব্যক্তির বিবাহ এবং সেই বৎসর তার কি সন্তান জন্মলাভ করবে এবং সেই বৎসর কখন
মৃত্যুবরণ করবে তার যাবতীয় তালিকাও প্রস্তুত করা হয় এই শবে বরাতে।” হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
(২৪৭)
عن
حضرت محمد بن الميسرة بن الاخفش رحمة الله عليه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم
قال يقطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل لينكح ويولد له ولقد اخرج اسمه
فى الموتى.
অর্থ: “হযরত মুহম্মদ ইবনে মাইসারা ইবনে আখফাশ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার
থেকে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, শা’বান মাসে (শবে বরাতে) পরবর্তী শাবান মাস পর্যন্ত মৃত্যুর ফায়ছালা
করা হয়। এমনকি লোকেরা যে বিবাহ করবে এবং ওই বৎসর তার থেকে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তার তালিকাও
প্রস্তুত করা হয় এবং ওই বৎসরে মৃত্যুদের নামেরও তালিকা প্রস্তুত করা হয়।” (তাফসীরে মাযহাবী ৮ম খ-, ৩৬৮ পৃষ্ঠা) “তাফসীরে মাযহারী”-এর ১০ম খ-ে উল্লেখ আছে-
(২৪৮)
قال
عكرمة تقدير المقادير وابرام الامور فى ليلة النصف من شعبان فيها ينسخ الاحياء من
الاموات فلا يزداد فيهم ولاينقص منهم ويؤيده.
অর্থ: “হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, স্থিরকৃত যাবতীয় বিষয়গুলো যথাসময়ে
নির্ধারণ ও ফায়ছালা করা হয়ে থাকে মধ্য শাবানের
রাতে তথা শবে বরাতে। এই রাতে তালিকা প্রস্তুত করা হয় মৃত্যু ও জীবিতদের। এই তালিকা থেকে কোন
বৃদ্ধিও করা হয়না এবং কোন কমতিও করা হয়না। বরং তা সুদূরভাবে সম্পন্ন করা হয়।” “তাফসীরে মাদারিক” ও “তাফসীরে হাশিয়ায়ে খাযিন”-এর ৪র্থ খ-ের ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(২৪৯-২৫০)
ليلة
النصف من شعبان هذه الليلة مفرق كل أمر حكيم ومعنى يفرق ويفصل ويكتب كل امر من
ارزاق العباد واجالهم وجميع أمورهم من هذه الليلة الى ليلة القدر التى تجئ فى
السنة المقبلة.
অর্থ: “অর্ধ শাবানের রাত তথা শবে বরাত এ রাতে সকল প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়সমূহের
ফায়সালা করা হয়। আয়াত শরীফে “يفرق” শব্দের অর্থ হচ্ছে “يفصل” তথা ফায়সালা করা হয় এবং “يكتب” তথা লিপিবদ্ধ করা হয়
প্রত্যেক বান্দাদের রিযিকসমূহ এবং তাদের মৃত্যুর সময়সীমাও লেখা হয় এবং সমস্ত বিষয়ের
তালিকাও লেখা হয় এই রাতে তথা শবে বরাতে। আর কদর রাতে তা চালু
তথা কার্যকরী করা হয় সামনের এক বৎসর পর্যন্ত।”
হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে-
(২৫১)
عن
حضرت ابن عباس رضى الله تعالى عنه ان الله يقضى الاقضية فى ليلة النصف من شعبان
ويسلمها الى اربابها فى ليلة القدر.
অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার
থেকে বর্ণিত আছে, হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, অর্ধ শাবানের রাতে তথা শবে
বরাতে আল্লাহ পাক তিনি যাবতীয় বিষয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন আর ক্বদর রাতে সেই সিদ্ধান্ত
বাস্তবায়ন বা কার্যকরী করার জন্য তালিকা অর্পণ করেন বাস্তবায়নকারী ফেরেশতাগণের হাতে।” (তাফসীরে খাযিন ৪র্থ খ-, ১১২ পৃষ্ঠা)। হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে-
(২৫২-২৯২)
عن
ام المؤمنين حضرت عائشة عليها السلام ان النبى صلى الله عليه وسلم كان يصوم شعبان
كله فسالته قال ان الله تعالى يكتب فيه كل نفس ميتة تلك السنة.
অর্থ: “উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা
আলাইহাস সালাম তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
পূর্ণ শা’বান মাসে রোযা রাখতেন অতঃপর আমি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি জবাবে বললেন, শাবান মাসে (শবে বরাতে) ওই বৎসর যারা ইন্তিকাল করবে তাদের প্রত্যেকেরই
তালিকা প্রস্তুত করা হয়।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ৬ষ্ঠ
খ- ২৬ পৃষ্ঠা)
অতএব, “শাবানের মধ্য রাতে অর্থাৎ শবে বরাতে রিযিক বৃদ্ধি করা হয় এবং
কতজন জন্মগ্রহণ করবে এবং কতজন মৃত্যুবরণ করবে তা ধার্য বা ফায়ছালা করা হয়”- এটা সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহ সম্মত তা উপরোক্ত বিশ্ববিখ্যাত, নির্ভরযোগ্য হাদীছ শরীফ, তাফসীর, শরাহ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকে
প্রমাণিত হলো। সুতরাং এর বিপরীত বক্তব্য পেশ করা সম্পূর্ণরূপে কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কোন মুসলমান কুফরী
করলে সে ইসলাম ও মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে প্রকাশ্য মুরতাদ ও কাফিরে পরিণত হয়ে যাবে। [দলীলসমূহ: তাফসীরে
খাযিন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছির, মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, আবী সউদ, বাইযাবী, দুররে মানছূর, জালালাইন, কামালাইন, তাবারী, লুবাব, নাযমুদ্ দুরার, গরায়িব, মাদারিক, ছফওয়াতুত্ তাফাসীর, যাদুল মাছীর, আল মুহাররারুল ওয়াজিয, মাওয়াহিব, হাশিয়ায়ে শিহাব, ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু,
দুররে
মাছূন, কাশ্শাফ, দিয়াউল কুরআন, আহকামুল কুরআন, কাসীমী, মিযান, মাওয়ারদী, নূরুল ইরফান, তাফহীমুল কুরআন, বাইহাক্বী, মিশকাত, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ব ত্বীবী, তালিকুছ্ ছবীহ, মুযাহিরে হক্ব ইত্যাদি।]
আলফিয়াহ বা রগায়িবের নামায
৭. অর্ধ শা’বানের রাতে আলফিয়াহ
বা রগায়িব নামক কোন নামায আছে কি-না?
উপরোক্ত বক্তব্যের সঠিক জবাব হলো, হ্যাঁ, আলফিয়াহ বা রগায়িব উপলক্ষে
নামায রয়েছে। তবে এ নামায অর্ধ শা’বানের রাতে নয় বরং রজব মাসের প্রথম জুমুয়ার রাতে।
এখানে শবে বরাত বিরোধী ওহাবী, খারিজী, জামাতী, তাবলীগী ও লা-মাযহাবীদের চরম
নাদানী ও জিহালতী দেখে আশ্চর্য হতে হয় যে, তারা শবে বরাতের বিরোধিতা করতে গিয়ে রজব মাসে অনুষ্ঠিত আলফিয়াহ
বা রগায়িবকে শা’বান মাসের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে।
মূলত হক্বের বিরোধিতা করলে এরূপই হয়ে থাকে। পর্যায়ক্রমে ইলম্ সলব
হয়, বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়, আমল নষ্ট হয়, ঈমান-আক্বীদা বিধ্বস্ত হয়, পরিণামে জাহান্নামের ইন্ধন
হতে হয়।
উল্লেখ্য যে, রজব মাসের প্রথম জুমুয়ার রাতটি হচ্ছে ‘লাইলাতুর রগায়িব’ বা রাগায়িবের রাত। এটি ফযীলতপূর্ণ রাতসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি রাত। এ মহান রাত্রিতে যিনি
নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের নবী, রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার আম্মার রেহেম শরীফ-এ কুদরতীভাবে তাশরীফ নেন।
এ মুবারক রাত্রির ফযীলত প্রসঙ্গে যিনি হাম্বলী
মাযহাবের ইমাম হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “লাইলাতুর রগায়িবের ফযীলত শবে
ক্বদর, শবে বরাত এবং অন্যান্য
ফযীলত পূর্ণ দিন-রাত্রির চেয়েও বেশি।” তিনি যখন এ বক্তব্য
পেশ করলেন, তখন সমসাময়িক আলিম-উলামা, ইমাম-মুজতাহিদগণ উনার নিকট
এসে বললেন, হুযূর! শবে ক্বদর, শবে বরাত এবং অন্যান্য ফযীলতপূর্ণ দিন-রাত্রির ফযীলত কুরআন শরীফ
ও হাদীছ শরীফ-এ বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু লাইলাতুর রগায়িব বা শবে রাগায়িবের বর্ণনা তো কুরআন শরীফ
ও হাদীছ শরীফ-এ নেই, তাহলে কিভাবে এ রাত্রির ফযীলত উল্লিখিত ফযীলতপূর্ণ দিন-রাত্রির চেয়ে বেশি হতে পারে? তখন হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল
রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, আপনারা কি জানেন, লাইলাতুর রগায়িব কোন রাত্রিকে বলে? তারা জানেন না বলে স্বীকার
করলে, তিনি লাইলাতুর রগায়িবের
পরিচয় তুলে ধরলেন, লাইলাতুর রগায়িব হচ্ছে ওই রাত্রি যে রাত্রিতে আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনার আম্মার রেহেম শরীফ-এ তাশরীফ নিয়েছেন। এ রাত্রির ফযীলত অন্যান্য সমস্ত
ফযীলতপূর্ণ দিন-রাত্রির চেয়ে বেশি এই জন্য যে, যদি আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আম্মার রেহেম শরীফে না আসতেন তাহলে শবে ক্বদর, শবে বরাত এবং অন্যান্য ফযীলতপূর্ণ
দিন-রাত কোনটিই আসতোনা। আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনার আগমনের ওসীলাতেই শবে ক্বদর, শবে বরাতসহ সমস্ত ফযীলতপূর্ণ দিন-রাত্রি এসেছে। কাজেই লাইলাতুর রগায়িবের
ফযীলত সবচেয়ে বেশি। সুবহানাল্লাহ!
তিনি যখন লাইলাতুর রগায়িবের পরিচয় পেশ করলেন, তখন সকল আলিম-উলামা, ইমাম-মুজতাহিদগণ নির্দ্ধিধায়
তা মেনে নিলেন। সুবহানাল্লাহ!
ছলাতুর রগায়িব সম্পর্কে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-
(২৯৩-২৯৪)
عن
حضرت انس رضى الله تعالى عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم ذكر صلوة الرغائب
وهى اول ليلة جمعة من رجب فصلى فيها بين المغرب والعشاء ثنتى عشرة ركعة بست
تسليمات كل ركعة بفاتحة الكتاب والقدر ثلثا وقل هو الله احد ثنتى عشرة مرة فاذا
فرغ من صلوته قال اللهم صل على محمدن النبى الامى وعلى اله بعد ما سلم سبعين مرة
ثم سجد سجدة وقال فى سجوده سبوح قدوس رب الملئكة والروح سبعين مرة ثم رفع رأسه
وقال رب اغفر وارحم وتجاوز عما تعلم انك انت العلى الاعظم فى رواية اخرى الاعز
الاكرم سبعين مرة ثم سجد وقال مثل ما قال فى السجدة الاولى ثم سأل الله وساجد
حاجته فان الله لا يرد سائله.
অর্থ:
হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন যে, রগায়িবের নামায হচ্ছে রজব মাসের প্রথম জুমুয়ার রাতের নামায। তিনি এ রাতে মাগরিব
ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে ৬ সালামে ১২ রাকায়াত নামায আদায় করেন। প্রত্যেক রাকায়াতে সূরা ফাতিহার সাথে সূরা ক্বদর তিনবার এবং
সূরা ইখলাছ ১২ বার পড়েন। অতঃপর নামায শেষ করে ৭০ বার এই দুরূদ শরীফ পাঠ করেন-
اللهم
صل على محمدن النبى الامى وعلى اله وسلم
(আল্লাহুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন্ নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া
আলা আলিহী ওয়া সাল্লিম)
অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ পাক! নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের লক্ষ্যস্থল হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং উনার আল ও ইয়ালগণের উপর খাছ রহমত ও খাছ শান্তি
নাযিল করুন। অতঃপর সিজদা করেন এবং সিজদাতে গিয়ে ৭০ বার এই তাসবীহ পাঠ করেন-
سبوح
قدوس ربنا ورب الملئكة والروح
কুদ্দূসুন রব্বুল মালায়িকাতি ওর্য়া রূহি) অর্থাৎ “সমস্ত তাসবীহ ও সমস্ত পবিত্রতা ফেরেশতা ও রূহগণের রব আল্লাহ
পাক উনার জন্যে।” অতঃপর মাথা মুবারক উঠিয়ে এই দোয়া পাঠ করেন-
رب
اغفر وارحم وتجاوز عما تعلم انك انت العلى الاعظم
(রব্বির্গ্ফি ওর্য়াহাম ওয়া তাজাওয়ায্ আম্মা তা’লামু ইন্নাকা আন্তাল আলিয়্যূল আ’যামু) অর্থাৎ “হে আমার রব! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, রহম করুন এবং যা আমার জন্য
ভাল মনে করেন তা আমার জন্য বরাদ্দ বা সাব্যস্ত করুন। নিশ্চয়ই আপনি সুউচ্চ ও সুমহান
মর্যাদার অধিকারী।”
অপর বর্ণনায় রয়েছে, উচ্চতর ইজ্জত ও সম্মানের অধিকারী। অতঃপর আরেক সিজদা করেন
এবং সিজদাতে গিয়ে প্রথম সিজদার ন্যায় দোয়া করেন, অতঃপর সিজদা অবস্থায় নিজের যা যা প্রয়োজন তা আল্লাহ
পাক উনার নিকট সুওয়াল করেন। কারণ নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি সুওয়ালকারীকে ফিরিয়ে দেননা। (রযীন, মা ছাবাতা মিনাস্ সুন্নাহ)
অতএব, আলফিয়াহ বা রগায়িব নামক নামায বলতে নামায রয়েছে তবে তা রজব মাসের
প্রথম জুমুয়ার রাতে। অর্ধ শা’বানের রাতে নয়।
বি:দ্র: পবিত্র লাইলাতুর রগায়িব-এর মহান রাত্রিতে
যে ইবাদত-বন্দেগীর কথা বর্ণিত হয়েছে তা মূলত: আমালিয়াত। কাজেই, তরিকতপন্থীগণ স্বীয় মুর্শিদ
ক্বিবলা উনার মুবারক ইজাযত ছাড়া এরূপ আমালিয়াত করা থেকে বিরত থাকবেন। অর্থাৎ তরীক্বার ছবক
অনুযায়ী আমল করবেন। এটাই কামালিয়াত হাছিলের মূল সোপান। ৮. অর্ধ শা’বানের রাতে কবর যিয়ারত
করা নাকি বিদয়াত?
উপরোক্ত
গোমরাহী ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যের সঠিক ও দলীলভিত্তিক জবাব হলো- না, অর্ধ শা’বানের রাতে কবর যিয়ারত বিদয়াত নয় বরং সুন্নত। সুন্নতকে বিদয়াত বলা
কাট্টা কুফরী। কোন মুসলমান যদি কুফরী করে সে মুরতাদ ও কাফিরে পরিণত হয়। তার যিন্দিগীর সমস্ত আমল বরবাদ
হয়ে যায়। বিবাহ করে থাকলে স্ত্রী তালাক হয়ে যায়। হজ্জ করে থাকলে তা বাতিল হয়ে যায়। তার ওয়ারিছ সত্ত রহিত
হয়ে যায়। তওবার জন্য তার সময় মাত্র তিনদিন। এর মধ্যে সে তওবা না করলে খিলাফতের পক্ষ হতে তার
একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদ-। সে মারা যাবার পর তার জানাযা পড়ানো ও তাতে শরীক থাকা জায়িয নেই। তাকে কোন মুসলমান কবর
স্থানে দাফন করা যাবেনা। বরং তাকে কুকুর শৃগালের মতো কোন স্থানে পুঁতে রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, অর্ধ শা’বানের রাতটি বিভিন্ন
নামে নাম করণ করা হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, ليلة الزيارة (লাইলাতুয্ যিয়ারাতি)
অর্থাৎ কবর যিয়ারতের রাত।
মূলত অর্ধ শা’বানের রাতে যিয়ারত
করা হয় বলেই এ রাতকে যিয়ারতের রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ রাতে যিয়ারত
করা খাছ সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অন্তর্ভুক্ত। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ
শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে-
(২৯৫-৩০১)
عن
ام المؤمنين حضرت عائشة عليها السلام قالت فقدت رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة
فاذا هو بالبقيع فقال اكنت تخافين ان يحيف الله عليك ورسوله قلت يا رسول الله انى
ظننت انك اتيت بعض نسائك فقال ان الله تعالى ينزل ليلة النصف من شعبان الى السماء
الدنيا فيغفر من اكثر من عدد شعر غنم كلب
অর্থ: “উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা
আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে কোন এক রাত্রিতে রাত্রিযাপন করছিলাম। এক সময় উনাকে বিছানায়
না পেয়ে আমি মনে করলাম যে, তিনি হয়তো অন্য কোন উম্মুল মু’মিনীন আলাইহাস উনার
হুজরা শরীফ-এ তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর আমি তালাশ করে উনাকে জান্নাতুল বাক্বীতে পেলাম। সেখানে তিনি উম্মতের
জন্য আল্লাহ পাক উনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এ অবস্থা দেখে আমি স্বীয় হুজরা
শরীফ-এ ফিরে আসলে তিনিও ফিরে এসে আমাকে বললেন, আপনি কি মনে করেছেন, আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা আপনার সাথে আমানতের খিলাফ করেছেন! আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো অপর কোন উম্মুল মু’মিনীন আলাইহাস সালাম
উনার হুজরা শরীফ তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন। অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল
করেন। অতঃপর তিনি বনী ক্বাল্বের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে
ক্ষমা করে থাকেন।” (তিরমিযী,
ইবনে
মাযাহ, রযীন, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত)
উপরোক্ত হাদীছ শরীফ-এ স্বয়ং আল্লাহ পাক উনার হাবীব
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
শা’বানের অর্ধ রাতে অর্থাৎ শবে বরাতে জান্নাতুল বাক্বী কবরস্থানে
গিয়ে উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তাদের জন্য দোয়া করেছেন। কাজেই অর্ধ শা’বানের রাতে কবর যিয়ারত করা
খাছ সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ৯. হালুয়া-রুটি ও রকমারি খাদ্য প্রস্তুত করা ও বিলি করা নাকি
বিদ্য়াত?
বাতিলপন্থীদের উক্ত মনগড়া ও ভিত্তিহীন বক্তব্যের
সঠিক জবাব হলো, না, শবে বরাতে হালুয়া-রুটি
ও রকমারি খাদ্য প্রস্তুত করা ও বিলি করা বিদ্য়াত ও নাজায়িয কোনটিই নয়। বরং তা সম্পূর্ণরূপে
শরীয়ত তথা কুরআন-সুন্নাহ সম্মত ও অশেষ ছওয়াব বা নেকীর কারণ। শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষ করে আমাদের দেশ ও তার আশপাশের
দেশসমূহে যে রুটি হালুয়ার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে তার পিছনে ইতিহাস রয়েছে।
ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ববর্তী যামানায় বর্তমানের
মতো বাজার, বন্দর, হোটেল-রেস্তোরাঁ ইত্যাদি সর্বত্র
ছিলনা। তখন মানুষ সাধারণত সরাইখানা, লঙ্গরখানা, মুছাফিরখানা ইত্যাদিতে ছফর অবস্থায় প্রয়োজনে রাত্রিযাপন করতেন। অর্থাৎ মুছাফিরগণ তাদের
ছফর অবস্থায় চলার পথে আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনের ঘর-বাড়ি না পেলে সাধারণত সরাইখানা, মুছাফিরখানা ও লঙ্গরখানায় রাত্রিযাপন
করতেন।
আর এ সমস্ত মুসাফিরখানা, লঙ্গরখানা ও সরাইখানার দায়িত্বে
যারা নিয়োজিত থাকতেন তারাই মুছাফিরদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন।
বিশেষ করে মুছাফিরগণ শ’বে বরাতে যখন উল্লিখিত স্থানসমূহে রাত্রি যাপন করতেন তাদের মধ্যে
অনেকেই রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করতেন ও দিনে রোযা রাখতেন। যার কারণে উল্লিখিত স্থানসমূহের
দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ খাবারের ব্যবস্থা করতেন যাতে মুসাফিরদের রাত্রে ইবাদত-বন্দেগী
করতে ও দিনে রোযা রাখতে অসুবিধা না হয়।
আর যেহেতু হালুয়া-রুটি ও গোশ্ত-রুটি খাওয়া সুন্নত
সেহেতু তারা হালুয়া-রুটি বা গোশ্ত-রুটির ব্যবস্থা করতেন। এছাড়াও আরবীয় এলাকার লোকদের
প্রধান খাদ্য রুটি-হালুয়া বা রুটি-গোশ্ত। তারা ভাত, মাছ, ইত্যাদি খেতে অভ্যস্ত নয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে শ’বে বরাত উপলক্ষে হালুয়া-রুটির প্রচলন আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, প্রত্যেক আমলের ক্ষেত্রেই বদ্ রছম বা বদ প্রথার
অনুসরণ করা জায়িয নেই।
এখন মাসয়ালা হচ্ছে- কেউ যদি শ’বে বরাত উপলক্ষে রছম রেওয়াজ না করে বা নিজের ইবাদত-বন্দেগীর
ব্যাঘাত না ঘটিয়ে উক্ত হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা করে তাহলে তা অবশ্যই জায়িয।
শুধু তাই নয় বরং যদি কেউ তার নিজের ইবাদত-বন্দেগী
ঠিক রেখে অন্যান্যদের জন্য যারা রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করবে ও দিনে রোযা রাখবে তাদের
ইবাদত-বন্দেগী ও রোযা পালনের সুবিধার্থে হালুয়া-রুটি বা গোশ্ত-রুটি অথবা আমাদের দেশে
প্রচলিত খাদ্যসমূহের কোন প্রকারের খাদ্যের ব্যবস্থা করে তা অবশ্যই নেকীর কারণ হবে।
চলবে >>> আবা-২০৭
0 Comments:
Post a Comment