কুরআন শরীফ,
হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে লাইলাতুন
নিছফি মিন শা’বান বা শবে বরাত ও তার সংশ্লিষ্ট
বিষয় সম্পর্কে
ফতওয়া দেয়ার কারণ
সুন্নতের পথিকৃত,
হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, দ্বীন ইসলামের নির্ভীক সৈনিক,
সারা জাহান থেকে কুফর, শিরক ও বিদয়াতের মুলোৎপাটনকারী, বাতিলের আতঙ্ক এবং আহ্লে সুন্নত
ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক তাজদীদী মুখপত্র- “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় এ যাবৎ যত লেখা বা ফতওয়াই প্রকাশ বা পত্রস্থ হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ হবে তার প্রতিটিরই
উদ্দেশ্য বা মাকছূদ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ “মাসিক আল বাইয়্যিনাত”-এ এমন সব লেখাই পত্রস্থ হয় যা মানুষের আক্বীদা ও আমলসমূহ পরিশুদ্ধ ও হিফাযতকরণে
বিশেষ সহায়ক।
উলামায়ে ‘ছূ’রা ‘শবে বরাত’ সম্পর্কে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
উলামায়ে ‘ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ীরা বলে ও প্রচার
করে থাকে যে, শবে বরাত কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর
কোথাও নেই, শবে বরাত পালন করা বিদয়াত, নাজায়িয ও হারাম। নাঊযুবিল্লাহ!
তাদের এ বক্তব্যের
কারণে তারা নিজেরা যেরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তদ্রুপ তাদের উক্ত কুফরীমূলক বক্তব্য ও বদ আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ই’তিক্বাদী বা আক্বীদাগত ও আ’মালী বা আমলগত উভয় দিক থেকেই বিরাট ক্ষতির সম্মুক্ষীন হচ্ছে। কেননা হাদীছ শরীফে
শবে বরাতের অশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-
ان
الدعاء يستجاب فى خمس ليال اول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة القدر
المباركة وليلتا العيدين
অর্থ: “নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রিতে দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে থাকে। (১) রজব মাসের প্রথম রাতে,
(২) শবে বরাতের রাতে, (৩) ক্বদরের রাতে, (৪) ঈদুল ফিতরের রাতে, (৫) ঈদুল আযহার রাতে।”
হাদীছ শরীফে
আরো ইরশাদ হয়েছে-
عن على
رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من
شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء
الدنيا فيقول الامن مستغفر فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا
الا كذا حتى يطلع الفجر.
অর্থ: “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যখন শা’বানের পনের তারিখ রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে
এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর
আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, “কোন ক্ষমা প্র্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা
করে দিব।” “কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে রিযিক
দান করব।” “কোন মুছিবতগ্রস্থ ব্যক্তি আছ কি? আমি তার মুছিবত
দূর করে দিব।” এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ্, মিশকাত)
এ ধরনের আরো
অসংখ্য হাদীছ শরীফ রয়েছে, যাতে শবে বরাত-এর ফযীলতের কথা বলা
হয়েছে অর্থাৎ যারা শবে বরাত পালন করবে তারা মহান আল্লাহ পাক ও উনার
হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদের উভয়েরই খাছ রেযামন্দি বা সন্তুষ্টি
লাভ করবে।
অতএব,
নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, উলামায়ে “ছূ"দের উক্ত বক্তব্য ও বদ আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ‘শবে বরাত’ পালন থেকে বিরত থেকে অশেষ ফযীলত
থেকে মাহরূম হবে। যা আমলের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
কাজেই যারা এ
ধরনের কুফরী আক্বীদায় বিশ্বাসী ও কুফরী বক্তব্য প্রদানকারী, তারা ও হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণ ঈমান ও আমলকে যেন হিফাযত করতে পারে। অর্থাৎ শবে বরাতসহ সকল বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার ন্যায় আক্বীদা পোষণ
করতে পারে এবং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস মোতাবেক আমল করে আল্লাহ পাক-উনার রেজামন্দী হাছিল করতে পারে। সে
জন্যই কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান বা শবে বরাত’-এর আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত ফতওয়াটি প্রকাশ করা হলো।
কুরআন শরীফ-এর
আয়াত শরীফ দ্বারাই ‘শবে বরাত’ প্রমাণিত
শবে বরাত বা
ভাগ্য রজনীকে স্বয়ং আল্লাহ পাক স্বীয় কুরআন শরীফ-এ সূরা ‘আদ দোখান’ এর ৩-৪ নম্বর আয়াত শরীফে ليلة مباركة (বরকত পূর্ণ রাত) হিসেবে উল্লেখ করে
মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-
انا
انزلناه فى ليلة مباركة انا كنا منذرين. فيها يفرق كل امر حكيم
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি উহা (কুরআন শরীফ) এক রবকতপূর্ণ রাত্রিতে নাযিল করেছি। অর্থাৎ নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী, ওই রাত্রিতে সমস্ত হিকমতপুর্ণ কাজসমূহের বণ্টন করা হয় তথা বণ্টনের ফায়সালা করা
হয়।” (সূরা আদ দোখান-৩-৪)
উক্ত আয়াত শরীফ-এ
বর্ণিত ‘লাইলাতুম মুবারকাহ’ দ্বারা অনুসরণীয় মুফাসসিরীনে কিরাম উনারা শবে বরাতকেই বুঝিয়েছেন
পূর্ব প্রকাশিতের
পর
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত
তাফসীর “তাফসীরে রুহুল মায়ানী”-এর ১৩তম খ-ের ১১০-১১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ
আছে-
(৭২-৭৭)
وقال
عكرمة وجماعة: هى ليلة النصف من شعبان وتسمى ليلة الرحمة والليلة المباركة وليلة
الصك وليلة البراءة ... وذكروا فى فضل هذه الليلة اخبارا كثيرة منها ما اخرجه ابن
ماجه والبيهقى فى شعب الايمان عن على كرم الله وجهه رضى الله تعالى عنه قال قال
رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا
نهارها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الا مستغفر
فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الاكذا حتى يطلع الفجر.
وما
اخرجه الترمذى وابن ماجه ابى شيبة البيهقى وابن ماجه عن عائشة عليها السلام قالت
فقدت رسول الله صلى الله عليه وسلم ذات ليلة فخرجت اطلبه فاذا هو بالبقيع رافعا
رأسه الى السماء فقال يا عائشة عليها السلام أكنت تخافين ان يحيف الله تعالى عليك
ورسوله؟ فقلت مابى من ذالك ولكن ظننت أنك أتيت بعض نسائك فقال ان الله تعالى عزوجل
ينزل ليلة النصف من شعبان الى السماء الدنيا فيغفر لاكثر من عدد شعر غنم كلب.
وما
اخرجه احمد بن حنبل فى المسند عن عبد الله ابن عمرو بن العاص ان رسول الله صلى
الله عليه وسلم قال يطلع الله تعالى الى خلقه ليلة النصف من شعبان فيغفر لعباده
الا الاثنين مشاحن وقاتل نفس.
অর্থ: হযরত ইকরামা
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের
একটি জামায়াত বলেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শা’বান তথা ১৫ শা’বানের রাত তথা শবে বরাত। ১৫ শা’বানের রাতকে লাইলার্তু রহমত তথা রহমতের
রাত হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে এবং লাইলাতুম মুবারাকা তথা বরকতের রাত হিসেবেও নামকরণ
করা হয়েছে এবং লাইলাতুছ ছক্ক তথা চেক বা রসিদ কাটার রাত হিসেবেও নাম করণ করা হয়েছে
এবং লাইলাতুল বারায়াত তথা মুক্তি বা ভাগ্যের রাত হিসেবেও নামকরণ করা হয়েছে।
..উনারা সকলে এই
শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে অসংখ্য হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে যেটা হযরত
ইমাম ইবনে মাজাহ এবং হযরত ইমাম বাইহাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি ‘শুয়াবুুল ঈমান’-এর মধ্যে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে
বর্ণনা করেন। হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ইরশাদ
করেন, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, যখন অর্ধ শা’বানের রাত আগমন করে তখন তোমরা (ইবাদতে) রাত্রি জাগরণ কর এবং দিনের বেলায় রোযা রাখ।
কেননা, মহান আল্লাহ পাক ওই শবে বরাতে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে
দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন।
অতঃপর বলেন,
সাবধান! কে আছো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি আজ তাকে ক্ষমা করে দিব। কে
আছো রিযিক তালাশকারী? আজ আমি তার রিযিক (পর্যাপ্ত) দিয়ে
দিব। কে আছ রোগী? আমি তার রোগ মাফ করে দিব। (সাবধান!
সাবধান!) জেনে রাখ, জেনে রাখ। এভাবেই ফজর পর্যন্ত ডাকতে
থাকেন।
অতঃপর হযরত ইমাম
তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত ইমাম ইবনে আবি শাইবা রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম বাইহাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম ইবনে মাজাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণনা করেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি ইরশাদ করেন, আমি একদা রাত্রিকালে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হারিয়ে ফেললাম
অর্থাৎ দেখতে না পেয়ে তালাশ করার জন্য আমি ঘর থেকে বের হয়ে উনাকে জান্নাতুল বাকীতে আকাশের
দিকে মাথা মুবারক উঠানো অবস্থায় দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
হে উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম! আপনি কি আশঙ্কা করেতেছিলেন যে, আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার (আমানত) খিয়ানত
করছেন? উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম জাওয়াবে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম! আমি মনে করেছিলাম হয়তোবা আপনি আপনার অন্যান্য উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের হুজরা শরীফ-এ তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর আখিরী রসূল,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক ১৫ই শা’বানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বনী কলব গোত্রের ছাগলের লোমের সংখ্যা
পরিমাণ থেকেও অধিক সংখ্যক গুনাহগার বান্দাদের মহান আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দেন। সুবহানাল্লাহ!
হযরত ইমাম আহমদ
ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুসনাদে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয়ই হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহ পাক অর্ধ শা’বান তথা শবে বরাতে বান্দাদের উদ্দেশ্যে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন এবং উনার অসংখ্য বান্দাদেরকে ক্ষমা করার কথা ঘোষণা করেন।
তবে হিংসুক এবং মুসলমানকে হত্যাকারী ব্যতীত।
“তাফসীরে রুহুল মায়ানী” কিতাবের ১৩তম খ-ের ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(৭৮)
ووصف
الليلة بالبركة لما أن انزال القران مستتبع للمنافع الدينية والدنوية بأ جمعها أو
لما فيها من تنزل الملائكة والرحمة واجابة الدعوة وفضيلة العبادة او لما فيها من
ذلك وتقدير الأرزاق وفضل الأقضية لاجال وغيرها واعطاء تمام الشفاعة له عليه الصلاة
والسلام وهذا بناء على أنها ليلة البراءة فقد روى أنه صلى الله تعالى عليه وسلم
سأل ليلة الثالث عشر من شعبان فى أمته فأعطى الثلث منها ثم سأل ليلة الرابع عشر
فأعطى الثلثين ثم سأل ليلة الخامس عشر فاعطى الجميع الا من شرد على الله تعالى
شراد البعير.
অর্থ: “লাইলাতুল মুবারাকাকে বরকতের রাত হিসেবে এজন্যই গুনান্বিত করা হয়েছে যেহেতু পবিত্র
কুরআন শরীফ দ্বীনি এবং দুনিয়াবী বহুবিদ কল্যাণের জন্যই (ঐ রাতেই) অবতীর্ণ হয়েছে। সমস্ত
ফেরেশ্তাগণ উনারা অবতরণ করেন এবং রহমত নাযিল হয়, বান্দাদের দোয়া কবুল করা হয়। বান্দাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় এবং যেহেতু ঐ রাতেই
বান্দাদের রিযিক্ব বন্টন করা হয় এবং সমস্ত কিছুর ভাগ্যসমূহ পৃথক করা হয়। যেমন মৃত্যু
এবং অন্যান্য সব বিষয়ের। এবং হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার
সমস্ত বিষয়ের সুপারিশ কবুল করা হয়। আর এই বরকতের রাতকে বরাতের রাত হিসেবেও নাম করা
হয়। যেহেতু এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে যে, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শা’বান মাসের ১৩ তারিখ রাতে স্বীয় উম্মতের ক্ষমার জন্য আল্লাহ পাক-উনার কাছে প্রার্থনা
করেন। অতঃপর সেই রাতে মহান আল্লাহ পাক হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার উম্মত থেকে এক তৃতীয়াংশ উম্মতকে ক্ষমা করেন। সুবহানাল্লাহ!
অতঃপর অনুরূপভাবে
শা’বান মাসের ১৪ তারিখের রাতে আল্লাহ পাক-উনার কাছে প্রার্থনা করেন তখন সেই শবে বরাতে
মহান আল্লাহ পাক উনার উম্মতের দুই তৃতীয়াংশ উম্মতকে ক্ষমা করেন। অতঃপর অনুরূপভাবে ১৫ই
শা’বান তথা শবে বরাতেও মহান আল্লাহ পাক-উনার কাছে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন
তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি সেই শবে বরাতে উনার সমস্ত উম্মতগণকে ক্ষমা করে দেন। তবে ওই সমস্ত লোক ব্যতীত যারা মহান আল্লাহ পাক-উনার
ব্যাপারে চরম বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে।
“তাফসীরে রহুল মায়ানী” -কিতাবের ১৩তম খ-ের ১১৩ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে-
(৭৯-৮২)
ان
الليلة المباركة هى ليلة البراءة اخرج ابن جرير وابن المنذر ابن ابى حاتم من طريق
محمد بن سوقة عن عكرمة انه قال فى الاية فى ليلة النصف من شعبان يبرم امر السنة
وينسخ الاحياء من الاموات ويكتب الحاج فلا يزاد فيهم ولا ينقص منهم احد وفى كثير
من الاخبار الاقتصار على قطع الاجال اخرج ابن جرير والبيهقى فى شعب الايمان عن
الزهرى عن عثمان محمد بن المغيرة بن الاخفش قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم
تقطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل لينكح ويولد له وقد خرج اسمه فى
الموتى. واخرج الدينورى فى المجالسة عن راشد بن سعد ان النبى صلى الله عليه وسلم
قال فى ليلة النصف من شعبان يوحى الله تعالى الى ملك الموت بقبض كل نفس يريد قبضها
فى تلك السنة (نحوه كثير) وقيل يبدأ ان فى استنساخ كل أمر حكيم من اللوح المحفوظ
فى ليلة البراءة ويقع الفراغ فى ليلة القدر فتدفع نسخة الارزاق الى ميكائيل عليه
السلام ونسخة الحروب الى جبرائيل عليه السلام وكذالك الزلازل والصواعق والخسف
ونسخة الاعمال الى اسماعيل عليه السلام صاحب سماء الدنيا وهو ملك عظيم ونسخة
المصائب الى ملك الموت وروى عن ابن عباس رضى الله تعالى عنهما تقضى الاقضية كلها
ليلة النصف من شعبان وتسلم الى اربابها ليلة السابع العشرين من شهر رمضان نعمر حكى
عن عكرمة ان ليلة النصف من شعبان هى ليلة القدر.
অর্থ: নিশ্চয়ই
লাইলাতুল মুবারকাই হচ্ছে লাইলাতুল বরাত তথা ভাগ্য রজনী। হযরত ইমাম ইবনে জারীর তাবারী
রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইবনে মুনযির রহমতুল্লাহি আলাইহি,
হযরত ইবনে হাতীম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা সকলেই হযরত মুহম্মদ ইবনে সাওকাহ রহমতুল্লাহি
আলাইহি থেকে বর্ণনা করেন। তিনি আবার প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেন। হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এই আয়াত
শরীফ-এর ব্যাপারে বলেন যে, অর্ধ শা’বানের রাত তথা শবে বরাতে আগামী এক বৎসরের ভাগ্য লিপিবদ্ধকরণ হয়ে থাকে। আরো লিপিবদ্ধ করা হয় মৃত্যু ও জীবিতদের। এবং লেখা
হয় হাজীদের তালিকা। তাদের ওই তালিকা থেকে কোন কমবেশি করা হয় না। আর এই শবে বরাতে মৃত্যুর
সময় নির্ধারণের ব্যাপারেও অসংখ্য হাদীছ শরীফ রয়েছে।
যেমন,
হযরত ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম বায়হাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “শুবুলুল ঈমান’ কিতাবে, হযরত ইমাম যুহরী রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণনা করেন। তিনি আবার হযরত উছমান ইবনে
মুহম্মদ ইবনে মুগীরাহ ইবনে আখফাশ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণনা
করেন। তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময় কর্তন করা
হয় শা’বান মাসে তথা শবে বরাতে তা পরবর্তী শা’বান তথা পরবর্তী শবে বরাত পর্যন্ত এর সময়সীমা থাকে, এমনকি এর মধ্যেই সেই ব্যক্তি বিবাহ করে, তার থেকে সন্তান জন্মগ্রহণ করে অথচ তার নাম বেরিয়ে আসে মৃত্যুর তালিকায়।
অনুরূপভাবে হযরত দাইনূরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘মাজালিসাত’ নামক কিতাবে হযরত রশিদ ইবনে সা’দ রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি মালাকুল মউত
হযরত আজরাঈল আলাইহিস্ সালাম তিনি আগামী এক বৎসরে কতগুলো জীবন কবয তথা মৃত্যু ঘটাবেন এ ব্যাপারে আল্লাহ
পাক উনাকে অহী করে থাকেন এই অর্ধ শা’বানে (শবে বরতে)। এরূপ অসংখ্য হাদীছ শরীফ রয়েছে।
কোন কোন মুফাসসিরীনে
কিরাম উনারা বর্ণনা করেন, বরাতের রাতেই প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ
বিষয়ের তালিকা লওহে মাহফুয থেকে আসা শুরু হয়। অতঃপর সেই তালিকা আসা শেষ হয় শবে ক্বদরে।
এবং সেই ক্বদরের রাতেই তথা শবে ক্বদরেই ভাগ্যের তালিকাগুলো পেশ করা হয় কার্যকরী (ফেরেশতা
উনাদের হাতে) যেমন রিযিকের তালিকা পেশ করা হয় হযরত মিকাঈল আলাইহিস সালাম-উনার হাতে।
যুদ্ধ বিগ্রহ-এর তালিকা পেশ করা হয় হযরত জিবরাঈল আলাইহিস্ সালাম-উনার হাতে। অনুরূপভাবে
ভূমিকম্প, বজ্রপাত, চন্দ্র এবং সূর্য
গ্রহণের তালিকাও উনার হাতে পেশ করা হয়।
অনুরূপভাবে আ’মলসমূহের তালিকা পেশ করা হয় দুনিয়ার আকাশের অধিবাসী একজন বড় ফেরেশতা হযরত ইসমাঈল
আলাইহিস সালাম-উনার হাতে। আর যাবতীয় মুছীবতের আমলসমূহ পেশ করা হযরত আজরাঈল আলাইহিস
সালাম-উনার হাতে।
হযরত আব্দুল্লাহ
ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণিত যে, সমস্ত ফরমানকৃত বিষয়ের ফায়ছালা করা হয় অর্ধশা’বান অর্থাৎ ১৫ শা’বানের রাতে তথা শবে বরাতে। আর এই ফয়ছালাকৃত তালিকাসমূহ কার্যকর করার জন্য পেশ করা
হয় কার্যকারী ফেরেশ্তাদের হাতে রমযান শরীফ-এর ২৭ তারিখে তথা শবে ক্বদরে।
...... হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে উত্তম বর্ণনা রয়েছে যে, অর্ধ শা’বানের রাতই হচ্ছে ভাগ্যের রাত।”
হযরতুল আল্লামা সাইয়্যিদ মাহমুদ আলুসী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “তাফসীরে রুহুল মায়ানী” কিতাবের ১৫ খ-ের ২২১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ
করেন-
(৮৩)
قول كثير
انه النصف من شعبان وهى المراد بالليلة المباركة التى قال الله تعالى فيها يفرق كل
امر حكيم واجاب بان ههنا ثلاثة اشياء الاول نفس تقدير الامور اى تعيين مقاديرها و
اوقاتها وذلك فى الازل والثانى اظهار تلك المقادير للملائكة عليهم السلام تكتب فى
اللوح المحفوظ وذلك فى ليلة النصف من شعبان الثالث اثبات تلك المقادير فى نسخ
وتسليمها الى اربابها من المدبرات فتدفع نسخة الارزاق والنباتات والامطار الى
ميكائيل عليه السلام ونسخة الحروب والرياح والجنود والزلازل والصواعق والخسف الى
جبرئيل عليه السلام ونسخة الاعمال الى اسرافيل عليه السلام ونسخة المصائب الى ملك
الموت وذلك فى ليلة القدر وقيل يقدر فى ليلة النصف من شعبان الاجال والارزاق وفى
ليلة القدر الامور التى فيها الخير البركة السلامة.
অর্থ: “অধিকাংশ বর্ণনাকারীর মতে অর্ধ শা’বানের রাত তথা শবে বরাত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল মুবারাকা তথা বরকতের রাত। আর এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র
কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন, فيها يفرق كل امر حكيم
“সেই রাত্রিতে প্রত্যেক হিক্বমতপূর্ণ বিষয়ের ফয়ছালা করা হয়।” এ ব্যাপারে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়, প্রথমটি হচ্ছে-
যাবতীয় বিষয়ের ভাগ্যগুলো মজবুত করা হয়, তথা ভাগ্যসমূহ
নির্ধারণ করা হয় এবং মৃত্যুর সময়ও নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয়ত: ওই ফয়ছালাকৃত বিষয়সমূহ
ফেরেশতাদেরকে প্রদর্শন করানো হয় যা লওহে মাহফুযে লিখিত আছে। এরূপ সমস্ত ভাগ্য তালিকা
প্রস্তুত হয় অর্ধ শা’বানের রাতে তথা শবে বরাতে। তৃতীয়ত: ওই সমস্ত ভাগ্যলিপিসমূহ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে
তা বাস্তবায়ন করার জন্য পেশ করা বাস্তবায়নকারীদের হাতে। যেমন, রিযিকের ও যাবতীয় ফসলাদির তালিকা এবং বৃষ্টির তালিকা সমূহ পেশ করা হয় হযরত মিকাঈল
আলাইহিস সালাম-উনার হাতে।
আর যুদ্ধের তালিকা,
বাতাস পরিচালনার তালিকা, সাহায্যকারীদের তালিকা,
ভূমিকম্প, বজ্রপাত এবং চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের
তালিকা পেশ করা হয় হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-উনার হাতে।
অনুরূপভাবে আমলসমূহের
তালিকা পেশ করা হয় হযরত ইসরাফিল আলাইহিস সালাম-উনার হাতে। এবং মুছীবতের তালিকাও পেশ
করা হয় মালাকুল মউত হযরত আজরাঈল আলাইহিস সালাম-উনার হাতে। আর এই সমস্ত বিষয় কার্যকরীকরণ
তথা চালু করা হয় ক্বদর রাতে তথা শবে ক্বদরে।
কোন কোন বর্ণনাকারী
বলেন অর্ধ শা’বানের রাতে তথা শবে বরাতে মৃত্যুর এবং রিযিকের তালিকা নির্ধারণ করা হয়। আর শবে
ক্বদরে ওইসব বিষয়ের খায়ের, বরকত এবং সালামত নেমে আসে।
উপরোক্ত দলীলভিত্তিক
আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, অধিকাংশ অনুসরনীয়
মুফাসসিরীণগণ উনারা ‘সূরা দুখানে’ বর্ণিত ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান’ অর্থাৎ শবে বরাতকেই বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ ‘শবে বরাত’ কুরআন শরীফ-এর আয়াত শরীফ দ্বারাই
অকাট্যভাবে প্রমাণিত। অতএব শবে বরাতের বিরোধিতা করা বা শবে বরাতকে অস্বীকার করা মূলত
কুরআন শরীফ-এর আয়াত শরীফকেই অস্বীকার করার নামান্তর। যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
আবা-২০০
0 Comments:
Post a Comment