কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান বা শবে বরাত ও তার সংশ্লিষ্ট
বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ
সুন্নতের পথিকৃত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, দ্বীন ইসলামের নির্ভীক সৈনিক, সারা জাহান থেকে কুফর, শিরক ও বিদয়াতের মুলোৎপাটনকারী, বাতিলের আতঙ্ক এবং আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক
তাজদীদী মুখপত্র- æমাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় এ যাবৎ যত লেখা বা ফতওয়াই প্রকাশ বা পত্রস্থ হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ হবে
তার প্রতিটিরই উদ্দেশ্য বা মাকছূদ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ æমাসিক আল বাইয়্যিনাত”-এ এমন সব লেখাই পত্রস্থ হয় যা মানুষের আক্বীদা ও আমলসমূহ
পরিশুদ্ধ ও হিফাযতকরণে বিশেষ সহায়ক।
উলামায়ে ‘ছূ’রা
‘শবে বরাত’ সম্পর্কে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। উলামায়ে ‘ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ীরা বলে ও প্রচার করে থাকে যে, শবে বরাত কুরআন শরীফ ও
হাদীছ শরীফ-এর কোথাও নেই, শবে বরাত পালন করা বিদয়াত, নাজায়িয ও হারাম। নাঊযুবিল্লাহ!
তাদের এ বক্তব্যের কারণে
তারা নিজেরা যেরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তদ্রুপ তাদের উক্ত কুফরীমূলক বক্তব্য
ও বদ আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ই’তিক্বাদী বা আক্বীদাগত ও আ’মালী
বা আমলগত উভয় দিক থেকেই বিরাট ক্ষতির সম্মুক্ষীন হচ্ছে। কেননা হাদীছ শরীফে শবে বরাতের
অশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-
ان الدعاء يستجاب فى خمس ليال اول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة القدر المباركة وليلة العيدين
অর্থ: æনিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রিতে দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে থাকে। (১) রজব মাসের প্রথম রাতে, (২) শবে বরাতের রাতে, (৩) ক্বদরের রাতে, (৪) ঈদুল ফিতরের রাতে, (৫) ঈদুল আযহার রাতে।”
হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ
হয়েছে-
عن على رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الامن مستغفر فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر.
অর্থ: æহযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যখন শা’বানের
পনের তারিখ রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা
রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন
অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, æকোন ক্ষমা প্র্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।” æকোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে রিযিক দান করব।” æকোন মুছিবতগ্রস্থ ব্যক্তি আছ কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিব।” এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ্, মিশকাত)
এ ধরনের আরো অসংখ্য হাদীছ
শরীফ রয়েছে,
যাতে শবে বরাত-এর ফযীলতের কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ যারা শবে বরাত
পালন করবে তারা মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদের
উভয়েরই খাছ রেযামন্দি বা সন্তুষ্টি লাভ করবে।
অতএব, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, উলামায়ে æছূ"দের উক্ত বক্তব্য ও বদ আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ‘শবে
বরাত’ পালন থেকে বিরত থেকে অশেষ ফযীলত থেকে মাহরূম হবে। যা আমলের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে
ক্ষতিকর।
কাজেই যারা এ ধরনের কুফরী
আক্বীদায় বিশ্বাসী ও কুফরী বক্তব্য প্রদানকারী, তারা ও হক্ব তালাশী সমঝদার
মুসলমানগণ ঈমান ও আমলকে যেন হিফাযত করতে পারে। অর্থাৎ শবে বরাতসহ সকল বিষয়ে আহলে সুন্নত
ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার ন্যায় আক্বীদা পোষণ করতে পারে এবং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস মোতাবেক আমল করে আল্লাহ পাক-উনার রেজামন্দী
হাছিল করতে পারে। সে জন্যই কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান
বা শবে বরাত’-এর আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত ফতওয়াটি প্রকাশ করা হলো।
কুরআন শরীফ-এর আয়াত শরীফ
দ্বারাই ‘শবে বরাত’ প্রমাণিত
শবে বরাত বা ভাগ্য রজনীকে
স্বয়ং আল্লাহ পাক স্বীয় কুরআন শরীফ-এ সূরা ‘আদ দোখান’ এর ৩-৪ নম্বর আয়াত শরীফে ليلة مباركة (বরকত পূর্ণ রাত) হিসেবে উল্লেখ করে মহান আল্লাহ
পাক তিনি ইরশাদ করেন-
انا انزلناه فى ليلة مباركة انا كنا منذرين. فيها يفرق كل امر حكيم
অর্থ: æনিশ্চয়ই আমি উহা (কুরআন শরীফ) এক রবকতপূর্ণ রাত্রিতে নাযিল করেছি। অর্থাৎ নাযিল
করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী, ওই রাত্রিতে সমস্ত হিকমতপুর্ণ
কাজসমূহের বণ্টন করা হয় তথা বণ্টনের ফায়সালা করা হয়।” (সূরা আদ দোখান-৩-৪)
উক্ত আয়াত শরীফ-এ বর্ণিত
‘লাইলাতুম মুবারকাহ’ দ্বারা অনুসরণীয় মুফাসসিরীনে কিরাম উনারা শবে বরাতকেই
বুঝিয়েছেন
পূর্ব প্রকাশিতের পর
সূরা আদ দুখান-এর ليلة مباركة এর পরবর্তী আয়াত শরীফ-এ বলা হয়েছে-
فيها يفرق كل امر حكيم
অর্থ: æসেই মুবারক রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়সমূহের ফায়ছালা করা হয়।”
এখানে فيها তথা মুবারকপূর্ণ রাতের
ব্যাখ্যায় সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর æতাফসীরে কুরতুবী”-এর ১৬তম খ-ের ১২৬/১২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(১৯-২১)
وقال عكرمة رضى الله تعالى هى ليلة النصف من شعبان يبرم فيها امر السنة وينسخ الاحياء من الاموات ويكتب الحاج فلا يزاد فيهم احد ولا ينقص منهم احد. وروى عثمان ان المغيرة رضى الله تعالى عنه قال قال النبى صلى الله عليه وسلم تقطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل لينكح ويلد له وقد خرج اسمه فى الموتى.
عن النبى صلى الله عليه وسلم قال اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلتها وصوموا نهارها فان الله ينزل لغروب الشمس الى سماء الدنياء يقول الا من مستغفر فاغفر له الا مبتلى فاعافيه الا مسترزق فارزقه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر.
ذكر الثعلبى وخرج الترمذى بمعناه عن عائشة عليها السلام عن النبى صلى الله عليه وسلم قال ان الله عز وجل ينزل ليلة النصف من شعبان الى سماء الدنيا فيغفر لاكثر من شعر غنم كلب. وقد ذكر حديث عائشة عليها السلام مطولا صاحب كتاب العروس. واختار ان الليلة التى يفرق فيها كل امر حكيم ليلة النصف من شعبان وانها تسمى ليلة البراءة.
অর্থ: æবিখ্যাত ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, ফায়ছালার রাতই হচ্ছে- অর্ধ শা’বানের তথা ১৫ই শা’বানের
রাত। এই শবে বরাতে সামনে এক বৎসরে যাবতীয় কিছুর ফায়ছালা করা হয় এবং তালিকা প্রস্তুত
করা হয় মৃত ও জীবিতদের। এমনকি হজ্জ পালনকারীদের তালিকাও করা হয় সেই অর্ধ শা’বানের
রাতে। ওই রাতে যার যার ভাগ্যে যা কিছু লেখা হয় তা থেকে কোন কমতিও করা হয়না এবং কোন
কিছু বেশিও করা হয় না।
হযরত উসমান ইবনে মুহম্মদ
ইবনে মুগীরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত মুগীরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, এক শা’বান হতে পরবর্তী শা’বান পর্যন্ত মৃতদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ
এক অর্ধ শা’বান থেকে পরবর্তী অর্ধ শা’বান পর্যন্ত মৃতদের ভাগ্য তালিকা প্রস্তুত
করা হয়। এবং ওই রাত্রিতে এটাও লেখা হয় ব্যক্তির বিবাহ কখন হবে এবং সেই বৎসর তার কি
সন্তান হবে এবং সেই বৎসর কখন মৃত্যুবরণ করবে তার তালিকাও প্রস্তুত করা হয় শবে বরাতে।
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো ইরশাদ করেন, যখন অর্ধ শা’বান তথা শবে বরাত তোমাদের কাছে সমাগত হয়, তখন তোমরা ওই ১৫ই শা’বানের রাত্রিতে ইবাদত বন্দেগী করে রাত্রি জাগরণ করিও এবং
উহার দিবা বেলায় রোযা রাখিও। কেননা মহান আল্লাহ পাক ওই ১৫ই শা’বানের
রাত্রির সূচনালগ্নে সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথেই পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে
থাকেন, হে পৃথিবীবাসী! তোমাদের মধ্যে এমন কে আছ? ক্ষমা প্রার্থী, আমার কাছে ক্ষমা চাও (আজ) আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিব। কে আছো রোগী? আমার কাছে দরখাস্ত কর আমি রোগ মোচন করে দিব। কে আছো রিযিক তালাশী? আমার কাছে রিযিক চাও, আজ আমি তাকে প্রচুর পরিমাণে রিযিক দিয়ে দিব। সাবধান! সাবধান!
এইভাবেই মহান আল্লাহ পাক বান্দাদেরকে ফজর পর্যন্ত ডাকতে থাকেন। হযরত ইমাম ছালাবী রহমতুল্লাহি
আলাইহি এভাবে বর্ণনা করেন এবং ইমাম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি উপরোক্ত হাদীছ শরীফখানার
সমার্থবোধক হিসেবে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা
বর্ণনা করেন।
উম্মুল মু’মিনীন
হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনার থেকে বর্ণনা করে বলেন, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক অর্ধ শাবান তথা ১৫ই শা’বানের রাত্রে অর্থাৎ শবে
বরাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। অতপর বনী কলব গোত্রেয় ছাগলের লোম পরিমাণ অধিক সংখ্যক
গুনাহগার ব্যক্তিদেরকে ক্ষমা করে থাকেন।
আর উম্মুল মুমিনীন হযরত
আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম-উনার এই বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা অনেক লম্বা হাদীছ শরীফ
যেটা æকিতাবুল উরুস’ গ্রন্থকার উল্লেখ করেন। আর তিনি নির্ভরযোগ্য
মত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, নিশ্চয়ই যেই রাত্রিতে সমস্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ
বিষয়সমূহের ফায়ছালা করা হয়ে থাকে সেই রাত্রিই হচ্ছে অর্ধ শা’বান
তথা ১৫ই শা’বানের রাত। আর অবশ্যই ওই রাতকেই লাইলাতুল বরাত বা বরাতের রাত তথা ভাগ্য রজনী বলা
হয়।
এ প্রসঙ্গে সূরা ক্বদরের
তাফসীরে ‘তাফসীরে কুরতুবী’-এর ২০তম জুযে ১৩০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(২২)
وعن ابن عباس رضى الله تعالى عنه ايضا ان الله تعالى يقضى الاقضية فى ليلة النصف من شعبان ويسلمها الى اربابها فى ليلة القدر.
অর্থ: æপ্রখ্যাত ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে
বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শা’বান
তথা ১৫ই শা’বানের রাত্রিতে অর্থাৎ শবে বরাতে যাবতীয় বিষয়ের ভাগ্য তালিকা প্রস্তুত করেন। আর
ক্বদরের রাত্রিতে ওই ভাগ্যতালিকা পেশ করেন বাস্তবায়নকারী ফেরেশতাদের হাতে।
কাজেই উক্ত আলোচনা থেকে
পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠলো যে, শবে বরাত বান্দাদের তালিকা প্রস্তুত
করা হয় আর শবে ক্বদরে সেই ভাগ্যতালিকা জারি বা কার্যকরী করা হয়। এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত
তাফসীর ‘তাফসীরে লুবাব’-এর ১৭তম খ-ের ৩১০-৩১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(২৩-২৪)
(فيها) اى فى الليلة المباركة (يفرق) يفصل (كل امر حكيم) ... وقال عكرمة رضى الله تعالى عنه هى ليلة النصف من شعبان يقوم فيها امر السنة وتنسخ الاحياء من الاموات فلا يزاد فيهم ولا ينقص منهم احد قال عليه الصلاة السلام تقطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل لينكح ويولد له ولقد اخرج اسمه فى الموتى وعن ابن عباس رضى الله تعالى عنهما ان الله يقضى الاقضية فى ليلة النصف من شعبان ويسلمها الى اربابها فى ليلة القدر وروى ان الله تعالى انزل كل القران من اللوح المحفوظ فى ليلة البراءة وقع الفراغ فى ليلة القدر.
অর্থ: æওই মুবারক তথা বরকতপূর্ণ রাত্রিতে অর্থাৎ শবে বরাতে প্রত্যেক হিক্বমতপূর্ণ যাবতীয়
বিষয়সমূহের ফায়ছালা করা হয়। বিখ্যাত ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
তিনি বলেন,
লাইলাতুম মুবারকা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শা’বান
তথা ১৫ই শা’বানের রাত। এই শবে বরাতে আগামী এক বৎসরের যাবতীয় বিষয়ের ভাগ্যতালিকা প্রস্তুত করা
হয় এবং তালিকা প্রস্তুত করা হয় মৃত ও জীবিতদের। ওই তালিকা থেকে কোন কম বেশি করা হয়না
অর্থাৎ কোনরূপ পরিবর্তন হয় না।
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, এক শা’বান
তথা ১৫ই শাবান থেকে পরবর্তী ১৫ই শা’বান পর্যন্ত মৃতদের তালিকা প্রস্তুত
করা হয়। এমনকি লোকেরা ওই বৎসরে বিবাহ করবে তার থেকে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সেই বৎসর
কখন মৃত্যুবরণ করবে তার তালিকাও ওই শবে বরাতে প্রস্তুত করা হয়।
প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনার থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক অর্ধ শা’বানের
রাতে তথা শবে বরাতে যাবতীয় বিষয়ের ফায়ছালা করে থাকেন। আর শবে ক্বদরে ওই নির্ধারিত ফায়ছালার
বাস্তবায়ন করার জন্য বাস্তবায়নকারী ফেরেশতাদের হাতে সেই তালিকা পেশ করেন।
আর এটাও বর্ণিত আছে যে, æনিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ শবে বরাতে লাওহে মাহফূয থেকে অবতীর্ণ
করা শুরু করেন এবং শবে ক্বদরে তা শেষ করেন।”
এ প্রসঙ্গে সুবিখ্যাত
তাফসীর ‘তাফসীরে গারায়িবুল কুরআন ওয়া রাগায়িবুল কুরআন, হাশিয়ায়ে জামিউল বয়ান’-এর ৩০তম জুযের ১৩৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(২৫-২৭)
وعن عكرمة رضى الله تعالى عنه انها ليلة البراءة
অর্থ: æপ্রখ্যাত ছাহাবী হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই পবিত্র কুরআন শরীফ যে রাতে অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয় তা হচ্ছে বরাতের রাত।
তথা শবে বরাতে।” (তাফসীর তাবারী, ৩০ খ-)
বিশ্বখ্যাত তাফসীর æতাফসীরে কুরতুবী”-এর ১৬তম খ-ের ১২৮ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে-
(২৮)
يبدأ فى استنساخ ذالك من اللوح المحفوظ فى ليلة البراءة ويقع الفراغ فى ليلة القدر.
অর্থ: æলাওহে মাহফূয-এর প্রত্যেকটি বিষয়ের অনুলিপি বা ভাগ্যলিপি লেখা শুরু হয় শবে বরাতের
রাত্রে এবং শেষ হয় শবে ক্বদরের রাত্রে।”
এ প্রসঙ্গে তাফসীর জগতের
সুবিখ্যাত এবং সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর, ‘তাফসীরে ইবনে কাছীর’-এর ৪র্থ খ-ের ২১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(২৯-৩০)
ومن قال انها ليلة النصف من شعبان كما روى عن عكرمة ... والحديث الذى رواه عبد الله بن صالح عن الليث عن عقيل عن االزهرى. اخبرنى عثمان بن محمد بن المغيرة الاخنس قال ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال تقطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل لينكح ويولد له وقد اخرج اسمه فى الموتى.
অর্থ: æযারা বলে থাকেন লাইলাতুম মুবারাকা দ্বারা উদ্দেশ্য অর্ধ শা’বানের
রাত তথা শবে বরাত। তারা দলীল হিসেবে পেশ করেন যেমন, হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু উনার বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা। তাছাড়াও আরো হাদীছ শরীফ-এ রয়েছে। যেমন হযরত
আব্দুল্লাহ ইবনে ছলেহ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত লাইছ রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে
বর্ণনা করেন,
তিনি হযরত আকীল রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে, তিনি হযরত ইমাম যুহরী রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হযরত উসমান ইবনে মুহম্মদ ইবনে মুগীরা ইবনে আখনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, এক শা’বান
থেকে পরবর্তী শা’বান পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ই শা’বান
হতে পরবর্তী ১৫ই শা’বান পর্যন্ত মৃতদের তালিকা প্রস্তুত করা হয় এবং এমনকি
ব্যক্তির বিবাহ সেই বৎসর তার কি সন্তান জন্মলাভ করবে এবং সেই বৎসর কখন মৃত্যুবরণ করবে
তার যাবতীয় তালিকা প্রস্তুত করা এই শবে বরাতে।” (অনুরূপভাবে তাফসীরে জালালাইন
শরীফ-এর ৪১০ পৃষ্ঠায় ২২ নম্বর হাশিয়ায় উল্লেখ আছে।)
æতাফসীরে আবী সুয়ূদ”-এর ৮ম খ-ের ৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(৩১)
وقيل ليلة البراءة ابتدئ فيها انزال او انزل فيها جملة الى السماء الدنيا من اللوح.
অর্থ: æমুফাসসিরীনে কিরামগণের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, লাইলাতুল মুবারাকা অর্থ
হচ্ছে লাইলাতুল বরাত তথা বরাতের রাত। উক্ত রাত্রিতে কুরআন শরীফ ও অন্যান্য সবকিছু অবতীর্ণ
হওয়া শুরু হয়। অথবা ওই রাত্রিতে একই সাথে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ লাওহে মাহফুয থেকে দুনিয়ার
আকাশে অবতীর্ণ করা হয়।”
উক্ত কিতাবের ৫৮ পৃষ্ঠায়
আরো উল্লেখ আছে-
(৩২)
وقيل يبدأ فى استنساخ ذلك من اللوح فى ليلة البراءة ويقع الفراغ فى ليلة القدر.
অর্থ: æমুফাসসিরীনে কিরামগণ উনাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, লাওহে মাহফুয থেকে যা
কিছু নাযিল হয় তার সবকিছুই লিপিবদ্ধ শুরু করা হয় শবে বরাতে। আর সেই ভাগ্যলিপি সম্পাদন
তথা কার্যকরী করার জন্য পেশ করা হয় শবে ক্বদরে।” এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত
æতাফসীরে তাবারী”-এর ২৫তম খ-ের ৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(৩৩)
وقال اخرون بل هى ليلة النصف من شعبان
অর্থ: æমুফাস্সিরীনে কিরামগণের অনেকেই উল্লেখ করেছেন যে, লাইলাতুল মুবারকা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শা’বানের
তথা ১৫ই শা’বানের রাত।”
æতাফসীরে তাবারী” কিতাবের ২৫তম খ-ের ৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(৩৪)
فيها يفرق كل امر حكيم
æওই রাতেই সমস্ত হিক্বমতপূর্ণ বিষয়সমূহের
ফায়ছালা করা হয়।”
এই আয়াত শরীফ-এর তাফসীরে
উল্লেখ করা হয়-
(৩৫-৩৭)
وقال اخرون بل هى ليلة النصف من شعبان ذكر من قال ذلك حدثنا الفضل بن الصباح والحسن بن عرفة قالا ثنا الحسن بن اسماعيل البجلى عن محمد بن سوقة عن عكرمة فى قول الله تبارك وتعالى فيها يفرق كل امر حكيم قال فى ليلة النصف من شعبان يبرم فيه امر السنة وتنسخ الاحياء من الاموات ويكتب الحاج فلايزاد فيهم احد ولا ينقص منهم احد.
حدثنا عبيد ابن ادم بن ابى ايس قال ثنا ابى قال ثنا الليث عن عقيل بن خالد عن ابن شهاب عن عثمان بن محمد بن المغيرة بن الاخنس قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم تقطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل لينكح ويولد له وقد خرج اسمه فى الموتى. حدثنا محمد ابن معمر قال ثنا ابو هشام قال ثنا عبد الواحد قال ثنا عثمان بن حكيم قال ثنا سعيد ابن جبير قال قال ابن عباس ان الرجل ليمشى فى الناس وقد رفع فى الاموات قال ثم قرأ هذه الاية انا انزلناه فى ليلة المباركة انا كنا منذرين فيها يفرق كل امر حكيم قال ثم قال يفرق فيها امر الدنيا من السنة الى السنة.
অর্থ: æমুফাসসিরীনগণের একটি দল বলেন, যেই রাত্রিতে সমস্ত বিষয়ের ফায়ছালা
করা হয় সেই ভাগ্য বা ফায়ছালার রাতই হচ্ছে অর্ধ শা’বান তথা ১৫ই শা’বানের
রাত অর্থাৎ শবে বরাত। তারা দলীল হিসেবে নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফগুলো পেশ করে বলেন, যেমন হযরত ইমাম জারীর তাবারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফখানা বর্ণনা করেছেন হযরত ফযল ইবনে ছিবাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি
এবং হযরত হাসান ইবনে উরফাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি। উনারা উভয়ে বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেন, হযরত হাসান ইবনে ইসমাঈল বাজালী রহমতুল্লাহি
আলাইহি হযরত মুহম্মদ ইবনে সাওকাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে। তিনি আবার বিখ্যাত
ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে। হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু আল্লাহ পাক উনার মহান বাণী ওই মুবারকপূর্ণ রাতে সমস্ত হিক্বমতপূর্ণ বিষয়সমূহের
ফায়ছালা নির্ধারণ করা হয়- এই আয়াত শরীফ-এর তাফসীরে বলেন, এখানে ফায়ছালা নির্ধারণ করার রাতই হচ্ছে ১৫ই শা’বানের রাত তথা শবে বরাত।
এই রাতেই আগামী এক বৎসরের যাবতীয় বিষয়ের ভাগ্য তালিকা প্রস্তুত করা হয় এবং তালিকা প্রস্তুত
করা হয় মৃত ও জীবিতদের এবং হাজীদের তালিকাও প্রস্তুত করা হয়। ওই তালিকা থেকে কোন প্রকারের
কম বেশি তথা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়না।
হযরতুল আল্লামা জারীর
তাবারী রহমতুল্লাহি আলাইহি আরো বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন
হযরত উবাইদ ইবনে আদম ইবনে আবী আইয়্যাস রহমতুল্লাহি আলাইহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আমার পিতা। তিনি বলেন, আমাদের কাছে আল লাইছ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি আবার হযরত আক্বীল ইবনে খালিছ রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনার থেকে, তিনি হযরত ইবনে শিহাব রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে, তিনি হযরত উছমান ইবনে মুহম্মদ ইবনে মুগীরা ইবনে আখনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
থেকে। তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তিনি ইরশাদ করেন, ‘এক শা’বান থেকে পরবর্তী এক শা’বান
পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ই শাবান তথা শবে বরাত থেকে পরবর্তী ১৫ই শাবান তথা শবে বরাত পর্যন্ত
মৃতদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
এমনকি লোকেরা যে বিবাহ
করবে তা থেকে কি সন্তান হবে এবং ওই বৎসর সন্তান কখন মৃত্যুবরণ করবে সেই তালিকাও প্রস্তুত
করা হয় শবে বরাতে। আল্লামা হযরত জারীর তাবারী রহমতুল্লাহি আলাইহি আরো বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন হযরত মুহম্মদ ইবনে মু’মার
রহমতুল্লাহি আলাইহি, তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন হযরত আবু
হিশাম রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেন হযরত আব্দুল
ওয়াহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেন, হযরত উসমান ইবনে হাকীম রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেন, হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু। তিনি বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা
তিনি বলেন,
লোকেরা মানুষদের মাঝে চলাচল করবে এমন অবস্থায় তাদেরকে মৃত্যু
ঘটানো হবে এই কথা বলার পর তিনি এই আয়াত শরীফখানা পাঠ করেন-
انا انزلناه فى ليلة مباركة انا كنا منذرين فيها يفرق كل امر حكيم
অর্থ: æনিশ্চয়ই আমি উহা অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ মুবারকপূর্ণ রাত্রিতে অবতীর্ণ করার সিদ্ধান্ত
নিয়েছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। ওই মুবারক রাত্রিতে প্রত্যেক হিক্বমতপূর্ণ বিষয়সমূহের
তালিকা প্রস্তুত করা হয়। রাবী বলেন, অতঃপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা তিনি বলেন, সেই শবে বরাতে পরবর্তী এক বৎসরের জন্য
দুনিয়ার যাবতীয় কর্মকা-ের তালিকা প্রস্তুত করা হয়।”
(অসমাপ্ত)
পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায়
থাকুন
আবা-১৯৮
0 Comments:
Post a Comment