৫১৭ নং- সুওয়াল : প্রতি দুই বা চার রাকাআত নামায অন্তে আমরা মুনাযাত করে থাকি। শরীয়তের দৃষ্টিতে এরূপ মুনাযাত করার নিয়ম আছে কি? যদি না থাকে, তবে কি ধরণের দোয়া আমাদেরকে পড়তে হবে?


সুওয়াল : মাসিক মুঈনুল ইসলাম, ডিসেম্বর ৯৫ইং সংখ্যায় নিম্মোক্ত জিজ্ঞাসা-সমাধান ছাপা হয়-
জিজ্ঞাসা : প্রতি দুই বা চার রাকাআত নামায অন্তে আমরা মুনাযাত করে থাকি। শরীয়তের দৃষ্টিতে এরূপ মুনাযাত করার নিয়ম আছে কি? যদি না থাকে, তবে কি ধরণের দোয়া আমাদেরকে পড়তে হবে?
সমাধান : রাসূল আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবাই কিরামদের অনুসৃত আমল থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রচলিত নিয়মে প্রতি চার বা দুই রাকাআত ফরজ নামায অন্তে ইমাম-মুক্তাদী সকলে মিলে হাত তুলে দোওয়া করতেন না। বরং যে সকল ফরয নামাযের পর সুন্নতে মুয়াক্কাদা রয়েছে, সে সকল ফরয নামাযান্তে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ আদায়ের জন্যে দ্রুত দাঁড়িয়ে যেতেন। আবার কখনো আল্লাহুম্মা আন্তাস সালামু ওয়া মিনকাস সালামইত্যাদী দোয়া পড়ে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যেতেন। তাই ফিক্বাহবিদগণ মত ব্যক্ত করেন যে, যে সকল ফরয নামাযের পর সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ রয়েছে, মুনাযাত বাদ দিয়ে তা আদায় করে নেয়া সর্বপেক্ষা উত্তম। ............। (ফাতওয়ায়ে শামী ১/৫১৩, বাদায়ে ১/১৫৯, বাহরুর রায়েক ১/৩৩৫, বজলুল মাজহুদ ১/৩৪৪)
এখন আমার প্রশ্ন হলো- মুনাযাত সম্পর্কে মুঈনুল ইসলাম পত্রিকার উপরোক্ত জবাবের দুটো বিষয়ে আমার সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে- ১। রসূলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণের অনুসৃত আমল থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রচলিত নিয়মে প্রতি চার বা দুই রাকাআত ফরজ নামায অন্তে ইমাম-মুক্তাদী সকলে মিলে অর্থাৎ ইজতেমায়ীভাবে হাত তুলে দোয়া করতেন না। ২। তাই ফিক্বাহবিদগণ মত ব্যক্ত করেন যে, যে সকল ফরজ নামাযের পর সুন্নতে মুয়াক্কাদা রয়েছে, মুনাজাত বাদ দিয়ে তা আদায় করে নেওয়া সর্বাপেক্ষা উত্তম অর্থাৎ ফরজ নামাযের পর মুনাজাত করা উত্তমের খেলাফ বা বিপরীত।
এখন আমি জানতে ইচ্ছুক, মুঈনুল ইসলামের উপরোক্ত বক্তব্য দুটো কতটুকু সত্য ও দলীল ভিত্তিক? কারণ তাদের উপরোক্ত বক্তব্যের কারণে আমরা মুনাজাত সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছি। অকাট্য ও গ্রহণযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন ও আমাদের বিভ্রান্তি দূর করবেন।

জাওয়াব : ফরয নামাযের পর ইজতিমায়ী (সম্মিলিতভাবে) মুনাযাত করার ব্যাপারে মাসিক মুঈনুল ইসলামপত্রিকার উপরোক্ত বক্তব্য শুধু অশুদ্ধই নয় বরং ভিত্তিহীন, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও অজ্ঞতা প্রসূত। যা সমাজে ও মুসলমানদের মধ্যে ফিৎনা সৃষ্টির কারণ। শুধু তাই নয়, তাদের উপরোক্ত বক্তব্যদ্বয় সরাসরি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত ফুক্বাহায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের প্রতি মিথ্যারোপ করার শামিল, যেটা স্পষ্টতঃ গোমরাহীর নামান্তর। কেননা এ ব্যাপারে তাদের প্রথম বক্তব্য হলো- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা ফরয নামাযের পর হাত তুলে ইজতেমায়ীভাবে মুনাযাত করেননি, অতএব এটা সুন্নত নয়।
মূলতঃ মুনাযাত সম্পর্কে তাদের উক্ত বক্তব্য খুবই আপত্তিকর, যার পরিনাম অত্যন্ত ভয়াবহ। কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
من كذب على متعمد افا ليتبوأ مقعده من النار.
অর্থ : যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আমার নামে মিথ্যারোপ করলো, সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিল।
অতএব, যেখানে পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে নিয়ে ফরয নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাযাত করেছেন। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে,
عن الاسود العامرى عن ابيه قال صليت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم- الفجر فلما سلم انصرف ورفع يديه ودعا. (مصنف بن ابى شيبه)
অর্থ : হযরত আসওয়াদ আমিরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পিতা হতে বর্ণনা করেন, উনার পিতা বলেন- আমি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে ফরয নামায পড়লাম। যখন তিনি সালাম ফিরালেন, ঘুরে বসলেন এবং উভয় হাত মোবারক উঠিয়ে মুনাযাত করলেন।” (মুছান্নেফ ইবনে আবী শায়বা)
সেখানে মুনাযাত করতেন না বলা পবিত্র হাদীছ শরীফ অস্বীকার করা ও উনাদের প্রতি মিথ্যারোপ করার অন্তর্ভূক্ত নয় কি?
হ্যাঁ, এখন কেউ বলতে পারেন, উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা তো সহীহ নয় বরং জঈফ।
এর জবাব হলো- উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা যদিও জঈফ, কিন্তু হযরত ইমাম-মুজতাহিদ উনাদের মতে জঈফ হাদীছ শরীফ ফযীলত লাভের জন্যে আমল করা জায়িয এবং জঈফ হাদীছ শরীফ দ্বারা মোস্তাহাব প্রমাণিত হয়। যেমন বিখ্যাত মুহাদ্দীস ও ফক্বীহ, ইমাম মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
الضعيف يعمل به فى فضائل الاعمال انفاقا. (الموضوعة الكبير)
অর্থ : সকলের ঐক্যমতে ফযীলত লাভের উদ্দেশ্যে জঈফ হাদীছ শরীফ আমল করা জায়িয।” (আল মওজূয়াতুল কবীর)
আর তাই দেখা যায়, অনেক অনুসরণীয় হযরত ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা ফযীলত হাছীলের উদ্দেশ্যে অনেক জঈফ হাদীছ শরীফ আমল করেছেন। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
قال النبى صلى الله عليه وسلم- من حفظ على امتى اربعين حديثا فى امردينها- بعضه الله تعالى يوم القيامة فقيها..... (رواه البيهقى)
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “আমার যে উম্মত চল্লিশ খানা হাদীছ শরীফ হিফয (মুখস্ত) করবে, মহান আল্লাহ পাক তিনি তাকে ক্বিয়ামতের দিন ফক্বীহ হিসাবে উঠাবেন ....।” (বায়হাক্বী শরীফ)
সুতরাং উপরোক্ত ক্বাওলী হাদীছ শরীফসমূহের দ্বারাও ফরয নামাযের পর মুনাযাত করা সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রমাণিত হলো। অতএব, এটাকে বিদয়াত বা সুন্নাতের খেলাফ বলা গোমরাহী বৈ কিছুই নয়।
দ্বিতীয়ত : তারা লিখেছে যে, ‘ফিক্বাহবিদগণ মত ব্যক্ত করেন, মুনাযাত বাদ দিয়ে তা আদায় করে নেয়া সর্বাপেক্ষা উত্তম।
এর জবাব হলো- মুনাযাত সম্পর্কে মাসিক মুঈনুল ইসলামের উপরোক্ত বক্তব্যখানি সরাসরী ফিক্বাহবিদগণের প্রতি মিথ্যারোপ করার শামিল। কারণ ফিক্বাহের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে উক্ত অবস্থায় সংক্ষিপ্ত মুনাযাত করার কথা বলা হয়েছে। যেমন ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব ফতওয়ায়ে আলমগীরীতউল্লেখ আছে,
وفى الحدة- الامام اذا فرغ من الظهر والمغرب والعشاء يشرع فى الستة ولا يشتغل باد عية طويلة كذا فى التاتار خائية.
অর্থ : কিতাবুল হুজ্জাতে উল্লেখ আছে যে, ইমাম ছাহেব যখন যুহর, মাগরিব ও ইশা (যে নামাযের পর সুন্নতে মুয়াক্বাদাহ রয়েছে) শেষ করবেন, (তখন সংক্ষিপ্ত মুনাযাত করে) সুন্নত নামায শুরু করবেন, মুনাযাত অধিক দীর্ঘ করবেন না। অনুরূপ ফতওয়ায়ে তাতার খানিয়াতে উল্লেখ আছে।
তাছাড়া মাসিক মুঈনুল ইসলাম কর্তৃপক্ষ তাদের মাদ্রাসায় যে সিলসিলার সিলেবাস অনুযায়ী তালীম দেয়, উক্ত সিলসিলার কিতাবসমূহেও অনুরূপ বলা হয়েছে।
যেমন ফতওয়ায়ে দেওবন্দ’-এর ২য় জিঃ ১৯৭নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
جن فرائض کے بعد سنن ھین. ان کے بعد امام اور مقتدیان مختصر دعا مانگ کر سنتین ادا کرے.
অর্থ : যে সকল ফরয নামাযের পর সুন্নত নামায রয়েছে, সে সকল নামাযের পরে ইমাম ও মুক্তাদীগণ সংক্ষিপ্ত মুনাযাত করে সুন্নত আদায় করবে।
আর ইমদাদুল আহকাম ১ম জিঃ ২৪৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে,
جن نمارون کے بعد سنتیسن ھین ان مین اولی یہ ھے کہ دعا طو یل نہ مانگے ............ وھذا کل فی الدر الختار و ردالمحتار.
অর্থ : যে সকল ফরয নামাযের পর সুন্নত নামায রয়েছে, উহার পর মুনাযাত দীর্ঘ না করাই উত্তম। অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত মুনাযাত করবে। ....... অনুরূপ দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মোহতার কিতাবেও উল্লেখ আছে।
এছাড়াও শামী, আযীযুল ফতওয়া, ইলমুল ফিক্বাহ, মুনিয়াতুল মুছল্লী, আহসানুল ফতওয়া, বেহেস্তী জিওর, গায়াতুল আওতার ইত্যাদি কিতাবসমূহে অনুরূপ বক্তব্য পেশ করা হয়েছে।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, তাদের উক্ত বক্তব্যখানিও মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর। সুতরাং উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, মুনাযাত সম্পর্কে মাসিক মুঈনুল ইসলামের উপরোক্ত বক্তব্য দলীল বিহীন, মিথ্যা, বানোয়াট ও অজ্ঞতা প্রসূত। আর ফরয নামাযের পর হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাযাত করা জায়িয তো বটেই, বরং সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
নিম্মোক্ত কিতাবসমূহেও ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে মুনাযাত করাকে জায়িয ও সুন্নত বলা হয়ছে। যেমন- তিরমিযী শরীফ, মায়ারিফুস সুনান, ইলাউস সুনান, কিতাবুল আযকার, সাবাহাতুল ফিকর, নুযহাতুল মাযালিস, ইমদাদুল ফতওয়া, ইমদাদুল মুফতীন, নুরুল ইজাহ, মারাক্বিউল ফালাহ, মাজমাউয যাওয়ায়েদ, বেহেস্তী জিওর, ফতওয়ায়ে রহিমিয়া, ফতওয়ায়ে মাহমূদীয়া, নাফায়েসুল মারগুবাহ, ক্বিফায়াতুল মুফতী, ইখতেলাফে উম্মত আওর ছিরাতে মুস্তাক্বীম, ফতওয়ায়ে দেওবন্দ ইত্যাদি।
[এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার ১৪তম সংখ্যা হতে ২০তম সংখ্যাগুলো পাঠ করুন, তবেই মুনাজাত সম্পর্কে আপনার সকল বিভ্রান্তি দূরীভূত হবে এবং মুনাজাত বিরোধীদের মুখোশ উম্মোচিত হবে।]
 আবা-৩০

0 Comments: