ইয়াওমুল ফীল বা হস্তিবাহিনী ধ্বংসের দিবস-২২ মুহররমুল হারাম শরীফ


 
ইয়াওমুল ফীল বা হস্তিবাহিনী ধ্বংসের দিবস-২২ মুহররমুল হারাম শরীফ

 

সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র বরকতময় বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশের ৫০ দিন পূর্বে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র ২২শে মুহররমুল হারাম শরীফ মহাসম্মানিত ও মহপবিত্র সাইয়্যিদু সাইয়্যিদিল আইয়্যাম শরীফ (মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র ইছনাইনিল ‘আযীম শরীফ) সাইয়্যিদুনা হযরত জাদ্দু রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (হযরত আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম) উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র বদদো‘আ মুবারক উনার কারণে আছ্হাবুল ফীল তথা হস্তি বাহিনী অর্থাৎ আবরাহা ও তার দলবল খোদায়ী গযবে পরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, ধ্বংস হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ! আহলু বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ক্বায়িম মাক্বামে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মামদূহ মুর্শিদ ক্বিবলা সাইয়্যিদুনা ইমাম খলীফাতুল্লাহ হযরত আস সাফফাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উক্ত তারীখ মুবারক উনাকে ‘ইয়াওমুল ফীল তথা হস্তি বাহিনীর ধ্বংসের দিবস’ হিসেবে নামকরণ মুবারক করেছেন। সুবহানা মামদূহ মুর্শিদ ক্বিবলা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!

আহলু বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ক্বায়িম মাক্বামে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মামদূহ মুর্শিদ ক্বিবলা সাইয়্যিদুনা ইমাম খলীফাতুল্লাহ হযরত আস সাফফাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “পবিত্র তাফসীর শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছেন, আবিসিনিয়ার রাজার অনুমতিক্রমে তার প্রতিনিধি হিসেবে ‘আবরাহা’ নামে এক ব্যক্তি ইয়েমেনের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হয়।

‘আবরাহা’ লক্ষ্য করলো, পবিত্র হজ্জ উনার সময় লক্ষ লক্ষ লোক প্রচুর মাল-সম্পদ নিয়ে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মক্কা শরীফ হজ্জ করতে যায়, তা দেখে সে ঈর্ষান্বিত হয় এবং চিন্তা করে, ইয়েমেনে সানা শহরে একটা সুন্দর গির্জা তৈরী করে মানুষদেরকে হজ্জ করার জন্য আহবান করবে। তার ডাকে লোকজন যদি সাড়া দিয়ে হজ্জ করতে আসে তাহলে সমস্ত পশুপাল ও মাল-সম্পদ দ্বারা সে ফায়দা লাভ করতে পারবে। এ খেয়ালে সে ইয়েমেনের সানা শহরে মূল্যবান পাথর দিয়ে একটা গির্জা তৈরি করে। সে গির্জাকে ‘খলীছা’ নামে নামকরণ করে। গির্জার দেয়ালগুলি স্বর্ণ, মণি-মুক্তা হীরা-জহরত দিয়ে প্রলেপ দেয় এবং নানা রকম মূর্তি, প্রতিমা স্থাপন করে। অতঃপর সে তার দেশ ও আশেপাশের এলাকায় ঘোষণা করে দেয়, যাতে সকলে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মক্কা শরীফ না গিয়ে তার এ ‘খলীছা’ গির্জায় হজ্জ করতে আসে। এতে আরববাসী বিশেষ করে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মক্কা শরীফবাসী ও উনার অধিবাসী কুরাঈশগণ অসন্তুষ্ট হন। 

এক বর্ণনায় রয়েছে, কেনানা গোত্রের এক ব্যক্তি সেখানে চাকুরি নেয়। অতঃপর সে সুযোগ বুঝে এক রাত্রিতে গির্জায় প্রবেশ করে সেখানে ইস্তিঞ্জা করে অপবিত্র করে সেখান থেকে চলে যায়। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, এক ব্যবসায়ী কাফেলা সেখানে রাত্রি যাপন করে। তারা আলো এবং খাবার পাক করার জন্য আগুন জ্বালায়, সে আগুনে হঠাৎ গির্জার একটা অংশ পুড়ে যায়। আবরাহার কিছু লোক যারা সেখানে পূজা করতো তারা সে স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। এটা শুনে আবরাহা অত্যন্ত রাগান্বিত হয় এবং শপথ করে, মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ সে ধ্বংস করে দিবে। নাঊযুবিল্লাহ! কারণ স্বরূপ সে বলে, মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মক্কা শরীফ উনার অধিবাসী উনারাই তার গির্জা অপবিত্র করেছে ও পুড়িয়ে দিয়েছে।

তখন সে আবিসিনিয়ার রাজাকে ব্যাপারটা জানিয়ে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মক্কা শরীফ উনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নাঊযুবিল্লাহ! অনেক সৈন্য-সামন্ত ও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হাতি মাহমুদসহ ১৩টি হাতি নিয়ে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মক্কা শরীফ উনার দিকে রওয়ানা হয়। আবরাহা চেয়েছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আটটা হাতি দিয়ে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনার চারটা ভিত উনাদের সাথে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে সজোরে টান দিয়ে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনাকে সহজেই ভূপতিত করবে। নাঊযুবিল্লাহ! রাস্তায় অনেকে বাধা দেয়া স্বত্ত্বেও সে বাধা উপেক্ষা করে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মক্কা শরীফ পৌঁছে। সেখানে পবিত্র মক্কাবাসী উনাদের উটসহ অনেক চতুষ্পদ জন্তু তারা লুটপাট করে নেয়। তার মধ্যে সাইয়্যিদুনা হযরত জাদ্দু রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দুইশত উটও ছিল। এ সংবাদ শুনে সাইয়্যিদুনা হযরত জাদ্দু রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আবরাহার সাথে দেখা করেন এবং উনার দুইশত উট ফেরত চান। আবরাহা উনাকে দেখে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত তা’যীম-তাকরীম করে এবং বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, আপনি মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনার হিফাযতের কথা না বলে শুধু আপনার উট চাইলেন, এর কি কারণ? 

জবাবে সাইয়্যিদুনা হযরত জাদ্দু রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, উটের মালিক আমি, সেজন্য উটগুলি হিফাযত করা আমার দায়িত্ব। আর মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনার মালিক আমি নই। মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনার মালিক হচ্ছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তিনি। আর আমি হচ্ছি মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনার খিদমতগার বা খাদিম। কাজেই, মহান আল্লাহ পাক উনার ঘর মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনাকে তিনি নিজেই হিফাযত করবেন; তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। আর তোমাদের সাথে যুদ্ধ করার আদৌ কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। এখন তোমার যা ইচ্ছা তুমি তা-ই করতে পারো। আমরা অতিসত্ত্বর স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয় নিবো। 

অতঃপর আবরাহা সাইয়্যিদুনা হযরত জাদ্দু রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উট ফেরত দিলো সাইয়্যিদুনা হযরত জাদ্দু রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কিছু লোকজনসহ মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনার কাছে গিয়ে উনার গিলাফ ধরে মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট রোনাজারি করে দুয়া করলেন এবং বললেন, ‘আয় আল্লাহ পাক! আপনি এ ঘরের মালিক ও হিফাযতকারী। আমি এ ঘরের দেখাশুনার দায়িত্বে ছিলাম তা যথাযথ পালন করার চেষ্টা করেছি। এখন আবরাহা এসেছে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনার ক্ষতি করার জন্য। সে যে পরিমাণ সৈন্য-সামন্ত ও অস্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে তাকে বাধা দেয়ার মত আমাদের ক্ষমতা নেই। কাজেই, আপনার ঘর মুবারক আপনার হিফাযতে দিয়ে আমরা নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয়ে চলে যাচ্ছি।’

পরের দিন আবরাহা তার সমস্ত বাহিনী নিয়ে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কা’বা শরীফ উনার ক্ষতি করার জন্য অগ্রসর হলো। কিন্তু হাতিগুলো একটাও সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেলো, কিছু ক্ষুদ্র আকৃতির পাখি যা আকারে কবুতরের চেয়ে ছোট। কতগুলি সাদা বর্ণের, কতগুলি কালো বর্ণের, কতগুলি নীল বর্ণের। সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে লাগলো।

তাদের মাথা ছিলো হিংস্র জন্তুর মত, ঠোট ছিলো হাতির শুঁড়ের মত আর নখগুলি ছিলো কুকুরের মত। প্রত্যেকটি পাখি তিনটি কঙ্করময় প্রস্তর বহন করে এনেছিলো। একটি ঠোঁটে, দু’টি পায়ে। আবরাহা ও তার বাহিনীর উপরে এসে সে কঙ্করগুলি নিক্ষেপ করতে লাগলো। এর ফলে তৎক্ষনাৎ কিছু ধ্বংস হয়ে গেলো। কিছু আহত অবস্থায় পলায়ন করার পথে ধ্বংস হলো। কঙ্করগুলি উপর দিক থেকে পড়ে নিচ দিয়ে বের হয়ে মাটিতে অদৃশ্য হয়ে যেত। যার কারণে আবরাহার সৈন্য বাহিনী, হস্তিবাহিনী ভক্ষিত তৃণের ন্যায় হয়ে গেলো। কুরাঈশগণ দূর থেকে এ ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলেন। আর কঙ্করগুলি ছিলো ডাল অপেক্ষা বড় ও ছোলা বুট থেকে ছোট। আবরাহা ইয়েমেন পর্যন্ত পৌঁছলো। এবং তার উপর দিয়ে পাখিগুলি উড়তে থাকলো। সেখানে পৌঁছার পরে পাখির কঙ্কর নিক্ষেপের কারণে সেও ভক্ষিত তৃণের ন্যায় হয়ে গেলো। আর নাক কাটা যালিম আবরাহার মন্ত্রী ইয়াকছুম পালিয়ে আবিসিনিয়ায় রাজার কাছে এ সংবাদ পৌঁছায়। তার উপর দিয়েও একটি পাখি উড়ছিলো। সে সংবাদ পৌঁছানোর পর পাখিটি কঙ্কর নিক্ষেপ করায় সেও ভক্ষিত তৃণের ন্যায় হয়ে যায়।

যিনি খ¦লিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি এ বিষয়কে কেন্দ্র করে ‘সম্মানিত ও পবিত্র সূরা ফীল শরীফ’ নাযিল করেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,


(১) আপনি কি দেখেননি অর্থাৎ আপনি তা দেখেছেন যে, আপনার মহান রব তায়ালা তিনি হস্তিবাহিনীর সাথে বা হাতিওয়ালাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করলেন? اَلَـمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِاَصْحٰبِ الْفِيلِ 

(২) তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ বা ব্যর্থ করে দেননি? اَلَـمْ يَـجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِىْ تَضْلِيلٍ 

(৩) এবং প্রেরণ করলেন তাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি وَاَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا اَبَابِيلَ 

(৪) উহারা তাদের উপর কঙ্করময় পাথর নিক্ষেপ করল تَرْمِيهِم بِـحِجَارَةٍ مِّن سِجِّيلٍ 

(৫) অত:পর তিনি তাদেরকে ভক্ষিত তৃণের ন্যায় করলেন। فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّاْكُولٍ 


(তরজমায়ে মুজাদ্দিদে আ’যম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সংকলিত)



0 Comments: