মহাসম্মানিত সুন্নতী খাদ্যসমূহ- হারীসাহ,ছাতু ও যবের রুটি


 
মহাসম্মানিত সুন্নতী খাদ্যসমূহ- হারীসাহ,ছাতু ও যবের রুটি

১০. হারীসাহ্‌ (هَرِيْسَةٌ)

হযরত ইমাম যুবাইর ইবনে বাক্কার ইবনে আব্দুল্লাহ কুরাইশী আসাদী মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি (বিছাল শরীফ: ২৫৬ হিজরী শরীফ) তিনি হারিসাহ্ সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

وَاَوْلَـمَ عَلَيْهَا جَزُوْرًا فَكَثُـرَ الْمَسَاكِيْنُ فَـتَـرَكَهُمُ النَّاسَ وَالطَّعَامْ ثُـمَّ غَدَا النَّاسُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَدْ خَلَا لَـهُمْ وَجْهُه فَجَعَلَ الرَّجُلُ يَأْتِـيْ بِالْـهَرِيْسَةِ فَـلَمْ يَـجْتَمِعْ لَـهُمْ اِلَّا الْـهَرَائِسُ فَدَعَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنْ يُـبَارِكَ لَـهُمْ فِيْـهَا

অর্থ: (“নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উট যবেহ করে উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যিদাতুনা হযরত আস সাবি‘য়াহ হযরত যাইনাব বিনতে জাহ্শ আলাইহাস সালাম উনার সম্মানিত ওলীমা মুবারক উনার মেহমানদারী মুবারক করেন। সুবহানাল্লাহ!) সম্মানিত ওলীমা মুবারক-এ অসংখ্য গরীব-মিসকীন, ফক্বীর-ফুক্বারা’, নিঃস্ব-অসহায় ও দরিদ্র লোক উপস্থিত হন। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহুম উনারা সকলকে (প্রস্তুতকৃত সমস্ত) খাদ্য খাওয়ায়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত খিদমত মুবারক-এ উপস্থিত হন। তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহুম উনাদের প্রতি মনোযোগী হন। তখন একজন হযরত ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহু তিনি ‘হারীসাহ্’ নামক (গম চূর্ণ ও গোশত দ্বারা তৈরী) এক প্রকার খাদ্য নিয়ে আসেন। তখন উনাদের জন্য ‘হারীসাহ্’ নামক খাদ্য ব্যতীত অন্য কোন খাদ্য মুবারক উপস্থিত ছিলো না। অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাদের সকলের জন্য এই সম্মানিত খাদ্য মুবারক-এ বরকত দানের জন্য সম্মানিত দো‘আ মুবারক করেন।” সুবহানাল্লাহ! (আল মুনতাখাবু মিন কিতাবি আযওয়াজিন নাবিয়্যি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ دَاؤُدَ بْنِ صَالِحِ بْنِ دِيْنَارٍ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ عَنْ اُمِّه اَنَّ مَوْلَاتَـهَا اَرْسَلَتْـهَا بِـهَرِيْسَةٍ اِلٰى حَضْرَتْ اُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ الثَّالِثَة الصِّدِّيْـقَةِ عَلَيْهَا السَّلَامُ قَالَتْ فَـوَجَدْتُّـهَا تُصَلِّى فَاَشَارَتْ اِلٰى اَنْ ضَعِيْـهَا

অর্থ: “তাবিয়ী হযরত দাঊদ ইবনে ছলিহি ইবনে দীনার রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার মাতা থেকে বর্ণিত। উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছা হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার মুবারক খিদমতে উনার (মায়ের) আযাদকারীণী মুনিব একবার উনার মাকে কিছু ‘হারীসাহ্’ সহ পাঠালেন। উনার মা বলেন, আমি উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছা হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনাকে পবিত্র নামাযরত শান মুবারকে পাই। উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছা হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি তখন উনার মাকে (হাত মুবারক দিয়ে) ইশারা মুবারক দিয়ে বুঝালেন, ‘তা রেখে দাও’।” (আবূ দাঊদ শরীফ: কিতাবুত ত্বহারাত: হাদীছ শরীফ নং ৭৬)

হারীসাহ্ তৈরীর প্রস্তুত প্রণালী:

উপকরণ: ১. গম, ২. তেহারি সাইজ গোশত (সাথে চর্বি থাকবে), ৩. গোল মরিচ, ৪. দারুচিনি, ৫. হলুদ, ৬. পেয়াজ, ৭. ধনিয়া গুড়া, ৮. ধনিয়া পাতা (৫০ গ্রাম)।

প্রস্তুত প্রণালী: ধনিয়া ছাড়া সব মশলা দিয়ে গোশত রান্না করুন। ৬ ঘন্টা পূর্বে ভেজানো গম বিচূর্ণ করে রান্নার জন্য চুলায় বসিয়ে দিন। সাথে রান্না করা গোশত ঢেলে দিন। কিছুক্ষণ জাল দিয়ে অর্ধেক ধনিয়া পাতা ঢেলে দিন। ৫ মিনিট পর নামিয়ে উপরে অবশিষ্ট ধনিয়া পাতা ছিটিয়ে দিন। তৈরী হয়ে গেল পুষ্টিকর হারীসাহ।

১১. ছাতু (سَوِيْقٌ) সাওয়ীক্ব

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ تعَالٰى عَنْهُ اَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَوْلَـمَ عَلٰى حَضْرَتْ اُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ صَفِيَّةَ بِنْتِ حُيَىٍّ عَلَيْهَا السَّلَامَ بِسَوِيْقٍ وَتَـمْرٍ‏.

অর্থ: “হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উম্মুল মুমিনীন সাইয়্যিদাতুনা হযরত আলআশিরাহ আলাইহাস সালাম উনার নিসবতে আযীম শরীফে ওলীমা মুবারক করেছিলেন খুরমা ও ছাতু সহযোগে।” (আবূ দাঊদ শরীফ: কিতাবুত ত্বয়ামাহ: হাদীছ শরীফ নং ৩৭৭৪; তিরমিযী শরীফ: কিতাবুন নিকাহ: হাদীছ শরীফ নং ১০৯৫; ইবনে মাজাহ শরীফ: কিতাবুন নিকাহ: হাদীছ শরীফ নং ১৯৮৪)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ سُوَيْدِ بْنِ النُّعْمَانِ الْاَنْصَارِي رَضِىَ اللهُ تعَالٰى عَنْهُ اَنَّـهُمْ خَرَجُوْا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِلٰى خَيْبَرَ حَتّٰى اِذَا كَانُوْا بِالصَّهْبَاءِ صَلَّى الْعَصْرَ ثُـمَّ دَعَا بِاَطْعِمَةٍ فَلَمْ يُؤْتَ اِلَّا بِسَوِيْقٍ فَاَكَلُوْا وَشَرِبُوْا ثُـمَّ دَعَا بِـمَاءٍ فَمَضْمَضَ فَاهُ ثُـمَّ قَامَ فَصَلَّى بِنَا الْمَغْرِبَ‏.‏

অর্থ: “হযরত সুওয়াইদ বিন নু‘মান আনসারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক ছোহবতে তিনি ও অন্যান্য ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহুম উনারা খায়বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। উনারা ছহ্‌বা নামক স্থানে পৌঁছে আছরের নামায আদায় করেন।

অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি খাবার আনতে বললেন, ছাতু ছাড়া আর কিছুই মুবারক খিদমতে পেশ করা গেলো না। উনারা সকলে পানাহার করলেন। অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পানি আনতে বললেন এবং মুখ মুবারক-এ পানি নিয়ে কুলি করলেন, তারপর দাঁড়িয়ে আমাদেরকে সাথে নিয়ে মাগরিবের নামায আদায় করেন।” (ইবনে মাজাহ শরীফ: কিতাবুত ত্বাহারাত ওয়াস সুন্নাহ: হাদীছ শরীফ নং ৪৯২)

গম, যব, চাল বা ছোলা ভেজে যাঁতায় বা ঢেঁকিতে বা মেশিনে গুড়া করে ছাতু তৈরী করা হয়। শুধু গম, যব, চাল বা ছোলার আলাদা আলাদা ছাতু হতে পারে। তবে একসঙ্গে সব উপাদান মিশিয়ে ছাতু বানালে তা বেশ সমৃদ্ধ হয়।

ছাতুর উপকারিতা:

১. ছাতু খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিমেষে উপকারি উপাদানগুলি রক্তে মিশে যায়। ফলে তৎক্ষণাৎ শক্তির মাত্রা বাড়তে শুরু করে।

২. প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকার কারণে ছাতু নিয়মিত পানিতে গুলিয়ে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যার প্রকোপ কমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে হজমশক্তিরও উন্নতি ঘটে।

৩. গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ার কারণে ছাতুতে উপস্থিত শর্করা খুব ধীরে ধীরে রক্তে মিশে থাকে। ফলে এই ধরণের খাবার খেলে হঠাৎ করে শরীরে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই থাকে না। তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের অত্যন্ত উপকারী।

৫. শিশুর শরীরের যথাযথ বৃদ্ধির জন্য যে যে উপাদানগুলির প্রয়োজন তা সবই উপস্থিত রয়েছে ছাতুতে। তাইতো বাজার চলতি হেলথ ড্রিঙ্কের পরিবর্তে বাচ্চাদের নিয়মিত ছাতু খাওয়ানো বেশি উপকারী।

৬. কিডনী সুস্থ রাখে।

৭. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।

৮. নিয়মিত খেলে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি ও মেদ- ভুঁড়ি কমায়।


রুটি (خُبْزٌ) খ্বুবয্

সাধারণভাবে বিভিন্ন শস্যদানাকে পেষণ করে যে গুড়া/আটা পাওয়া যায়, তা থেকে রুটি তৈরী করা হয়। তবে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যবের রুটিই বেশিরভাগ সময় গ্রহণ করেছেন।

১২. যবের রুটি (خُبـْـزُ الشَّعِيْرِ) খুবযুশ শা‘য়ীর

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَبِيْتُ اللَّيَالِيَ الْمُتَـتَابِعَةَ طَاوِيًا وَاَهْلُه لَا يَـجِدُوْنَ عَشَاءً وَكَانَ اَكْثَـرُ خُبْزِهِمْ خُبْـزَ الشَّعِيْرِ.

অর্থ: “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ও উনার মহাসম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা একাধারে কয়েক রাত না খেয়ে কাটিয়ে দিতেন। উনারা রাতের খাবার পরিহার করতেন। আর বেশিরভাগ সময় যবের রুটিই ছিল উনাদের খাদ্য।” (তিরমিযী শরীফ: কিতাবুয যুহুদ: হাদীছ শরীফ নং ২৩৬০)



0 Comments: