নাস্তিকদের আপত্তি : কুরানের কোথাও ‘পৃথিবী’ এবং ‘ঘুরছে’ শব্দ দুটোর পাশাপাশি অবস্থান নেই, বরং বার বার বলা আছে আল্লাহ পৃথিবিকে রেখেছেন ‘স্থির’ যেন তা নড়াচড়া করতে না পারে একজন মুসলিম এরপরেও কি করে দাবি করতে পারে কুরানের সকল আয়াত বিজ্ঞানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ?
নাস্তিকদের আপত্তি : কুরানের কোথাও ‘পৃথিবী’ এবং ‘ঘুরছে’ (falak) শব্দ দুটোর পাশাপাশি অবস্থান নেই, বরং বার বার বলা আছে আল্লাহ পৃথিবিকে রেখেছেন ‘স্থির’ যেন তা নড়াচড়া করতে না পারে (Quran 27:61, 35:41, 40:64)! একজন মুসলিম এরপরেও কি করে দাবি করতে পারে কুরানের সকল আয়াত বিজ্ঞানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ?
খণ্ডণ : সাধারণভাবে কোন একজন মানুষের প্রশ্ন করা থেকেই বুঝে নেয়া যায় তার জ্ঞানের সীমানা কতটুকু। তেমনিভাবে নাস্তিকদের এই বক্তব্যটি থেকেও বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে।
তাদের বক্তব্য - “কুরানের কোথাও ‘পৃথিবী’ এবং ‘ঘুরছে’ (falak) শব্দ দুটোর পাশাপাশি অবস্থান নেই”। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ‘পৃথিবী’ এবং ‘ঘুরছে’ (falak) শব্দ দুটো পাশাপাশি অবস্থান করলেই কি পৃথিবী ঘুরছে- কথাটি প্রমাণিত হয়ে যায়? উত্তর হচ্ছে না।
যে আয়াত শরীফগুলো পৃথিবীকে স্থির প্রমাণ করতে গর্দভগুলো ব্যবহার করেছে সেই আয়াত শরীফত্রয়ের মধ্যে প্রথম আয়াত শরীফখানা হচ্ছে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখা বিষয়ক আয়াত শরীফ। আয়াত শরীফখানা হচ্ছে -
اَمَّن جَعَلَ الْاَرْضَ قَرَارًا وَجَعَلَ خِلَالَـهَا اَنْهَارًا وَجَعَلَ لَـهَا رَوَاسِيَ وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجِزًا ۗ
অর্থ : “বলুন তো কে পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থিত রাখার জন্যে পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন।” (পবিত্র সূরা নমল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬১)
এই আয়াত শরীফ উনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক তিনি ভূপৃষ্ঠ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের প্রতি ইহসানের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। ভূ-অভ্যন্তরস্থ গলিত উতপ্ত তরলের উপর ভূপৃষ্ঠকে সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে পৃথিবীকে বসবাসোপযোগী করেছেন। আর তরলের উপর দোদুল্যমান যমীনকে পাহাড়-পর্বতের মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন। সুতরাং এই আয়াত শরীফ উনার মধ্যে পৃথিবীকে স্থির বলা হয়েছে - এই কথাটি ডাহা মিথ্যা বৈ অন্য কিছু নয়।
মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন-
وَالْأَرْضَ مَدَدْنَاهَا وَاَلْقَيْنَا فِيهَا رَوَاسِيَ وَاَنبَتْنَا فِيهَا مِن كُلِّ شَيْءٍ مَّوْزُونٍ ﴿١٩﴾ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ وَمَن لَّسْتُمْ لَهُ بِرَازِقِينَ ﴿٢٠﴾
অর্থ : “আমি ভূপৃষ্ঠকে বিস্তৃত করেছি এবং তার উপর পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে প্রত্যেক বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি। আমি তোমাদের জন্যে তাতে জীবিকার উপকরণ সৃষ্টি করেছি এবং তাদের জন্যেও যাদের অন্নদাতা তোমরা নও।” (পবিত্র সূরা হিজর শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৯-২০)
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি ভূপৃষ্ঠকে বিস্তৃত করে এই পৃথিবীকে বাসোপযোগী বাসস্থান করেছেন। কিন্তু ভূপৃষ্ঠ হচ্ছে শক্ত ছালের মত একটি পাতলা স্তর, যার পুরুত্ব ২-৩৫ কিলোমিটার। পক্ষান্তরে ভূপৃষ্ঠের নিচের স্তরগুলো গরম ও তরল যা কোন উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য বাসোপযোগী নয়। উপরন্তু ভূপৃষ্ঠ পাতলা হওয়ার কারণে তরল স্তরের উপরে নড়াচড়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। আর তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি পাহাড়গুলোকে স্থাপন করলেন যাতে ভূপৃষ্ঠ টলমল না করে স্থিতিশীল থাকে। অর্থাৎ পৃথিবী তার নিজ অক্ষের উপর প্রচ- বেগে ঘোরা সত্ত্বেও মানুষ ও অন্যান্য জীবের সুবিধার জন্য পৃথিবীকে আপাতদৃষ্টিতে স্থির অবস্থায় রাখা হয়েছে। অন্যথায় পৃথিবীতে জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে পারতো। সুতরাং ভূপৃষ্ঠের উপর পাহাড়-পর্বতগুলো এক-একটি গোঁজ বা খিলের মতো কাজ করছে, যার ফলে ভূপৃষ্ঠ টলমল করা থেকে বা ঝটুকে পড়া থেকে রক্ষা পেয়েছে।
আর এই বিষয়টিই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন এভাবে-
اَلَـمْ نَـجْعَلِ الْاَرْضَ مِهَادًا ﴿٦﴾ وَالْـجِبَالَ اَوْتَادًا ﴿٧﴾
অর্থ : “আমি কি যমীনকে বিস্তৃত করিনি এবং পাহাড়কে গোঁজ বানাইনি?” (পবিত্র সূরা আন নাবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬-৭)
মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন-
وَجَعَلْنَا فِي الْاَرْضِ رَوَاسِيَ اَن تَـمِيْدَ بِـهِمْ
অর্থ : “আমি পৃথিবীতে পাহাড় রেখে দিয়েছি যাতে তাদেরকে নিয়ে পৃথিবী ঝুঁকে না পড়ে।” (পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩১)
মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্যত্র আরো ইরশাদ মুবারক করেন-
وَاَلْقٰى فِي الْاَرْضِ رَوَاسِيَ اَن تَـمِيْدَ بِكُمْ
অর্থ : “তিনি পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পর্বতমালা, যাতে পৃথিবী তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে।” (পবিত্র সূরা লুকমান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১০)
মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-
وَاَلْقَىٰ فِي الْاَرْضِ رَوَاسِيَ اَن تَـمِيْدَ بِكُمْ وَأَنْهَارًا
অর্থ : “এবং তিনি পৃথিবীর উপর পর্বতমালা স্থাপন করেছেন যে, কখনো যেন তা তোমাদেরকে নিয়ে হেলে-দুলে না পড়ে।” (পবিত্র সূরা নাহল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫)
উপরোক্ত আলোচনা হতে বুঝা গেল যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ভূপৃষ্ঠকে টলে যাওয়া প্রতিরোধের জন্যই মূলত পাহাড়-পর্বতগুলো গোঁজ বা খিল হিসেবে যমীনে স্থাপন করেছেন।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার সাথে বিজ্ঞান সাদৃশ্যতাপূর্ণ।
পৃথিবীকে স্থির প্রমাণ করতে তাদের ব্যবহৃত ২য় আয়াত শরীফখানা হচ্ছে -
إِنَّ اللهَ يـُمْسِكُ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضَ أَن تَزُولَا ۚ وَلَئِن زَالَتَا إِنْ اَمْسَكَهُمَا مِنْ اَحَدٍ مِّن بَعْدِهِ ۚ اِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُوْرًا ﴿٤١﴾
অর্থ : “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি আসমান ও যমীনকে ধরে রেখেছেন, যাতে স্থানচ্যুত না হয়। যদি এগুলো স্থানচ্যুত হয়ে যায়, তবে তিনি ব্যতীত কে এগুলো ধরে রাখবে। তিনি সহনশীল ও ক্ষমাপরায়ণ।” (পবিত্র সূরা ফাত্বির শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪১)
মহান আল্লাহ পাক তিনি এই আয়াত শরীফ উনার মধ্যে আসমান ও যমীন উভয়েরই কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ এই পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা ঘূর্ণায়মান পৃথিবীসহ সকল গ্রহ-নক্ষত্রের কার্যাবলী বর্ণনা করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, এগুলো ঘূর্নায়মান হওয়ার পরও ছিটকে যাচ্ছে না বরং নিজ নিজ কক্ষপথে আর্বনশীল রয়েছে। তিনি উনার কুদরত মুবারক দ্বারা পৃথিবী সহ সকল গ্রহ-নক্ষত্রকে ধরে রেখেছেন যাতে হেলে দুলে ও স্বস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে না যায়। আর উনার কুদরত মুবারক উনার একটি বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে মহাকর্ষ বল, যার ফলে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলো ঘূর্ণায়মান হওয়া সত্ত্বেও নিজ নিজ কক্ষপথ হতে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে না। যদি পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলো ঘূর্ণায়মান না হয়ে থেমেই থাকতো তাহলে তা ধরা ও সংরক্ষণের প্রয়োজনই ছিল না। সুতরাং এই আয়াত শরীফ দ্বারাও পৃথিবী স্থির বুঝানো হয়নি বরং মহাকর্ষ বলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আর পৃথিবীকে স্থির প্রমাণ করতে তাদের ব্যবহৃত তৃতীয় আয়াত শরীফখানা হচ্ছে -
اَللهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ قَرَارًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ ۚ ذٰلِكُمُ اللهُ رَبُّكُمْ ۖ فَتَبَارَكَ اللهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ﴿٦٤﴾
অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি পৃথিবীকে করেছেন তোমাদের জন্যে বাসোপযোগী বাসস্থান, আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতি সুন্দর করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন পরিচ্ছন্ন রিযিক। তিনি মহান আল্লাহ পাক, তোমাদের রব তায়ালা। বিশ্বজগতের রব তায়ালা মহান আল্লাহ পাক তিনি বরকতময়।” (পবিত্র সূরা মু’মিন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬৪)
এই আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি মানুষকে কি কি নিয়ামত প্রদান করে ইহসান করেছেন সে নিয়ামতসমূহের কিছু নমুনা উল্লেখ করেছেন। এখানে ‘পৃথিবী স্থির’ এ ধরণের কোন কথা বলা হয়নি। তাই এই আয়াত শরীফ দ্বারা পৃথিবী স্থির প্রমাণের চেষ্টা নিতান্তই মূর্খতার পরিচায়ক।
সুতরাং প্রদত্ত আয়াত শরীফত্রয় দ্বারা কখনোই প্রমাণিত হয় না যে, পৃথিবী স্থির। আয়াত শরীফ উনাদের সাথে বিজ্ঞানের কোন অসঙ্গতিও নেই। উপরন্তু বিজ্ঞান এখনো শিশুতুল্য। তাই এ কথা বলা যায় যে, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার প্রতিটি আয়াত শরীফ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার পরিপূর্ণ ও একমাত্র পথনির্দেশক। কেননা পবিত্র কুরআন শরীফ নিজেই বিজ্ঞানময়।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
وَالْقُرْاٰنِ الْـحَكِيمِ ﴿٢﴾
অর্থ : “কসম! প্রজ্ঞাময় পবিত্র কুরআন শরীফ উনার।” (পবিত্র সূরা ইয়াছিন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২)
0 Comments:
Post a Comment