মানুষ চিন্তা করে হৃদয় বা মন ও মস্তিষ্কের সমন্বয়ে। যদিও কথিত বিজ্ঞান হৃদয় বা মন অস্তিত্ব খুঁজে পায় না বলে, অস্বীকার করার চেষ্টা করে থাকে।
নাস্তিকদের আপত্তি ১১ : মানুষ কি চিন্তা করে হৃদয় দিয়ে নাকি মস্তিষ্ক দিয়ে (Quran 22:46, 11:5, 3:118)?
খণ্ডন : মানুষ চিন্তা করে হৃদয় বা মন ও মস্তিষ্কের সমন্বয়ে। যদিও কথিত বিজ্ঞান হৃদয় বা মন অস্তিত্ব খুঁজে পায় না বলে, অস্বীকার করার চেষ্টা করে থাকে।
বস্তুত হৃদয় বা মনের অবস্থান হচ্ছে হৃৎপিণ্ডে । আর তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
اَفَلَمْ يَسِيْرُوْا فِى الْاَرْضِ فَتَكُوْنَ لَـهُمْ قُلُوْبٌ يَعْقِلُوْنَ بِـهَا اَوْ اٰذَانٌ يَسْمَعُوْنَ بِـهَا ۖ فَاِنَّـهَا لَا تَعْمٰى الْاَبْصَارُ وَلٰكِنْ تَعْمَى الْقُلُوْبُ الَّتِىْ فِى الصُّدُوْرِ.
অর্থ : “তারা কি এই উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণ করেনি, যাতে তারা সমঝদার হৃদয় ও শ্রবণ শক্তি সম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে? বস্তুতঃ চক্ষু তো অন্ধ হয় না, কিন্তু বক্ষস্থিত অন্তরই অন্ধ হয়।” (পবিত্র সূরা হজ্জ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৬)
اَلَا اِنَّـهُمْ يَثْنُوْنَ صُدُوْرَهُمْ لِيَسْتَخْفُوْا مِنْهُ ۚ اَلَا حِيْنَ يَسْتَغْشُوْنَ ثِيَابَـهُمْ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّوْنَ وَمَا يُعْلِنُوْنَ ۚ اِنَّهُ عَلِيْمٌ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ.
অর্থ : “জেনে রাখ, নিশ্চয়ই তারা নিজেদের বক্ষদেশ ঘুরিয়ে দেয় যেন মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট হতে লুকাতে পারে। শুন, তারা তখন কাপড়ে নিজেদেরকে আচ্ছাদিত করে, তিনি তখনও জানেন যা কিছু তারা চুপিসারে বলে আর প্রকাশ্যভাবে বলে। নিশ্চয়ই তিনি জানেন যা কিছু অন্তরসমূহে নিহিত রয়েছে।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫)
يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوْا بِطَانَةً مِّنْ دُوْنِكُمْ لَا يَأْلُوْنَكُمْ خَبَالًا وَدُّوْا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ اَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُـخْفِىْ صُدُوْرُهُمْ اَكْبَرُ ۚ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْاٰيَاتِ ۖ اِن كُنْتُمْ تَعْقِلُوْنَ.
অর্থ : “হে ঈমানদারগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না, তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোন ক্রটি করে না-তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসুত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশী জঘন্য। তোমাদের জন্যে নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১৮)
সুতরাং হৃদয় বা মন বা অন্তর হলো মানুষের এমন একটি স্থান যেখান থেকে উৎপন্ন হয় সচেতনতা, ইন্দ্রিয়ানুভূতি বা আবেগ-উত্তেজনা, চিন্তাভাবনা ইত্যাদি।
আর তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
الَّذِىْ يُوَسْوِسُ فِىْ صُدُوْرِ النَّاسِ.
অর্থ : “যে মানুষের ছুদূর বা অন্তরে ওয়াসওয়াসা দেয়।” (পবিত্র সূরা নাস শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫)
অর্থাৎ মনের মধ্যে মানুষের শুভ চিন্তা বা কুচিন্তার উদয় হয়। পরবর্তীতে মনের চিন্তা মস্তিষ্কের সহযোগিতায় প্রসারণ ঘটে বা বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই মনকে বাদ দিয়ে মস্তিষ্কের ভাবনা চিন্তার কথা যেমন কল্পনা করা যায় না তেমনি মস্তিষ্ককে বাদ দিয়ে মন কোন ভাবনা চিন্তা করতে পারে না; মূলত মন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভাবনা চিন্তার উদ্রেক তৈরী করে আর মস্তিষ্ক তার সম্প্রসারণ ঘটায়। ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে, মনের সাথে মস্তিষ্কের ভাবনাচিন্তার কেন্দ্রের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, বলতে গেলে দু’ দু’টো কেন্দ্রই ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ ভাবনা চিন্তার কাজটি মস্তিষ্কই সম্পন্ন করে, মন তার যোগানদাতা।
আর চিন্তা-ভাবনার কাজটি যে মস্তিষ্ক সম্পন্ন করে দেয় তার প্রমাণও পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তিনি نَاصِيَةٍ শব্দ মুবারক ব্যবহার করে চিন্তা-ভাবনার কাজে মস্তিষ্কের সম্পৃক্ততাকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
كَلَّا لَئِنْ لَّـمْ يَنْتَهِ لَنَسْفَعًا بِالنَّاصِيَةِ. نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ.
অর্থ : “কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবই। মিথ্যাচারী, পাপীর সম্মুখভাগের কেশগুচ্ছ।” (পবিত্র সূরা আলাক্ব শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫-১৬)
অত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখিত نَاصِيَةٍ শব্দ মুবারক দ্বারা মানুষের চিন্তা-ভাবনায় যে মস্তিষ্কই দায়ী, সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। আর এই কারণেই মহান আল্লাহ তিনি পাপীদেরকে তাদের চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে কৃতকর্মের জন্যে পাকড়াও করবেন।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, চিন্তা-ভাবনার কাজটি মনে সূত্রপাত ঘটে মস্তিষ্ক দ্বারা সম্পাদিত হয়। আর এই বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যেই বর্ণিত রয়েছে-
وَجَعَلْنَا عَلٰى قُلُوْبِـهِمْ اَكِنَّةً اَنْ يَّفْقَهُوْهُ وَفِىْ اٰذَانِـهِمْ وَقْرًا وَاِذَا ذَكَرْتَ رَبَّكَ فِى الْقُرْاٰنِ وَحْدَهُ وَلَّوْاْ عَلٰى اَدْبَارِهِمْ نُفُوْرً.
অর্থ : “আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়ে দিয়েছি, যাতে তারা একে উপলব্ধি করতে না পারে এবং তাদের কর্ণকুহরে বোঝা চাপিয়ে দেই। যখন আপনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান রব তা‘য়ালা উনার একত্ব তিলাওয়াত মুবারক করেন, তখনও অনীহাবশতঃ তারা পৃষ্ট প্রদর্শন করে চলে যায়।” (পবিত্র সূরা বনী ইসরাঈল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৬)
وَمِنْهُمْ مَّنْ يَّسْتَمِعُ اِلَيْكَ وَجَعَلْنَا عَلٰى قُلُوْبِـهِمْ اَكِنَّةً اَنْ يَّفْقَهُوْهُ وَفِىْ اٰذَانِـهِمْ وَقْرًا وَاِنْ يَّرَوْاْ كُلَّ اٰيَةٍ لَا يُؤْمِنُواْ بِـهَا حَتّٰى اِذَا جَآؤُوْكَ يُـجَادِلُوْنَكَ يَقُوْلُ الَّذِيْنَ كَفَرُواْ اِنْ هٰذَا اِلَا اَسَاطِيْرُ الْاَوَّلِيْنَ.
অর্থ : “তাদের কেউ কেউ আপনার দিকে কান লাগিয়ে থাকে। আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ রেখে দিয়েছি যাতে একে না বুঝে এবং তাদের কানে বোঝা ভরে দিয়েছি। যদি তারা সব নিদর্শন অবলোকন করে তবুও সেগুলো বিশ্বাস করবে না। এমনকি, তারা যখন আপনার কাছে ঝগড়া করতে আসে, তখন কাফেররা বলে, এটি পূর্ববর্তীদের কিচ্ছাকাহিনী বৈ তো নয়।” (পবিত্র সূরা আন‘আম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৫)
অত্র আয়াত শরীফদ্বয় উনাদের মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন যে,
جَعَلْنَا عَلٰى قُلُوْبِـهِمْ اَكِنَّةً اَنْ يَّفْقَهُوْهُ وَفِىْ اٰذَانِـهِمْ
অর্থাৎ তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে তারা একে উপলব্ধি করতে না পারে এবং তাদের কর্ণকুহরে বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি।
বস্তুত মহান আল্লাহ পাক তিনি কারো প্রতিই যুলুম করেন না। তাই তাদের অন্তরের উপর আবরণ ও কর্ণকুহরে বোঝা তাদের নিজেদের আমলেরই ফল।
যেহেতু তাদের অন্তরের উপর আবরণ পড়ে গিয়েছে তাই উপলব্ধি করতে অক্ষম। অর্থাৎ তাদের হৃৎপি- নির্লিপ্ত থাকে। এর ফলে তাদের কানে কোন উপদেশ/পরামর্শ ইত্যাদি প্রবেশ করলেও সেটা তাদের কাছে বিচ্ছিন্ন কতগুলো শব্দ বা ধ্বনি হিসেবে পরিগণিত হয়, যা তারা অনুধাবন করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে তাদের মস্তিষ্কও কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মূলতঃ মহান আল্লাহ পাক তিনি কানের প্রসঙ্গটি টেনে একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, কানে শুনে, মস্তিষ্ক দিয়ে ভেবে চিন্তেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণ তার অন্তর নির্লিপ্ত হয়ে আছে; সেখানে অবিশ্বাস স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে আছে। ফলে মস্তিষ্কের কার্যকলাপের সাথে হৃৎপিণ্ডের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবেই পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে বলে প্রমাণিত হলো।
মহান আল্লাহ পাক তিনি মস্তিষ্কের কার্যকলাপের সাথে হৃৎপিণ্ডের সম্পৃক্ততার বিষয়ে অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন-
اِنَّ فِىْ ذٰلِكَ لَذِكْرٰى لِمَنْ كَانَ لَهُ قَلْبٌ اَوْ اَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيْدٌ
অর্থ : “এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্যে, যার অনুধাবন করার মত অন্তর রয়েছে। অথবা সে নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে।” (পবিত্র সূরা ক্বাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৭)
অনুধাবন করার মত অন্তর বা হৃৎপি- যার রয়েছে অর্থাৎ যার হৃৎপি- আবেগ অনুভূতিতে উদ্দীপ্ত হয়; সে রকম ব্যক্তির জন্যে রয়েছে উপদেশ। আবার যে নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম মুবারক, অবশ্যই তার মস্তিষ্ক হৃৎপি-কে উদ্দীপ্ত করে। বিজ্ঞান বলছে এমনটা করে তখনই যখন মানুষ আবেগে উদ্বেলিত হয়, মন যখন গভীর অনুভূতি প্রবণ হয়ে উঠে অর্থাৎ মস্তিষ্ক যখন নিবিষ্টতার সাথে কিছু ধরে রাখতে চায়, তখন সে হরমোন নিষ্কাষণের মাধ্যমে হৃৎপি-কে উদ্দীপ্ত করে, তবে কেন করে তার কোন পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের কাছে নেই। রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধিকল্পে এই নিষ্কাষণ ঘটে থাকে বলে যে প্রচলিত ব্যাখ্যা রয়েছে তা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ সঞ্চালন বৃদ্ধির জন্যে হৃৎপি-কে চঞ্চল বা উদ্দীপ্ত হতে হয় না; কোন প্রয়োজনে মস্তিষ্ক নির্দেশ দিলেই হৃৎপি- এই কাজটি করতে শুরু করে, ক্ষণিকের তরে সামান্য কোন চিন্তার জন্যে মস্তিষ্কের যে পরিমাণ অতিরিক্ত রক্ত প্রয়োজন হয় তা সরবরাহ করতে হৃৎপি-কে অতিমাত্রায় উদ্দীপ্ত হতে হয় না, কাজটি তার স্বাভাবিকতার মধ্যেই পড়ে।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, মানুষ চোখ দিয়ে চাক্ষুষ দেখে, কান দিয়ে শ্রবণ করে, হৃদয় দিয়ে চিন্তা-ভাবনার সূত্রপাত ঘটিয়ে মস্তিষ্কের মাধ্যমে ভাবনা সমাপ্ত করে আর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে।
উল্লেখ্য যে, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মন বা অন্তর বা হৃদয় বুঝাতে قَلْب শব্দ মুবারক ব্যবহৃত হয়েছে। আর এই قَلْب মানুষের বক্ষে অবস্থিত বিধায়, সমার্থক হিসেবে صُدُوْرِ শব্দ মুবারকও ব্যবহৃত হয়েছে। আবার قَلْب বা অন্তরের ৭টি স্তরের (সুদূর, নশর, শামছি, নূরী, কুরব, মকিম ও নাফসি) ১ম স্তরকেও صُدُوْرِ বলে। কিন্তু পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে قَلْب বা صُدُوْرِ উল্লেখ করেই ছেড়ে দেয়া হয়নি। তাই পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বরাত দিয়ে কোনভাবেই এই কথা বলার সুযোগ নেই যে, হৃৎপিণ্ড ই ভাবনা-চিন্তা করে। কেননা এমন অনেক আয়াত শরীফ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বিভিন্ন সূরা শরীফ উনাদের মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে যেখানে মহান আল্লাহ মানুষের হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের সমন্বিত কাজের বর্ণনা করেছেন। আর এই বিষয়টি বুঝাতে কখনো কখনো ‘اَفْئِدَ’ আফ্ইদা শব্দ মুবারক ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও তরজমাকারকগণ এই শব্দ মুবারক হৃৎপিণ্ড হিসেবে তরজমা করেছেন। কিন্তু আরবী ভাষা সাহিত্যে হৃৎপিণ্ড শব্দের সাথে ‘اَفْئِدَ’ আফ্ইদা শব্দের কোন সংশ্রব নেই।
তরজমাকারকগণ ‘اَفْئِدَ’ আফ্ইদা শব্দ মুবারক উনার অর্থ হৃৎপি- গ্রহণ করার ফলে, নাস্তিকরা এই প্রলাপ বকার প্রয়াস পাচ্ছে যে, পবিত্র কুরআন শরীফ বর্ণনা করছে- সকল প্রকার ভাবনা-চিন্তার কাজ হৃৎপিণ্ডের , মস্তিষ্কের নয়। বরং বিষয়টা ঠিক উল্টো; কেননা ‘اَفْئِدَ’ আফ্ইদা শব্দ মুবারক উনার তরজমা হৃৎপিণ্ড নয়। তাছাড়া পবিত্র কুরআন শরীফ নিজেই বলছেন, চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব মস্তিষ্কের, আর মস্তিষ্কের সম্মুখ ভাগই ভাবনা-চিন্তার জন্য দায়ী।
এরপরে আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানুষ তার মস্তিষ্ক দিয়েই চিন্তা ভাবনা করে, আর হৃৎপিণ্ড মানুষকে আবেগের তাড়নায় তাড়িত করে ও চিন্তা চেতনার কাজে প্রয়োজনমত সহযোগিতা করে অর্থাৎ অনুভূতি জাগায়। বস্তুত মস্তিষ্ক আবেগ সৃষ্টির কোন যন্ত্র নয়, এটি চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত তৈরী করে ও সেইমত কার্যাদেশ প্রদান করে, মস্তিষ্কের চিন্তা-ভাবনার সময়ে হৃৎপি- প্রয়োজনীয় আবেগময় অনুভূতির উৎসরণ ঘটায়।
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, মস্তিষ্ক ও মানব মনের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক বা যোগসূত্র রয়েছে। অর্থাৎ মন-মস্তিষ্কের দ্বৈত প্রতিক্রিয়া দ্বারাই মানুষ পরিচালিত হয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছে যে, ট্রম্যাটিক ব্রেইন ইনজুড়ি (traumatic brain injury) ও সাইকো একটিভ ড্রাগ মস্তিষ্কের মাধ্যমে মনের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। দার্শনিক পেট্রিসীয়া মনে করে, মস্তিষ্কে এই ঔষধের ক্রিয়া মনের উপর যে প্রভাব ফেলে তাতেই বুঝা যায় যে, মন-মস্তিষ্ক এক সূত্রে গাঁথা।
বিজ্ঞানীরাও মনে করতে শুরু করেছে, হৃৎপি- শুধুমাত্র রক্ত সঞ্চালনকারী অঙ্গ নয়; এর নিজস্ব স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে এবং তা প্রায় ৪০,০০০ নিউরন দিয়ে গঠিত। (পক্ষান্তরে মানুষের মগজ বা মস্তিষ্কে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন থাকে এবং প্রত্যেকে কমপক্ষে ১০ হাজার অন্যান্য নিউরনের সাথে সংযুক্ত থাকে।) হৃৎপিণ্ডের এই নিউরনগুলো শরীরের অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় কিছুটা আলাদা ও বিভিন্ন উপায়ে ও বিস্তৃতভাবে সংযুক্ত এবং তারা সংবেদনশীলতার পাশাপাশি মস্তিষ্ক কর্তৃক ও বিভিন্ন গ্রহ্নি থেকে ক্ষরিত নানাপ্রকার রাসায়নিক পদার্থকে সনাক্ত করতে সক্ষম; আগত হরমোন ও নানাবিদ রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে তার প্রয়োজনীয় অংশটুকু চিনে নিতে সক্ষম। তারা স্বাধীনভাবে তাদের নিজ দক্ষতায় কাজ করে। বিজ্ঞানীরা মনে করে, হৃৎপি-ের ক্ষুদে মস্তিষ্ক রয়েছে, যে কারণে তার প্রতিস্থাপন করা যায়। কারণ সাধারণতঃ শরীরের অন্যান্য অঙ্গে কাটা পড়া স্নায়ু পূণঃসংযুক্ত হয় না। বৈদ্যুতিক পালসের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং ক্রিয়া সচল রাখা ছাড়াও এই স্নায়ুতন্ত্রের বহুবিধ কাজ রয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই কোন প্রাণী অজ্ঞান হলেও তার হৃৎপিণ্ড সম্পূর্ণ সচল থাকে। তাছাড়াও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছে যে, হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনে রোগীর মধ্যে স্বকীয়তার অনেক পরিবর্তন আসে। আরও দেখা গেছে, রোগীর মধ্যে হৃৎপিণ্ড দাতার কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞানীরা বলছে, মস্তিষ্ক ও হৃৎপি- সমন্বিতভাবে কাজ করে। হৃৎপিণ্ড যদি সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের নির্দেশে কাজ করতো তবে সমন্বয় বা বুঝাপড়ার প্রয়োজন হতো না। শুধুমাত্র মস্তিষ্কের নির্দেশ মেনে চলতো। অনেক সময় দেখা গেছে, আক্রান্ত হৃৎপিণ্ডের কার্যপ্রণালীতে নানাবিধ পরিবর্তনের ফলে মস্তিষ্ক তার সাথে মানিয়ে তার নিজের কাজ পরিচালনা করে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের ভাবনা চিন্তার উপর মনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মন মানুষের মস্তিষ্কে কিছু সুনিদিষ্ট ভাবনার উদ্রেক করে যা অন্যান্য ইন্দ্রীয়ের প্রভাব মুক্ত।
মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
وَهُوَ الَّذِي اَنشَاَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْاَبْصَارَ وَالْاَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَّا تَشْكُرُونَ
অর্থ : “তিনি তোমাদের কান, চোখ ও অন্তঃকরণ সৃষ্টি করেছেন; তোমরা খুবই অল্প কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে থাক।” (পবিত্র সূরা মু’মিনুন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৭৮)
মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন-
صُمٌّ بُكْمٌ عُمْيٌ فَهُمْ لاَ يَرْجِعُوْنَ.
অর্থ : “তারা বধির, মূক ও অন্ধ। সুতরাং তারা ফিরে আসবে না।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৮)
পবিত্র সূরা মু’মিনুন শরীফ উনার ৭৮নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মানুষকে কান, চোখ ও অন্তঃকরণ সৃষ্টির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে আর পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ১৮নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে কান, চোখ ও বাকযন্ত্রের অকার্যকারিতা বলতে মস্তিষ্কে তাদের সুস্থ চিন্তার অভাব ও হৃৎপি-ের নির্লিপ্ততাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যাদের অন্তরে মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি বিশ্বাস নেই তাদের চোখ কান থাকা সত্ত্বেও তাদের মস্তিষ্ক মহান আল্লাহ পাক উনাকে নিয়ে ভাবে না।
0 Comments:
Post a Comment