পবিত্র কুরআন শরীফ কোন বিজ্ঞান গ্রন্থ নয়। তবে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বিভিন্ন আয়াত শরীফ নিয়ে গবেষণার পথ ক্বিয়ামত পর্যন্ত উন্মুক্ত রয়েছে। আর তাই পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বিভিন্ন উদাহরণ টেনে শেষে বলা হয়েছে এতে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন।
নাস্তিকদের আপত্তি ১২ : কুরানের আয়াত (96:15-16) দ্বারা মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল লোব যে মিথ্যা বলার জন্যে দায়ী তা বোঝানো হচ্ছে (Shakir ~ A lying, sinful forehead)- এ দাবির সত্যতা কতটুকু? যেখানে আয়াতের অন্যান্য অনুবাদে (nāṣiyatin) শব্দ খানা দ্বারা কপালের কেশগুচ্ছকে (forelock) বোঝানো হয়েছে যার প্রমান মেলে আয়াত ১১:৫৬ এবং কিছু হাদিসে (Malik's Muwatta 28:28.22.52, 3:3.15.61 Sahih Muslim 34:6551) ! দ্বিতীয়ত, মিথ্যা বলার জন্যে ব্রেইনের যে যে অঞ্চল গুলো দায়ী তা হল - frontal (medial inferior and pre-central), temporal (hippocampus and middle temporal), and limbic (anterior and posterior cingulate) lobes.
খণ্ডন: পবিত্র কুরআন শরীফ কোন বিজ্ঞান গ্রন্থ নয়। তবে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বিভিন্ন আয়াত শরীফ নিয়ে গবেষণার পথ ক্বিয়ামত পর্যন্ত উন্মুক্ত রয়েছে। আর তাই পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বিভিন্ন উদাহরণ টেনে শেষে বলা হয়েছে এতে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন। একইভাবে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে ব্যবহৃত نَاصِيَةٍ শব্দ মুবারক দ্বারা শাব্দিকভাবে কপালের কেশগুচ্ছকে (forelock) বোঝানো হলেও, গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের প্রধান কাজ হল চিন্তাভাবনা করা। তাই অত্র আয়াত শরীফ দ্বারা “মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল লোব যে মিথ্যা বলার জন্যে দায়ী তা বোঝানো হচ্ছে” দাবী করাটা অযৌক্তিক বা ভিত্তিহীন নয়।
বিজ্ঞানের কোন সিদ্ধান্তকেই শেষ কথা বলা যাবে না, সময়ের পরিবর্তনে নতুন নতুন তথ্য ও তত্ত্ব বিভিন্ন ধারণার জন্ম দিচ্ছে। বিজ্ঞান তাদের পূর্বে প্রদত্ত কোন তথ্য ও তত্ত্বকে বলছে ভুল, আবার পূর্বের কোন তথ্য ও তত্ত্বকে সংশোধন করে নতুন তথ্য ও তত্ত্ব প্রদান করছে। অর্থাৎ বিজ্ঞান আজো পূর্ণতার স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। তাই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম বা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের বিষয়গুলোকে বিজ্ঞান দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করাটা চরম মূর্খতার পরিচায়ক। বরং পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের দ্বারা বিজ্ঞানের তথ্য ও তত্ত্বকে যাচাই-বাচাই করতে হবে।
মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-
اِنِّـىْ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ رَبِّـىْ وَرَبِّكُم مَّا مِنْ دٰابَّةٍ اِلَا هُوَ اٰخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا اِنَّ رَبِّـىْ عَلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ.
অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক উনার উপর আমি নিশ্চিত ভরসা করেছি, যিনি আমার এবং তোমাদের পরওয়ারদেগার। পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নাই যার মাথার সম্মুখভাগের কেশগুচ্ছ আঁকড়াইয়া ধরবেন না। আমার মহান রব তায়ালা উনার সরল পথে কোন সন্দেহ নেই।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৬)
অত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে نَاصِيَةٍ শব্দ মুবারক ব্যবহৃত হয়েছে যার শাব্দিক অর্থ “কপালের কেশগুচ্ছ”। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক তিনি তো এখানে “চুলের মুঠি ধরে টেনে আনা হবে” বলতে পারতেন। তখন সেটা মাথার যেকোন স্থানের চুলকেই বুঝাতো, কিন্তু নির্দিষ্ট করে “মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের চুল” বলা হলো কেন?
আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার ফলাফল বলছে, মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কার্যকারিতার মধ্যে সম্মুখভাগের প্রধান কাজ হল চিন্তা-ভাবনা করা। শরীরের বিভিন্ন অংশ, পরিবেশ এমনকি স্মৃতিকোষ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, বিভিন্ন বিষয়ে বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব মস্তিষ্কের সম্মুখ ভাগই পালন করে থাকে। সুতরাং এর থেকে বলা যায় যে, প্রতিটি প্রাণীর সারা জীবনের কৃতকর্মের সিন্ধান্তগুলো মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ কর্তৃক গৃহীত হয়।
গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে, মস্তিস্কের প্রিফ্র্রন্টাল অঞ্চল যা মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তা মাথার খুলির অভ্যন্তরে সম্মুখভাগে বিদ্যমান। এই অঞ্চলের কার্যাবলীর উপরে গবেষণার ফলাফলের কথা উল্লেখ রয়েছে ÔEssentials of Anatomy and PhysiologyÕ নামক বইটিতে-
“পরিকল্পনা করার আর নড়াচড়া শুরু করার জন্য উদ্বুদ্ধতা আর দুরদশির্তা মস্তিষ্কের-সামনের লোবের (Frontal Lobe) সম্মুখের অংশে অর্থাৎ প্রিফ্রন্টাল-অঞ্চলে ঘটে থাকে। এটি সহযোগী কর্টেক্সের অঞ্চল...।”
বইটি আরো বলে- “প্রিফ্রন্টাল অঞ্চলের উদ্বুদ্ধ করার কাজে জড়িত থাকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এটিও ধারণা করা হয় যে, এই অঞ্চলটি আগ্রাসনের কার্যকর কেন্দ্র।”
তাই এই অঞ্চলটি পরিকল্পনা, উদ্বুদ্ধ করা আর ভাল ও মন্দ আচরণ শুরু করা এবং সত্য-মিথ্যা বলার জন্য দায়ী।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা fMRI (functioning magnetic resonance imaging) প্রযুক্তির মাধ্যমে মিথ্যা বলা সনাক্ত করে থাকে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এটা বোঝা গেছে যে, মানুষ যখন মিথ্যা বলে তখন তাদের অগ্রমস্তিষ্কের কার্যাবলী বৃদ্ধি পায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার স্নায়ু বিজ্ঞানী ড. ইয়ালি নিয়েং এবং তার সহকর্মীরা ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং বা এম. আর. আই.-এর মাধ্যমে তোলা মানুষের মস্তিষ্কের ছবি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। ড. ইয়েলি নিয়েং ব্যাখ্যা করে বলছে, এটা অনেকটা মস্তিষ্কের ফটো তোলার মতো একটি ব্যাপার, যাতে মস্তিষ্কের ভেতরের কাঠামোগত সব পার্থক্য দেখা যায়। কেউ মিথ্যা কথা বলার সময় মস্তিষ্কের সামনের দিকটা তৎপর হয়ে ওঠে।
সাধারণভাবে মানুষের শরীরের যাবতীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে তার মস্তিষ্ক; এই কাজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে তার সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে থাকে এক বিশাল ও জটিল জালিকা, যাকে বলা হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম। মস্তিষ্ক থেকে সুষুষ্মা কা-ের মাধ্যমে এই স্নায়ুতন্ত্র সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই স্নায়ুতন্ত্র তৈরী হয় স্নায়ু কোষ দিয়ে, যাদেরকে বলা হয় নিউরন। প্রায় এক হাজার কোটি (১০০০০০০০০০০০) নিউরন দিয়ে মানব দেহের স্নায়ুতন্ত্র তৈরী হয়।
এই স্নায়ু কোষের প্রধান অংশ হল কোষ দেহ (Cell Body) বা সোমা। নিউরনের সেল বডি বা দেহ থেকে তন্তু আকারে বিভিন্ন রকমের সরু তারের মত লম্বা লেজের আকৃতি বের হয়ে থাকে, একে বলা হয় এক্সন। এক্সনের মাথায় তন্তুর ন্যায় শিকড় দেখা যায়, এগুলো নিউরনের দেহ থেকেও বেরুতে পারে; এদের নাম ডেনড্রাইটস। নিউরনের সাথে নিউরনের যোগাযোগ রাখতে এদের ব্যবহার হয়ে থাকে। এরা রিসিপ্টর বা এন্টেনার কাজ করে থাকে। অর্থাৎ ডেনড্রাইট হচ্ছে বলা যায় নিউরনের শাখা প্রশাখা যা এক কোষ থেকে আরেক কোষে মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল পৌঁছে দেয়। আবার মস্তিষ্কে দু ধরণের ম্যাটার বিদ্যমান রয়েছে- গ্রে ম্যাটার ও হোয়াইট ম্যাটার। খুব সহজভাবে বলতে গেলে, গ্রে ম্যাটার হচ্ছে- মস্তিষ্কের বাদামী-ধূসর রংয়ের অংশ, যার মধ্যে ডেনড্রাইড থাকে। হোয়াইট ম্যাটার হচ্ছে মস্তিষ্কের সাদা মতো অংশ যার মধ্যে কোন নিউরন বা ডেনড্রাইড থাকে না।
ড. নিয়েং-এর একজন সহযোগী গবেষক রেডিওলজিস্ট ড. প্যাট্রিক কলেডি জানায়, এটাই প্রথম গবেষণা যাতে দেখানো হয়েছে যে, মিথ্যা কথা বলা যাদের অভ্যাস, তাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে অন্যদের মস্তিষ্কের গঠনে পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য হচ্ছে মস্তিষ্কের হোয়াইট আর গ্রে ম্যাটারের পরিমাণের মধ্যে পার্থক্য।
ড. প্যাট্রিক কলেডি বলছে, মস্তিষ্কের আসল কোষগুলো গ্রে ম্যাটারের মধ্যে থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কের সব কোষগুলোর পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকতে হয়। আর কোষগুলোর মধ্যে সেই যোগাযোগ ঘটে হোয়াইট ম্যাটারের মধ্যে দিয়ে। সুতরাং এখানে গ্রে ম্যাটারকে যদি একটি কম্পিউটার হিসেবে মনে করা হয়, তাহলে হোয়াইট ম্যাটার হচ্ছে তার সংযোগ রক্ষাকারী ক্যাবল।
মিথ্যা কথা বলা যাদের সহজাত অভ্যাস, তাদের মস্তিষ্কের সামনের দিকে অস্বাভাবিক বেশী মাত্রায় হোয়াইট ম্যাটার দেখা যায়। আর তাদের মস্তিষ্কের সামনের দিকে গ্রে ম্যাটার অন্যদের তুলনায় কম থাকে।
মার্কিন গবেষকরা দেখতে পেয়েছে, যারা মিথ্যা কথা বলায় পারদর্শী তাদের মস্তিষ্কে হোয়াইট ম্যাটারের পরিমাণ ২৫% বেশী দেখা গেছে। মিথ্যা কথা বলা প্রকৃতপক্ষেই একটি জটিল কাজ। যখন কেউ মিথ্যা কথা বলে তখন তাদের কোন কথা যেমন গোপন রাখতে হয়, তেমনি বানিয়ে ভুল তথ্যও দিতে হয়। সুতরাং মিথ্যা বলার সময় লোকজনকে খুব দ্রুত অনেক তথ্য বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়। সে কারণেই বলা হয়, যাদের মস্তিষ্কের মধ্যে হোয়াইট ম্যাটার যত বেশী তাদের জন্য মিথ্যা কথা বলা তত সহজ।
ড. নিয়েং জানায়, মিথ্যুকদের মস্তিষ্কে গ্রে ম্যাটারের পরিমাণ সাধারণের চাইতে ১৪% কম থাকে। সে কারণে তারা সত্য গোপন করতে বেশী পারদর্শী হয়। সহজাতভাবে যারা মিথ্যা কথা বলায় পারদর্শী তাদের মস্তিষ্কে হোয়াইট এবং গ্রে ম্যাটারের পরিমাণের তারতম্যের কারণ, সাধারণের চাইতে তাদের মস্তিষ্কের গঠনও আলাদা। তবে ভিন্ন গঠনের এই মস্তিষ্ক ঠিক কিভাবে কাজ করে, সে বিষয়ে অনেক প্রশ্নের জবাব এখনো তাদের জানা নেই। মানুষ কেন অসৎ হয়, তার মূল কারণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এই গবেষণা আমাদের জ্ঞান কিছুটা বাড়াবে বলে ড. নিয়েং এবং ড. কলেডি আশাবাদী।
(https://www.bbc.com/bengali/news/story/2006/05/printable/060502_sciencewk18.shtml)
সুতরাং এটি পরিস্কার বুঝা গেল যে, মস্তিষ্কের সামনের লোবের (Frontal Lobe) সম্মুখের অংশ অর্থাৎ প্রিফ্রন্টাল অঞ্চল মিথ্যা বলার জন্য দায়ী। আর তাই কোন কোন মুসলিম গবেষক (যেমন- Shakir) পবিত্র সূরা আলাক্ব শরীফ উনার ১৫-১৬ নং আয়াত শরীফ (96:15-16) দ্বারা মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল লোব যে মিথ্যা বলার জন্যে দায়ী তা বোঝানো হচ্ছে বলে দাবী করেছেন।
0 Comments:
Post a Comment