একমাস ব্যাপি রোযা রাখায় রয়েছে প্রচুর সাস্থ্যগত সাইড ইফেক্ট - এই কথাটি একটি নাস্তিকীয় কুসংস্কার, যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে এক মাস ব্যাপী রোযা রাখার ফলে স্বাস্থ্যের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয় এবং বিভিন্ন রোগ থেকেও মুক্তি লাভ করা যায়।
নাস্তিকদের আপত্তি : মুহম্মদ কতৃক একমাস ব্যাপি রোযা রাখা বিষয়টা ইসলামে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য কি যার রয়েছে প্রচুর সাস্থ্যগত সাইড ইফেক্ট এবং যা এসেছে ইসলামপূর্ব কুরাইশদের থেকে (Sahih Bukhari 5:58:172) ?
http://www.bangladeshiatheist.com/dr_mushfique/451.html
খণ্ডন : যেহেতু রোযার মধ্যে রয়েছে প্রভূত কল্যাণ। তাই মুসলমানদের শত্রু হওয়ার কারণে কাফির-মুশরিকরা রোযাকে অন্য একটি নামে নামকরণ করেছে আর তা হচ্ছে ‘অটোফেজি’ বা ‘অটোফ্যাগি’ (Autophagy)।
‘অটোফেজি’ বা ‘অটোফ্যাগি’ শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রীক শব্দ αὐτόφαγος অটোফেজোস ও κύτος কাইটোস থেকে। প্রাচীন গ্রীক শব্দ αὐτόφαγος অটোফেজোস অর্থ “আত্ম-ধ্বংসকারী” এবং κύτος কাইটোস অর্থ “ফাঁপা জায়গা”। সুতরাং বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে আত্ম ভক্ষণ বা নিজেকে খেয়ে ফেলা।
মূলত ‘অটোফেজি’ বা ‘অটোফ্যাগি’ অটোফেজোসাইটোসিস বা আত্মভক্ষণ হলো এমন একটি প্রাকৃতিক ও নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া যা ঘনীভূত, জমাটবদ্ধ বা অকার্যকর উপাদানগুলিকে পৃথক করে শরীর থেকে বের করে দেয় বা ভক্ষণ করে ফেলে।
‘অটোফেজি’ বা ‘অটোফ্যাগি’ বিষয়টি সহজ ভাষায় এরকম, আপনি যখন কিছু খাবেন না, তখনও কোষগুলো পুষ্টি চাহিদা মেটাতে চাইবে এবং নিজেদের মাঝে খাবার খুঁজবে। এটা করতে গিয়ে শরীরের অনেক অনিষ্টকারী উপাদান খেয়ে ফেলবে (সেখান থেকে পুষ্টি উপাদান বাছাই করবে) এবং বিপাকীয় ক্রিয়ায় শরীরের বর্জ্য বের করে দিবে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের গ্রহণ করা প্রোটিনের একটা অংশ কাজে লাগে না, সেগুলো বিভিন্নভাবে কোষে জমা থাকে, সেগুলো মাঝে মাঝে বের করে দিতে পারলে ভালো। আর ‘অটোফেজি’ বা ‘অটোফ্যাগি’-এর মাধ্যমে শরীর থেকে সে অনিষ্টকারী উপাদান বের হয়ে যায়।
সাধারণভাবে শরীরে অ্যামাইনো এসিডের তিন ধরনের বিপাক প্রক্রিয়া আছে।
১. কিছু অ্যামাইনো এসিড যকৃতে চলে যায় ও গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদন করে।
২. কিছু অ্যামাইনো এসিড ট্রাই কার্বক্সিলিক এসিড সাইকেল (TCA cycle) এ ঢুকে ও গ্লুকোজ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। আর
৩. কিছু অ্যামাইনো এসিড নতুন প্রোটিন তৈরীতে ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ রিসাইকেল হয়।
এখন যদি শরীরে এর বেশী অ্যামাইনো এসিড থাকে, তাহলে শরীর তা বর্জ্য আকারেই বের করে দিবে।
অটোফেজি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যা শুধুমাত্র শরীরে তখনই হয় যখন শরীর মেটাবলিক স্ট্রেসে থাকে অথবা নিউট্রিয়েন্ট ডেপ্রাইভড স্টেটে থাকে, অর্থাৎ শরীরে পুষ্টি উপাদান কম- এমন অবস্থায় থাকে।
আর সাধারণভাবে রোযা রাখলে যেহেতু ছুবহে সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময়টুকু না খেয়ে থাকা হয়, তাই এই সময়ে অবশ্যই শরীরে মেটাবলিক স্ট্রেস তৈরী হয়, নিউট্রিয়েন্ট ডেপ্রাইভেশন হয়। তখন শরীরে ইনসুলিন কমে যায়, গ্লুকাগন হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়, আর সেই বাড়তি গ্লুকাগন শরীরের অন্যান্য গ্রোথ হরমোনকে সংকেত পাঠায় যেন শরীরের বিভিন্ন কোষীয় অঙ্গানুগুলো নতুন করে তৈরী হয় এবং পুরনো কোষীয় অঙ্গানুগুলো অটোফেজি সাথে জড়িত জিনগুলোকে সক্রিয় করার মাধ্যমে অটোফ্যাজোসোম বা অটোফেজোসাইটোসিস তৈরীর কম্পার্ট্মেন্টে ওই অঙ্গানুগুলোকে আবদ্ধ করে এরপর ভেঙ্গে ফেলে অ্যামাইনো এসিডে। এটি এক ধরনের কোষীয় বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়া ও প্রয়োজনীয় পদার্থগুলো রিসাইকেল করার প্রক্রিয়া।
এখন পর্যন্ত অটোফ্যাগির সাথে জড়িত ৩২টি জিন আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তিন ধরনের অটোফ্যাগি প্রক্রিয়া- মাইক্রো, ম্যাক্রো এবং চ্যাপেরন মেডিয়েটেড আবিষ্কৃত হয়েছে।
শরীরের বিভিন্ন কাজ করার জন্য প্রতিনিয়ত প্রোটিন তৈরি হয় এবং প্রোটিনের কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রোটিনের গঠনটি অ্যামিনো অ্যাসিড দ্বারা ত্রিমাত্রিক হতে হয়। যদি ত্রিমাত্রিক না হয় তবে প্রোটিনটি শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হবে ও নানা রোগের সৃষ্টি করবে। সহজভাবে যদি বলা হয়- আমাদের ঘরে যেমন ডাস্টবিন থাকে অথবা আমাদের কম্পিউটারে যেমন রিসাইকেল বিন থাকে, তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন আছে। সারা বছর শরীরের কোষগুলো খুব ব্যস্ত থাকার কারণে ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না। ফলে কোষগুলোতে অনেক আবর্জনা ও ময়লা জমে যায়। শরীরের কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তাহলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরে বিভিন্ন প্রকারের রোগের উৎপন্ন করে। ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতো অনেক বড় বড় রোগের শুরু হয় এখান থেকেই।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০% প্রোটিন সঠিকভাবে সংশ্লেষ হতে পারে না ফলে এদের ধ্বংস করা, শরীর থেকে বের করে দেওয়া কিংবা অন্য উপায়ে কাজে লাগানো জরুরি। কেননা শরীরে এরা থাকলে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়।
মুসলমানদের দীর্ঘ একমাস রোযা পালনের ফলে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় যখন খালি পেটে থাকে, তখন শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা তো আর আমাদের মত অলস হয়ে বসে থাকে না, তাই প্রতিটি কোষ তার ভিতরের আবর্জনা ও ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে দেয়। কোষগুলোর আমাদের মতো আবর্জনা ফেলার জায়গা নেই বলে তারা নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলে।
১৯৬০ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম দেখতে পায়, কোষ নিজের ভেতরে একটি বস্তার মতো ঝিল্লি তৈরি করে নিজের আবর্জনা বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদানকে তার ভেতরে আটকে ফেলে। তবে সুস্পষ্টভাবে সেখানে কীভাবে কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রিত হয় তা বিজ্ঞানীদের তখন জানা ছিল না। বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডে ঝিল্লি-আবৃত এ অংশটির নাম দেয় লাইসোজম। আর এই লাইসোজম আবিষ্কারের কারণে ১৯৭৪ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ক্রিস্টিয়ান ডে-কে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। তবে সেখানে ঠিক কী ঘটে সেটা তখনও বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল।
জাপানের বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি ক্রিস্টিয়ান ডে-এর আবিষ্কারের সীমাবদ্ধতা বা তাত্ত্বিক দিকের প্রায়োগিক জায়গায় সর্বপ্রথম কাজ করে এবং যে জিনটি অটোফেজি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সেটি শনাক্ত করে। ইয়োশিনোরি লক্ষ্য করে লাইসোজম শুধু দেহের আবর্জনা বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদান জমা করে রাখে না। এটা রিসাইক্লিং চেম্বার বা নবায়নযোগ্য শক্তিব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে নতুন উপাদান/কোষ তৈরি করে। ইয়োশিনোরি দেখিয়েছে, কোষেরা নিজেরাই নিজেদের বর্জিতাংশ বা আবর্জনাকে আটকায়। এরপর সেখান থেকে উপকারী উপাদানগুলোকে ছেঁকে আলাদা করে ফেলে। তারপর ওই দরকারী উপাদানগুলো দিয়ে উৎপাদন করে শক্তি কিংবা গড়ে তোলে নতুন নতুন অনেক কোষ। এ আবিষ্কার তাকে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে।
অটোফেজির কারণে অনেক কোষ মরে যায়, স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল ও রোগাক্রান্ত কোষগুলোই মারা পড়ে, তাই ক্যান্সারসহ বার্ধক্যজনিত নানাবিধ রোগের গবেষণায় ইয়োশিনোরির অটোফেজি নিয়ে এ গবেষণার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
এছাড়াও ড. লুটজানারের মতে, “খাবারের উপাদান থেকে সারাবছর ধরে মানুষের শরীরে জমে থাকা কতিপয় বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিন), চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র সহজ ও স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে উপবাস।”
ন্যাশনাল একাডেমি অব সাইন্সের মতে রোযা রাখার মধ্যে অন্যান্য উপকার হলো স্ট্রেস রেজিস্ট্যান্স বা স্ট্রেস কমিয়ে দেয়া, ইনস্যুলিন সেনসিটিভি বাড়িয়ে দেওয়া, মরবিডিটি (morbidity) দকমিয়ে দেওয়া এবং আবার জীবনচক্র বাড়িয়ে দেওয়া। একজন সুস্থ্য মানুষ রোযা রাখলে তা স্বাস্থ্যের জন্য সুফল বয়ে আনে। এটি একটি কার্যকরী ডিটোক্সিফিকেশন থেরাপি। যার ফলে শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থগুলো ভেংগে পরে শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। যাদের শরীরের ওজন বেশি এবং যাদের কম, উভয়ের জন্যই রোযার উপযোগিতা রয়েছে। এটা সহজেই অনুমেয় যে, রোযা শরীরের ওজন কমায়। রোযা সময়টুকুতে শরীরে জমে থাকা চর্বিগুলো ব্যবহৃত হয়, পুড়ে নিঃষেশিত হয় এবং এইভাবে শরীরের ওজন কমে যায়। যাদের শরীরের ওজন কম রোযা রাখার ফলে তাদের হজমের প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক হয়ে আসে। রোযা রাখার ফলে তারা যে খাদ্য খায় তা হজম করতে ও তার থেকে পুষ্টিকে গ্রহন করার জন্য শরীর তৈরি হয়ে উঠে।
সুতরাং রোযার মধ্যে কোন সাস্থ্যগত সাইড ইফেক্ট তো নেই উপরন্তু রোযা রাখার মাধ্যমে মানুষ নানাবিধ রোগ ব্যাধি থেকে নিস্তার লাভ করে।
আর তাই রোযা রাখলে যে শরীর সুস্থ থাকে সে ব্যাপারে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, রোযা রাখ সুস্থ থাকবে। (ত্ববারানী, মুসনাদে আহমদ)
কিন্তু রোযা রাখার পরও মানুষ অসুস্থ হয়। তখন এই অসুস্থতাকে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার দিকে ঢেলে দেয়ার অপচেষ্টা করে থাকে নাস্তিকরা। নাঊযুবিল্লাহ!
অথচ রোযা রেখেও অসুস্থ হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময়কালে দু’জন মহিলা রোযা রেখেছিলেন। উনারা তীব্র ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক খিদমতে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা ঘটনাটি পেশ করলেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ওই দুই মহিলাকে একটি পেয়ালায় বমি করতে নির্দেশ মুবারক দিলেন। উনাদের বমির মধ্যে গোশতের টুকরা ও তাজা রক্ত বের হলো। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা এতে খুব আশ্চর্য হলেন। এর কারণ জানার জন্য উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রইলেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, উনারা হালাল রুজি দিয়ে রোযা রাখলেও হারাম জিনিস খাচ্ছিলেন। অর্থাৎ গীবত করছিলেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
وَلا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ
অর্থ : “তোমাদের মধ্যে কেউ কি পছন্দ করবে যে, আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাবে? অবশ্যই তোমরা তা অপছন্দ করবে। বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই করো।”
সুতরাং গীবত বা পরনিন্দা সহ যাবতীয় বদস্বভাবের দরুণ মানুষ রোযা রেখেও কষ্ট অনুভব করে বা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
আর তাই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
عَنْ حَضْرَتْ اَبِـىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ اِلَّا الْـجُوْعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ اِلَّا السَّهَرُ.
অর্থ: “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, কতক রোযাদার আছে যাদের রোযার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। কতক ছলাত আদায়কারী আছে যাদের রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই জোটে না।” (ইবনে মাজাহ শরীফ : কিতাবুছ ছিয়াম)
অর্থাৎ সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত উনার বিধান অনুযায়ী রোযা না রাখার কারণে যে সুস্থতা অর্জন করার কথা তা অর্জিত না হয়ে বরং শুধু ক্ষুধার্থই থাকা হয়।
এছাড়া খাবার গ্রহণের সম্মানিত সুন্নত মেনে না চলার কারণেও রোযা রেখে মানুষ অসুস্থ হয়। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
عَنْ حَضْرَتْ مِقْدَامِ بْنِ مَعْدِيْكَرِبَ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ سَـمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ مَا مَلَا اٰدَمِيٌّ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطْنٍ بِـحَسْبِ ابْنِ اٰدَمَ اُكُلَاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهٗ فَاِنْ كَانَ لَا مُـحَالَةَ فَثُلُثٌ لِطَعَامِهٖ وَثُلُثٌ لِشَرَابِهٖ وَثُلُثٌ لِنَفَسِهٖ.
অর্থ: “হযরত মিকদাম ইবনে মা’দীকারিব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ইরশাদ মুবারক করতে শুনেছি, মানুষ পেট হতে অধিক নিকৃষ্ট কোন পাত্র পূর্ণ করে না। মেরুদন্ড সোজা রাখতে পারে এমন কয়েক গ্রাস খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।” (তিরমিযী শরীফ : কিতাবুয যুহুদ : হাদীছ শরীফ নং ২৩৮০, ইবনে মাজাহ শরীফ : কিতাবুত ত্বয়ামাহ : হাদীছ শরীফ নং ৩৩৪৯)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-
عَنْ حَضْرَتْ اَبِـىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ اَنَّ رَجُلًا كَانَ يَأْكُلُ اَكْلًا كَثِيْرًا فَأَسْلَمَ فَكَانَ يَأْكُلُ أَكْلًا قَلِيْلًا فَذُكِرَ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ اِنَّ الْمُؤْمِنَ يَأْكُلُ فِي مِعًى وَاحِدٍ وَالْكَافِرَ يَأْكُلُ فِي سَبْعَةِ أَمْعَاءٍ.
অর্থ: “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক লোক খুব বেশী পরিমাণে আহার করতো। লোকটি মুসলিম হলে অল্প আহার করতে লাগলো। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুবারক-এ ব্যাপারটি পেশ করা হলে তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, মু’মিন এক পেটে খায়, আর কাফির খায় সাত পেটে।” (বুখারী শরীফ : হাদীছ শরীফ নং ৫৩৯৭; মুসলিম শরীফ : হাদীছ শরীফ নং ২০৬০)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-
اَخْبَرَنِـىْ حَضْرَتْ اَبُوْ الزُّبَيْرِ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ اَنَّهُ سَـمِعَ حَضْرَتْ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللهِ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ يَقُوْلُ سَـمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ طَعَامُ الْوَاحِدِ يَكْفِى الْاِثْنَيْنِ وَطَعَامُ الْاِثْنَيْنِ يَكْفِى الْاَرْبَعَةَ وَطَعَامُ الْاَرْبَعَةِ يَكْفِىْ الثَّمَانِيَةَ.
অর্থ : “হযরত আবূ যুবায়ের রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে খবর পৌঁচেছে যে, তিনি হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে বলতে শুনেছেন যে, তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে আমি বলতে শুনেছি যে, একজনের খাবার দু’জনের জন্য যথেষ্ট। আর দু’জনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট, আবার চারজনের খাবার আটজনের জন্য যথেষ্ট।” (মুসলিম শরীফ : কিতাবুশ শারাবাহ্ : বাবু ফাদ্বীলাতিল মুওয়াসাহ্)
সুতরাং সম্মানিত দ্বীন ইসলাম মানুষকে পেট ভরে খাওয়ার কথা বলেননি। বরং মেরুদন্ড সোজা রাখার জন্য যতটুকু খাবার প্রয়োজন হয় সে পরিমাণ খাবার খেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য গ্রহণের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বরাদ্দ রাখতে উপদেশ মুবারক দেয়া হয়েছে। এটাই খাবার গ্রহণের সুন্নতী পদ্ধতি। কিন্তু রোযাদার এই সুন্নতী পদ্ধতি অনুসরণ না করার কারণে রোযা রেখে সুস্থতা অর্জনের পরিবর্তে অসুস্থতাকেই বরণ করে নিচ্ছে। নাঊযুবিল্লাহ! আর রোযাদারের এ ধরনের কার্যক্রমের জন্য কোনভাবেই রোযাকে দোষারোপ করা যায় না। অর্থাৎ ‘রোযার রয়েছে প্রচুর সাস্থ্যগত সাইড ইফেক্ট’ বক্তব্যটি একটি ডাহা মিথ্যা বক্তব্য।
রোযার বিরোধিতা করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক কোন প্রমাণ ছাড়াই বলা হয়ে থাকে যে, রোযায় পাকস্থলীর এসিড বা অম্লীয় রস বৃদ্ধি পায় এবং ফলে ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথমাংশে ঘা হতে পারে। অথচ গবেষণায় একথা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া এরূপ ধারণা শারীরবিদ্যারও বিপরীত।
Peptic Ulcer নামক একটি গবেষণামূলক পুস্তকে ডাক্তার ক্লীভ বিবরণ দিয়েছে যে, বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথমাংশে ঘা (পেপটিক আলসার) রোগ অনেক কম অথচ দক্ষিণ ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ নাইজেরিয়ায় এ রোগ অত্যন্ত বেশি। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় মুসলমান ও মালয়েশিয়ার মালয়ী মুসলমানদের তুলনায় ঐসব দেশের চীনাদের মধ্যে এ রোগ বেশ কয়েকগুণ বেশি। এছাড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান ও জাপানী বন্দী শিবিরের অনাহারক্লিষ্ট যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে কারো পেপটিক আলসার (ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথমাংশে ঘা বা ছিদ্র) হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তাই ডাক্তার ক্লীভ জোর দিয়ে বলে, ÔFasting does not produce organic diseaseÕ| (Peptic Ulcer by Cleave T. L. (1962), John Wright & Sons ltd. Bristol. p-93)
এছাড়া বাংলাদেশের কয়েকজন উচ্চপদস্থ গবেষক-ডাক্তার রোযার উপর গবেষণা চালান, তার বিবরণ ও গবেষণার ফলাফল বর্ণনা করা হলো। ১৯৫৯ সালের পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাসে ৭ জন রোযাদার ও ৫ জন বেরোযাদার স্বেচ্ছাসেবকের পাকস্থলীর এসিড পরীক্ষা (Gastric Juica Analysis) করা হয়। রোযার আগে ও পরে বেরোযাদার কন্ট্রোলদের এসিড প্রায়ই অপরিবর্তিত থাকে, কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। রোযাদারদের সংখ্যা কম বলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবকের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। উভয় পর্যায়ে মোট ২৫ জন রোযাদারের মধ্যে ১৭ জনের স্বাভাবিক (Isochlorhydria), ৭ জনের বেশি (Hyperchrlorhydric) এবং ১ জনের কম (Hypochlorhydria) ছিল। রোযার মাসে চতুর্থ সপ্তাহে এদের এসিড দাঁড়ায় ২০ জনের স্বাভাবিক আর ৫ জনের বেশি। প্রথম দিকে যে ৭ জনের বেশি এসিড ছিল, রোযা শেষে সে ৭ জনের মধ্যে ৫ জনের স্বাভাবিক হয়ে যায় ও ২ জনের বেশিই থাকে। তবে যে ১৭ জনের এসিড স্বাভাবিক ছিল রোযা শেষে তাদের ১৪ জনের স্বাভাবিক থাকে আর ৩ জনের এসিড বাড়ে। যে ১ জনের কম এসিড ছিল রোযা শেষে স্বাভাবিক হয়। সুতরাং রোযায় এসিড বৃদ্ধির তুলনায় হ্রাস পায় অনেক বেশি।
বাংলাদেশের প্রাক্তন জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম বলেছেন, “রোযা মানুষের দেহে কোনো ক্ষতি করে না। ইসলামের এমন কোনো বিধান নেই, যা মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর। গ্যাস্ট্রিক ও আলসার-এর রোগীদের রোযা নিয়ে যে ভীতি আছে তা ঠিক নয়। কারণ রোযায় এসব রোগের কোনো ক্ষতি হয় না বরং উপকার হয়। রমযান মানুষকে সংযমী ও নিয়মবদ্ধভাবে গড়ে তুলে।”
১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডা. গোলাম মুয়াযযম কর্তৃক “মানব শরীরের উপর রোযার প্রভাব” সম্পর্কে যে গবেষণা চালানো হয়, তাতে প্রমাণিত হয় যে, রোযার দ্বারা মানব শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না, কেবল ওজন সামান্য কমে।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলীর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোযা রাখার ফলে তা স্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন উপকার বয়ে আনে। যেমন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যাওয়া, বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটিকে মন্থর করে দেওয়া এবং জীবনচক্রকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়িয়ে দেওয়া।
অর্গানিজমের জীবনচক্রকে বাড়িয়ে দেওয়ার একমাত্র প্রমাণিত পদ্ধতি হলো কম ক্যালরি গ্রহণ করা। তাই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিং এর নিউরোসাইন্স ল্যাবরেটরি প্রধানের অভিমত- ক্যালরি রেস্ট্রিকসন ডায়েটের মত রোযাও ক্যালরি গ্রহণকে কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
পুরোপুরি অভুক্ত থাকার প্রধান সমস্যার দুটি হলো হাইপোকালেমিয়া এবং কার্ডিয়াক এরিথমিয়া। প্রথমটিতে রক্তে পটাসিয়ামের লেভেল অনেকটা নীচে নেমে যায় আর দ্বিতীয়টিতে হার্টবিট অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। কিন্তু রোযা টোটাল ফাস্টিং নয়, রোজাদাররা নিয়ম করে ইফতার এবং সাহরীর সময় খাদ্য গ্রহণ করে থাকেন। রক্তে সুগারের যে ঘাটতি দেখা দেয় তাও পুরণ হয়ে যায়। অতএব এটাতে কোন মতভেদ নেই যে, রোযা একজন সুস্থ্য মানুষের স্বাস্থের আরো উন্নতি ঘটায়।
ডাঃ স্যামুয়্যাল হ্যানিম্যান স্পিরিচুয়াল ফোর্স বৃদ্ধিকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। তাই রোযা রাখার ফলশ্রুতিতে প্রকৃত মুমিনগণ অতিরিক্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লাভ করে থাকেন। দৈহিক শক্তি, মানসিক শক্তি এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বৃদ্ধিতে রোযা একটি বিষ্ময়কর নিয়ামক। সুতরাং ঈমানদারদের রোযা রাখা পুরোপুরি বিজ্ঞান সম্মত।
রোযার অন্যান্য উপকারিতাগুলো নিম্নরুপ-
১. রোযা অনেক ধরনের চর্ম রোগের সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। এটি হয়ে থাকে শরীর থেকে বিষাক্ত দ্রব্যগুলো বেরিয়ে যাওয়ার ফলে এবং রক্ত পরিশুদ্ধ হওয়ার ফলে। রোযা সিগারেট এবং মদের মত অনেক ধরনের আসক্তি থেকেও মুক্তি দিতে পারে।
২. রোযা কিডনীতে পাথর সৃষ্টিতে বাধা দেয় বা পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমায়। রোযার ফলে রক্তের সোডিয়ামের মাত্রা বাড়ে। যা ক্যালসিয়ামকে জমতে বাধা দেয়। কিডনীতে ক্যালসিয়াম জমেই পাথরের সৃষ্টি হয়। ডঃ রবার্টের মতে রোযা সে সকল মাইক্রোর ধ্বংস করে যা বিভিন্ন কোষকে আক্রমণ করে। ফলে তা নতুন করে গঠিত হয়।
৩. রোযায় রক্তস্বল্পতা ও রক্তশূণ্যতা দূর হয়। কেননা রোযার মাধ্যমে ক্ষুধার অনুভূতি সৃষ্টি হলে দেহে সঞ্চিত লৌহ জাতীয় পদার্থ নির্গত হয় এবং তা রক্তের সল্পতা বা রক্ত শূন্যতা পূরণ করে।
৪. হায়াত বাড়ে ও বার্ধক্য দেরিতে আসে।
৫. পুরুষ হরমোন বৃদ্ধি পায়।
৬. দাঁত ও মাড়ির উপকার হয়।
৭. যৌনরোগ থেকে বাঁচা যায়।
৮. স্নায়ুতন্ত্র শান্ত থাকে ইত্যাদি।
কয়েকজন বিখ্যাত আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে পবিত্র রমাদ্বান শরীফ :
১. ডা. জুয়েলস এম. ডি - “যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে।”
২. ডক্টর ডিউই - “রোগজীর্ণ এবং রোগকিষ্ট মানুষটির পাকস্থলী হতে খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে ফেলো, দেখবে রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না, সত্যিকাররূপে উপবাস থাকছে রোগটি।”
৩. ডা. আলেক্স হেইগ - “রোজা হতে মানুষের মানসিক শক্তি ও এবং বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়।”
৪. বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড নারায়ড - “রোযা মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মূল করে দেয়।”
৫. প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী Macfadden - “রোযার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে কি পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করা হলো তার উপর বুদ্ধিবৃত্তির কর্মক্ষমতা নির্ভর করে না। বরং কতিপয় বাধ্যবাধকতার উপরই তা নির্ভরশীল। একজন ব্যক্তি যত রোযা রাখে তার বুদ্ধি তত প্রখর হয়।”
৬. ডা. এ এম গ্রিমী - “রোযার সামগ্রিক প্রভাব মানব স্বাস্থ্যের উপর অটুটভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে এবং রোযার মাধ্যমে শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠে।”
৭. ডা. আর ক্যাম ফোর্ডের মতে, “রোযা হচ্ছে পরিপাক শক্তির শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।”
৮. ডা. এম. কাইভ - “রোযা রাখলে শ্লেষ্মা ও কফজনিত রোগ দূরীভূত হয়।”
৯. ডা. আব্রাহাম জে. হেনরি - “রোযা হলো পরম হিত সাধনকারী ঔষুধ।”
১০. ডা. অ্যাডওয়ার্ড নিক্সন - “রোযা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং অনেক রোগের কবল থেকে দেহকে রক্ষা করে।”
১১. ডা. লিউ থার্ট - “দেহের রোযা অত্যন্ত হিতকর টনিক। রোযাদাররা অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকেন।”
১২. ডা. লুইস ফ্রন্ট - “রোযা পালনে মানবদেহ যথেষ্ট পুষ্ট এবং বলিষ্ঠ হয়ে থাকে। মুসলমানরা নিশ্চয়ই রোযার মাসকে সুস্বাস্থ্যের মাস হিসেবে গণ্য করে থাকেন। রোযা বা উপবাস মেধাশক্তিকেও বৃদ্ধি করে থাকে।”
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, রোযার মাধ্যমে প্রচুর স্বাস্থ্যগত ব্যাধির আরোগ্য সাধন হয়। আর তাই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম মুসলমান উনাদের জন্য এক মাস ব্যাপী রোযা রাখার বিধান জারী করেছে। বছরে এক মাস ব্যাপী রোযা রাখার বিধান জারী করার মাধ্যমে বরং মুসলমান উনাদের প্রতি ইহসান করা হয়েছে। কেননা পূর্ববর্তী উম্মতের জন্য আরো বেশি রোযা রাখার বিধান জারী ছিল। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার রোযা রাখার বিধান প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে-
عَنْ حَضْرَتْ عَبْدَ اللهِ بْنَ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ يَقُوْلُ سَـمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ صَامَ نُوْحٌ الدَّهْرَ اِلَّا يَوْمَ الْفِطْرِ وَيَوْمَ الاَضْحَى.
অর্থ : “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদ্বহার দিন ছাড়া হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম তিনি সারা বছর রোযা রাখতেন।” (ইবনে মাজাহ্ শরীফ)
অর্থাৎ হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার যামানায় সারা বছরে মাত্র ২ দিন রোযা রাখা হতো না।
আবার হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম তিনি ১ দিন অন্তর সারা বছর ব্যাপী রোযা রাখতেন।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
عَنْ حَضْرَتْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِنَّ اَحَبَّ الصِّيَامِ اِلَى اللهِ صِيَامُ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ وَاَحَبَّ الصَّلَاةِ اِلَى اللهِ صَلَاةُ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَنَامُ نِصْفَ اللَّيْلِ وَيَقُوْمُ ثُلُثَهُ وَيَنَامُ سُدُسَهُ وَكَانَ يَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا.
অর্থ : “হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট পছন্দনীয় রোযা হচ্ছে হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম উনার রোযা এবং উনার নিকট পছন্দনীয় নামায হচ্ছে হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম উনার নামায। তিনি অর্ধ রাত ঘুমাতেন। অতঃপর এক তৃতীয়াংশ রাত ইবাদতে কাটাতেন। অতঃপর এক ষষ্ঠাংশ রাত ঘুমাতেন। তিনি একদিন রোযা পালন করতেন এবং একদিন বাদ দিতেন।” (মুসলিম শরীফ : কিতাবুছ ছাওম : হাদীছ শরীফ নং ১৬২৯)
অর্থাৎ হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম তিনি অর্ধ বছর রোযা রাখতেন।
এখন প্রশ্ন আসে, সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার বিধান- বছরে এক মাস (২৯ বা ৩০ দিন) ব্যাপী রোযা রাখলেই যদি প্রচুর স্বাস্থ্যগত সাইড ইফেক্টের শিকার হতে হয়। তাহলে হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম তিনি বছরে ১৭৭ বা ১৭৮ দিন কিভাবে রোযা রাখতেন? উপরন্তু তিনি ঘুমাতেনও কম। আর হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম তিনি তো আরো বেশি- বছরে ৩৫২ বা ৩৫৩ দিন রোযা রাখতেন, আর তিনি প্রায় ৯৫০ বছর হায়াত মুবারক-এ ছিলেন। উনার তো স্বস্থ্যগত সাইড ইফেক্ট আরো বেশি হওয়ার কথা। নাঊযুবিল্লাহ! কেননা, তিনি উনার ৯৫০ বছরের যিন্দেগী মুবারক-এ মাত্র ১৯০০ দিন রোযা ছাড়া ছিলেন বাকি প্রায় ৩৩৪৮৭৫ দিন রোযা রেখেছেন। গণ্ডমূর্খ নাস্তিকদের এ ব্যাপারে জবাব কি?
পবিত্র হাদীছ শরীফ (Sahih Bukhari 5:58:172 উনার মধ্যে পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযার ব্যাপারে বর্ণিত রয়েছে-
عَنْ اُمّ الْمُؤْمِنِيْنَ حَضْرَتْ عَائِشَةَ الصّـدّيْقَةِ عَلَيْهَا السَّلَامَ قَالَتْ كَانَ عَاشُوْرَاءُ يَوْمًا تَصُوْمُهُ قُرَيْشٌ فِي الْـجَاهِلِيَّةِ وَكَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُوْمُهُ فَلَمَّا قَدِمَ الْمَدِيْنَةَ صَامَهُ وَاَمَرَ بِصِيَامِهِ فَلَمَّا نَزَلَ رَمَضَانُ كَانَ مَنْ شَاءَ صَامَهُ وَمَنْ شَاءَ لَا يَصُوْمُهُ.
অর্থ : “সাইয়্যিদাতুনা হযরত উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জাহিলি যুগে পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন কুরাইশরা রোযা পালন করতো। এ দিনে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও রোযা মুবারক পালন করতেন। যখন হিজরত মুবারক করে পবিত্র মদীনা শরীফ তাশরীফ মুবারক রাখলেন, তিনি নিজেও পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা পালন করতেন এবং অন্যকেও তা পালনে আদেশ দিতেন। যখন পবিত্র রমাদ্বান শরীফ উনার রোযা ফরয করা হলো, (তখন পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা ঐচ্ছিক করে দেওয়া হলো)। তখন যার ইচ্ছা রোযা রাখতেন আর যার ইচ্ছা রোযা রাখতেন না।” (বুখারী শরীফ : কিতাবু মানাক্বিবুল আনছার : হাদীছ শরীফ নং ৩৮৩১)
অত্র পবিত্র হাদীছ শরীফ উপস্থাপন করে নাস্তিকরা বলছে যে, রোযা এসেছে ইসলামপূর্ব কুরাইশদের থেকে। নাঊযূবিল্লাহ! কিন্তু অত্র পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এ কথা বলা হয়নি যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন যে রোযা মুবারক রেখেছেন সে রোযা মুবারক কুরাইশদের রোযা পালনের অনুসরণে। বরং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সম্মানিত দ্বীন ইসলাম অনুযায়ী রোযা মুবারক পালন করেছেন।
কেননা মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ মুবারক করেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ
অর্থ : “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল যাতে তোমাদের পরহেয্গারী অর্জিত হয়।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৮৩)
অর্থাৎ রোযা পালনের বিধান সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সময় থেকেই ছিল।
এজন্য তাফসীরে উল্লেখ আছে, হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার যামানায় প্রতিমাসে তিন দিন রোযা রাখার হুকুম ছিল। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূর্ব পর্যন্ত বহাল ছিল। শুরুতে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা মাসে তিন দিন রোযা রাখতেন। পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাসের একমাস রোযা পালনের হুকুম সম্বলিত আয়াত শরীফ নাযিল হলে, তা রহিত হয়ে যায়। (তাফসীরে ইবনে কাছীর)
অর্থাৎ সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার কুরাইশদের থেকে রোযার বিধান চালু হয়নি, বরং হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার থেকে শুরু হওয়া রোযার বিধান হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার মাধ্যম দিয়ে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে জারী রয়েছে।
এছাড়াও পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন শুধু পবিত্র মক্কা শরীফ উনার কুরাইশরাই রোযা রাখতো না, বরং পবিত্র মদীনা শরীফ উনার ইয়াহুদীরাও পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন রোযা রাখতো। যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
عَنْ حَضْرَتْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ فَرَاَى الْيَهُودَ تَصُوْمُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ مَا هٰذَا. قَالُوْا هٰذَا يَوْمٌ صَالِحٌ هٰذَا يَوْمٌ نَـجَّى اللهُ بَنِـي اِسْرَائِيْلَ مِنْ عَدُوّهِمْ فَصَامَهٗ مُوْسٰى عَلَيْهِ السَّلَامُ. قَالَ فَاَنَا اَحَقُّ بِـمُوْسٰى عَلَيْهِ السَّلَامُ مِنْكُمْ (نَـحْنُ اَحَقُّ بِـمُوْسٰى عَلَيْهِ السَّلَامُ مِنْكُمْ.) فَصَامَهٗ وَاَمَرَ بِصِيَامِهٖ.
অর্থ : “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে তাশরীফ মুবারক নিয়ে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদীরা পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন রোযা রেখে থাকে। তিনি উম্মতকে তা’লীম প্রদানের জন্য তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন ইয়াহুদীরা বললো, ওই দিনে ফির‘আঊন ও তার সৈন্যবাহিনী পানিতে ডুবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো। আর হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি ও উনার সঙ্গী-সাথিরা যুল্ম-নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এজন্য মহান আলাহ পাক উনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি রোযা পালন করেন। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি হক্বদার। (ইবনে মাজাহ শরীফ উনার রেওয়াতে- তোমাদের চেয়ে আমরাই বেশি হক্বদার।) অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বয়ং পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন রোযা রাখলেন এবং ওই মুবারক দিনে সবাইকে রোযা রাখার হুকুম মুবারক দিলেন।” (বুখারী শরীফ : হাদীছ শরীফ নং ২০০৪, ইবনে মাজাহ শরীফ : হাদীছ শরীফ নং ১৭৩৪)
অন্য বর্ণনায় বর্ণিত আছে-
عَنْ حَضْرَتْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَدِمَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ فَوَجَدَ الْيَهُودَ يَصُومُوْنَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَسُئِلُوا عَنْ ذٰلِكَ فَقَالُوا هٰذَا الْيَوْمُ الَّذِي اَظْهَرَ اللهُ فِيْهِ مُوسٰى عَلَيْهِ السَّلَامُ وَبَنِىْ اِسْرَائِيْلَ عَلٰى فِرْعَوْنَ فَنَحْنُ نَصُوْمُهُ تَعْظِيْمًا لَهٗ. فَقَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَـحْنُ اَوْلٰى بِـمُوْسٰى عَلَيْهِ السَّلَامُ مِنْكُمْ فَاَمَرَ بِصَوْمِهٖ.
অর্থ : “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে তাশরীফ মুবারক নিয়ে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহূদীরা পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন রোযা রেখে থাকে। তিনি উম্মতকে তা’লীম প্রদানের জন্য তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন ইয়াহূদীরা বললো, ওই দিনে ফির‘আঊন ও তার সৈন্যবাহিনী পানিতে ডুবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো। আর হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি ও উনার সঙ্গী-সাথিরা যুল্ম-নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এজন্য আমরা মহান আলাহ পাক উনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে রোযা পালন করি। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি হক্বদার। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বয়ং পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন রোযা রাখলেন এবং ওই মুবারক দিনে সবাইকে রোযা রাখার হুকুম মুবারক দিলেন।” (বুখারী শরীফ : কিতাবু মানাক্বিবিল আনছার : বাবু ইতইয়ানিল ইয়াহূদীন নাবিয়্যি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হীনা ক্বদিমাল মাদীনাহ্ : হাদীছ শরীফ নং ৩৯৪৩, মুসলিম শরীফ : কিতাবুছ্ ছিয়াম : বাবু ছওমি ইয়াওমি আশূরা : হাদীস শরীফ নং ১১৩০, আবূ দাঊদ : কিতাবুছ্ ছওম : বাবুন ফী ছওমি ইয়াউমি আশূরা : হাদীছ শরীফ নং ২৪৪৪)
উপরোক্ত হাদীছ শরীফদ্বয় উনাদের বর্ণনা অনুযায়ী দেখা গেল যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে তাশরীফ মুবারক নিয়ে ইয়াহুদীদেরকে পবিত্র আশূরা শরীফ উপলক্ষ্যে রোযা রাখতে দেখলেন ও উম্মতের জন্য পবিত্র আশূরা শরীফ উপলক্ষ্যে রোযা রাখার বিধানকে সত্যায়ন করে দিলেন।
তাহলে প্রশ্ন আসে, পবিত্র মদীনা শরীফ উনার ইয়াহুদীরা পবিত্র আশূরা শরীফ উপলক্ষ্যে রোযা রাখার বিধান পেল কিভাবে? তারা তো ওই দিনে ফির‘আঊন ও তার সৈন্যবাহিনী পানিতে ডুবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো আর হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি ও উনার সঙ্গী-সাথিরা যুল্ম-নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন বিধায় মহান আলাহ পাক উনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে রোযা পালন করে। হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি তো পবিত্র মক্কা শরীফ উনার অধিবাসীদের জন্য নবী হিসেবে আসেননি, বরং তিনি মিশরবাসীদের জন্য নবী হিসেবে এসেছেন।
পবিত্র মক্কা শরীফ উনার কুরাইশরা ওই দিনে কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে রোযা রাখতো? নাস্তিকদের এ ব্যাপারে যুক্তি-প্রমাণ কি?
সুতরাং রোযা এসেছে ইসলামপূর্ব কুরাইশদের থেকে- বক্তব্যটি একটি ডাহা মিথ্যাচার। কেননা রোযা যদি কুরাইশদের থেকেই এসে থাকে তাহলে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার ইয়াহুদীরা রোযা পালন করেছে কিভাবে?
আর একই দিন (পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন) উপলক্ষ্যে দুইটি ভিন্ন সম্প্রদায় - পবিত্র মক্কা শরীফ উনার কুরাইশ সম্প্রদায়, যারা মূলত মুশরিক বা পৌত্তলিক ছিল এবং পবিত্র মদীনা শরীফ উনার ইয়াহুদী সম্প্রদায় রোযা রাখার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার মাধ্যম দিয়েই রোযা যেমন কুরাইশ সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছেছে, ঠিক তেমনি ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের কাছেও পৌঁছেছে। কেননা হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্মানিত আওলাদ হযরত ইসমাঈল যাবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার মাধ্যম দিয়ে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম কুরাইশদের কাছে পৌঁছেছে। আর হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার আরেক সম্মানিত আওলাদ হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম উনার মাধ্যম দিয়ে হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার দ্বারা সম্মানিত দ্বীন ইসলাম ইয়াহুদীদের কাছে পৌঁছেছে।
অধিকিন্তু হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি ছিলেন মুসলমান উনাদের অন্তর্ভুক্ত।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
وَمَنْ يَّرْغَبُ عَنْ مِّلَّةِ اِبْرَاهِيْمَ اِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ ۚ وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِى الدُّنْيَا ۖ وَاِنَّهُ فِى الْاٰخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِـحِيْنَ. اِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ اَسْلِمْ ۖ قَالَ اَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ. وَوَصّٰى بِـهَا اِبْرَاهِيْمُ بَنِيْهِ وَيَعْقُوْبُ يَا بَنِىَّ اِنَّ اللهَ اصْطَفٰى لَكُمُ الدِّيْنَ فَلَا تَـمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ. اَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ اِذْ حَضَرَ يَعْقُوْبَ الْمَوْتُ اِذْ قَالَ لِبَنِيْهِ مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ بَۢعْدِى قَالُوْا نَعْبُدُ اِلٰـهَكَ وَاِلٰهَ اٰبَائِكَ اِبْرَاهِيْمَ وَاِسْـمَاعِيْلَ وَاِسْحَاقَ اِلٰـهًا وَاحِدًا وَنَـحْنُ لَهُ مُسْلِمُوْنَ. تِلْكَ اُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ ۖ لَـهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَّا كَسَبْتُمْ ۖ وَلَا تُسْأَلُوْنَ عَمَّا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ. وَقَالُوْا كُوْنُوْا هُوْدًا اَوْ نَصَارٰى تَـهْتَدُوْا ۗ قُلْ بَلْ مِلَّةَ اِبْرَاهِيْمَ حَنِيْفًا ۖ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ. قُوْلُوْا اٰمَنَّا بِاللهِ وَمَا اُنْزِلَ اِلَيْنَا وَمَا اُنْزِلَ اِلٰى اِبْرَاهِيْمَ وَاِسْـمَاعِيْلَ وَاِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ وَالْاَسْبَاطِ وَمَا اُوْتِـىَ مُوْسٰى وَعِيْسٰى وَمَا اُوْتِـىَ النَّبِيُّوْنَ مِنْ رَّبِّـهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ اَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَـحْنُ لَهُ مُسْلِمُوْنَ.
অর্থ : “হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্মানিত দ্বীন থেকে কে মুখ ফিরায়? কিন্তু সে ব্যক্তি, যে নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করে। নিশ্চয়ই আমি উনাকে পৃথিবীতে মনোনীত করেছি এবং তিনি পরকালে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। স্মরণ করুণ, যখন উনাকে উনার মহান রব তায়ালা বললেন, অনুগত হোন। তিনি বললেন, আমি মহান রব তায়ালা উনার অনুগত হলাম। এরই ওছিয়ত করেছেন হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি উনার আওলাদ উনাদের এবং হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তিনিও যে, হে আমার আওলাদগণ, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদের জন্য এ সম্মানিত দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলমান না হয়ে কখনও ইন্তিকাল করবে না। তোমরা কি উপস্থিত ছিলে, যখন হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র বিছাল শরীফ নিকটবর্তী হয়? যখন তিনি আওলাদদের বললেন, আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা বললো, আমরা আপনার পিতৃপুরুষ হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম, হযরত ইসমাঈল যাবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম ও হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম উনাদের ইলাহ উনার ইবাদত করবো। তিনি একক ইলাহ। আমরা সবাই উনার আজ্ঞাবহ। তারা ছিল এক সম্প্রদায়- যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদেরই জন্যে। তারা কি করতো, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না। তারা বলে, তোমরা ইয়াহুদী অথবা খৃষ্টান হয়ে যাও, তবেই সুপথ পাবে। আপনি বলুন, কখনই নয়; বরং আমরা হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্মানিত দ্বীন উনার উপর আছি যাতে বক্রতা নেই। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তোমরা বলো, আমরা ঈমান এনেছি মহান আল্লাহ পাক উনার উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম, হযরত ইসমাঈল যাবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম, হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম, হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এবং তদীয় বংশধরের প্রতি এবং হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম, হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম, অন্যান্য হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মহান রব তায়ালা উনার পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে, তৎসমুদয়ের উপর। আমরা উনাদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আমরা উনারই আনুগত্যকারী।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩০-১৩৬)
প্রমার্ণিত হলো যে, একমাস ব্যাপি রোযা রাখায় রয়েছে প্রচুর সাস্থ্যগত সাইড ইফেক্ট - এই কথাটি একটি নাস্তিকীয় কুসংস্কার, যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে এক মাস ব্যাপী রোযা রাখার ফলে স্বাস্থ্যের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয় এবং বিভিন্ন রোগ থেকেও মুক্তি লাভ করা যায়। এমনকি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতারও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। আর রোযার বিধানটি কুরাইশদের থেকে সম্মানিত দ্বীন ইসলামে অনুপ্রেবশ করেনি বরং সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার শুরু অর্থাৎ হযরত ছফীউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার থেকে ধারাবাহিকভাবে হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার মাধ্যম হয়ে সম্মানিত দ্বীন ইসলামে চলমান রয়েছে। তাই রোযা এসেছে ইসলামপূর্ব কুরাইশদের থেকে- বক্তব্যটি একটি ডাহা মিথ্যাচার, যা মিথ্যাবাদী নাস্তিকদের আরেকটি মিথ্যা উৎগীরণ।
0 Comments:
Post a Comment