মহান আল্লাহ পাক তিনি মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার বিধান দিয়েই প্রথম নবী ও প্রথম রসূল হযরত আদম ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে যমীনে প্রেরণ করেছেন। আর সম্মানিত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনাদের সর্বশেষ নবী ও রসূল হচ্ছেন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি।

মহান আল্লাহ পাক তিনি মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার বিধান দিয়েই প্রথম নবী ও প্রথম রসূল হযরত আদম ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে যমীনে প্রেরণ করেছেন। আর সম্মানিত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনাদের সর্বশেষ নবী ও রসূল হচ্ছেন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি।

নাস্তিকদের আপত্তি : ইসলাম কি প্যাগান ধর্মের নতুন সংস্করন নয় যেখান থেকে তাদের রীতিনীতির অনেক কিছুই উঠে এসেছে?

১. দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করা (The Encyclopedia of Islam - edited by Eliade, P. 303FF)

২. রোযা রাখা (Sahih Bukhari 5:58:172)

৩. কাবার চারিদিকে ঘোরা/ তাওয়াফ এবং ইহরাম (Sahih Bukhari 2:26:710 Sahih Bukhari 2:26:706)

৪. কালো পাথরে চুম্বন (Sahih Bukhari 2:26:667, 2:26:675 The Book of Idols, p 14 Encyclopedia Britannica - Arabian Religions, p1059, 1979)

৫. বাকা চাঁদের প্রতিক (http://www.bible.ca/islam/islam-moon-god-hubal.htm)

Islamic ritual, including the Hajj, the stand, the throw and the run were all practiced by the pagans long before Muhammad adopted them into Islam. Muhammad took these pagan practices and declared them to be the correct way to worship a monotheistic Allah. In this way, the pagans could keep their old pagan practices and apply them to one god rather than hundreds. It made conversion to Islam very easy for the Arabs since Islam felt the same as their paganism.

http://www.bible.ca/islam/islam-polytheism-moon-worship.htm

খণ্ডণ : মহান আল্লাহ পাক তিনি মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার বিধান দিয়েই প্রথম নবী ও প্রথম রসূল হযরত আদম ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে যমীনে প্রেরণ করেছেন। আর সম্মানিত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনাদের সর্বশেষ নবী ও রসূল হচ্ছেন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنَّ اللهَ اصْطَفٰى اٰدَمَ وَنُوْحًا وَاٰلَ اِبْرَاهِيْمَ وَاٰلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ.

অর্থ : “নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ পাক তিনি আবুল বাশার হযরত আদম ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম, আবুল বাশার ছানী হযরত নূহ আলাইহিস সালাম ও আবুল মুসলিমীন হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার বংশধর এবং হযরত ইমরান আলাইহিস সালাম উনার খান্দানকে মনোনীত করেছেন।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৩)

مَا كَانَ اِبْرَاهِيْمُ يَهُوْدِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلٰكِنْ كَانَ حَنِيْفًا مُّسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ.

অর্থ : “আবুল মুসলিমীন হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি ইয়াহুদী ছিলেন না এবং নাছারাও ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন ‘হানীফ’ অর্থাৎ, সব মিথ্যা ধর্মের প্রতি বিমুখ ও মুসলমান এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬৭)

فَلَمَّا اَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ اِلَيْكَ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُؤْمِنِيْنَ.

অর্থ : “হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, হে মহান রব তায়ালা! আপনার মহান সত্ত্বা পবিত্র, আপনার দরবারে আমি আত্মসমর্পন করছি এবং আমিই প্রথম বিশ্বাস স্থাপন করছি।” (পবিত্র সূরা আ’রাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪৩)

قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ أَوَّلَ مَنْ أَسْلَمَ ۖ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ. 

অর্থ : “আপনি বলে দিন, আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, সর্বাগ্রে আমিই মুসলমান। আপনি কদাচিতও অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।” (পবিত্র সূরা আন‘আম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪)

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اَبِـىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ‏ اِنَّ مَثَلِىْ وَمَثَلَ الاَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِىْ كَمَثَلِ رَجُلٍ بَنَى بَيْتًا فَاَحْسَنَهُ وَاَجْـمَلَهُ اِلَّا مَوْضِعَ لَبِنَةٍ مِنْ زَاوِيَةٍ فَجَعَلَ النَّاسُ يَطُوْفُوْنَ بِهِ وَيَعْجَبُوْنَ لَهُ وَيَقُوْلُوْنَ هَلَّا وُضِعَتْ هَذِهِ اللَّبِنَةُ قَالَ فَاَنَا اللَّبِنَةُ وَاَنَا خَاتِـمُ النَّبِيِّينَ‏‏.‏

অর্থ : “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমার ও আমার পূর্ববর্তী সম্মানিত আম্বিয়া ও মুরসালীন আলাইহিমুস সালাম উনাদের দৃষ্টান্ত হলো ওই ব্যক্তির মতো, যিনি উত্তমরূপে একটি ঘর বানিয়েছেন এবং সুন্দরভাবে তা সাজিয়েছেন। তবে ফাঁকা রেখেছেন এক কোণে একটি ইটের জায়গা। তখন লোকেরা তা প্রদক্ষিণ করতে লাগলো এবং অভিভূত হয়ে বলতে লাগলো, এই ইটটি কেন লাগানো হলো না? নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমি হলাম সে ইটটি। আর আমিই শেষ নবী।” (বুখারী শরীফ : কিতাবুল মানাকিব - বাবু খাতিমিন নাবীয়্যীন ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম; মুসলিম শরীফ : কিতাবুল ফাদ্বায়িল - বাবু যিকরি কাউনিহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

মহান আল্লাহ পাক তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মাধ্যমে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার পূর্ণতা প্রদান করেছেন। আর তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন- 

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ

অর্থ : “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতসমূহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” (পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫)

সুতরাং উপরোক্ত দলীলের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই সম্মানিত দ্বীন ইসলামকে মানুষের জীবন যাপনের সমস্ত বিধান হিসেবেই প্রেরণ করেছেন। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার প্রতি নাযিলকৃত বিধি-বিধানগুলো প্রত্যেক সম্মানিত নবী বা রসূল আলাইহিস সালাম উনার যামানার অবস্থার প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ পাক তিনি পরিমার্জন, পরিবর্ধন বা সংশোধন, যেটাই প্রয়োজন সে অনুযায়ী পরিমার্জন, পরিবর্ধন বা সংশোধন করে প্রেরণ করতেন। আর সর্বশেষ সম্মানিত নবী বা রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি চুড়ান্ত সংশোধিত, পরিমার্জিত বা পরিবর্ধিত অবস্থায় নাযিল করেছেন। তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنَّ الدِّيْنَ عِندَ اللهِ الْاِسْلَامُ ۗ

অর্থ : “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন হচ্ছে ইসলাম।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৯)

পবিত্র দ্বীন ইসলাম যেহেতু মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন। তাই কোন আমল করতে হলে বিধর্মী বা বিজাতীয়দের কোন অনুসরণ-অনুকরণ করা যাবে না বা তাদের থেকে কোন নিয়ম-নীতি গ্রহণ করা যাবে না। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি তা বাতিল ঘোষণা করেছেন। তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন,

وَمَنْ يَّبْتَغِ غَيْرَ‌ الْاِسْلَامِ دِيْنًا فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْاٰخِرَ‌ةِ مِنَ الْـخَاسِرِ‌يْنَ ◌

অর্থ : “যে ব্যক্তি পবিত্র দ্বীন ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন (নিয়ম-নীতি, অন্য ধর্ম) তালাশ করে, তা কখনোই তার থেকে গ্রহণ করা হবেনা এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৫)

 পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যেও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইয়াহুদী-নাছারাদের অনুসরণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে- 

عَنْ حَضَرَتْ عُمَرُو بْنِ شُعَيْبِ عَنْ اَبِيْهِ عَنْ جَده اَنَّ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا لاَتَشَبَّهُوْا بِالْيَهُوْدِ وَلا بِالنَّصَارٰى.

অর্থ : “হযরত উমর বিন শুয়াইব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনার পিতা হতে উনার পিতা উনার দাদা হতে বর্ণনা করেন যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যে ব্যক্তি আমাদের ভিন্ন অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে আমাদের দলভূক্ত নয়। কাজেই আপনারা ইয়াহুদী এবং নাছারাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করবেন না।” (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ-৩৯৯ পৃষ্ঠা)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত আছে,

عَنْ حَضْرَةْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرُ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُمَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.

অর্থ : “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথে হবে।” (আবূ দাউদ শরীফ, মুসনদে আহমদ শরীফ)

অতএব সম্মানিত দ্বীন ইসলাম যেহেতু মহান আল্লাহ পাক উনার কর্তৃক মনোনীত ও নাযিলকৃত এবং তিনিই এই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম অবস্থার প্রেক্ষিতে সংশোধন, পরিমার্জিন বা পরিবর্ধন করেছেন, সেহেতু অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদ থেকে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার জন্য কোন নিয়ম-নীতি বা রীতি-নীতি গ্রহণের নিষ্প্রয়োজনীয়তা সহজেই অনুধাবনীয়। বরং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন যারা সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার কিছু বিষয় মেনে নিয়ে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করেছে, আর কিছু বিধি-বিধান তাদের মনঃপুত না হওয়ার কারণে তাদের নফসের তাড়নায় তা ছেড়ে দিয়ে শয়তানের অনুসরণ করে পথভ্রষ্ট হয়েছে। ফলে এই পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের লোকদের জীবনে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মেনে নেয়া বিধি-বিধানগুলো বংশানুক্রমে চালু রয়ে গেছে। তবে তা মহান আল্লাহ পাক উনার কর্তৃক চুড়ান্ত সংশোধিত, পরিমার্জিত বা পরিবর্ধিত বিধি-বিধানের ভিত্তিতে নয়, বরং নিজেদের মন মতো। 

এ ধরণের একটি সম্প্রদায় হচ্ছে পৌত্তলিক বা মূর্তিপুজক সম্প্রদায়। মহান আল্লাহ পাক উনার কর্তৃক চুড়ান্ত সংশোধিত, পরিমার্জিত বা পরিবর্ধিত বিধি-বিধানের ভিত্তিতে নয়, বরং নিজেদের মন মতো ও তাদের নিজেদের তৈরি নিয়ম-নীতির ভিত্তিতে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার বিভিন্ন বিধি-বিধান যেমন নামায, রোযা, হজ্জ ইত্যাদি বিষয়গুলো বংশানুক্রমে চালু রেখেছে।

নামায, রোযা, হজ্জ ইত্যাদি বিষয়গুলো যে মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার বিধান হিসেবে চালু ছিল তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-

নামায আদায়ের ইতিহাস :

প্রথম নবী ও প্রথম রসূল হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম হতে শুরু করে সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর্যন্ত যত সম্মানিত নবী-রসূল আলাইহিমুছ ছলাতু ওয়াস সালাম উনারা এই যমীনে তাশরীফ মুবারক নিয়েছেন উনাদের সকলের সম্মানিত শরীয়তেই নামাযের বিধান ছিল।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে- “উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত আছে, ফজরের নামাযের ওয়াক্তে হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার দু‘আ মুবারক মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হলে তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার শুকরিয়া আদায় স্বরূপ দুই রাকায়াত নামায আদায় করেন, এটা হলো ফজরের নামায। যোহরের ওয়াক্তে হযরত ইসমাঈল যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে কুরবানীর জন্য পেশ করার পর তা কবুলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হলে হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি চার রাকআত নামায আদায় করেন, এটা হলো যোহরের নামায। হযরত উযায়ের আলাইহিস সালাম উনাকে একশত বছর পর পুনরায় জাগ্রত করা হলে তিনি চার রাকআত নামায আদায় করেন, এটা হলো আছরের নামায। মাগরিবের নামাযের ওয়াক্তে হযরত দাঊদ খলীফাতুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে সুউচ্চ মর্যাদা মুবারক প্রদানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হলে তিনি চার রাকআত নামায শুরু করেন। অতি ক্রন্দনের ফলে তিনি তিন রাকআত নামায আদায়ের মাধ্যমে নামায সমাপ্ত করেন, এ হলো মাগরিবের নামায। আর ইশার নামায নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিই সর্বপ্রথম আদায় করেন।” (তাহাবী)

অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার উপর ফজরের নামায, হযরত দাঊদ খলীফাতুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার উপর যোহরের নামায, হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম উনার উপর আছরের নামায, হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম উনার উপর মাগরিবের নামায এবং হযরত ইউনুছ আলাইহিস সালাম উনার উপর ইশার নামায ফরয করা হয়েছিল।

সুতরাং নামায এমন একটি ইবাদত, যা পূর্ববর্তী সকল সম্মানিত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম ও উনাদের উম্মত পালন করতেন। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি নামায আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত করার দু‘আ মুবারকখানা উল্লেখ করেছেন এভাবে-

رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلٰوةِ وَمِن ذُرِّيَّتِى ۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ

অর্থ : “হে বারে ইলাহী! আমাকে নামায কায়েমকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমার বংশধরকেও নামাযে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিন! হে আমার মহান রব তায়ালা! আপনি আমার দু‘আ কবুল করুন।” (পবিত্র সূরা ইবরাহীম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪০)

মহান আল্লাহ পাক উনার ঘর পবিত্র খানায়ে কা’বা উনার নিকটে রেখে যাওয়া আহাল-ইয়াল বা পরিবারবর্গের দ্বারা পবিত্র কা’বা শরীফ কেন্দ্রিক জনবসতি গড়ে ওঠার আরজীর মধ্যে হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার নামায কায়েম হওয়ার আরজীও ছিল। হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি দু‘আ মুবারক করেন-

رَّبَّنَا إِنِّى أَسْكَنتُ مِن ذُرِّيَّتِى بِوَادٍ غَيْرِ ذِى زَرْعٍ عِندَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلٰوةَ

অর্থ : “হে বারে ইলাহী! আমি নিজের এক আওলাদ উনার দ্বারা আপনার সম্মানিত ঘর কা’বা শরীফ উনার সন্নিকটে আবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি; হে আমাদের মহান রব তায়ালা! এটা এ উদ্দেশ্যে যে, যাতে তারা নামায কায়েম রাখে।” (পবিত্র সূরা ইবরাহীম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৭)

মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার নামাযের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে-

وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ وَكَانَ عِندَ رَبِّهِ مَرْضِيًّا

অর্থ : “তিনি উনার পরিবারবর্গকে নামায ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিতেন এবং তিনি উনার মহান রব তায়ালা উনার কাছে আদরনীয় ছিলেন।” (পবিত্র সূরা মারইয়াম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৫)

হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার প্রতি ওহী মুবারক নাযিল হয়েছিল যে-

اِنَّنِي أَنَا اللهُ لَا اِلٰهَ اِلَّا اَنَا فَاعْبُدْنِـى وَاَقِمِ الصَّلٰوةَ لِذِكْرِى

অর্থ : “আমিই মহান আল্লাহ পাক আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদত করুন এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম করুন।” (পবিত্র সূরা ত্বহা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪)

দোলনায় থাকা অবস্থায় হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনিও নিজেকে নামায কায়েম করার জন্যে আদেশপ্রাপ্ত বলে আত্মপরিচয়ে উল্লেখ করেছেন- 

وَجَعَلَنِى مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنتُ وَأَوْصَانِى بِالصَّلٰوةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا

অর্থ : “আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমার অস্তিত্বকে বরকতপূর্ণ করেছেন, যতোদিন আমি জীবিত আছি ততোদিন আমাকে নামায কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” (পবিত্র সূরা মারইয়াম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩১)

সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনাকে দূর্বল হিসেবে তুলে ধরার জন্য ইহুদী পন্ডিতরা একবার এক ফন্দি আঁটে। এ ফন্দি অনুযায়ী নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জ্ঞানের দিক থেকে দূর্বল হিসেবে তুলে ধরার জন্য উনাকে ইহুদী পন্ডিতরা কিছু জটিল প্রশ্ন করার উদ্যোগ নেয়। নাঊযুবিল্লাহ! মহান আল্লাহ পাক উনার সর্বশেষ সম্মানিত নবী ও রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এইসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না এবং এর ফলে উনার ও সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার দূর্বলতা মানুষের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হবে বলে ইহুদী পন্ডিতরা ভেবেছিল। নাঊযুবিল্লাহ! কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদে প্রকাশ্য মজলিশে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইহুদী পন্ডিতদের জটিল সব প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন এবং তারা সবাই উত্তর পেয়ে বিস্মিত হল। সবশেষে ইহুদী পন্ডিতদের নেতা অসৎ উদ্দেশ্যে তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি উত্থাপন করলো। ওই পন্ডিতের প্রশ্ন ছিল- বলুন তো দেখি মহান আল্লাহ পাক তিনি কেন দিন ও রাতে ৫ ওয়াক্ত নামায আপনার উপর ফরয করেছেন? কেন এর চেয়ে কম বা বেশী করা হলো না?

নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এর উত্তরে ইরশাদ মুবারক করেন- যোহরের নামাযের ওয়াক্তে মহান আল্লাহ পাক উনার আরশের নিচে অবস্থিত সব কিছু মহান আল্লাহ পাক উনার প্রশংসা করে ও উনার তাসবীহ পাঠে মশগুল হয়। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ পাক তিনি এ সময় অর্থাৎ মধ্যাহ্নের পর আমার ও আমার উম্মতের জন্য নামায ওয়াজিব করেছেন।

নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আছরের নামায ফরয হবার কারণ সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক করেন, আছরের ওয়াক্ত হল সেই সময় যখন হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত গাছের ফল খেয়েছিলেন। ফলে মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাকে যমীনে প্রেরণ করেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সন্তানদেরকে আছরের নামায আদায় করতে বলেছেন এবং আমার উম্মতের জন্যও তা ওয়াজিব করা হয়েছে। এই নামায মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে সবচেয়ে প্রিয় নামাযসমূহের মধ্যে অন্যতম।

এরপর মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মাগরিবের নামায ফরয হওয়ার কারণ সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক করেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি অনেক বছর পর হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার দু‘আ কবুলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন এবং তিনি তখন তিন রাকায়াত নামায আদায় করেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমার উম্মতের জন্যও মাগরিবের নামায ফরয করেছেন, কারণ এ সময় দোয়া কবুল হয়। পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

اَقِمِ الصَّلٰوةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ اِلٰى غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْاٰنَ الْفَجْرِ ۖ

অর্থ : “তোমরা রাত নেমে আসার সময় ও সকালে মহান আল্লাহ পাক উনার প্রশংসা কর।” (পবিত্র সূরা বনী ইসরাঈল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৭৮)

মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইশার নামায ফরয হবার কারণ সম্পর্র্কে ইরশাদ মুবারক করেন, কবরে ও কিয়ামতের দিনের ভয়াবহ অন্ধকারগুলো ইশার নামাযের আলোয় কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, ইশার নামায আদায়ের জন্য অগ্রসর হওয়া এমন কোনো ব্যক্তি নেই যাকে মহান আল্লাহ পাক তিনি দোযখ বা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন না। 

আর ফজরের নামাযের দর্শন হল, সূর্য-পূজারীরা সূর্যদোয়ের সময়ে ইবাদত করতো। তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি কাফিরদের সিজদার আগেই ইবাদতে মশগুল হতে মুমিনদেরকে ফজরের নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।

৫ ওয়াক্ত নামায আদায়ের রহস্য বা দর্শন সম্পর্কে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছ থেকে বক্তব্য শোনার পর ইহুদী পন্ডিতরা লা-জওয়াব হয়ে গেলো। কারণ, তাদের আর বলার কিছুই ছিল না। ফলে তারা অবনত মস্তকে মসজিদ ত্যাগ করে।

ঠিক একইভাবে নাস্তিকদেরও বলার আর সুযোগ থাকলো না যে, পৌত্তলিকদের দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করার রীতি-নীতি থেকে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার নামায এসেছে। বরং নামাযের বিধি-বিধান মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই ছিল।

রোযা পালনের ইতিহাস :

রোযার ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ

অর্থ : “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল যাতে তোমাদের পরহেয্গারী অর্জিত হয়।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৮৩)

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম রোযা পালনকারীর ব্যাপারে বর্ণিত রয়েছে- হযরত উনাযাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমি হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনার নিকট জিজ্ঞাসা করলাম, আইয়্যামে বীজের নামকরণের কারণ কি ছিল? তিনি জবাবে বললেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে যখন জান্নাত হতে দুনিয়াতে পাঠালেন, তখন সূর্যের প্রখর তাপে উনার জিসিম মুবারক উনার শ্বেতবর্ণ কালবর্ণ ধারণ করলো। অতঃপর হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি উনার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম! আপনি কি ইচ্ছা করেন যে, আপনার জিসিম মুবারক উনার এই কালো বর্ণ দূর হয়ে আবার পূর্বানুরূপ শুভ্র হয়ে যাক। হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হ্যাঁ অবশ্যই তা হোক। তখন হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, আপনি প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে ৩টি রোযা রাখবেন। এতে মহান আল্লাহ পাক তিনি আপনার জিসিম মুবারক উনার রং পূর্বানুরূপে পরিবর্তন করে দিবেন। হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনার পরামর্শানুযায়ী মাসের ১৩ তারিখে রোযা রাখলেন। এতে উনার জিসিম মুবারক উনার এক তৃতীয়াংশ শুভ্রবর্ণ ধারণ করলো। তারপর মাসের ১৪ তারিখে রোযা রাখলেন। এতে উনার জিসিম মুবারক উনার দুই তৃতীয়াংশ শুভ্রবর্ণ ধারণ করলো। তারপর তিনি মাসের ১৫ তারিখে রোযা রাখলেন। এতে উনার জিসিম মুবারক উনার রং পূর্বের মতো উজ্জ্বল শুভ্রবর্ণ ধারণ করলো। এই কারণেই উক্ত দিন ৩টিকে আইয়্যামে বীজ বলে এবং ৩দিনের রোযাকে আইয়্যামে বীজের রোযা বলে। (গুনইয়াতুত ত্বলিবীন)

আইয়্যামে বীজ সম্পর্কিত অন্য বর্ণনায় রয়েছে- হযরত খিজির ইবনে হুবাইশ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, একদা আমি বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে আইয়্যামে বীয (অর্থাৎ প্রতিটি আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযা) সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে দুনিয়ার কঠিন যিন্দেগী বেছে নেয়ায় জান্নাত থেকে দুনিয়ায় তাশরীফ মুবারক নেন। সে সময় উনার জিসিম মুবারক উনার রং কালো হয়ে যায়। ফলে উনার এ অবস্থা দেখে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা কেঁদে কেঁদে মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট আরজু জানান যে, হে মহান আল্লাহ পাক! হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি আপনার প্রিয় সৃষ্টি! আপনি উনাকে জান্নাতে স্থান দিয়েছিলেন, আমাদের দ্বারা উনাকে সিজদাও করালেন, আর গন্ধম গাছের ফল খাওয়ার কারণে উনার জিসিম মুবারক উনার রং কালো হয়ে গেলো? উনাদের আরজুর প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার কাছে এ ওহী মুবারক পাঠালেন যে, আপনি আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখুন। হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি তাই করলেন। ফলে উনার জিসিম মুবারক উনার রং আবার উজ্জ্বল হলো। এ জন্যই এ তিনটি দিনকে আইয়্যামে বীয বা উজ্জ্বল দিন বলে। (গুনইয়াতুত ত্বলিবীন)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার যামানায় রোযার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে-

عَنْ حَضْرَتْ عَبْدَ اللهِ بْنَ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ يَقُوْلُ سَـمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ ‏صَامَ نُوْحٌ الدَّهْرَ اِلَّا يَوْمَ الْفِطْرِ وَيَوْمَ الاَضْحَى‏.‏

অর্থ : “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদ্বহার দিন ছাড়া হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম তিনি সারা বছর রোযা রাখতেন।” (ইবনে মাজাহ্ শরীফ)

তাফসীরে ইবনে কাছীরে উল্লেখ আছে, হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার যামানায় প্রতিমাসে তিন দিন রোযা রাখার হুকুম ছিল। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূর্ব পর্যন্ত বহাল ছিল। শুরুতে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা মাসে তিন দিন রোযা রাখতেন। পবিত্র রমাদ্বান মাসের একমাস রোযা পালনের হুকুম সম্বলিত আয়াত শরীফ নাযিল হলে, তা রহিত হয়ে যায়। (তাফসীরে ইবনে কাছীর)

হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার রোযার বিষয়ে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে-

عَنْ حَضْرَتْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا قَدِمَ الْمَدِينَةَ وَجَدَهُمْ يَصُومُونَ يَوْمًا يَعْنِي عَاشُورَاءَ فَقَالُوا هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ وَهْوَ يَوْمٌ نَـجَّى اللهُ فِيهِ مُوسَى وَاَغْرَقَ اٰلَ فِرْعَوْنَ فَصَامَ مُوسَى شُكْرًا لِلّٰهِ‏.‏ فَقَالَ‏ اَنَا اَوْلَى بِـمُوسَى مِنْهُمْ‏‏.‏ فَصَامَهُ وَاَمَرَ بِصِيَامِهِ‏.‏‏

অর্থ : “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হিজরত করে পবিত্র মদীনা শরীফ তাশরীফ মুবারক নেয়ার পর দেখলেন যে, ইয়াহুদীরা পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন রোযা পালন করছে। তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এটি কি ধরনের রোযা? জবাবে তারা বলল, এটি আমাদের জন্য একটি মহান দিন। এদিনে মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার দুশমন ফির’আউনকে তার দলবলসহ পানিতে ডুবিয়ে মেরে বনী ইসরাঈলকে নাযাত দিয়েছেন। তাই এ দিনে শুকরিয়াস্বরূপ হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি রোযা রাখতেন। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, তাদের তুলনায় আমি হলাম হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার অধিক নিকটবর্তী। কাজেই তিনি নিজেও এদিন রোযা পালন করেছেন এবং এদিন রোযা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।” (বুখারী শরীফ)

এ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার যামানায়ও রোযা ছিল এবং সে ধারা বনী ইসরাইল ও ইয়াহুদীদের মধ্যে বজায় ছিল।

হযরত দাঊদ খলীফাতুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার যামানায়ও রোযার প্রচলন ছিল। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ عَبْدَ اللهِ بْنَ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَحَبُّ الصِّيَامِ اِلَى اللهِ صِيَامُ دَاوُدَ كَانَ يَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا وَأَحَبُّ الصَّلَاةِ اِلَى اللهِ صَلَاةُ دَاوُدَ كَانَ يَنَامُ نِصْفَ اللَّيْلِ وَيَقُومُ ثُلُثَهُ وَيَنَامُ سُدُسَهُ

অর্থ : “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ‘আম্র রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাকে বলেছেন, মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট অধিক পছন্দনীয় রোযা হলো হযরত খলীফাতুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার নিয়মে রোযা পালন করা। তিনি একদিন রোযা পালন করতেন আর একদিন বিরত থাকতেন। মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট অধিক পছন্দনীয় নামায হলো হযরত খলীফাতুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার নিয়মে নামায আদায় করা। তিনি রাতের অর্ধাংশ ঘুমাতেন, রাতের এক তৃতীয়াংশ নামাযে দাঁড়াতেন আর বাকী ষষ্ঠাংশ আবার ঘুমাতেন।” (বুখারি শরীফ ও মুসলিম শরীফ)

হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশের সময় কৌতুহলী জনতা উনার সম্মানিতা আম্মাজান আলাইহাস সালাম উনাকে হযরত রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ সম্পর্কে সুওয়াল করতে থাকলে, উত্তরে তিনি বললেন-

اِنِّـى نَذَرْتُ لِلرَّحْـمٰنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ اِنْسِيًّا

অর্থ : “আমি দয়াময় আল্লাহ পাক উনার উদ্দেশ্যে মান্নত করে রোযা রেখেছি। সুতরাং আমি কোন কিছুতেই কোন মানুষের সঙ্গে বাক্যলাপ করবো না।” (পবিত্র সূরা মারইয়াম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৬)

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার থেকে শুরু করে হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পর্যন্ত প্রত্যেক নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা রোযা পালন করেছেন। অতএব উনাদের উম্মতরাও রোযা পালন করেছেন। এমনকি হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার যামানায় প্রতিমাসে তিন দিন রোযা রাখার হুকুম নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূর্ব পর্যন্ত বহাল ছিল। শুরুতে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা মাসে তিন দিন রোযা রাখতেন। পবিত্র রমাদ্বান মাসের একমাস রোযা পালনের হুকুম সম্বলিত আয়াত শরীফ নাযিল হলে, তা রহিত হয়ে যায়। অর্থাৎ রোযা পালনের বিধানে পরিমার্জন ও পরিবর্ধন ঘটে।

সুতরাং পৌত্তলিকদের রোযা রাখার রীতি-নীতি থেকে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার রোযার বিধান আসেনি বরং রোযার বিধি-বিধান মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই ছিল।

তাওয়াফের ইতিহাস :

সপ্ত আসমানের উপরে বায়তুল মামুর নামক একটা মসজিদ আছে যেখানে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা নিয়মিত তাওয়াফ করেন। হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি জান্নাতে অবস্থানকালীন সময় হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের তাওয়াফ করার স্থান পবিত্র বায়তুল মামুর শরীফকে লক্ষ্য করেছিলেন।

পবিত্র মিরাজ শরীফ উনার রাত্রিতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র বায়তুল মামুর শরীফ উনার মধ্যে তাশরীফ নিয়ে উম্মতকে তা’লীম দেয়ার জন্য হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনাকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ মুবারক করেন, হে জিবরীল আলাইহিস সালাম! এটি কি? তিনি বললেন, এটি হচ্ছে ‘পবিত্র বায়তুল মামুর শরীফ’। প্রত্যহ এখানে ৭০ হাজার ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তাওয়াফের জন্য প্রবেশ করেন। উনারা একবার তাওয়াফ সেরে বের হলে কখনও উনাদের আর ফের তাওয়াফের সুযোগ হয় না।” (মুসলিম শরীফ : কিতাবুল ঈমান)

মূলত পবিত্র কা’বা শরীফ হলো পবিত্র বায়তুল মামুর শরীফ উনার ঠিক সোজাসুজি নিচে। পবিত্র কা’বা শরীফ হচ্ছে দুনিয়ায় পবিত্র বায়তুল মামুর শরীফ উনার প্রতিনিধি। হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের মূল ইবাদতের ক্ষেত্র যেমন পবিত্র বায়তুল মামুর শরীফ ঠিক তেমনি যমীনবাসীদের জন্য পবিত্র কা’বা শরীফ। হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা যেমন মহান আল্লাহ পাক উনার সম্মানিত আরশ পাক ও পবিত্র বায়তুল মামুর শরীফ উনাদেরকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করেন ঠিক তেমনি আমরাও পবিত্র কা’বা শরীফ উনাকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করি।

তাওয়াফ করার আমলটা মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকেও শিখিয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

وَعَهِدْنَا اِلٰى اِبْرَاهِيْمَ وَاِسْـمَاعِيْلَ اَنْ طَهِّرَا بَيْتِىَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْعَاكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ

অর্থ : “এবং আমি হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম ও হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাদেরকে আদেশ মুবারক করলাম, আপনারা আমার সম্মানিত ঘর উনাকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারী অর্থাৎ নামায আদায়কারীদের জন্য পবিত্র রাখুন।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১২৫)

অন্য পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَن لَّا تُشْرِكْ بِى شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِىَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ 

অর্থ : “যখন আমি হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে পবিত্র বায়তুল্লাহ শরীফ উনার স্থান ঠিক করে দিয়েছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক করবেন না এবং আমার সম্মানিত ঘর উনাকে পবিত্র রাখুন তাওয়াফকারীদের জন্যে, ক্বিয়ামকারীদের জন্যে এবং রুকু-সিজদাকারীদের জন্যে।” (পবিত্র সূরা হজ্জ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৬)

যদি তাওয়াফ করা পৌত্তলিক রীতি-ই হতো তাহলে তাওয়াফের বিধান পৌত্তলিকদের দ্বারাই উদ্ভাবিত হতো। কিন্তু তা পৌত্তলিকদের দ্বারাই উদ্ভাবিত হয়নি বরং মহান আল্লাহ পাক উনার কর্তৃক মুবারক আদেশক্রমে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তা সম্পাদন করেন। 

তাফসীরে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ سَيِّدِنَا حَضْرَتْ مُحَمَّدِ بْنِ عَلِىِّ بْنِ الْـحُسَيْنِ بْنِ عَلِىِّ بْنِ اَبِىْ طَالِبٍ رِضْوَانُ اللَّهِ تَعَالـٰى عَلَيْهِمْ اَجْـمَعِيْنَ عَنْ اَبِيْهِ عَنِ النَّبِـىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اِنَّ اللهَ تَعَالٰى بَعَثَ مَلَائِكَتَهٗ فَقَالَ ابْنُوْا لِـىْ فِى الْاَرْضِ بَيْتًا عَلٰى مِثَالِ الْبَيْتِ الْمَعْمُوْرِ وَاَمَرَ اللهُ تَعَالٰى مَنْ فِى الْاَرْضِ اَنْ يَّطُوْفُوْا بِهٖ كَمَا يَطُوْفُ اَهْلُ السَّمَاءِ بِالْبَيْتِ الْمَعْمُوْرِ وَهٰذَا كَانَ قَبْلَ خَلْقِ اٰدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ.

অর্থ : “ইমামুল খমিস মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাইয়্যিদুনা হযরত মুহম্মদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবী ত্বালিব আলাইহিমুস সালাম তিনি উনার সম্মানিত পিতা ইমামুর রবি’ মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম উনার সূত্রে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে বর্ণনা করেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে এই কথা মুবারক বলে প্রেরণ করেন যে, আপনারা আমার জন্য দুনিয়ার যমীনে পবিত্র বাইতুল মা’মূর শরীফ উনার অনুরূপ একখানা পবিত্র ঘর মুবারক (পবিত্র কা’বা শরীফ) তৈরী করুন। আর মহান আল্লাহ পাক তিনি আসমানবাসী (হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম) উনারা যেভাবে পবিত্র বাইতুল মা’মূর শরীফ তাওয়াফ করে থাকেন, পৃথিবীবাসী উনাদেরকে সেভাবে পবিত্র কা’বা শরীফ উনাকে তাওয়াফ করার জন্য সম্মানিত আদেশ মুবারক করেন। সুবহানাল্লাহ! আর এটা ছিলো আবুল বাশার সাইয়্যিদুনা হযরত ছফীউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে সৃষ্টি করার পূর্বের ঘটনা।” সুবহানাল্লাহ! (তাফসীরে কবীর শরীফ ৮/২৯৬)

আর তাই যমীনে তাশরীফ মুবারক নেয়ার পর হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি মানবজাতির জন্য তাওয়াফ করেন অর্থাৎ হজ্জ সম্পাদন করেন।

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

حدثنا أبو حازم عن ابن عباس رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم ان اٰدم عليه السلام أتى البيت ألف إتيه لـم يركب قط فيهن من الـهند على رجليه قال فحدثت بذلك مـحمد بن علي فقال صدق الأزرق وابن عباس فقال مـحمد حج من ذلك ثلاثـمائة حجة وسبعمائة عمرة وكان أول حجة حجها اٰدم عليه السلام وهو واقف بعرفة أتاه جبرئيل عليه السلام فقال بر نسكك أما إنا قد طفنا بـهذا البيت قبل أن تـخلق بـخمسمائة ألف سنة

অর্থ : “হযরত ইবনে খুযায়মা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণিত হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হযরত আদম ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি ভারত থেকে পায়ে হেঁটে ১০০০ বার পবিত্র কা’বা শরীফ এসেছেন। কখনও কোন সওয়ারীতে আরোহণ করেননি। রাবী বলেন, হযরত আযরাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারা সত্যই বলেছেন। মুহম্মদ হজ্জ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এই ছফরের মধ্যে ৩০০ বার হজ্জের উদ্দেশ্যে এবং ৭০০ বার উমরার উদ্দেশ্যে। হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি প্রথম যে হজ্জ করেন তখন আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়েছিলেন, এমতাবস্থায় হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি আসলেন। অতঃপর বললেন, আস্ সালামু আলাইকা হে হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম! মহান আল্লাহ পাক তিনি আপনার কুরবানী কবূল করুন। তবে আমরা এ ঘরকে আপনার সৃষ্টির ৫০০০ বছর পূর্ব হতে তাওয়াফ করছি।” (আল আযমাত লি আবূ শাইখুল আছবাহানী)

বস্তুত সমস্ত হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনারা হজ্জ করেছেন। এ ব্যাপারে হযরত ‘উরওয়াহ ইবন জুবায়র রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বর্ণনাটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, সব আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামই হজ্জ পালন করেছিলেন। তবে হযরত হুদ আলাইহিস সালাম ও হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম উনাদের বিষয়টি ভিন্ন। নিজ নিজ উম্মতের কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার মহান দিদারে মিলিত হন। হযরত নূহ আলাইহিস সালাম তিনি হজ্জ করেন; কিন্তু উনার সময়কালের প্লাবনে পবিত্র কা’বা শরীফ আক্রান্ত হয়। হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি পবিত্র কা’বা শরীফ পুণঃনির্মাণের পর পরবর্তী সব নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা পবিত্র কা’বা শরীফ এসে হজ্জ পালন করেছিলেন। (বায়হাকী শরীফ ৫ম খ- পৃষ্ঠা ১৭৭ : হাদীছ শরীফ নং ১০১২২)

হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পরবর্তী সময়ে আগত হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিমুস সালাম তিনি। উনার হজ্জ করার ব্যাপারে বর্ণিত রয়েছে- হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, ‘রাওহা’ দিয়ে ৭০ জন হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনারা রওয়ানা করেছিলেন, উনাদের মধ্যে হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিমুস সালাম তিনিও ছিলেন। আবা পরিহিত, খালী পা বিশিষ্ট এসব হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনাদের গন্তব্য ছিল মহান আল্লাহ পাক উনার ঘর পবিত্র কা’বা শরীফ। (ত্ববারানী শরীফ বরাত আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ২য় খ- ১৮০ পৃষ্ঠা)

অন্য বর্ণনায় বর্ণিত রয়েছে- হযরত আব্দুুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিমুস সালাম তিনি লাল ষাঁড়ের উপর সাওয়ার হয়ে কুতওয়ানি জামা মুবারক পরিহিত অবস্থায় পবিত্র হজ্জ করেছিলেন। (ত্ববারানী শরীফ বরাত আত-তারগীব ওয়াত তারহীব)

হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনার সময়ে মহাপ্লাবনে গায়েব হয়ে যাওয়ার পরবর্তীতে পবিত্র কা’বা শরীফ পুণঃনির্মাণের পর হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার মুবারক আদেশক্রমে এই তাওয়াফের বিধান পুণঃপ্রবর্তন করে দেন।

আর হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

وَقَالُوْا كُوْنُوْا هُوْدًا اَوْ نَصَارٰى تَـهْتَدُوْا ۗ قُلْ بَلْ مِلَّةَ اِبْرَاهِيْمَ حَنِيْفًا ۖ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ.

অর্থ : “তারা বলে, তোমরা ইয়াহুদী অথবা নাছারা (খৃষ্টান) হয়ে যাও, তবেই সুপথ পাবে। আপনি বলুন, কখনই নয়; বরং আমরা হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার দ্বীনের উপর আছি যাতে বক্রতা নেই। তিনি মুশরিকদের (পৌত্তলিকদের) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩৫)

মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন-

مَا كَانَ اِبْرَاهِيْمُ يَهُوْدِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلٰكِنْ كَانَ حَنِيْفًا مُّسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ.

অর্থ : “হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি ইয়াহুদী ছিলেন না এবং নাছারাও (খৃষ্টান) ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন ‘হানীফ’ অর্থাৎ, সব মিথ্যা ধর্মের প্রতি বিমুখ এবং আত্মসমর্পণকারী আর তিনি মুশরিক ছিলেন না।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬৭)

মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

قُلْ صَدَقَ اللهُ ۗ فَاتَّبِعُوْا مِلَّةَ اِبْرَاهِيْمَ حَنِيْفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ.

অর্থ : “বলুন, মহান আল্লাহ পাক তিনি সত্য বলেছেন। এখন সবাই হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার দ্বীনের অনুগত হয়ে যাও, যিনি ছিলেন একনিষ্ঠভাবে সত্য দ্বীনের অনুসারী। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৯৫)

সুতরাং তাওয়াফের বিধান কোন পৌত্তলিক থেকে নেয়া হয়নি বরং হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনারও বহু পূর্ব থেকে তাওয়াফের নিয়ম চালু ছিল। সে সময় শুধুমাত্র হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারাই তাওয়াফ করতেন। পরবর্তীতে যখন হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি যমীনে তাশরীফ মুবারক নেন, তখন থেকে মানবজাতির তাওয়াফের বিধান চালু হয়। পবিত্র কা’বা শরীফ পুণঃনির্মাণের পর হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার মুবারক আদেশক্রমে এই তাওয়াফের বিধান পুণঃপ্রবর্তন করে দেন। সেই বিধান থেকে পরিমার্জনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক তিনি উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের জন্য তাওয়াফের বিধান দিয়েছেন।

ইহরাম

اَلْاِحْرَامُ (ইহরাম) শব্দটি حَرَامٌ (হারাম) শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো কোনো জিনিসকে নিজের উপর হারাম বা নিষিদ্ধ করে নেয়া। আর এ ইহরামই হজ্জ ও উমরার প্রথম ফরয কাজ। পুরুষদের জন্য সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা কাপড় আর নারীদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় শালীন পোশাক পরিধান করাই হলো ইহরাম।

এ কারণেই হজ্জ ও উমরা পালনকারী ব্যক্তি ইহরামের মাধ্যমে নিজের ওপর নির্জনবাস, মাথার চুল, হাতের নখ, গোঁফ, বগল ও নাভির নিচের ক্ষৌর কার্যাদি, সুগন্ধি ব্যবহার, সেলাই করা পোশাক পরিধান এবং শিকার করাসহ কিছু বিষয়কে হারাম করে নেয়।

উল্লেখিত কাজগুলোর পাশাপাশি ‘হজ্জ ও উমরা’ এ দুটির মধ্যে যেটি আদায় করার ইচ্ছা করবে; তার নিয়ত করে চার ভাগে উচ্চ স্বরে তিন বার তালবিয়া পাঠ করাকেই ইহরাম বলে।

অথচ পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মুশরিকরা কোন পোশাক পরিধান করা ছাড়াই বিবস্ত্র অবস্থায় তাওয়াফ করতো। 

নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি অষ্টম হিজরীতে ফতেহ মক্কা বা পবিত্র মক্কা শরীফ বিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ফলে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মুশরিকরা আগের মতই এ শহরে তখনও কুসংস্কার, কুফর ও শিরকে পরিপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানগুলো অব্যাহত রাখে। তারা তখনও পবিত্র কা’বা শরীফ উনার চারদিকে উলঙ্গ অবস্থায় তাওয়াফ করতো। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের জন্য এইসব অনুষ্ঠান ছিল অসহ্য বিষয়। উনারা এ বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশ মুবারক উনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ অবস্থায় পবিত্র সূরা তওবা শরীফ নাযিল হয়।

পবিত্র সূরা তওবা শরীফ নাযিল হওয়ার পরে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একটি ঘোষণা পত্র দিয়ে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম ও হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনাদেরকে পবিত্র মক্কা শরীফ প্রেরণ করেন। ঘোষণা পত্রে পবিত্র হজ্জ উনার বিধি-বিধানের মধ্যে এ কথা ছিল যে, আর কোন মুশরিক হজ্জ করবে না, আর কোন বিবস্ত্র লোক পবিত্র কা’বা শরীফ তাওয়াফ করবে না।

এই বিষয়টি পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে এভাবে যে-

عَنْ حَضْرَتْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ بَعَثَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَضْرَتْ اَبَا بَكْرٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَاَمَرَهُ اَنْ يُنَادِىَ بِـهَؤُلَاءِ الْكَلِمَاتِ ثُـمَّ اَتْبَعَهُ عَلِيًّا فَبَيْنَا حَضْرَتْ اَبُو بَكْرٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ فِىْ بَعْضِ الطَّرِيْقِ اِذْ سَـمِعَ رُغَاءَ نَاقَةِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْقَصْوَاءَ فَخَرَجَ حَضْرَتْ اَبُو بَكْرٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ فَزِعًا فَظَنَّ اَنَّهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاِذَا هُوَ حَضْرَتْ عَلِيٌّ عَلَيْهِ السَّلَامُ فَدَفَعَ اِلَيْهِ كِتَابَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاَمَرَ حَضْرَتْ عَلِيًّا عَلَيْهِ السَّلَامُ اَنْ يُنَادِىَ بِـهَؤُلَاءِ الْكَلِمَاتِ فَانْطَلَقَا فَحَجَّا فَقَامَ حَضْرَتْ عَلِىٌّ عَلَيْهِ السَّلَامُ اَيَّامَ التَّشْرِيْقِ فَنَادَى ذِمَّةُ اللهِ وَرَسُوْلِهِ بَرِيئَةٌ مِنْ كُلِّ مُشْرِكٍ فَسِيْحُوْا فِى الْاَرْضِ اَرْبَعَةَ اَشْهُرٍ وَلَا يَـحُجَّنَّ بَعْدَ الْعَامِ مُشْرِكٌ وَلَا يَطُوْفَنَّ بِالْبَيْتِ عُرْيَانٌ وَلَا يَدْخُلُ الْـجَنَّةَ اِلَّا مُؤْمِنٌ وَكَانَ حَضْرَتْ عَلِىٌّ عَلَيْهِ السَّلَامُ يُنَادِىْ فَاِذَا عَيِىَ قَامَ حَضْرَتْ اَبُو بَكْرٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ فَنَادَى بِـهَا ‏.‏

অর্থ : “হযরত ইবনে ‘আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাকে (আমীরুল হজ্জ নিয়োগ করে) পাঠান এবং এই বাক্যগুলো ঘোষণার জন্যে উনাকে নির্দেশ মুবারক দেন। তারপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনাকে পাঠান। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি পথিমধ্যে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উটনী কাস্ওয়ার শব্দ শুনতে পান। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে বের হলেন। তিনি ভেবেছিলেন হয়ত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এসেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম। হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাকে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার লেখা ফরমান মুবারকটি দিলেন এবং তাতে উনাকে এসব বিষয় ঘোষণা দেয়ার জন্য নির্দেশ মুবারক দেন। উনারা দু’জনেই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং হজ্জ সম্পন্ন করলেন। হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি আইয়্যামে তাশরিক্বে (কুরবানীর দিন) দাঁড়িয়ে বললেন, প্রত্যেক মুশরিকের সাথে মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অর্থাৎ উনাদের সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া হলো। অতএব তোমরা আর চার মাস দেশে চলাফেরা কর। এ বছরের পর আর কোন মুশরিক হজ্জ করতে পারবে না। বিবস্ত্র অবস্থায় কেউ পবিত্র বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করবে না। শুধু মু’মিন ব্যতীত আর কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি এভাবে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি দাঁড়িয়ে একই রকম ঘোষণা দিতে থাকেন।” (তিরমিযী শরীফ : কিতাবু তাফসীরুল কুরআন : হাদীছ শরীফ নং ৩৩৭১)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ইহরাম বাঁধার বিধান মুশরিকদের থেকে নেয়া হয়নি। বরং মুশরিকরা পবিত্র কা’বা শরীফ বিবস্ত্র অবস্থায় তাওয়াফ করতো। সম্মানিত দ্বীন ইসলাম বিবস্ত্র অবস্থায় তাওয়াফের এই অশালীন কর্মকা-কে বন্ধ করে দিয়েছে।

হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের ইতিহাস :

জান্নাতে অবস্থানকালীন সময় মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার প্রতি নির্দেশ মুবারক ছিল,

وَقُلْنَا يَا اٰدَمُ اسْكُنْ اَنْتَ وَزَوْجُكَ الْـجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ

অর্থ : “এবং আমি হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে হুকুম করলাম যে, আপনি ও হযরত উম্মুল বাশার আলাইহাস সালাম জান্নাতে বসবাস করতে থাকুন এবং ওখানে যা চান, যেখান থেকে চান, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাকুন। কিন্তু এ (গন্ধম) গাছের নিকটবর্তী হবেন না।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৫)

হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম ও হযরত উম্মুল বাশার আলাইহাস সালাম উনারা যাতে এ আদেশ যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, আর বিতাড়িত ইবলিশ যাতে উনাদেরকে নিষিদ্ধ গন্ধম গাছের ফল খাওয়াতে না পারে, সেজন্য একজন ফেরেশ্তা আলাইহিস সালাম মোতায়েন করেছিলেন। শয়তান যখন মিথ্যা কসম খেয়ে, মিথ্যা কথার দ্বারা হযরত উম্মুল বাশার আলাইহাস সালাম উনার মাধ্যমে অনুরূপ বিপরীত দিকের অন্য একটি গাছের ফল হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে উনার অজান্তে খাওয়ালো, তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি উক্ত পাহারদার ফেরেশ্তা আলাইহিস সালাম উনাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিতাড়িত ইবলিশ যখন মিথ্যা কসম খেয়ে, মিথ্যা কথার দ্বারা উনাদেরকে নিষিদ্ধ গন্ধম গাছের ফল খাওয়ালো, তখন আপনি কোথায় ছিলেন? ফেরেশ্তা আলাইহিস সালাম তিনি জবাবে বললেন, হে মহান আল্লাহ পাক! আপনার দেয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আসছিলাম কিন্তু এতে কোন প্রকার অঘটনের কিছু না দেখে আপনার সুন্দরতম সৃষ্টি বেহেশত দেখার জন্য অন্যদিকে গিয়েছিলাম, এ সময়ের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটে যায়।

মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যেহেতু হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম ও হযরত উম্মুল বাশার আলাইহাস সালাম উনারা উভয়ে গন্ধম ফল খেয়েছেন, সেহেতু উনাদেরকে যমীনে চলে যেতে হবে। আর সেখানে উনাদের সন্তান জম্মগ্রহণ করবে, তাদের পক্ষে দুনিয়ার গুনাহ্ থেকে বেঁচে থাকা কঠিন হবে। এখন আপনাকে উনাদের সাথে গিয়ে উনাদের সন্তানদের যে গুনাহ্ হবে, তা ক্ষমা করাতে হবে।

তখন ফেরেশ্তা আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, হে মহান আল্লাহ পাক! আপনার আদেশ তো অবশ্যই পালন করবো। কিন্তু প্রত্যেকের বাড়ী বাড়ী গিয়ে কি করে সম্ভব? কারণ আমি একদিক থেকে আদম সন্তানের গুনাহ্ ক্ষমা করাতে করাতে যখন অন্যদিকে যাবো, তখন যেদিক থেকে ক্ষমা করিয়ে আসবো সেদিকে আবার আদম সন্তান নতুন করে জন্মগ্রহণ করবেন। তাদের গুনাহ ক্ষমা করার জন্য পুণরায় তাদের কাছে যেতে হবে। সেটা কি করে সম্ভব, তা আমার কাছে দূরূহ মনে হচ্ছে। আপনি দয়া করে আমাকে কোন এক নির্দিষ্ট স্থানে রাখলে সেখানে আদম সন্তানগণ এসে আমাকে চুম্বন বা স্পর্শ করলেই আমি তাদের গুনাহ চুষে নিবো। তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “বেশ। তাই হবে। আপনাকে কা’বা শরীফ উনার পার্শ্বে স্থাপন করা হবে।” এবং সে অনুযায়ী উক্ত ফেরেশ্তা আলাইহিস সালাম উনাকে পাথরের আকৃতিতে যমীনে প্রেরণ করা হয়। (সমূহ তাফসীরের কিতাব) 

জান্নাত থেকে যমীনে অবতরণের পর হযরত আবুল বাশার ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম ও হযরত উম্মুল বাশার আলাইহাস সালাম উনারা দীর্ঘ সময় পরস্পর পরস্পরকে খুঁজছিলেন। খুঁজতে খুঁজতে উনারা প্রথমে আরাফাত ময়দানে জাবালে রহমতে একত্রিত হয়েছিলেন। হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে উনার ওয়াদা ও মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করছিলেন, এমন সময় মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে ওহী মুবারক নাযিল করে বললেন, হে হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম! আমার আরশ বরাবর একটি হারাম বা সম্মানিত ঘর আছে আপনি সেখানে যান এবং আমার আরশের চারপাশে তওয়াফকারী ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের মতো আপনিও তওয়াফ করুন। আমি সেখানে আপনার ও আপনার সন্তানদের দোয়া কবুল করবো। হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি জবাবে বললেন, হে বারে ইলাহী! আমি তো সে জায়গাটি চিনি না। তারপর মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশে একজন ফেরেশতা আলাইহিস সালাম এসে উনাকে বললেন, হে হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম! আমরা আপনার আগমনের ২ হাজার বছর আগে থেকেই এই সম্মানিত ঘর উনার তওয়াফ ও হজ্জ আদায় করে আসছি। এ কথা বলে ফেরেশতা আলাইহিস সালাম তিনি হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে নিয়ে গন্তব্যের দিকে নিয়ে রওয়ানা হলেন। যাওয়ার সময় উনারা আরাফাত ময়দানে মহান আল্লাহ পাক উনার শুকরিয়া আদায় করেন আর পথিমধ্যে মুজদালিফায় উনারা রাত্রি যাপন করেন। যার কারণে হাজী ছাহেবদের উপর আরাফাত ময়দানে সূর্য হেলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ফরয আর মুজদালিফায় রাত্রি যাপন করা ওয়াজিব। হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে মহান আল্লাহ পাক উনার হুকুম মুতাবিক দিয়ে কা’বা ঘর তওয়াফ করেন।

হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি পৃথিবীতে আসার সময় উনার সাথে বেহেশতে উনার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিযুক্ত উক্ত ফেরশেতা আলাইহিস সালাম উনাকেও মহান আল্লাহ পাক তিনি পাথরের আকৃতিতে যমীনে প্রেরণ করেন। যা হাজরে আসওয়াদ নামে পরিচিত। এটি তখন ধবধবে সাদা ছিলো। মানুষের গুণাহ চোষার কারণে সেটি কালো হয়ে যায় বলে একে হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর বলা হয়।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنِ حَضْرَتْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَزَلَ الْـحَجَرُ الاَسْوَدُ مِنَ الْـجَنَّةِ وَهُوَ اَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ فَسَوَّدَتْهُ خَطَايَا بَنِي اٰدَمَ.

অর্থ : “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে নাযিল হয়েছে এবং সেটা দুধ অপেক্ষা সাদা ছিল, অতঃপর মানুষের গুনাহ্র কারণে সেটা কালো হয়ে গিয়েছে।” (আহমদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ)

হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি সেই ধবধবে সাদা পাথরকে পবিত্র কা’বা শরীফ উনার এক কোণে লাগিয়ে দেন। পবিত্র কা’বা শরীফ উনাকে কেন্দ্র করেই পবিত্র মক্কা নগরী উনার সূচনা। আর পবিত্র মক্কা শরীফ উনাকে কেন্দ্র করেই দুনিয়ার বাকী সকল গ্রাম-গঞ্জ, শহর-নগর আর বন্দর সৃষ্টি করা হয়। হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তো পূর্ব থেকেই তাওয়াফ করতেন, তারপরেও সে সময় থেকে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা, জ্বিন সম্প্রদায় ও হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সন্তান-সন্ততিও পবিত্র কা’বা শরীফে তাওয়াফ ও মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত করতে থাকেন।

মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার যামানায় মহাপ্লাবনের সময় পাথরটিকে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মধ্যে অবস্থিত ‘আবু কুবাইস’ পাহাড়ে সংরক্ষণ করেন এবং ঘোষণা দেন, আমার খলীল হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনাকে যখন আমার সম্মানিত ঘর নির্মাণ করতে দেখবেন, তখন উনার নিকট পাথরটি পৌঁছে দিবেন।

পরবর্তীতে আবুল মুসলিমীন হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার ও উম্মুল মুসলিমীন হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম উনাদের বসবাসের সূত্রেই পবিত্র মক্কা শরীফ উনার উন্নয়ন সূচিত হতে থাকে। 

মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশ মুবারক অনুযায়ী হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম ও হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনারা যখন পবিত্র কা’বা শরীফ পুণঃনির্মানের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি উনার সম্মানিত পিতা হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্মানিত ক্বদম মুবারক উনাদের নিচে একটি পাথর রেখে দিলেন। যার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি নির্মাণ কাজ করতেন। আর হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি পবিত্র কা’বা শরীফ উনার বিভিন্ন কোণে অসমাপ্ত কাজ পূর্ণ করতেন। অবশেষে নির্মাণ কাজ বর্তমান ‘হাজরে আসওয়াদ’ উনার স্থান পর্যন্ত এলে, হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে লক্ষ্য করে বললেন- ‘আমি একটি পাথরের টুকরো চাই যা আমি এই স্থানটিতে রাখবো। লোকেরা দেখে বুঝবে যে, তাওয়াফ এই স্থানটি থেকে শুরু হবে। সম্মানিত পিতা হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার নির্দেশে হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি পাথর খুঁজতে গিয়ে পাথর হাতে ফিরে আসার পূর্বেই হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি ‘হাজরে আসওয়াদ’ নিয়ে উপস্থিত হন।

তারপর হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি ফিরে এসে উনার সম্মানিত পিতা হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে লক্ষ্য করে বললেন, এ পাথর আপনি কোথা থেকে লাভ করলেন? উত্তরে বললেন, পাথরটি আমার নিকট এমন এক ব্যক্তি নিয়ে এসেছেন, তিনি হলেন সম্মানিত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। তারপর হাজরে আসওয়াদকে যখন তার স্বীয় স্থানে প্রতিস্থাপন করা হলো। তখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিনি তার চারপার্শ্ব পাকা করে দিলেন।

তাওয়াফ করার সময় হাজীগণ বরকতের কারণে হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “হযরত আবেস বিন রাবেয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম উনাকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করতে দেখেছি। তিনি বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমি জানি তুমি একখানি পাথরমাত্র, কোন উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা তোমরা নেই। যদি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে তোমায় চুম্বন করতে না দেখতাম, তবে কখনোই আমি তোমায় চুম্বন করতাম না। একথা বলে হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি চুম্বন করতে থাকেন। তখন হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! হাজরে আসওয়াদ উপকার বা অপকার উভয়ই করতে পারে। হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তা কিরূপে? হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি আলমে আরওয়াহ্তে যখন সমস্ত বনী আদমের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, তখন তার একটি পূর্ণ তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সেই পূর্ণ তালিকাটি হাজরে আসওয়াদ গ্রাস করেছিল। ওটা ঈমানদারগণের অঙ্গীকার পূরণ করার পক্ষে এবং কাফেরদের অঙ্গীকার পূরণ না করার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে।” (ইহ্ইয়াউল উলুমুদ্দিন)

আবার অনেকে হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা মূর্তিপুজার সমতূল্য বলে মনে করে থাকে। নাঊযূবিল্লাহ! অথচ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, তোমরা মুশরিকদের অর্থাৎ মূর্তিপুজকদের বিপরীত আমল কর।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো এসেছে,

عَنْ حَضْرَتْ مُـجَاهِدٍ رَحْـمَةُ اللهِ عَـلَيْهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّـمَ بُعِثْتُ لِكَسْرِ الْـمَزَامِيْرِ وَالْاَصْنَامِ

অর্থ : “হযরত মুজাহিদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমি বাদ্য-যন্ত্র ও মূর্তি ধ্বংস করার জন্যে প্রেরিত হয়েছি।” (তাফসীরে রূহুল বয়ান শরীফ)

নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন,“নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক আমাকে প্রেরণ করেছেন সমস্ত জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ এবং হেদায়েতস্বরূপ। আর আদেশ করেছেন বাদ্যযন্ত্র, মূর্তি, ক্রুশ ও জাহিলী কাজসমূহ ধ্বংস করার জন্য।” (আহমদ শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ)

সুতরাং হাজরে আসওয়াদে চুম্বন কোন পৌত্তলিক রীতি নয়, বরং সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার ধারাবাহিক রীতি।

সা‘য়ী করার ইতিহাস :

মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশ মুবারক মুতাবিক হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম ও হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাদেরকে পবিত্র কা’বা শরীফ উনার নিকটবর্তী ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে রেখে যান। সে সময় পবিত্র কা’বা শরীফ উনার তেমন কোন চিহ্ন ছিলো না বললেই চলে। তখন পবিত্র কা’বা শরীফ উনার ভিটিটি যমীন থেকে বেশ উঁচু ছিলো তবে চারপাশ ভেঙ্গে গিয়েছিলো। হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম উনার ও উনার আওলাদ হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাদের খাদ্য ও পানীয় যখন শেষ হয়ে গেলে হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম খাদ্য ও পানির সন্ধানে উক্ত ছাফা ও মারওয়া দু‘পাহাড়ে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার পর যখন নিরাশ হয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে করতে ফিরছিলেন, তখন একটি আওয়াজ শুনতে পান। তিনি বলে উঠলেন, কে আছেন আমি আপনার আওয়াজ তো শুনতে পাচ্ছি। সম্ভব হলে আমাকে সাহায্য করুন। হঠাৎ তিনি উনার শিশু আওলাদ হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার কাছে একজন লোক (ফেরেশতা আলাইহিস সালাম) দেখতে পেলেন। তিনি (ফেরেশতা আলাইহিস সালাম) উনার পায়ের গোড়ালী অথবা ডানা দ্বারা যমীনে আঘাত করলে সেখান থেকে পানি প্রবাহিত হতে লাগলো। হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম তিনি উনার মশক পূর্ণ করে নিলেন আর নিজেও পানি পান করলেন। এতে উনার শিশু আওলাদ হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার জন্যে প্রয়োজনীয় দুধেরও ব্যবস্থা হয়ে গেলো। এ সেই কূপ যা বর্তমানে যমযম নামে বিশ্ব মুসলিমের কাছে পরিচিত।

এ কূপ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

قَالَ حَضْرَتْ اِبْنُ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَرْحَمُ اللهُ اُمَّ اِسْـمَاعِيلَ عَلَيْهَ السَّلَامَ لَوْ تَرَكَتْ زَمْزَمَ ـ أَوْ قَالَ لَوْ لَـمْ تَغْرِفْ مِنَ الْمَاءِ ـ لَكَانَتْ عَيْنًا مَعِينًا، وَأَقْبَلَ جُرْهُمُ فَقَالُوا أَتَأْذَنِينَ أَنْ نَنْزِلَ عِنْدَكِ قَالَتْ نَعَمْ وَلاَ حَقَّ لَكُمْ فِي الْمَاءِ‏.‏ قَالُوا نَعَمْ.

অর্থ : “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম উনার উপর মহান আল্লাহ পাক তিনি রহম করুন। কেননা, যদি তিনি যমযমকে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দিতেন অথবা তিনি বলেছেন, যদি তা হতে অঞ্চলে পানি না নিতেন, তাহলে তা একটি প্রবাহিত ঝর্ণায় পরিণত হতো। হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম উনার নিকট জুরহাম গোত্র এসে বলল, আপনি কি আমাদেরকে আপনার নিকট অবস্থান করার অনুমতি দিবেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে পানির উপর তোমাদের কোন অধিকার থাকবে না। তারা বলল, ঠিক আছে।” (বুখারী শরীফ) 

হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম উনার ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ক্রমাগত ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার কারণে সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহান আল্লাহ পাক তিনি হজ্জ ও ওমরাহ পালনকারীদের জন্যে ছাফা-মারওয়া পাহাড়ে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার বিধান জারি করেছেন।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ ۖ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ اَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ اَنْ يَطَّوَّفَ بِـهِمَا ۚ وَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَاِنَّ اللهَ شَاكِرٌ عَلِيْمٌ.

অর্থ : “নিঃসন্দেহে ছাফা ও মারওয়া মহান আল্লাহ পাক উনার নিদর্শনগুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা পবিত্র কা’বা শরীফ উনার মধ্যে হজ্জ বা ওমরাহ পালন করে, তাদের পক্ষে ছাফা ও মারওয়াতে প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই। বরং কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিছু নেকীর কাজ করে, তবে মহান আল্লাহ পাক তিনি অবশ্যই তা অবগত হবেন এবং তার সে আমলের সঠিক মূল্য দিবেন।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫৮)

সুতরাং সা‘য়ী করার বিধানও পৌত্তলিকদের সাথে সম্পৃক্ত নয়। বরং পৌত্তলিকরা সম্মানিত দ্বীন ইসলাম থেকে সা‘য়ী করার বিধানটি গ্রহণ করেছে।

রমী করা বা কঙ্কর নিক্ষেপের ইতিহাস :

মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে স্বপ্নের মাধ্যমে হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি উনার একমাত্র আওলাদ হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে কুরবানী করার নির্দেশ মুবারক প্রাপ্ত হয়ে উনার আওলাদ হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে স্বপ্নের বিষয়টি অবহিত করেন এভাবে-

قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرٰ‌ى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَـحُكَ فَانظُرْ‌ مَاذَا تَرٰىۚ

অর্থ : “হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, হে আমার সম্মানিত আওলাদ! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি আপনাকে যবেহ করছি, এখন বলুন, আপনার অভিমত কী?” (পবিত্র সূরা আছ-ছফফাত শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১০২)

অতঃপর হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার উত্তর মুবারক ছিল এরূপ-

قَالَ يَا اَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِـىْ اِنْ شَاءَ اللهُ مِنَ الصَّابِرِ‌يْنَ◌

অর্থ : “হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্মানিত পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, মহান আল্লাহ পাক উনার ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন।” (পবিত্র সূরা আছ-ছফফাত শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১০২)

স্বপ্নে আদিষ্ট উক্ত আদেশ মুবারক পালনার্থে সকাল বেলায় যখন হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি উনার একমাত্র আওলাদ হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে নিয়ে মিনা ময়দানের দিকে রওয়ানা দিলেন, তখন মরদুদ শয়তান কুরবানীর এ মহান কাজে বাঁধা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রথমে হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম উনাকে ও হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে উল্টো বুঝিয়ে এ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু উনারা মরদুদ শয়তানের প্ররোচনায় কোন পাত্তা দিলেন না। ফলে মরদুদ শয়তান এখানে নিরাশ হয়ে পিতা ও পুত্র উনাদের পিছু নেয়। অতঃপর এক হিতৈষী বন্ধুর বেশ ধরে উনাদের গতি রোধ করতে চায়। কিন্তু উনারা মরদুদ শয়তানকে এড়িয়ে চলেন। পরে সে অন্য বেশ ধরে পথ রোধ করে দাঁড়ায়। তখন একজন ফেরেশতা আলাইহিস সালাম এসে হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে বলেন, ‘ওকে পাথর ছুঁড়ে মারুন।’ তিনি সাতটি পাথর মারেন এবং প্রতিবার ‘আল্লাহু আকবর’ বলেন। শয়তান পাথরের আঘাতে সরে গিয়ে একটু দূরে পুনরায় পথ বন্ধ করে দাঁড়ায়। এখানেও তিনি তাকবীর বলে আবার সাতটি পাথর মারেন। সে আবারও সরে যায় এবং তৃতীয় বারের মতো পথ আগলে দাঁড়ায়। হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম এখানেও পূর্বের আমল করতঃ নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পৌঁছেন।

অদ্যাবধি এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতি স্বরূপ মিনায় ‘জামরায়ে আকাবাহ’, ‘জামারায়ে উসত্বা’ এবং ‘জামরায়ে উলা’ এই তিনটি স্থানে কংকর নিক্ষেপ করার বিধান হাজীদের জন্য ওয়াজিব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে- “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যখন হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি সম্মানিত হজ্জ পালন করতে আসেন তখন জামরাহ আকাবার কাছে শয়তানে এসে হাজির হয়। তিনি তার প্রতি সাতটি পাথরখ- নিক্ষেপ করায় সে মাটিতে কুপোকাত হয়ে পড়ে। তারপর মেঝো জামরায় হাজির হলে সেখানেও তাকে পাথর মেরে চিতপটাং করে দেন। অনুরূপভাবে ছোটো জামরায় পুনরায় শয়তান আবির্ভূত হলে সেখানেও শয়তানকে পাথর মেরে কাবু করেন এবং ধরাশায়ী করে ফেলেন। হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, শয়তানকে পাথর মেরে মিল্লাতে ইবরাহীমের অনুসরণ করো।” (বায়হাকী শরীফ)

সুতরাং রমী বা কঙ্কর নিক্ষেপ কোন পৌত্তলিক রীতি নয় বরং হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সুন্নত মুবারক। যা পরবর্তীতে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে বলবৎ রয়েছে।

বাঁকা চাঁদের প্রতীক :

বিভিন্ন সময়ে বাঁকা চাঁদকে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার প্রতীক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের দলীল দ্বারা বাঁকা চাঁদ সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার প্রতীক বলে প্রমাণিত নয়।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো নামায, রোযা, তাওয়াফ, হাজরে আসওয়াদে চুম্বনের বিষয়গুলো আবুল বাশার হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্মানিত শরীয়ত দ্বারা প্রমাণিত। আর হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার যামানায় সবাই তাওহীদপন্থি ছিল। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে- 

كَانَ النَّاسُ اُمَّةً وَاحِدَةً

অর্থ : “হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সময়ে ঈমানের সাথে শিরক ও কুফরের মুকাবিলা ছিল না। তখন সবাই তওহীদের অনুসারী একই উম্মতভুক্ত ছিলেন।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২১৩)

সুতরাং যে আমলগুলো হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার শরীয়ত দ্বারাই প্রমাণিত সে আমলগুলো মুশরিকদের কাছ থেকে ধার করে নিয়ে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে সন্নিবেশিত করার কোন অবকাশ নেই।

এছাড়াও হযরত ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পরে হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার পূর্ব পর্যন্ত যেহেতু সবাই একই উম্মতভুক্ত ছিলেন, আর হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার যামানায় কুফর-শিরকের উৎপত্তি লাভ করে। সেহেতুও একথা বলার সুযোগ নেই যে তখনকার মুশরিকদের থেকে ধার করে নিয়ে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে নামায, রোযা, তাওয়াফ ও হাজরে আসওয়াদে চুম্বনের বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে। কেননা সেসময়কার সমস্ত কাফির-মুশরকিদেরকে যমীন থেকে মুছে দেয়া হয়েছিল। আর তাই হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনাকে ‘আবুল বাশার ছানী’ (ابوالبشرالثانى) বা মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা বলে আখ্যায়িত করা হয়।

হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার কাওমের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া বাকিরা যে ঈমান আনবে না সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে-

وَاُوحِىَ اِلٰى نُوْحٍ اَنَّهُ لَن يُؤْمِنَ مِن قَوْمِكَ إِلَّا مَن قَدْ آمَنَ فَلَا تَبْتَئِسْ بِـمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ

অর্থ : “আর হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার প্রতি ওহী প্রেরণ করা হলো যে, যারা ইতিমধ্যেই ঈমান এনেছে তাদের ছাড়া আপনার জাতির অন্য কেউ ঈমান আনবেনা। অতএব তাদের কার্যকলাপে বিমর্ষ হবেন না।” (পবিত্র সূরা হূদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৬)

হযরত আবুল বাশার ছানী আলাইহিস সালাম উনার কাওমের কাফির-মুশরিককে যে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে-

مِّـمَّا خَطِيئَاتِـهِمْ أُغْرِقُوا فَأُدْخِلُوا نَارًا فَلَمْ يَـجِدُوا لَـهُم مِّن دُونِ اللهِ أَنصَارًا

অর্থ : “তাদের গোনাহসমূহের দরুন তাদেরকে নিমজ্জিত করা হয়েছে, অতঃপর দাখিল করা হয়েছে জাহান্নামে। অতঃপর মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত কাউকে তারা সাহায্যকারী পায়নি।” (পবিত্র সূরা নূহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৫)

সুতরাং নামায, রোযা, তাওয়াফ ও হাজরে আসওয়াদে চুম্বনের বিষয়গুলো মুশরিকদের থেকে নয় বরং সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে পূর্ব থেকেই ধারাবাহিকভাবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

আর হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার কর্তৃক পবিত্র কা’বা শরীফ পুণঃনির্মানের পর রমী বা কঙ্কর নিক্ষেপ, সাঈ ইত্যদি বিষয়গুলো নতুনভাবে সন্নিবেশিত করা হয়। যা হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার, হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম ও হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি থেকে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এখানেও মুশরিকদের কোন অংশ নেই।

সুতরাং সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে মুশরিকদের থেকে কোন রীতি-নীতি গ্রহণ করা হয়নি, বরং সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার অনেক রীতি-নীতি মুশরিকরা গ্রহণ করেছে, অতঃপর তাদের নিজেদের নফস বা কুপ্রবৃত্তি মুতাবিক বিকৃত করে বংশপরম্পরায় পালন করে আসছে। যেমন দিনে ৫ বার প্রার্থনা করা, উপবাস ব্রত পালন করা, পবিত্র কা’বা শরীফ বিবস্ত্র হয়ে তাওয়াফ করা ইত্যাদি।

সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনাকে নিয়ে নাস্তিকরা আদ্যপান্ত মিথ্যাচার করতে গিয়ে মূলত এ সমস্ত বিষয়ের অবতারণা করেছে, যার সাথে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার বিন্দুমাত্র কোন যোগসূত্র নেই।


0 Comments: