মদ্যপানের ব্যাপারে বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের দাঁতভাঙ্গা জবাব

 মদ্যপানের ব্যাপারে বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের দাঁতভাঙ্গা জবাব

নাস্তিকদের আপত্তি : মদ খাওয়ার ব্যাপারে কুরান কি বলে? খাওয়া যাবে (Quran 16:67 তবে প্রার্থনা না করা অবস্থায় (Quran 4:43), খুবই খারাপ জিনিস (Quran 5:90যার জন্যে রয়েছে গুনাহ (Quran 2:219)!

খণ্ডণ : সাধারণ মুসলমানদেরকে ইসলাম সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্থ করার জন্যই এই প্রশ্নটির অবতারণা করা হয়েছে।

পবিত্র কুরআন শরীফ উনার প্রত্যেকটি আয়াত শরীফ নাযিলের প্রেক্ষাপট রয়েছে। যখন যে প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে তখন সে প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষিতে পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে। একে শানে নুযূল বলে।

মানুষ সাধারণত প্রবৃত্তির গোলাম। আর তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি মানুষের স্বভাব বুঝে ক্রমধারা অনুযায়ী ধাপে ধাপে মদকে নিষিদ্ধ করেছেন। শিশুকে বুকের দুধ ছাড়াতে মা যেমন ধীরগতির কৌশল অবলম্বন করেন, স্নেহশীল পালনকর্তা মহান আল্লাহ পাক তিনিও তেমনি বান্দাকে মদের কঠিন নেশা ছাড়াতে ধীরগতির কৌশল অবলম্বন করেছেন।

সে সময় আরবরা ছিল দারুণভাবে মদে অভ্যস্ত। মদ্যপান ছিল সে যুগে আভিজাত্যের প্রতীক। আরব-আজম সর্বত্র ছিল এর ব্যাপক প্রচলন। তাই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম প্রথমে মানুষদের মানসিকতা তৈরী করে নিয়েছে। তারপর চূড়ান্তভাবে একে নিষিদ্ধ করেছে। আর যখনই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, তখনই তা বাস্তবায়িত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এজন্য কোন জবরদস্তি প্রয়োজন হয়নি।

মদ নিষিদ্ধের জন্য পরপর তিনটি আয়াত নাযিল হয়। প্রতিটি আয়াত শরীফ নাযিলের মধ্যে নাতিদীর্ঘ বিরতি ছিল এবং মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের অবকাশ ছিল। প্রতিটি আয়াত শরীফ যেহেতু একেকটি ঘটনা উপলক্ষে নাযিল হয়। যাতে মানুষ নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাকে সহজে গ্রহণ করে নেয়। যেমন প্রথম ধাপে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক খিদমতে কিছু হযরত ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা এসে মদের অপকারিতা সম্পর্কে সুওয়াল করেন এবং এ বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের নির্দেশ মুবারক জানতে আরজু পেশ করেন। তখন নাযিল হয়,

يَسْاَلُوْنَكَ عَنِ الْـخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ ۖ قُلْ فِيْهِمَا اِثْـمٌ كَبِيْرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَاِثْـمُهُمَا اَكْبَرُ مِن نَّفْعِهِمَا ۗ 

অর্থ : “ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্যে উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২১৯)

এ পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিলের ফলে বহু ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা মদ-জুয়া ছেড়ে দেয়। কিন্তু কিছু ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা ছেড়ে দিতে পারেননি। অতঃপর ২য় ধাপে একদিন এক ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া শেষে মদ্যপান করে একজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অন্য ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ছলাতে ইমামতি করতে গিয়ে পবিত্র সূরা কাফিরূন উনার মধ্যে نَـحْنُ نَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ পড়েন। যার অর্থ “আমরা ইবাদত করি তোমরা যাদের ইবাদত কর’। যাতে আয়াতের মর্ম একেবারেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। তখন আয়াত নাযিল হয়-

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَقْرَبُوْا الصَّلٰوةَ وَاَنْتُمْ سُكَارٰى حَتّٰى تَعْلَمُوْا مَا تَقُوْلُوْنَ

অর্থ : “হে মুমিনগণ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাযের ধারে-কাছেও যেওনা, যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও যা কিছু তোমরা বলছ।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩)

এ আয়াত শরীফ নাযিলের পর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মধ্যে মদ্যপানের অভ্যস্ততা প্রায় শেষ হয়ে যায়। পরে সর্বশেষে একদিন জনৈক ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বাড়ীতে খানাপিনার পর মদ্যপান শেষে কিছু মেহমান অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ সময় একজন মুহাজির ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি নিজের বংশ গৌরব কাব্যাকারে বলতে গিয়ে হযরত আনছার ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের দোষারোপ করে কবিতা বলেন। এতে একজন আনছার যুবক ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উক্ত মুহাজির ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মাথা লক্ষ্য করে উটের হাড্ডি ছুঁড়ে মারেন। এতে উনার নাক মারাত্মকভাবে আহত হয়। পরে বিষয়টি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট পেশ করা হয়। তখন পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ উনার আলোচ্য আয়াত শরীফদ্বয় নাযিল হয়।

অন্য বর্ণনায় এসেছে- হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত, হযরত আবূ ত্বালহা আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বাড়ীতে খানাপিনা শেষে ‘ফাযীহ’ (الفضيح) নামক তৎকালীন উন্নতমানের মদ্যপান চলছিল। এমন সময় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হযযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পক্ষ থেকে একজন ঘোষক উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা দিয়ে যান-

 اَلاَ اِنَّ الْـخَمْرَ قَدْ حُرّمَتْ “হুঁশিয়ার হও! মদ হারাম করা হয়েছে।”

মদ নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার বর্ণনায় এসেছে, মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট তিনি মদ সম্পর্কে প্রার্থনা করে বলেন, اللّٰهُمَّ بَيّنْ لَنَا فِى الْـخَمْرِ بَيَانًا شَافِيًا ‘হে আল্লাহ! আমদেরকে মদ সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিন’। এর প্রেক্ষিতে পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ২১৯ নং আয়াত শরীফ নাযিল হলে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে ডেকে আয়াত শরীফখানা শুনিয়ে দেন। তখন হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি পুনরায় পূর্বের ন্যায় দো‘আ করেন। এর প্রেক্ষিতে পবিত্র সূরা নিসা শরীফ উনার ৪৩ নং আয়াত শরীফ নাযিল হলে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে পূর্বের ন্যায় হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম উনাকে ডেকে আনেন ও আয়াত শরীফখানা শুনিয়ে দেন। কিন্তু হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি পুনরায় পূর্বের ন্যায় দো‘আ করেন। তখন এর প্রেক্ষিতে পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ উনার ৯০-৯১ নং আয়াত শরীফদ্বয় নাযিল হয়। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম উনাকে ডেকে এনে আয়াত শরীফদ্বয় শুনিয়ে দেন। এবারে হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি খুশী হয়ে বলে ওঠেন, انْتَهَيْنَا ‘এখন আমরা বিরত হলাম’ (অর্থাৎ আর দাবী করব না)।

সুতরাং শানে নুযূলের প্রেক্ষিতে বিষয়টি স্পষ্ট যে, মদ ৩ ধাপে নিষিদ্ধ হয়। আর তাই মদ্যপান করা স্পষ্টরূপে হারাম। ৩ ধাপে মদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে প্রথম আয়াত শরীফদ্বয় উনাদের বিধান মদ্যপানের ক্ষেত্রে বলবৎ নেই বরং পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ উনার ৯০-৯১ নং আয়াত শরীফদ্বয় স্থায়ীভাবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। কিন্তু প্রথম আয়াত শরীফদ্বয় উনাদের হুকুম বলবৎ না থাকলেও পবিত্র কুরআন শরীফ উনার অংশ হিসেবে থেকেই যাবে যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তিলাওয়াত করা হবে।


0 Comments: