“হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায ফাসিদ হওয়ার কারণ (পর্ব-৪)
“হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে
কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায ফাসিদ হওয়ার কারণ এবং তার
প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” পেশ করতে পারায় মহান আল্লাহ পাক-এর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।
হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায
ফাসিদ হওয়ার কারণ এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ সুন্নতের
পথিকৃত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী,
দ্বীন ইসলামের নির্ভীক সৈনিক, সারা জাহান থেকে কুফরী, শিরেকী ও
বিদ্য়াতের মূলোৎপাটনকারী,
বাতিলের আতঙ্ক এবং আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায়
বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক তাজদীদী মুখপত্র- “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায়
এ যাবৎ যত লেখা বা ফতওয়াই প্রকাশ বা পত্রস্থ হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ হবে তার
প্রতিটিরই উদ্দেশ্য বা মাকছূদ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ “মাসিক আল বাইয়্যিনাতে” এমন সব
লেখাই পত্রস্থ হয়, যা মানুষের
আক্বীদা ও আমলসমূহ পরিশুদ্ধ করণে বিশেষ সহায়ক। তদ্রুপ ‘মাসিক আল
বাইয়্যিনাতে’ “হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায
ফাসিদ হওয়ার কারণ এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” দেয়ার
মাকছুদ এবং উদ্দেশ্যও ঠিক তাই। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাকে ‘সূরা
মায়িদার’ ৮২নং আয়াত শরীফে ইরশাদ করেন,
لتجدن اشد الناس عداوة للذين امنوا اليهود والذين اشركوا.
অর্থঃ-“তোমরা তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু
হিসেবে পাবে ইহুদীদেরকে। অতঃপর যারা মুশরিক তাদেরকে।” মূলতঃ এই
ইহুদীরাই মুসলমানের ঈমান-আমল বিনষ্ট করে
দ্বীন ইসলামে ফিৎনা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বাতিল ফিরকার জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ
শিয়া, খারিজী, মু’তাযিলা, জাবারিয়া, ক্বদরিয়া, বাহাই, কাদিয়ানী ও ওহাবী ইত্যাদি বাতিল ফিরকাগুলো ইহুদীদেরই এজেন্ট। বর্তমানে
ইহুদীদের এজেন্ট হিসেবে মুসলমানদের ঈমান আমলের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করছে যারা, তারা
হলো- ‘ওহাবী সম্প্রদায়’। উল্লেখ্য, ইহুদীদের
এজেন্ট, ওহাবী মতাবলম্বী দাজ্জালে কায্যাব তথা উলামায়ে ‘ছূ’রা ‘কুনূতে
নাযেলা’ সম্পর্কেও সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা সম্প্রতি আফগানিস্তান ও ইরাক
যুদ্ধের সময় শত্রুদের প্রতি ‘বদ্ দোয়া’ করার লক্ষে সারাদেশব্যাপী এমনকি বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম
দেশগুলোতেও মুছল্লীদেরকে ‘প্রতি ফজর নামাযে’
‘কুনূতে নাযেলা’ পাঠ করার আহ্বান জানায় এবং তারা
অনেক মসজিদেই ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকা, কিতাবাদী ও বক্তব্যে তারা ‘ফজর নামাযে কুনূতে নাযেলা’ পাঠ করাকে জায়িয বলে প্রচার
করেছে। আর এ ব্যাপারে তাদের মূল দলীল হলো, ‘ফতওয়ায়ে দেওবন্দ।’ অথচ ‘কুনূতে
নাযেলা’ সম্পর্কিত ‘ফতওয়ায়ে দেওবন্দ’-এর বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল, অশুদ্ধ, দলীলবিহীন ও হানাফী মাযহাবের ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের
মতের সম্পূর্ণই খিলাফ। যার প্রমাণ ও খ-ন অত্র ফতওয়াতেই আপনারা যথাসময়ে পেয়ে যাবেন
ইনশাআল্লাহ। তাদের উক্ত ভুল ফতওয়ার কারণে
সাধারণ লোক মনে করবে ‘হানাফী মাযহাব মতে বোধ হয় ‘ফজরে কুনূত পড়া জায়িয।’ অথচ শরীয়ত যেটাকে নাজায়িয ও হারাম
করেছে সেটাকে জায়িয বা হালাল মনে করা কুফরী বা ঈমান বিনষ্ট হওয়ার কারণ। অনুরূপ
তাদের উক্ত ভুল ও অর্ধেক ফতওয়ার কারণে হাজার হাজার মুছল্লী ফজর নামাযে কুনূত পাঠ
করার কারণে একটি ফরয আমল ‘নামায’ অনায়াসে ও অজান্তেই ফাসিদ বা বিনষ্ট করে দিচ্ছে বা দিবে। অথচ নামায হচ্ছে, দ্বীন
ইসলামের ভিত্তি বা খুঁটি। তাই বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, নামায
তরক করা, ইচ্ছা করে নামায ফাসিদ হয় এমন কাজ করা, নামাযে অবহেলা করা, খুশু-খুযূ’র সাথে
নামায আদায় না করা,
হারাম-নাজায়িয থেকে নামাযকে হিফাযত না করা ইত্যাদি
কার্যকলাপ কঠিন গুণাহ্র কাজ ও কুফরীর লক্ষণ। যেমন “মিশকাত শরীফ”-এর
কিতাবুছ্ ছলাহ্, বাবু ফাযায়িলিছ্ ছলাহ (নামাযের ফযীলত) অধ্যায়ের আল ফাছলুল্ আউয়াল-এর ৬নং হাদীছ
শরীফে বর্ণিত আছে,
عن جابر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم بين العبد وبين الكفر ترك الصلوة.
অর্থঃ- “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বান্দার
ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হলো নামায ত্যাগ করা।” (মুসলিম শরীফ) অর্থাৎ অস্বীকৃতির
সাথে নামায ত্যাগ করলে বান্দা কাফির হয়ে যায়। আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
من ترك الصلوة حتى مضى وقتها ثم قضى عذاب فى النار حقبا والحقبة ثمانون سنة والسنة ثلث مائة وستون يوما كل يوم كان مقداره الف سنة.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি নামায তরক করলো, এমনকি
নামাযের ওয়াক্ত শেষ হয়ে গেল, অতঃপর সে ব্যক্তি তার ক্বাযা আদায় করলো, সে
জাহান্নামে এক হোক্বা শাস্তি ভোগ করবে। আর এক হোক্বা হচ্ছে ৮০ বছর এবং এক বছর
হচ্ছে ৩৬০ দিন, প্রতিটি দিন হচ্ছে- হাজার বছরের সমান।” (মাজালিসুল আবরার, আল্
মানাসিক) হাদীছ শরীফের বর্ণনা মোতাবেক
হোক্বার পরিমাণ দুনিয়াবী বছর অনুযায়ী নিম্নরূপ-(৮০ বছর * ৩৬০ দিন = ২৮৮০০ দিন *
১০০০ বছর = ২,৮৮,০০০০০ বছর।) অতএব,
এক হোক্বা = ২,৮৮,০০০০০ বছর। উল্লেখ্য, ক্বাযা
নামায আদায়কারী ব্যক্তির উপর ওয়াক্ত মুতাবিক নামায ফরয হয়েছিল কিন্তু সে যথা সময়ে
ফরয আদায় করেনি। অর্থাৎ ওয়াক্ত ফউত হওয়ার পর সে আদায় করেছে। ফরয নামায যথা সময়
আদায় না করার কারণেই তাকে এক হোক্বা শাস্তি ভোগ করতে হবে। এখন সে যদি খালিছ তওবা
করে, তাহলে আল্লাহ্ পাক ক্ষমা করে দিবেন। অন্যথায় তওবা ব্যতীত নামাযের ক্বাযা আদায়
করলেও শাস্তি থেকে অব্যাহতি বা রেহাই পাওয়া যাবেনা। আর যারা নামাযের ক্বাযাও আদায়
করবেনা আর তওবাও করবে না,
তাদের যে কি শাস্তি হবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ পাকই সবচেয়ে
ভাল জানেন। নামাযের গুরুত্ব বুঝানোর জন্যই হাদীছ শরীফে উল্লেখিত শাস্তির কথা বলা
হয়েছে। নামায ফাসিদ তথা ভঙ্গ বা ফউত হবার
পর কাযা আদায় করলেও যেখানে এক হোক্বা তথা দুই কোটি আটাশি লক্ষ বছর শাস্তি ভোগ করতে
হয় সেখানে কুনূতে নাযেলা পাঠ করার কারণে নামায ভঙ্গ হওয়ার পর কাযা আদায় না করলে কত
কোটি বছর শাস্তি হবে তা বলার অপেক্ষাই রাখেনা। মূলকথা, যারাই
ফজর নামাযে কুনূতে নাযেলা পাঠ করবে তাদের নামায ফাসিদ বা বাতিল হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে বাতিল ফিরক্বার মৌলভীরা ফজর বা অন্যান্য নামাযে কুনূতে নাযেলা পাঠ করা
জায়িয ফতওয়া দিয়ে নিজেদের এবং সরলপ্রাণ মুছল্লীদের নামায ফাসিদ বা ভঙ্গ করে দেয়ার
মাধ্যমে লা’নত বা কঠিন আযাবের উপযোগী হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে ভুল ফতওয়া দিয়ে ইহুদীদের এজেন্ট, ওহাবী মতাবলম্বী, দাজ্জালে
কায্যাব ও উলামায়ে ‘ছূ’রা সাধারণ মুসলমানদের ঈমান-আমলকে বিনষ্ট করে দ্বীন ইসলামকে ধ্বংস করার
ষড়যন্ত্রই সর্বদা করে যাচ্ছে। কাজেই এদের ভুল ফতওয়া থেকে যেন সাধারণ মুসলমানগণ
নিজেদের ঈমান-আমল হিফাযত করতে পারে এবং যারা অজ্ঞতাহেতু ভুল ফতওয়া দিচ্ছে তারাও
যেন সঠিক ও দলীলভিত্তিক ফতওয়া পাওয়ার পর ভুল ফতওয়া ও আমল থেকে তওবা করে হক্বের উপর
ফিরে আসতে পারে, সর্বোপরি মহান আল্লাহ পাক-এর খাছ রেযামন্দী বা সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে, সে
উদ্দেশ্যেই মাসিক আল বাইয়্যিনাতে “হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে
কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায ফাসিদ হওয়ার কারণ এবং তার
প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” প্রকাশ করা হলো। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে উক্ত ফতওয়া
মুতাবিক আমল করে মহান আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম-এর খাছ রেযামন্দী হাছিল করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) হাদীছ শরীফের সংজ্ঞা প্রকারভেদ ও গ্রহণযোগ্যতা
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন, হাবীবুল্লাহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে এক মাস কুনূতে
নাযেলা পাঠ করেছেন তা পরবর্তীতে মানসূখ হয়ে যায়। সুতরাং ‘কুনূতে
নাযেলা’ পাঠ করা সংক্রান্ত যে সকল বর্ণনাসমূহ রয়েছে তা ‘মানসূখ’ হাদীছ
শরীফের অন্তর্ভুক্ত। অথচ বাতিলপন্থি ও
উলামায়ে ‘ছূ’রা সেই ‘মানসূখ’ হয়ে যাওয়া হাদীছ শরীফগুলোকে পুঁজি
করেই ফজর নামাযে ‘কুনূতে নাযেলা’
পাঠ করছে ও পাঠ করাকে জায়িয বলছে। অথচ শরীয়তের বিধান হলো- ‘মানসূখ’ হয়ে
যাওয়া হাদীছ শরীফের উপর আমল করা এবং সে সম্পর্কিত বিষয়কে জায়িয বলা সম্পূর্ণ হারাম
ও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন, শরাব পান করার হুকুম ‘মানসূখ’ হয়ে
গেছে। তাই এখন যদি কেউ ‘মানসূখ’ হয়ে যাওয়া হাদীছ শরীফসমূহকে গ্রহণ করে শরাব পান করে বা শরাব পান করাকে জায়িয
বলে তবে সেটা হবে সম্পূর্ণ হারাম ও কুফরী।
উল্লেখ্য,
হাক্বীক্বত বাতিলপন্থি ও উলামায়ে ‘ছূ’রা
দুনিয়ার মোহে মোহগ্রস্থ হয়ে এতটাই জাহিল বা মূর্খে পরিণত হয়েছে যে, কোন্
হাদীছ শরীফ দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য আর কোন্ হাদীছ শরীফ দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়, কোন্ হাদীছ
শরীফের উপর আমল করা যাবে,
আর কোন হাদীছ শরীফের উপর আমল করা যাবে না এবং কোন হাদীছ
শরীফ কোন্ মাযহাবের দলীল এ সম্পর্কেও তারা নেহায়েতই অজ্ঞ। অথচ যাদের ‘হাদীছ
শরীফ’ সম্পর্কিত পরিপূর্ণ ইল্ম নেই তাদের জন্য ফতওয়া দেয়া সম্পূর্ণই হারাম। কারণ তারা ফতওয়া দিলে তাদের ফতওয়া ভুল হবে।
যেরূপ ভুল হয়েছে ‘কুনূতে নাযেলা’র ক্ষেত্রে। তাদের যদি ‘হাদীছ শরীফ’ তথা হাদীছ শরীফের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ
ও গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি সংক্রান্ত সামান্যতম ইল্মও থাকতো তবে তারা কুনূতে নাযেলা
সম্পর্কে কখনোই ভুল ফতওয়া দিতে পারতো না এবং গোমরাহীতে নিমজ্জিত হতো না। তাই তাদের
জিহালতী ও গোমরাহী দূর করার লক্ষ্যে ‘হাদীছ শরীফ’ তথা
হাদীছ শরীফের সংজ্ঞা,
প্রকারভেদ ও গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত
আলোচনা করা হচ্ছে। এতে ‘কুনূতে নাযেলা’-এর বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। (ইনশাআল্লাহ) হাদীছ শরীফের সংজ্ঞা حديث (হাদীছ) শব্দটি একবচন, বহুবচনে حدثان (হাদ্দিছানুন) বা احاديث (আহাদীছু) বা حداثاء (হুদাছাউ) আসে।
যার লুগাতী বা শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কথা, বাণী, সংবাদ, ব্যাপার, বিষয়, পুরাতন
সংবাদ ইত্যাদি। আর ‘ইছতিলাহী’ বা পারিভাষিক অর্থে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্
নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ্,
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হায়াত
মুবারকে যা বলেছেন,
করেছেন বা অন্যের কোন কথা বা কাজের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন
করেছেন তাকে সুন্নাহ্ শরীফ বা হাদীছ শরীফ বলে। ব্যাপক অর্থে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ও হযরত তাবিয়ীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের কথা, কাজ এবং
সম্মতিকেও হাদীছ শরীফ বলে। কারো কারো মতে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ও হযরত তাবিয়ীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের কথা, কাজ ও
সম্মতিকে ‘আছার’ বলে। যেমন, এ প্রসঙ্গে “উছূলুল আছার”
কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, [২১৮]
الحديث هو اعم من ان يكن قول الرسول صلى الله عليه وسلم والصحابى والتابعى وفعله وتقريره.
অর্থঃ- “হাদীছ শরীফ’ শব্দটি
ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। সাধারণভাবে হযরত রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম-এর কথা, কাজ ও মৌন সম্মতিকে হাদীছ শরীফ বলে। এবং অনুরূপভাবে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ এবং হযরত তবিয়ীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের কথা, কাজ ও
মৌন সম্মতিকেও হাদীছ শরীফ বলে।” মুহাদ্দিছগণের কেউ কেউ বলেছেন যে, [২১৯-২২০]
الحديث هو قول رسول الله صلى الله عليه وسلم فقط.
অর্থঃ- “শুধুমাত্র হযরত রসূলে পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণীকে হাদীছ শরীফ বলে।” (উছূলুল
আছার) উছূল শাস্ত্রবিদগণের মতে হাদীছ শরীফের অপর নাম خبر (খবর) আর তা হযরত নবী পাক ছল্লৗাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা, কাজ ও
মৌন সম্মতিকে বলে। (উছূলুশ শাশী) ‘উছুলুল আসার’ নামক
কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
হাদীছ শরীফের অপর নাম হলো সুন্নত। যেমন বলা হয়েছে, [২২১]
السنة هى تطلق على قول رسول الله صلى الله عليه وسلم وفعله وتقريره واقوال الصحابة وافعالهم.
অর্থঃ- “হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা,
কাজ ও মৌন সম্মতি এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণের কথা,
কাজ (মৌন সম্মতিকেও) ‘সুন্নাহ’ বলে।” উল্লিখিত
আলোচনার দ্বারা বুঝা গেল যে, হযরত রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম এবং হযরত তাবিয়ীন রহমতুল্লাহি
আলাইহিমগণের কথা,
কাজ ও মৌন সম্মতিকে হাদীছ, খবর, সুন্নাহ
ও আছার বলে। হাদীছ শরীফও ওহীর অন্তর্ভুক্ত আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি যে সকল ওহী নাযিল করেছেন তা
দুই প্রকার। প্রথম প্রকার ওহীঃ যেটা যে
শব্দ বা বাক্যের সাথে নাযিল করা হয়েছে তা হুবহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বর্ণনা করেছেন। কুরআন শরীফ এই শ্রেণীর ওহী। এটাকে ওহীয়ে মাতলু বলে। নামাযে
কেবল এটারই তিলাওয়াত করা হয়। দ্বিতীয় প্রকার
ওহীঃ যার শব্দ বা বাক্য অবিকল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা
করেননি। ওহী দ্বারা প্রাপ্ত মূল ভাবটিকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
নিজস্ব ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এটাকে ওহীয়ে গইরে মাতলু বলে। এটা নামাযে পড়া যায়
না। হাদীছ শরীফ শাস্ত্রের কতিপয় পরিভাষা
ছাহাবী (صحابى) যারা ঈমানের সাথে হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহচর্য লাভ করেছেন, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছেন এবং ঈমানের সাথে ইন্তিকাল করেছেন
তাঁদেরকে ‘ছাহাবী’ বলে। তাবিয়ীন (تابعين) যারা কোন
ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট থেকে হাদীছ শরীফ শিক্ষা করেছেন বা
অন্ততপক্ষে তাঁকে দেখেছেন তাঁদেরকে ‘তাবিয়ীন’ বলে।
তাবে’ তাবিয়ীন (تابع تابعين) যারা কোন তাবিয়ীনের নিকট থেকে হাদীছ শরীফ শিক্ষা করেছেন অথবা
তাঁকে দেখেছেন তাঁদেরকে ‘তাবে’ তাবিয়ীন’ বলে। রিওয়ায়েত (روايت) ঃ হাদীছ শরীফ
বা আছার বর্ণনা করাকে ‘রিওয়ায়েত’ বলে এবং যিনি বর্ণনা করেন তাঁকে ‘রাবী’ (راوى) বলে। কোন
কোন সময় হাদীছ শরীফ বা আছারকেও রিওয়ায়েত বলে। যেমন, বলা হয় এ সম্পর্কে একটি রিওয়ায়েত
আছে। সনদ (سند) ঃ হাদীছ শরীফের রাবীর পরস্পর
বর্ণনা সূত্রকে সনদ বলে। কোন হাদীছ শরীফের সনদ বর্ণনা করাকে ইসনাদ (اسناد) বলে। কখনও কখনও ইসনাদ
সনদ অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রিজাল (رجال) ঃ হাদীছের রাবী সমষ্টিকে রিজাল বলে। আর যে শাস্ত্রে রাবীদের
জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে তাকে ‘আসমাউর রিজাল’ (اسماء الرجال) বলে। মতন
(متن) ঃ সনদ বর্ণনা করার পর যে মূল হাদীছটি বর্ণনা করা হয় তাকে ‘মতন’ বলে।
আদালত (عدالة) ঃ যে সুদৃঢ় শক্তি মানুষকে
তাক্বওয়া ও মরুওওয়াত অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাকে আদালত বলে। তাক্বওয়া অর্থে এখানে শিরক প্রভৃতি কবীরা
গুণাহ্ এবং পুনঃ পুনঃ ছগীরা গুণাহ্ করা হতে, হাদীছ শরীফ সম্পর্কে মিথ্যা কথা
বলা থেকে, সাধারণ কাজ-কারবারে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়া থেকে, অপরিচিত
হওয়া থেকে, বে-আমল-ফাসিক,
বদ্ আক্বীদা ও বিদ্য়াতী আমল থেকেও বেঁচে থাকাকে বুঝায়।
মরুওওয়াত অর্থে অশোভন বা অভদ্রোচিত, অশালীন, অশ্লীল, কুরুচীসম্পন্ন
এমনকি অপছন্দনীয় কথা ও কাজ হতে দূরে থাকাকে বুঝায়। যথা হাটেবাজারে প্রকাশ্যে
পানাহার করা বা রাস্তাঘাটে ইস্তিঞ্জা করা ইত্যাদি। এরূপ কার্য করেন এমন ব্যক্তির
হাদীছ ছহীহ নয়। আদল বা আদিল (عدل – عادل) ঃ যে ব্যক্তি আদালত গুণসম্পন্ন, তাকে আদল বা আদিল বলে। অর্থাৎ (১)
যিনি হাদীছ শরীফ সম্পর্কে কখনও মিথ্যা কথা বলেননি, (২) বা সাধারণ কাজ-কারবারে কখনও
মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হননি,
(৩) অজ্ঞাতনামা অপরিচিত অর্থাৎ দোষগুণ বিচারের জন্য যার
জীবনী জানা যায়নি এরূপ লোক নন, (৪) বেআমল ফাসিকও নন, (৫) বদ্ ই’তিকাদ
বিদ্য়াতীও নন, কবীরা গুণাহ্ এবং পুনঃ পুনঃ ছগীরা গুণাহ করা থেকে বেঁচে থাকেন, অশোভন,অশালীন, অশ্লীল, কুরুচী
সম্পন্ন এমনকি অপছন্দনীয় কোন কথা ও কাজও বলেননা বা করেন না তাকে ‘আদল বা
আদেল’ বলে। যব্ত (ضبط) ঃ যে স্মরণ
শক্তি দ্বারা মানুষ শ্রুত বা লিখিত বিষয়কে ভুলে যাওয়া বা বিনাশ হতে রক্ষা করতে
পারে এবং যখন ইচ্ছা তখন এটাকে সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারে তাকে ‘যব্ত’ বলে। যাবিত
(ضابط) ঃ যার ধীশক্তি তথা স্মরণশক্তি খুবই প্রখর তাকে যাবিত বলে। ছেক্বাহ্ (ثقة) ঃ যে ব্যক্তির মধ্যে আদালত ও যব্ত উভয় গুণ পূর্ণভাবে বিদ্যমান
তাকে ‘ছেক্বাহ্’ রাবী বলে। শায়খ (شيخ) ঃ হাদীছ শরীফ
শিক্ষাদাতা রাবীকে তাঁর শাগরিদের তুলনায় তাঁকে শায়খ বলা হয়ে থাকে। মুহাদ্দিছ (محدث) ঃ যে ব্যক্তি হাদীছ শরীফ চর্চা করেন এবং বহুসংখ্যক হাদীছ শরীফের
সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাকে মুহাদ্দিছ বলে। শায়খাইন (شيخين) ঃ হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ইমাম মুসলিম
রহমতুল্লাহি আলাইহিকে এক সঙ্গে ‘শায়খাইন’ বলে। (কিন্তু খুলাফায়ে রাশিদীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণের মধ্যে শায়খাইন বলতে হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং
হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বুঝায়। এভাবে হানাফী ফিক্বাহে শায়খাইন
বলতে হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত আবূ ইউছূফ রহমতুল্লাহি
আলাইহিকে বুঝায়। ছিহাহ্ সিত্তাহ (صحاح ستة) ঃ বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী
শরীফ, নাসাঈ শরীফ ও ইবনু মাজাহ শরীফ- হাদীছ শরীফের এই ছয়খানা কিতাবকে এ সঙ্গে ছিহাহ্
সিত্তাহ বলে। এটাই প্রসিদ্ধ। কিন্তু বিশিষ্ট আলিমগণ ইবনু মাজাহ-এর স্থলে মুয়াত্তা
ইমাম মালিক আবার কেউ কেউ সুনানে দারিমীকেও ছিহাহ্ সিত্তাহ্র মধ্যে শামীল করেন।
ছহীহাইন (صحيحين) ঃ বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফকে
এক সঙ্গে ‘ছহীহাইন’ বলে। সুনানে আরবায়া (سنن اربعة) ঃ ছিহাহ্ সিত্তার অপর চার কিতাব (আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী
শরীফ, নাসাঈ শরীফ ও ইবনে মাজাহ শরীফ) কে এক সঙ্গে ‘সুনানে আরবায়া’ বলে।
মুত্তাফাকুন্ আলাইহি (متفق عليه) ঃ যে হাদীছ শরীফকে একই ছাহাবী হতে হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি
আলাইহি ও হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি উভয়ে গ্রহণ করেছেন তাকে হাদীছে
মুত্তাফাকুন্ আলাইহি বা ঐক্যসম্মত হাদীছ শরীফ বলে। হাদীছ শরীফের কিতাবসমূহের
বর্ণনা মুহাদ্দিসগণ হাদীছ শরীফের কিতাব লিখতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন এবং
বিভিন্ন কিতাবকে বিভিন্নরূপে সাজিয়েছেন। নিচে এর কতিপয় প্রসিদ্ধ বর্ণনা দেয়া হলোঃ
জামে (جامع) ঃ যে কিতাবে হাদীছ শরীফসমূকে বিষয় অনুসারে সাজানো হয়েছে এবং যাতে
আকাইদ, সিয়ার, তাফসীর, ফিতান, আদাব, আহকাম, রিকাক ও মানাকিব- এ আটটি প্রধান অধ্যায় রয়েছে তাকে জামে বলে। যথা- জামেয়ে ছহীহ
হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি, জামেয়ে তিরমিযী, তিরমিযী
শরীফ কিতাবটি আসলে জামে হলেও এটা সুনান নামেই প্রসিদ্ধ। এ জাতীয় কিতাবে ইসলামের
যাবতীয় বিষয়ের হাদীছ শরীফ রয়েছে। সুনান বা মুছান্নাফ (سنن – مصنف) ঃ যে কিতাবে হাদীছ শরীফসমূহকে বিষয় অনুসারে সাজান হয়েছে এবং যাতে
তাহারাত, নামায, রোযা প্রভৃতি আহকামের হাদীছসমূহ সংগ্রহের প্রতিই বিশেষভাবে লক্ষ রাখা হয়েছে, তাকে
সুনান বা মুছান্নাফ বলে। যথা- সুনানে আবূ দাউদ, সুনানে ইবনে মাজাহ, সুনানে
দারিমী, মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, মুছান্নাফে আর্ব্দু রায্যাক প্রভৃতি। মুসনাদ (مسند) ঃ যে কিতাবে হাদীছ শরীফসমূহকে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণের নাম অনুসারে সাজানো হয়েছে এবং এক এক ছাহাবী হতে বর্ণিত
হাদীছসমূহকে এক এক অধ্যায়ে স্থান দেয়া হয়েছে তাকে মুসনাদ বলে। যথা- মুসনাদে ইমাম
আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি, মুসনাদে তায়লাসী, মুসনাদে
আবদ্ ইবনে হুমাইদ প্রভৃতি। মু’জাম (معجم) ঃ যে কিতাবে
হাদীছ শরীফসমূহকে শায়খ অর্থাৎ উস্তাদগণের নাম অনুসারে (তাঁদের মর্যাদা বা
বর্ণনাক্রমে) সাজানো হয়েছে তাকে মু’জাম বলে। যথা মু’জামে
ইবনে কানে,’ মু’জামে তাবারানী (মু’জামে কবীর, মু’জামে ছগীর, মু’জামে আওছাত) প্রভৃতি। শেষোক্ত মু’জাম তিনটি তাবারানী কর্তৃক রচিত।
এতে তিনি হাদীছ শরীফসমূহকে বর্ণনাক্রমে সাজিয়েছেন। এ মু’জাম
নিয়মের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন হযরত ইবনে কানে’ রহমতুল্লাহি আলাইহি। রিসালা (رسالة) ঃ যে ক্ষুদ্র কিতাবে মাত্র এক বিষয়ের হাদীছ শরীফসমূহকে একত্র করা
হয়েছে তাকে রিসালা বা জুয্ বলে। যথা কিতাবুত্ তাওহীদ- লি ইবনে খুযায়মা রহমতুল্লাহি
আলাইহি। এতে শুধু তাওহীদ সম্পর্কিয় হাদীছ শরীফসমূহ একত্র করা হয়েছে। কিতাবুত্
তাফসীর- লি সাঈদ ইবনে জুবায়ের রহমতুল্লাহি আলাইহি। এটাতে কেবল তাফসীর সংক্রান্ত
হাদীছসমূহ জমা করা হয়েছে। হাদীছ শরীফের কিতাব সমূহের স্তর হাদীছ শরীফের
কিতাবসমূহকে মোটামুটিভাবে পাঁচটি স্তর বা তবকায় ভাগ করা যেতে পারে। হযরত শাহ্
ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহিও তাঁর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল
বালিগা’ নামক কিতাবে হাদীছ শরীফের কিতাবসমূহকে পাঁচ স্তরে ভাগ করেছেন। প্রথম
স্তরঃ এ স্তরের কিতাবসমূহে শুধু ছহীহ
হাদীছ শরীফ রয়েছে। এ স্তরের কিতাবমাত্র তিনটি। মুয়াত্তা ইমাম মালিক, বুখারী
শরীফ ও মুসলিম শরীফ। দুনিয়ায় এ কিতাব তিনটির যত অধিক আলোচনা বা যাচাই-বাছাই হয়েছে, অপর কোন
কিতাবের এরূপ হয়নি। আলোচনায় এটাই সাব্যস্ত হয়েছে যে, সাধারণতঃ এ তিনটি কিতাবের সমস্ত
হাদীছ শরীফ নিশ্চিতরূপে ছহীহ। তবে এছাড়াও আরো অনেক কিতাব ছহীহ হিসেবে প্রমাণিত আছে।
কারো কারো মতে, পঞ্চাশটিরও অধিক ছহীহ হাদীছ শরীফের কিতাব রয়েছে। দ্বিতীয় স্তরঃ এ স্তরের
কিতাবসমূহ প্রথম স্তরের খুব কাছাকাছি। এ স্তরের কিতাবে সাধারণত ছহীহ ও হাসান হাদীছ
শরীফই রয়েছে। যঈফ হাদীছ শরীফ এতে খুব কম। নাসায়ী শরীফ, আবূ দাঊদ
শরীফ, তিরমিযী শরীফ এ স্তরের কিতাব। সুনানে দারিমী, সুনানে ইবনে মাজাহ এবং শাহ্ ওয়ালী
উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতে মুসনাদে ইমাম আহমদকে এ স্তরে
শামিল করা যেতে পারে। এ দুই স্তরের কিতাবের উপরই সকল মাযহাবের ফক্বীহগণ নির্ভর করে
থাকেন। তৃতীয় স্তরঃ এ স্তরের কিতাবে ছহীহ, হাসান, যঈফ, শায ও
মুন্কার সকল রকমের হাদীছ শরীফই রয়েছে। মুসনাদে আবুইয়ালা, মুছান্নাফে
আর্ব্দু রায্যাক,
মুছান্নাফে আবু বকর ইবনে আবী শাইবাহ, মুসনাদে
আবদ ইবনে হুমাইদ,
মুসনাদে তায়লাসী এবং বাইহাক্বী, তাহাবী ও
তাবারানীর কিতাবসমূহ এ স্তরেরই অন্তর্ভুক্ত। চতুর্থ স্তরঃ এ স্তরের কিতাবসমূহে সাধারণত যঈফ ও গ্রহণের
অযোগ্য হাদীছ শরীফ রয়েছে। ইবনে হিব্বানের কিতাবুয্ যুয়াফা, ইবনে
আছীরের কামিল এবং খতীব বাগদাদী, আবু নুয়াইম, জাওকানী, ইবনে
আসাকির, ইবনে নাজ্জার ফিরদাউস লিদ্ দায়লামীর কিতাবসমূহ এ স্তরের কিতাব। মুসনাদে
খাওয়ারিযমীও এ স্তরের। তবে এতে ছহীহ ও হাসান হাদীছ শরীফও রয়েছে। পঞ্চম স্তরঃ
উপরোক্ত স্তরে যে সকল কিতাবের স্থান নেই সে সকল কিতাবই এ স্তরের কিতাব। এখানে মনে
রাখা আবশ্যক যে, প্রথম স্তর ব্যতীত কোন স্তরেরই সমস্ত কিতাবের নাম এখানে দেয়া হয়নি বা উল্লেখ
করা হয়নি। উদাহরণ স্বরূপ কেবল কতক কিতাবের নাম দেয়া হয়েছে। হাদীছ শরীফের প্রকারভেদ, সংজ্ঞা ও
উদাহরণ মুহাদ্দিছীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ প্রধানতঃ হাদীছ শরীফ বা সুন্নাহ্
শরীফকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথাঃ (১) مرفوع (মারফূ)। (২) موقوف (মাওকূফ)।
ও (৩) مقطوع (মাকতূ)। মারফু হাদীছ শরীফের
সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ (১) مرفوع (মারফূ)ঃ মারফূ
হাদীছ শরীফ বলা হয় হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা, কাজ, মৌন
সম্মতিকে। অর্থাৎ যে হাদীছ শরীফের সনদ, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকেই ‘মারফু’ হাদীছ
শরীফ বলে। আর এ মারফূ হাদীছকে আবার তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা- (ক) قولى (ক্বওলী),
(খ) فعلى (ফে’লী) (গ) تقريرى (তাক্বরীরী)। মারফু ক্বওলী হাদীছ শরীফের সংজ্ঞা ও উদাহরণ (ক) مرفوع قولى (মারফু’
ক্বওলী) উছূল শাস্ত্রবিদগণের মতে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মূখ মুবারক নিসৃত বাণী মুবারককে
মারফু’ ক্বওলী হাদীছ বলে। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, [২২২]
هو قول رسول الله صلى الله عليه وسلم فقط.
অর্থাৎ- “শুধুমাত্র হযরত রসূলে পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুখ মুবারক নিসৃত বানী মুবারককে মারফু’ ক্বওলী
হাদীছ বলে।” (উছুলুল আছার) যেমন,
উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফ উল্লেখ করা যেতে পারেঃ
[২২৩-২২৪]
قال النبى صلى الله عليه وسلم انما الاعمال بالنيات.
অর্থঃ- “হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই কর্মের ফলাফলসমূহ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (বুখারী, মিশকাত)
বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা যেহেতু আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সরাসরি যবান মুবারক নিসৃত বাণী এবং এর ‘সনদ’ আখিরী
রসূল, হাবীবুল্লাহ,
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে
তাই উক্ত হাদীছ শরীফখানা ‘মারফূ ক্বওলী’
হাদীছ শরীফের অন্তর্ভুক্ত। মারফূ’ ফে’লী হাদীছ
শরীফের সংজ্ঞা ও উদাহরণ (খ) مرفوع فعلى (মারফূ’
ফে’লী)ঃ আখিরী রসূল,
হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম যা আমল করে বাস্তবে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন তাকে ‘মারফূ’ ফে’লী হাদীছ’ বলে।” যেমন, মিছালস্বরূপ
“বুখারী শরীফ”-এর ১ম খ- ১৩৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ করা যেতে পারে, [২২৫]
وعن انس رضى الله تعالى عنه ان النبى صلى الله عليه وسلم قنت شهرا ثم ترك.
অর্থঃ- “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু থেকে বর্ণিত। নিশ্চয়ই হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাস
(ফজর নামাযে) কুনূতে নাযেলা পড়েছিলেন। অতঃপর তা বর্জন করেছেন। অর্থাৎ মানসূখ করে
দিয়েছেন।” মিছালস্বরূপ আরো উল্লেখ করা যেতে
পারে, [২২৬-২২৮]
كان النبى صلى الله عليه وسلم اذا كبر رفع يديه حتى يحاذى بهما قروع اذنيه.
অর্থঃ- “হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম তাকবীরে তাহরীমার সময় দু’হাত কানের লতি পর্যন্ত উঠাতেন।” (মিশকাত, মিরকাত, আইনুল
হিদায়া) বর্ণিত হাদীছ শরীফদ্বয় যেহেতু আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সরাসরি ‘ফে’ল’ বা ‘আমল’ এবং এর ‘সনদ’ আখিরী
রসূল, হাবীবুল্লাহ,
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে
তাই উক্ত হাদীছ শরীফদ্বয় ‘মারফু’ ফে’লী হাদীছ শরীফের অন্তর্ভুক্ত। মারফূ’ তাক্বরীরী হাদীছ শরীফের সংজ্ঞা ও উদাহরণ (গ) مرفوع تقريرى (মারফূ’
তাক্বরীরী)ঃ আখিরী
রসূল, হাবীবুল্লাহ,
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ব্যাপারে কোন
কথা বলেননি এবং নিজে কোন কাজও করেননি বরং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণ তাঁর সামনে কোন কথাবার্তা বলেছেন কিংবা কোন কাজ-কর্ম করেছেন আর
আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাতে নিরবতা পালন কিংবা
সম্মতি প্রদান করেছেন তাকে ‘মারফূ’ তাকরীরী হাদীছ’ বলে। যেমন, উদাহরণস্বরূপ
নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ করা যেতে পারে। [২২৯]
كنا نقول و رسول الله صلى الله عليه وسلم حى افضل هذه الامة بعد نبينا ابوبكر وعمر وعثمان رضى الله تعالى عنهم ويسمع ذلك رسول الله صلى الله عليه وسلم فلاينكره.
অর্থঃ- “হযরত ছাহাবায়ে কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ বলেন, আমরা আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিতিতে একদা পরস্পর বলাবলি করি যে, আখিরী
রসূল, হাবীবুল্লাহ,
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরে এই
উম্মতের মধ্যে যথাক্রমে হযরত আবূ বকর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত
উমরঞ্জরদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ সবচেয়ে উত্তম
(মানুষ)। অথচ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা শুনতেন, কিন্তু
তিনি এর কোন প্রতিবাদ করেননি।” (মীযানুল আখবার) বর্ণিত হাদীছ শরীফখানাই মূলতঃ ‘মা’রফূ
তাকরীরী’ হাদীছ শরীফের মিছাল বা উদাহরণ। অর্থাৎ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সরাসরি মৌন সম্মতিসূচক হাদীছ শরীফখানাই ‘মারফূ
তাকরীরী’ হাদীছ শরীফের অন্তর্ভুক্ত। মাওকুফ হাদীছ শরীফের সংজ্ঞা প্রকারভেদ, উদাহরণ
(২) موقوف (মাওকূফ)ঃ হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের
কথা, কাজ ও মৌন সম্মতিকে ‘মাওকূফ
হাদীছ শরীফ’ বলে। যা হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বরাত না দিয়ে হযরত
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ নিজেরাই বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ যার ‘সনদ’ হযরত
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ পর্যন্ত পৌঁছেছে। যেমন উল্লেখ করা
যেতে পারে, [২৩০]
وعن زيد بن ثابت انه قال لاقراءة مع الامام فى شئ.
অর্থঃ- “হযরত যায়িদ বিন ছাবিত
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, নামাযে ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের কোন ক্বিরায়াত পড়তে হবে
না।” আরো উল্লেখ করা যেতে পারে। “আল হিদায়া মায়াদ দিরায়া” কিতাবের ১ম খ- ১৪৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ
আছে, [২৩১-২৩২]
عن ابن عمر رضى الله عنه انه ذكر القنوت فقال والله انه لبدعة ما قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم غير شهر واحد.
অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন যে, তিনি নিজেই একদিন ফজর নামাযের
কুনূতে নাযেলা সম্পর্কে আলোচনা করার পর বললেন, আল্লাহ পাক-এর কসম! অবশ্যই ফজর
নামাযে কুনূতে নাযেলা পাঠ করা বিদ্য়াত। কেননা, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধুমাত্র একমাস ব্যতীত আর কখনও কুনূতে নাযেলা
পাঠ করেননি। (নূরুল হিদায়া ১ম খ- ১১৭ পৃষ্ঠা) উল্লেখ্য, মারফু
হাদীছ শরীফের ন্যায় মাওকুফ হাদীছ শরীফও তিন প্রকার। (ক) قولى (ক্বাওলী) যা তাঁরা বলেছেন। (খ) فعلى (ফে’লী) যা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আমল করেছেন। (গ) تقريرى (তাক্বরীরী) হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ যে
কাজে বা কথায় সম্মতি প্রদান করেছেন। ‘মাক্বতূ’ হাদীছ
শরীফের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ
ও উদাহরণ (৩) (মাক্বতু)ঃ হযরত তাবিয়ীন
রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের কথা-কাজ ও মৌন সম্মতিকে মাকতু’ হাদীছ
শরীফ বলে। অর্থাৎ যার ‘সনদ’ হযরত তাবিয়ীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকেই ‘মাক্বতু’ হাদীছ
শরীফ বলে। উল্লেখ্য,
‘মারফূ’ ও ‘মাওকুফ’ হাদীছ শরীফের ন্যায় মাক্বতূ হাদীছ শরীফও তিন প্রকারঃ (ক) قولى ক্বওলী) (খ) فعلى ফে’লী (গ) تقريرى (তাকরীরী) (উছূলুল আছার) উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ইরশাদ
হয়েছে, [২৩৩-২৩৪]
عن ابراهيم عن علقمة والاسود ومسروق انهم قالوا كنا نصلى خلف عمر رضى الله تعالى عنه فى الفجر فلم يقنت.
অর্থাৎ- “হযরত ইব্রাহীম রহমতুল্লাহি আলাইহি
থেকে বর্ণিত। তিনি হযরত আলক্বামা, আসওয়াদ ও মাসরুক্ব তাবিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ থেকে
বর্ণনা করেন। তারা বলেন,
আমরা হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পিছনে ফজরের
নামায আদায় করতাম। কিন্তু তিনি ফজরের নামাযে কুনূতে নাযেলা’ পাঠ
করেননি।” (আবূ দাউদ শরীফ,
শরহে মায়ানিল আছার) উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফখানাও
উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, ইরশাদ হয়েছে, [২৩৫]
عن سليمان بن ابى عبد الله قال ادركت المها جرين الاولين يعتمون بعمائم كرابيس ... خضر ...
অর্থঃ- “হযরত সুলাইমান ইবনে আবী
আব্দুল্লাহ (তাবিয়ী) রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি
(ইসলামের) প্রথম দিকের সকল মুহাজিরীন (হিজরতকারী ছাহাবী) রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণকে সবুজ রংয়ের সূতী কাপড়ের পাগড়ী পরিধান করতে দেখেছি।” (মুছান্নাফে
ইবনে আবী শাইবাহ) রিওয়ায়েত বা সনদ অনুসারে হাদীছ শরীফের প্রকারভেদ “উছূলুল
আছার এবং মীযানুল আখবার”
কিতাবে উল্লেখ আছে, [২৩৬-২৩৭]
الحديث باعتبار السند متواتر واحاد.
অর্থঃ- “সনদ অনুসারে হাদীছ শরীফ দু’প্রকার
(১) মুতাওয়াতির (২) আহাদ।”
আর সনদ বলা হয়, [২৩৮]
السند هوالطريق الموصلة الى المتن الذى هوالفاظ الحديث.
অর্থঃ- “মতন তথা হাদীছের মূলভাষ্য পর্যন্ত
পৌঁছার পরস্পর বর্ণনা সূত্রকেই সনদ বলে। (এক কথায়- হাদীছ শরীফের মূল কথার বর্ণনার
ধারাবাহিকতাকেই সনদ বলে।)”
‘মুতাওয়াতির’ হাদীছ শরীফের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ (১) متواتر (মুতাওয়াতির)ঃ ঐ হাদীছ শরীফকে বলে, যার বর্ণনাকারী এত অধিক যে, যাদের
কাউকে মিথ্যা ও সন্দেহ পোষণ করা কখনও সমিচীন নয়। যেমন, “উসূলূশ
শাশী” কিতাবে উল্লেখ আছে,
[২৩৯]
المتواتر ما نقله جماعة عن جماعة لايتصور توافقهم على الكذب لكثرتهم.
অর্থঃ- “মুতাওয়াতির ঐ হাদীছ শরীফকে বলা হয়, যা
রাবীদের একটি জামায়াত অপর একটি জামায়াত থেকে বর্ণনা করেছেন। যাঁদের সংখ্যা অধিক
হওয়ার কারণে মিথ্যার উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চিন্তাও করা যায় না।” হুকুমঃ মুতাওয়াতি
হাদীছ শরীফের হুকুম বা বিধান হল এর উপর আমল করা ওয়াজিব ও ফরযের অন্তর্ভক্ত। আর
এটাকে অস্বীকার করা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। ‘আহাদ’ হাদীছ
শরীফের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ (২) احاد (আহাদ)ঃ মুতাওয়াতিরের বিপরীত হাদীছকে احاد (আহাদ) বলে। আর এটা আবার তিন প্রকারঃ (ক) غريب (গরীব)ঃ যে বিশুদ্ধ হাদীছ শরীফের বর্ণনাকারী সর্বদা একজন থাকে
তাকেই গরীব হাদীছ বলে। [২৪০] যেমন- النهى عن بيع الولاء অর্থঃ- “বাইউলওয়ালা’ তথা আযাদকৃত দাস-দাসীর ওয়ারিছসত্ত্ব ক্রয়-বিক্রয় নিষেধ।” (মিযানুল
আখবার) এ হাদীছটি শুধুমাত্র হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন দীনার রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত
ইবনে ওমর রদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণনা করেছেন। (খ) عزيز (আযীয)ঃ যেই সমস্ত হাদীছ শরীফের বর্ণনা কারী সর্বযুগে কমপক্ষে দু’জন থাকে
তাকে হাদীছে عزيز (আযীয) বলে। যেমন, [২৪১]
لايؤمن احدكم حتى اكون احب اليه من ولده وولده والناس اجمعين.
অর্থঃ- “তোমাদের মধ্যে কেউই কামিল মুমিন
হতে পারবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত; যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার সন্তান-সন্তুতি এবং পিতা-মাতা এমনকি
সকল মানুষের চেয়ে আমাকে বেশী মুহব্বত না করবে।” এ হাদীছটি শুধু আবূ হুরায়রা ও
হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। (গ) مشهور (মাশহুর)ঃ ঐ সমস্ত হাদীছ শরীফকে বলে যা সর্বযুগে সর্বস্তরে
কমপক্ষে দু’য়ের অধিক কিংবা তার চেয়ে আরো অধিক বর্ণনাকারী রয়েছে, তবে متواتر মুতাওয়াতিরের স্তরে পৌছেনা, বরং তার চেয়ে বর্ণনাকারী কম হয়।
যথাঃ [২৪২]
ان الله لايقبض العلم انتزاعا.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক হঠাৎ করে
ইল্মকে একেবারেই উঠিয়ে নিবেন না।” এ হাদীছ শরীফের রাবী সর্বযুগে সর্বকালে দু’য়ের অধিক
রয়েছে। হুকুমঃ مشهور এর বিধান
মুতাওয়াতির হাদীছ শরীফের মত, তবে এটা অস্বীকার করা কুফরী নয়। শরয়ী বিধান প্রতিষ্ঠায় দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য আহাদ হাদীছ শরীফ সমূহের
প্রকার ভেদ “উছূলুল্ আছার”
কিতাবে উল্লেখ আছে, [২৪৩]
ومقبول الاحاد والمحتج به فى الاحكام على اربعة اجزاء الصحيح لذاته والحسن لذاته والصحيح لغيره والحسن لغيره.
অর্থঃ- “শরীয়তের বিধান প্রতিষ্ঠায় গ্রহণীয়
ও প্রমাণযোগ্য আহাদ হাদীছ শরীফ সমূহ চার প্রকার যথাঃ (ক) ছহীহ লিযাতিহী (খ) হাসান
লিযাতিহী (গ) ছহীহ লিগাইরিহী (ঘ) হাসান
লিগাইরিহী।” (ক) ছহীহ্ লিযাতিহীঃ এটা খবরে ওয়াহিদের এমন এক প্রকার হাদীছ শরীফ যার রাবী বা
হাদীছ শরীফ বর্ণনা কারী ধারাবাহিকভাবে হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। যার রাবী পুর্ণ যবত, বা প্রখর স্মরণশক্তি সম্পন্ন এবং
ন্যায় পরায়ন। (মুয়াল্লাল) معلل তথা কোন গোপন
দোষত্রুটি থেকে মুক্ত। এবং (শায) شاذ তথা অন্য রাবীর বিশুদ্ধ বর্ণনার বিপরীত বর্ণনা থেকে মুক্ত। যেমন, [২৪৪-২৪৫]
حدثنا الحميدى قال حدثنا .... انما الاعمال بالنيات الخ.
অর্থঃ- “হযরত হুমাইদী রহমতুল্লাহি আলাইহি
বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই
কর্মের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (বুখারী, মিশকাত )
(খ) হাসান লিযাতিহীঃ যদি বর্ণনাকারীর
শুধুমাত্র যবত তথা স্বরণশক্তি কম থাকে, তাহলে তাকে হাসান লিযাতিহী বলে।
যথা- [২৪৬]
عن سفيان عن عبد الله ابن عقيل عن محمد بن الحنفية عن على عن النبى صلى الله قال مفتاح الصلوة الطهور الخ.
অর্থঃ- “হযরত ছূফিয়ান রহমতুল্লাহি আলাইহি
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে, তিনি
হযরত মুহম্মদ ইবনে হানাফিয়্যা রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে তিনি হযরত আলী
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন। হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘নামাযের চাবি হচ্ছে পবিত্রতা।’ (তিরমিযী
শরীফ) এ হাদীছ শরীফ-এর রাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি তার
সবগুণাবলী ছিল তবে স্মরণ শক্তি কিছুটা কম ছিল।
(গ) ছহীহ লিগাইরিহীঃ এটা হাসান
লিযাতিহী হাদীছ শরীফের অনুরূপ। ছহীহ হাদীছ শরীফ-এর কোন রাবীর মধ্যে স্বরণ শক্তি
কিছুটা কম থাকে। তবে সেই অভাব বা ত্রুটিটুকু অন্যান্য উপায়ে এবং অধিক রিওয়ায়েত
দ্বারা পুরণ হয়ে যায়। মোট কথা, উহার সমর্থণে বহু রিওয়ায়েত বর্ণিত থাকায় তাহার ত্রুটির
ক্ষতিপুরণ হয়ে গেছে। এরূপ হাদীছ শরীফকে ছহীহ লিগাইরিহী। (ঘ) হাসান লিগাইরিহীঃ এটা ঐ যঈফ হাদীছ শরীফকে বলে যে হাদীছ শরীফ
বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হওয়াতে বর্জনের স্তর অতিক্রম করে দলীল হিসাবে গ্রহণের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। মূলতঃ কোন হাদীছ শরীফকে যঈফ বলা যাবে না। কোন হাদীছ
শরীফ-ই যঈফ নহে। বরং রাবীর গুনাগুণের কারণেই এভাবে নামকরণ করা হয়েছে। যঈফ বলতে
যঈফুস্ সনদকেই বুঝায়। এছাড়াও আরো অনেক
প্রকারের হাদীছ শরীফ রয়েছে। যেমন, মুত্তাছিল
(متصل) ঃ যে হাদীছ শরীফের সনদের মধ্যে কোন স্তরের কোন রাবী বাদ পড়েননি।
অর্থাৎ সকল স্তরের সকল রাবীর নামই যথাস্থানে উল্লেখ রয়েছে। তাকে হাদীছে মুত্তাসিল
বলে। আর এ বাদ না পড়াকে বলা হয় ইত্তিসাল। মুনকাতে (مقطع) ঃ যে হাদীছ শরীফের সনদের মধ্যে কোন স্তরের কোন রাবীর নাম বাদ
পড়েছে তাকে হাদীছে মুনকাতে বলে। আর এ বাদ পড়াকে বলা হয় ইনকিতা। এ হাদীছ শরীফ
প্রধানত দুই প্রকার মুরসাল ও মুয়াল্লাক। মুরসাল (مرسل) ঃ যে হাদীছ শরীফে সনদের ইনকেতা শেষের দিকে হয়েছে অর্থাৎ ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের নামই বাদ পড়েছে এবং স্বয়ং তাবিয়ী হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম করে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন তাকে হাদীছে
মুরসাল বলে। (ইমামগণের মধ্যে কেবল হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত
ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহিই এটাকে নিঃসঙ্কোচে গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মতে তাবিয়ী
শুধু তখনই ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের নাম বাদ দিয়ে সরাসরি
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন। যখন
এটা তাঁর নিকট নিঃসন্দেহে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ
বলে সাব্যস্ত হয়েছে। মুয়াল্লাক্ব (معلق) ঃ যে হাদীছ শরীফের সনদের ইনকিতা প্রথম দিকে হয়েছে অর্থাৎ
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের পর এক বা একাধিক নাম বাদ পড়েছে
তাকে ‘মুয়াল্লাক’ বলে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কোন কোন গ্রন্থকার কোন কোন হাদীছ শরীফের পূর্ণ সনদকে
বাদ দিয়ে কেবল মূল হাদীছ শরীফটিকেই বর্ণনা করেছেন। এরূপ করাকে তা’লীক বলে।
কখনও কখনও তা’লীক রূপে বর্ণিত হাদীছ শরীফকেও তা’লীক বলে। হযরত ইমাম বুখারী
রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কিতাবে এরূপ বহু তা’লীক রয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে
দেখা গেছে যে, হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সমস্ত তা’লীকেরই
মুত্তাসিল সনদ রয়েছে। অপর সংকলনকারীগণ এই সমস্ত তা’লীক মুত্তাসিল সনদ সহকারে বর্ণনা
করেছেন। মুদাল্লাস (مدلس) ঃ যে হাদীছ
শরীফের রাবী নিজের প্রকৃত শায়খের (উস্তাদের) নাম না করে তাঁর উপরস্থ শায়খের নামে
এভাবে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন যাতে মনে হয় যে, তিনি নিজেই এটা উপরস্থ শায়খের
নিকট শুনেছেন অথচ তিনি নিজে এটা শুনেননি, (বরং তাঁর প্রকৃত উস্তাদই এটা তাঁর
নিকট শুনেছেন) সে হাদীছ শরীফকে হাদীছে মুদাল্লাস বলে এরূপ করাকে তাদলীস বলে। আর
যিনি এরূপ করেছেন তাঁকে মুদাল্লিস বলে। মুদাল্লিসের হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়। যে
পর্যন্ত না তিনি একমাত্র ছিকাহ রাবী হতেই তাদ্লীস করেন বলে সাব্যস্ত হয় অথবা তিনি
এটা আপন শায়খের নিকট শুনেছেন বলে পরিস্কারভাবে বলে দেন। মুদ্ব্তারাব (مضطرب) ঃ যে হাদীছ শরীফের মতন বা সনদকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকারে
গোলমাল করে বর্ণনা করেছেন। সে হাদীছ শরীফকে হাদীছে মুদ্বতারাব বলে। যে পর্যন্ত না
এটার কোনরূপ সমন্বয়সাধন সম্ভবপর হয় সে পর্যন্ত এটা সম্পর্কে তাওয়াক্কুফ (অপেক্ষা)
করতে হবে। (অর্থাৎ এটাকে দলীল তথা প্রমাণে ব্যবহার করা চলবে না।) মুদ্রাজ (مدرج) ঃ যে হাদীছ শরীফের মধ্যে রাবী তাঁর নিজের অথবা অপর কারো উক্তি
ভ্রুক্ষেপ করেছেন সে হাদীছ শরীফকে হাদীছে মুদ্রাজ বলে এবং এরূপ করাকে ইদ্রাজ বলে।
ইদ্রাজ হারাম- যদি না এটা কোন শব্দ বা বাক্যের অর্থ প্রকাশার্থে হয় এবং মুদ্রাজ
বলে সহজে বুঝা যায়। মুসনাদ (مسند) ঃ যে মারফূ’ হাদীছ
শরীফের কারো মতে যে কোন রকম হাদীছ শরীফের সনদ সম্পূর্ণ মুত্তাসিল সে হাদীছ শরীফকে
হাদীছে মুসনাদ বলে। মাহ্ফুয ও শায (محفوظ و شاذ) ঃ কোন ছিক্বাহ রাবীর হাদীছ শরীফ অপর কোন ছিক্বাহ রাবী বা
রাবীগণের হাদীছ শরীফের বিরোধি হলে যে হাদীছ শরীফের রাবীর যব্ত গুণ অধিক বা অপর কোন
সূত্র দ্বারা যার হাদীছ শরীফের সমর্থন পাওয়া অথবা যার হাদীছ শরীফের শ্রেষ্ঠত্ব অপর
কোন কারণে প্রতিপাদিত হয় তাঁর হাদীছ শরীফটিকে হাদীছে মাহফুয এবং অপর রাবীর
হাদীছটিকে হাদীছে শায বলে এবং এরূপ হওয়াকে শুযূয বলে। হাদীছ শরীফের পক্ষে শুযূয
একটি মারাত্মক দোষ। শায হাদীছ শরীফ
ছহীহ্রূপে গণ্য নয়। মা’রূফ ও মুনকার (معروف ومنكر) ঃ কোন জঈফ রাবীর হাদীছ শরীফ অপর কোন যঈফ রাবীর হাদীছ শরীফের
বিরোধি হলে অপেক্ষাকৃত কম জঈফ রাবীর হাদীছ শরীফকে হাদীছে মা’রূফ এবং
অপর রাবীর হাদীছ শরীফটিকে হাদীছে মুনকার বলে এবং এরূপ হওয়াকে নাকারাৎ বলে। নাকারাৎ
হাদীছ শরীফের পক্ষে একটা বড় দোষ। মুয়াল্লাল (معلل) ঃ যে হাদীছ শরীফের সনদে এমন কোন সূক্ষ্ম ত্রুটি রয়েছে যাকে কোন
বড় হাদীছ শরীফ বিশেষজ্ঞ ব্যতীত ধরতে পারেন না, সে হাদীছ শরীফকে হাদীছে মুয়াল্লাল
বলে। আর এরূপ ত্রুটিকে ইল্লত বলে। ইল্লত হাদীছের পক্ষে একটা মারাত্মক দোষ।
মুয়াল্লাল হাদীছ ছহীহ্ হতে পারে না। মুতাবি’ ও শাহিদ (مطابع و شاهد) ঃ এক রাবীর হাদীছ শরীফের অনুরূপ যদি অপর রাবীর কোন হাদীছ শরীফ
পাওয়া যায় তাহলে এই দ্বিতীয় রাবীর হাদীছটিকে প্রথম রাবীর হাদীছ শরীফটির মুতাবি বলে, যদি উভয়
হাদীছের মূল রাবী (অর্থাৎ ছাহাবী) একই ব্যক্তি হন। আর এরূপ হওয়াকে মুতাবায়াত বলে।
যদি মূল রাবী একই ব্যক্তি না হন, তবে দ্বিতীয় ব্যক্তির হাদীছ শরীফকে প্রথম ব্যক্তির হাদীছ
শরীফের শাহেদ বলে। আর এরূপ হওয়াকে শাহাদত বলে। মুতাবায়াত ও শাহাদত দ্বারা প্রথম
হাদীছ শরীফটির শক্তি বৃদ্ধি পায়। ছহীহ্ (صحيح) ঃ যে মুত্তাসিল হাদীছ শরীফের সনদের প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ আদালত ও
যব্ত গুণসম্পন্ন এবং হাদীছ শরীফটি শুযুয ও ইল্লত হতে দোষমুক্ত সে হাদীছ শরীফকে
হাদীছে ছহীহ্ বলে। (অর্থাৎ যে হাদীছ শরীফটি মুনকাতে নয় মু’দাল নয়, মুয়াল্লাক
নয়, মুদাল্লাস নয়,
কারো কারো মতে মুরসাল’ও নয়, মুবহাম
অথবা প্রসিদ্ধ যঈফ রাবীর হাদীছ শরীফ নয়, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার দরূণ অনেক
ভুল করেন এমন মুগাফ্ফার বারীর হাদীছ শরীফ নয় এবং হাদীছ শরীফটি শায্ ও মুয়াল্লাল’ও নয়-
একমাত্র সে হাদীছ শরীফকেই হাদীছে ছহীহ্ বলে। হাসান (حسن) ঃ যে হাদীছ শরীফের রাবীর যব্ত গুণে পরিপূর্ণতার অভাব রয়েছে সে
হাদীছ শরীফকে হাদীছে হাসান বলে। (ফক্বীহগণ সাধারণত এই দুই প্রকার হাদীছ হতেই আইন
প্রণয়ণে সাহায্য গ্রহণ করেন।) দ্বঈফ (ضعيف) ঃ যে হাদীছ শরীফের দ্বারা কোন রাবী হাসান হাদীছ শরীফের রাবীর
গুণসম্পন্ন নয় সে হাদীছ শরীফকে হাদীছে দ্বঈফ বলে। (রাবীর দ্বু’ফ বা
দুর্বলতার কারণেই হাদীছ শরীফটিকে দ্বঈফ বলা হয়, অন্যথায় (নাউযুবিল্লাহ) হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন কথাই দ্বঈফ নয়। দ্বঈফ হাদীছের দ্বু’ফ কম ও
বেশী হতে পারে। খুব কম হলে এটা হাসানের নিকটবর্তী থাকে। আর বেশী হতে হতে এটা
একাবারে মাওযূ’তেও পরিণত হতে পারে। প্রথম পর্যায়ের দ্বঈফ হাদীছ শরীফ আমলের ফযীলত বা আইনের
উপকারিতার বর্ণনায় ব্যবহার করা যেতে পারে, আইন প্রণয়নে নয়।) মাওদুউ’ (موضوع) ঃ যে
হাদীছ শরীফের রাবী জীবনে কখনও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে
ইচ্ছা করে কোন মিথ্যা কথা রচনা করেছে বলে সাব্যস্ত হয়েছে- তার হাদীছ শরীফকে হাদীছে
মাওদুউ বলে। এরূপ ব্যক্তির কোন হাদীছ শরীফই কখনও গ্রহণযোগ্য নহে- যদিও তিনি অতঃপর
খালিছ তওবা করেন। মাত্রূক (متروك) ঃ যে হাদীছ
শরীফের রাবী হাদীছের ব্যাপারে নয়। বরং সাধারণ কাজ-কারবারে মিথ্যা কথা বলে বলে
খ্যাত হয়েছেন- তার হাদীছ শরীফকে হাদীছে মাত্রূক বলে। এরূপ ব্যক্তিরও সমস্ত হাদীছ
পরিত্যাজ্য। অবশ্য তিনি যদি পরে খালিছ তওবা করেন এবং মিথ্যা পরিত্যাগ ও সত্য
অবলম্বনের লক্ষণ তাঁর কাজ-কারবারে প্রকাশ পায়, তা হলে তার পরবর্তীকালের হাদীছ
গ্রহণ করা যাইতে পারে। মুবহাম (مبهم) ঃ যে হাদীছ
শরীফের রাবীর উত্তমরূপে পরিচয় পাওয়া যায়নি- যাতে তাঁর দোষ-গুণ বিচার করা যাইতে
পারে, তাঁর হাদীছ শরীফকে হাদীছে মুবহাম বলে। এরূপ ব্যক্তি ছাহাবী না হলে তাঁর হাদীছ
গ্রহণ করা যায় না। মুহ্কাম (محكم) ঃ কোন হাদীছ
শরীফ বিপরীতার্থক অপর কোন হাদীছ শরীফ থেকে নিরাপদ হলে উহাকে মুহকাম হাদীছ বলে।
এরূপ বিপরীত অর্থ বোধক অবস্থায় উভয়ের
মধ্যে সমন্বয় সাধন সম্ভব না হলে এটাকে مختلف الحديث মুখতালিফুল হাদীছ শরীফ
বলে। নাসেখ-মানসূখ (ناسخ - منسوخ) ঃ পরস্পর বিপরীত মুখী দু’টি হাদীছ শরীফকে কোন ভাবেই যখন
সমন্বয় সাধন সম্ভব না হয় এবং একটিকে পূর্বেরও অপরটিকে পরের বলে জানা যায় তখন
পরেরটিকে নাসেখ বলে। আর পূর্বের বর্ণনাকে মানসূখ বলে। আর নাসেখ ও মানসূখ এর হুকুম
বা বিধান হলো নাসেখ-এর উপর আমল করা আবশ্যক। তথা ফরজ-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত। আর
মানসূখ হাদীছ যার উপর আমল করা বৈধ নয়। এ প্রসঙ্গে “ বুখারী শরীফে” উল্লেখ
আছে, [২৪৭]
وعن انس رضى الله تعالى عنه قال قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم شهرا يدعو على رعل وذكوان.
অর্থঃ- “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু বর্ণনা করেন যে,
হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রিল ও
যাকওয়ান গোত্রদ্বয়ের প্রতি বদ্ দোয়ায় একমাস ফজরের নামাযে কুনূতে নাযেলা পাঠ
করেছেন।” এ হাদীছ শরীফ খানা নিম্নে বর্ণিত হাদীছ শরীফ দ্বারা মানসূখ হয়ে যায়। । যেমন, “মিরকাত
শরীফ”-এর ৩য় খ-ের ১৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, [২৪৮]
عن انس رضى الله تعالى عنه قال ان النبى صلى الله عليه وسلم قنت شهرا ثم ترك.
অর্থঃ- “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই হযরত রসূলে
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুনূতে নাযেলা কেবল মাত্র একমাস পড়েছিলেন।
অতঃপর ঐ কুনূতে নাযেলা পাঠ করা পরিত্যাগ করেছেন” বর্ণিত হাদীছ শরীফের প্রথম অংশ
অর্থাৎ ‘এক মাস কুনূতে নাযেলা পাঠ করেছেন।’ এটা হলো ‘মানসূখ।’ আর
দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ ‘অতঃপর তা পরিত্যাগ করেছেন।’ এটা হলো ‘নাসেখ।’ হাদীছ শরীফ সম্পর্কিত উপরোক্ত বিস্তারিত ও দলীলভিত্তিক
আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হাদীছ শরীফ অনেক প্রকার রয়েছে। তন্মধ্যে এক প্রকার হচ্ছে, ‘নাসেখ ও
মানসূখ।’ নাসেখ হাদীছ শরীফ গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণীয়। আর মানসূখ হাদীছ শরীফের উপর আমল করা
শরীয়তে বৈধ নয়। এ সম্পর্কে ১৩৪তম সংখ্যায় দলীলভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা করা
হয়েছে। অতএব, কোন
বিষয়ে দলীল হিসেবে হাদীছ শরীফ উল্লেখ করার পূর্বে সে হাদীছ শরীফখানা কোন্ পর্যায়ের
তা ভালরূপে তাহক্বীক্ব করে নিতে হবে। নচেৎ ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন, ভুল
করেছে বাতিলপন্থি ও উলামায়ে ‘ছূ’রা ‘কুনূতে নাযেলা’
সম্পর্কে। তারা
হাদীছ শরীফ তথা ‘নাসেখ-মানসূখ’
সম্পর্কে নেহায়েত অজ্ঞ হওয়ার কারণেই ‘কুনূতে
নাযেলা’ সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে। তাদের সে বিভ্রান্তি দূর করার লক্ষ্যেই
উপরে ‘হাদীছ শরীফ’ সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যাতে করে সুস্পষ্টভাবেই
প্রমাণিত হয় যে, বাতিলপন্থি ও উলামায়ে ছূরা ‘কুনূতে নাযেলাকে’ জায়িয প্রমাণ করতে গিয়ে দলীল
হিসেবে যে হাদীছ শরীফ উল্লেখ করে থাকে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তা ‘মানসূখ’-এর
অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে
দ্বীনি ছহীহ্ সমঝ দান করুন। (চলবে) (পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় থাকুন)
0 Comments:
Post a Comment