“হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায ফাসিদ হওয়ার কারণ (পর্ব-২)
“হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায
ফাসিদ হওয়ার কারণ এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” পেশ করতে
পারায় মহান আল্লাহ পাক-এর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া। হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয
ও নামায ফাসিদ হওয়ার কারণ এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ সুন্নতের পথিকৃত, হক্বের
অতন্দ্র প্রহরী, দ্বীন ইসলামের নির্ভীক সৈনিক, সারা জাহান থেকে কুফরী, শিরেকী ও বিদ্য়াতের মূলোৎপাটনকারী, বাতিলের
আতঙ্ক এবং আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক
তাজদীদী মুখপত্র- “মাসিক আল বাইয়্যিনাত”
পত্রিকায় এ যাবৎ যত লেখা বা ফতওয়াই প্রকাশ বা পত্রস্থ হয়েছে
এবং ইনশাআল্লাহ হবে তার প্রতিটিরই উদ্দেশ্য বা মাকছূদ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ “মাসিক আল
বাইয়্যিনাতে” এমন সব লেখাই পত্রস্থ হয়, যা
মানুষের আক্বীদা ও আমলসমূহ পরিশুদ্ধ করণে বিশেষ সহায়ক। তদ্রুপ
‘মাসিক আল বাইয়্যিনাতে’
“হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ
করা নাজায়িয ও নামায ফাসিদ হওয়ার কারণ এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” দেয়ার
মাকছুদ এবং উদ্দেশ্যও ঠিক তাই। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাকে ‘সূরা
মায়িদার’ ৮২নং আয়াত শরীফে ইরশাদ করেন,
لتجدن اشد الناس عداوة للذين امنوا اليهود والذين اشركوا.
অর্থঃ-“তোমরা
তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে পাবে ইহুদীদেরকে। অতঃপর যারা মুশরিক তাদেরকে।” মূলতঃ এই ইহুদীরাই মুসলমানের ঈমান-আমল বিনষ্ট করে দ্বীন ইসলামে ফিৎনা সৃষ্টি করার
লক্ষ্যে বিভিন্ন বাতিল ফিরকার জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ শিয়া, খারিজী, মু’তাযিলা, জাবারিয়া, ক্বদরিয়া, বাহাই, কাদিয়ানী
ও ওহাবী ইত্যাদি বাতিল ফিরকাগুলো ইহুদীদেরই এজেন্ট। বর্তমানে ইহুদীদের এজেন্ট
হিসেবে মুসলমানদের ঈমান আমলের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করছে যারা, তারা
হলো- ‘ওহাবী সম্প্রদায়’। উল্লেখ্য, ইহুদীদের
এজেন্ট, ওহাবী মতাবলম্বী দাজ্জালে কায্যাব তথা উলামায়ে ‘ছূ’রা উল্লিখিত বিষয়গুলোর ন্যায় ‘কুনূতে
নাযেলা’ সম্পর্কেও সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা সম্প্রতি আফগানিস্তান ও ইরাক
যুদ্ধের সময় শত্রুদের প্রতি ‘বদ্ দোয়া’ করার লক্ষে সারাদেশব্যাপী এমনকি বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম
দেশগুলোতেও মুছল্লীদেরকে ‘প্রতি ফজর নামাযে’
‘কুনূতে নাযেলা’ পাঠ করার আহ্বান জানায় এবং তারা
অনেক মসজিদেই ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করে। শুধু
তাই নয়, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা,
কিতাবাদী ও বক্তব্যে তারা ‘ফজর নামাযে কুনূতে নাযেলা’ পাঠ
করাকে জায়িয বলে প্রচার করেছে। আর এ ব্যাপারে তাদের মূল দলীল হলো, ‘ফতওয়ায়ে
দেওবন্দ।’ অথচ ‘কুনূতে নাযেলা’
সম্পর্কিত ‘ফতওয়ায়ে দেওবন্দ’-এর
বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল,
অশুদ্ধ, দলীলবিহীন ও হানাফী মাযহাবের ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের
মতের সম্পূর্ণই খিলাফ। যার প্রমাণ ও খ-ন অত্র ফতওয়াতেই আপনারা যথাসময়ে পেয়ে যাবেন
ইনশাআল্লাহ। তাদের উক্ত ভুল ফতওয়ার কারণে সাধারণ লোক মনে করবে ‘হানাফী
মাযহাব মতে বোধ হয় ‘ফজরে কুনূত পড়া জায়িয।’
অথচ শরীয়ত যেটাকে নাজায়িয ও হারাম করেছে সেটাকে জায়িয বা
হালাল মনে করা কুফরী বা ঈমান বিনষ্ট হওয়ার কারণ। অনুরূপ তাদের উক্ত ভুল ও অর্ধেক
ফতওয়ার কারণে হাজার হাজার মুছল্লী ফজর নামাযে কুনূত পাঠ করার কারণে একটি ফরয আমল ‘নামায’ অনায়াসে
ও অজান্তেই ফাসিদ বা বিনষ্ট করে দিচ্ছে বা দিবে।
অথচ নামায হচ্ছে,
দ্বীন ইসলামের ভিত্তি বা খুঁটি। তাই বলার অপেক্ষাই রাখেনা
যে, নামায তরক করা,
ইচ্ছা করে নামায ফাসিদ হয় এমন কাজ করা, নামাযে
অবহেলা করা, খুশু-খুযূ’র সাথে নামায আদায় না করা, হারাম-নাজায়িয থেকে নামাযকে হিফাযত না করা ইত্যাদি
কার্যকলাপ কঠিন গুণাহ্র কাজ ও কুফরীর লক্ষণ। যেমন “মিশকাত শরীফ”-এর
কিতাবুছ্ ছলাহ্, বাবু ফাযায়িলিছ্ ছলাহ (নামাযের ফযীলত) অধ্যায়ের আল ফাছলুল্ আউয়াল-এর ৬নং হাদীছ
শরীফে বর্ণিত আছে,
عن جابر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم بين العبد وبين الكفر ترك الصلوة.
অর্থঃ- “হযরত
জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত
রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বান্দার
ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হলো নামায ত্যাগ করা।” (মুসলিম) অর্থাৎ অস্বীকৃতির সাথে
নামায ত্যাগ করলে বান্দা কাফির হয়ে যায়। আল্লাহ
পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
من ترك الصلوة حتى مضى وقتها ثم قضى عذاب فى النار حقبا والحقبة ثمانوان سنة والسنة ثلث مائة وستون يوما كل يوم كان مقداره الف سنة.
অর্থঃ- “যে
ব্যক্তি নামায তরক করলো,
এমনকি নামাযের ওয়াক্ত শেষ হয়ে গেল, অতঃপর সে
ব্যক্তি তার ক্বাজা আদায় করলো, সে জাহান্নামে এক হোক্বা শাস্তি ভোগ করবে। আর এক হোক্বা
হচ্ছে ৮০ বছর এবং এক বছর হচ্ছে ৩৬০ দিন, প্রতিটি দিন হচ্ছে- হাজার বছরের
সমান।” (মাজালিসুল আবরার,
আল্ মানাসিক) হাদীছ শরীফের বর্ণনা মোতাবেক হোক্বার
পরিমাণ দুনিয়াবী বছর অনুযায়ী নিম্নরূপ-(৮০ বছর * ৩৬০ দিন = ২৮৮০০ দিন * ১০০০ বছর =
২,৮৮,০০০০০ বছর।) অতএব, এক
হোক্বা = ২,৮৮,০০০০০ বছর। উল্লেখ্য,
ক্বাযা নামায আদায়কারী ব্যক্তির উপর ওয়াক্ত মোতাবেক নামায
ফরয হয়েছিল কিন্তু সে যথা সময়ে ফরয আদায় করেনি। অর্থাৎ ওয়াক্ত ফউত হওয়ার পর সে
আদায় করেছে। ফরয নামায যথা সময় আদায় না করার কারণেই তাকে এক হোক্বা শাস্তি ভোগ
করতে হবে। এখন সে যদি খালিছ তওবা করে, তাহলে আল্লাহ্ পাক ক্ষমা করে
দিবেন। অন্যথায় তওবা ব্যতীত নামাযের ক্বাযা আদায় করলেও শাস্তি থেকে অব্যাহতি বা
রেহাই পাওয়া যাবেনা। আর যারা নামাযের ক্বাযাও আদায় করবেনা আর তওবাও করবে না, তাদের যে
কি শাস্তি হবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ পাকই সবচেয়ে ভাল জানেন। নামাযের গুরুত্ব বুঝানোর জন্যই
হাদীছ শরীফে উল্লেখিত শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
নামায ফাসিদ তথা ভঙ্গ বা ফউত
হবার পর কাযা আদায় করলেও যেখানে এক হোক্বা তথা দুই কোটি আটাশি লক্ষ বছর শাস্তি ভোগ
করতে হয় সেখানে কুনূতে নাযেলা পাঠ করার কারণে নামায ভঙ্গ হওয়ার পর কাযা আদায় না
করলে কত কোটি বছর শাস্তি হবে তা বলার অপেক্ষায়ই রাখেনা। মূলকথা যারাই ফজর নামাযে কুনূতে নাযেলা পাঠ করবে তাদের নামায ফাসিদ
বা বাতিল হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে বাতিল ফিরক্বার মৌলভীরা ফজর বা অন্যান্য নামাযে
কুনূতে নাযেলা পাঠ করা জায়িয ফতওয়া দিয়ে নিজেদের এবং সরলপ্রাণ মুছল্লীদের নামায
ফাসিদ বা ভঙ্গ করে দেয়ার মাধ্যমে লা’নত বা কঠিন আযাবের উপযোগী
হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে
ভুল ফতওয়া দিয়ে ইহুদীদের এজেন্ট, ওহাবী মতাবলম্বী, দাজ্জালে কায্যাব ও উলামায়ে ‘ছূ’রা
সাধারণ মুসলমানদের ঈমান-আমলকে বিনষ্ট করে দ্বীন ইসলামকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রই
সর্বদা করে যাচ্ছে। কাজেই এদের
ভুল ফতওয়া থেকে যেন সাধারণ মুসলমানগণ নিজেদের ঈমান-আমল হিফাযত করতে পারে এবং যারা
অজ্ঞতাহেতু ভুল ফতওয়া দিচ্ছে তারাও যেন সঠিক ও দলীলভিত্তিক ফতওয়া পাওয়ার পর ভুল
ফতওয়া ও আমল থেকে তওবা করে হক্বের উপর ফিরে আসতে পারে। সর্বোপরি মহান আল্লাহ
পাক-এর খাছ রেযামন্দি বা সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে সে উদ্দেশ্যেই মাসিক আল
বাইয়্যিনাতে “হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায
ফাসিদ হওয়ার কারণ ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” প্রকাশ
করা হলো। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে
উক্ত ফতওয়া মুতাবিক আমল করে মহান আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ রেযামন্দী হাছিল করার তাওফীক দান করুন। (আমীন) (পূর্ব প্রকাশিতের পর) ‘কুনূত’ শব্দের
ইস্তিলাহী বা পারিভাষিক অর্থ [৬৪ ] ‘আল
কামূসুল ফিক্বহী’
কিতাবের ৩০৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
القنوت شرعا ذكر مخصوص مشتمل على دعاء وثناء.
অর্থঃ- “পারিভাষিক
অর্থে কুনূত বলা হয় এমন নির্দিষ্ট যিকিরকে, যা দোয়া এবং ছানা ছিফতকে শামীল
করে।” [৬৫ ] ‘ফিরোযুল
লুগাত’ কিতাবের ৯৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
উর্দূ কম্পোজ করতে
হবে অর্থঃ- “কুনূত
এমন একটি দোয়া যা বিত্র নামাযে পড়া হয়ে থাকে।” [৬৬] ‘আল
মুহীত্ব ফিল লুগাত’
নামক অভিধানের ৫ম খ-ের ৩৬৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
القنوت دعاء بعد القرأة فى اخر الوتر.
অর্থঃ- “কুনূত ঐ
দোয়াকে বলে যা বিত্র নামাযের শেষে পড়া হয়।” [৬৭] মুফতী সাইয়্যিদ আমীমূল ইহসান মুজাদ্দিদী বরকতী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
القنوت هو الدعاء يقرأ فى الوتر وهو عندنا اللهم انا نستعينك ونستغفرك ... الخ.
অর্থঃ- “কুনূত
এমন একটি দোয়া যা বিত্র নামাযে পাঠ করা হয়। আমাদের হানাফী মাযহাব মতে দোয়াটি হলো-
اللهم انا نستعينك ونستغفرك .....
অর্থঃ- “আয়
আল্লাহ পাক! আমরা আপনার কাছেই সাহায্য চাই, আপনার কাছেই ক্ষমা চাই ....।” [৬৮] ‘লিসানুল
আরব’ কিতাবের ৬নং খ-ের ৩৭৪৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
فحقيقة القنوت العبادة والدعاء لله عز وجل فى حال القيام ويجوز ان يقع فى سائر الطاعة الانه ان لميكن قيام بالرجلين فهو قيام بالشئ بالنية.
অর্থঃ- “অতঃপর
কুনূতের হাক্বীক্বত হচ্ছে,
আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে ইবাদত এবং দোয়া
করা, আর দাঁড়ানোর অবস্থাটা সকল আনুগত্যের ব্যাপারে ব্যবহার হয়ে থাকে। কেননা, যদি কেউ
দু’পায়ের সাহায্যে দাঁড়াতে নাও পারে তখন সে কোন জিনিসের উপর ভর করে দৃঢ়তার সাথে
দাঁড়ায়। [৬৯] ‘আল
মাগরিব’ নামক লুগাতের ২য় খ-ের ১৯২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, কুনূত দ্বারা দোয়ায়ে কুনূত
উদ্দেশ্য, যেটা আমরা বিত্র নামযে পড়ে থাকি। যা হচ্ছে,
اللهم انا نستعينك ونستغفرك ..... الخ.
অর্থঃ- “আয়
আল্লাহ পাক! আমরা আপনার কাছেই সাহায্য চাই, আপনার কাছেই ক্ষমা চাই ....।” [৭০] ‘লুগাতুল
হাদীছ’ এর ৩য় খ-ের ১৬০ পৃষ্ঠায় আছে, কুনুত বলা হয় শত্রুদের প্রতি বদ্দোয়া করাকেই। [৭১] ‘আল মুনজিদ’ নামক
অভিধানে রয়েছে, “দুশমনদের উপর বদ্দোয়া করাকে কুনূত বলে। (যা কুনূতে নাযেলা)” [৭২] ‘লিসানুল আরব’
কিতাবের ৬ষ্ঠ খ-ের ৩৭৪৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, “হুযূর
পাক ছল্লৗাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘রিল’ এবং ‘যাকওয়ান’ গোত্রেদ্বয়ের
প্রতি বদদোয়া করে ফজরের নামাযে রুকুর পড়ে যা পড়েছিলেন তাকেই কুনূতে নাযেলা বলে।” ‘কুনূত’ শব্দের উপরোক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ
দ্বারা প্রমাণিত হলো যে,
‘কুনূত’ শব্দটি লুগাতী বা আভিধানিক বিভিনস্থানে বিভিন্ন অর্থে
ব্যবহৃত হয়। তবে ইছতিলাহী বা পারিভাষিক অর্থে দুই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ১. বিত্র
নামাযের শেষ রাকায়াতে রুকূ থেকে দাঁড়িয়ে সূরা-ক্বিরয়াত পাঠের পর ‘দোয়ায়ে
কুনূত’ পাঠ করা যাকে কুনূতে রাতিবা বলে। যা ওয়াজিব ২. কারো প্রতি বদদোয়া করার
উদ্দেশ্যে ফজরের নামাযে ‘কুনূত’ পাঠ করা। যাকে কুনূতে নাযেলা বলে। যা পাঠ করা হানাফী মাযহাব মতে হারাম ও
বিদয়াত। যেহেতু তা পরবর্তীতে মানসূখ হয়ে গেছে। ‘কুনূতে নাযেলা’ কি এবং
কাকে বলে? কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, ‘কুনূতে
নাযেলা’-এর শাব্দিক অর্থ কি?
আর এটাকে ‘কুনূতে নাযেলা’ বলা হয় কেন? মূলতঃ ‘কুনূত’ শব্দের একাধিক অর্থের মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ‘বদ্দোয়া।’ আর نازلة ‘নাযেলাতুন’ শব্দটি
ওয়াহিদ মুয়ান্নাছ,
বাহাছ ইসমে ফায়েল نزلة - نزل বা نزول মাছদার থেকে
উৎপত্তি যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিপদাপদ, বালা-মুছীবত ইত্যাদি। এক
কথায় ‘কুনূতে নাযেলা’-এর অর্থ হচ্ছে “বিপদাপদ ও বালা-মুছীবত থেকে রক্ষার জন্যে, যুদ্ধে শত্রুর উপর বিজয়ী হওয়ার
উদ্দেশ্যে বা গযবে শত্রু ধ্বংস হয়ে যাক এ লক্ষ্যে ফরজ নামাযে রুকূর পর দাঁড়িয়ে ‘বদ্দোয়া’ করা।” সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কোন গোত্রের প্রতি তাঁর হায়াত
মুবারকে মাত্র একবারই একাধারে একমাস ফজরের নামাযে ‘কুনূতে নাযেলা’ পাঠ
করেন। অবশ্য পরে তা ওহীর মাধ্যমে ‘মানসূখ’ হয়ে
যায়। [৭৩] যেমন, এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে উল্লেখ
আছে,
عن النبى صلى الله عليه وسلم انه قنت شهرا فى صلاة الصبح بعد الركوع يدعو على رعل وذكوان.
অর্থঃ- “হযরত
রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাস ফজর নামাযের দ্বিতীয় রাকায়াতে
রুকুর পরে ‘রিল’ এবং ‘যাকওয়ান’ গোত্রদ্বয়ের প্রতি বদ্দোয়া করার লক্ষ্যে কুনূতে নাযেলা পাঠ করেন।” [৭৪] ‘মিশকাত
শরীফ’-এর ১১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।
وعن انس رضى الله تعالى عنه ان النبى صلى الله عليه وسلم قتنت شهرا.
অর্থঃ- “হযরত
আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক মাস কুনূত (নাযেলা) পড়েছিলেন।” [৭৫-৮০] ‘মিশকাত
শরীফ’-এর ১১৩ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে,
وعن ابن عباس رضى الله تعالى عنه قال قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم شهرا متتابعا فى الظهر والعصر والمغرب والعشاء وصلاة الصبح اذا قال سمع الله لمن حمده من الركعة الاخيرة يدعو على احياء من بنى سليم على رعل وذكوان وعصية ويومن من خلفه.
অর্থঃ- “হযরত
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত
রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাস যাবৎ বরাবর যোহর, আছর, মাগরিব, ইশা এবং
ফজরের নামাযে যখন শেষ রাকায়াতে ‘সামি আল্লাহুলিমান হামিদাহ’ বলতেন তখন বণী সুলাইম গোত্রের ‘রিল’, ‘যাকওয়ান’ ও ‘আছিয়্যা’ শাখার
প্রতি বদ্দোয়া করতেন। তাঁর পিছনে যারা থাকতেন তারা আমীন বলতেন।” (আবূ দাউদ
শরীফ, মুসলিম শরীফ,
তিরমিযী শরীফ, নাসায়ী শরীফ, ইবনে
মাজাহ্ শরীফ) উপরোক্ত বর্ণনা
দ্বারা প্রমাণিত হলো যে,
আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম ‘রিল’ ও ‘যাকওয়ান’ গোত্রদ্বয়ের প্রতি বদ্দোয়া করার লক্ষ্যে মাত্র একমাস ফজরের নামাযে ‘কুনূত’ অর্থাৎ ‘কুনূতে
নাযেলা’ পাঠ করেন। অতঃপর তা ওহীর মাধ্যমে মানসূখ হয়ে যায়। পারিভাষিক অর্থে এটাকেই
কুনূতে নাযেলা বলে। আমাদের হানাফী মাযহাবের ফতওয়া হলো- শুধুমাত্র বিত্র নামাযেই
দোয়া ‘কুনূত’ পাঠ করবে। এছাড়া অন্য কোন নামাযে ‘কুনূত’ বা ‘কুনূতে
নাযেলা’ কোনটিই পাঠ করা জায়িয নেই। অতএব, অত্র
ফতওয়ায় যে ‘কুনূত’ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হবে তাহলো ‘কুনূতে নাযেলা’ অর্থাৎ ‘ফজর
নামাযে বদদোয়া করার লক্ষ্যে কুনূত পাঠ করা জায়িয কিনা?’ তা
প্রমাণ করার জন্যে পর্যায়ক্রমে বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ পেশ করা হবে ইনশাআল্লাহ। ‘কুনূতে
নাযেলা’এর উৎপত্তির কারণ ও ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ
হিজরতের চতুর্থ বৎসরে উহুদ যুদ্ধের
চার মাস পর সফর মাসে নজদের কিছু মুনাফিক আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট কিছু হাদিয়া পেশ করে বলে, ‘ইয়া
রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যদি আপনি আমাদের সঙ্গে
আপনার ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মধ্য থেকে কতককে প্রেরণ করতেন তাহলে
ভালই হত কেননা, তাঁরা আমাদের কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের আমল শিক্ষা দিবেন।’ তাদের
আবেদনের প্রেক্ষিতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমি
নজদবাসীদের ব্যাপারে আশংকা করছি! তাদের মধ্যে আমর বিন তুফায়েলের বার বার আবেদনের
প্রেক্ষিতে মুসলমানদের সর্বত্তোম ক্বারী আনসার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণের মধ্য থেকে সত্তর জন ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণকে তাদের সাথে প্রেরণ করলেন। অতঃপর
সেই নজদবাসীর সঙ্গে সত্তর জন ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের বিরাট
কাফেলা ‘বীরে মাউনার’
কাছে গেল। তখন আমর ইবনে তুফাইল মুনাফিক রিল, যাকওয়ান
ও আছিয়্যা বলে চিৎকার শুরু করলো। তৎক্ষণাত এক ভাঙ্গাচুরা বাড়ী থেকে তীর ও
অস্ত্রধারী কাফিরের দল বের হয়ে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণের উপর হামলা চালালো। এমনকি যারা সঙ্গে ছিল তারাও বিশ্বাসঘাতকতা করে হযরত
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের উপর যুদ্ধ চালালো। এ অতর্কিত
যুদ্ধের ফলে সত্তর জন ক্বারী ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ-এর
প্রত্যেককেই শহীদ করে দিল। কোন বর্ণনায়
পাওয়া যায়, তারা শুধুমাত্র হযরত কা’ব ইবনে যায়িদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছাড়া সবাইকে শহীদ
করে ফেলে। পরে খন্দকের যুদ্ধে হযরত কা’ব ইবনে যায়িদ রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুও শহীদ হন। অতঃপর এ
মর্মান্তিক শাহাদাতের সংবাদ আখিরী রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম-এর কাছে পৌঁছলে তিনি ভীষণভাবে অন্তরে ব্যাথা অনুভব করেন এবং ঐ সমস্ত
কাফির ও মুনাফিকের প্রতি আন্তরিক বেদনার বহিঃপ্রকাশে ফজরের নামাযে তাদের প্রতি
বদ্দোয়া করে একমাস কুনূতে নাযেলা পড়েন। এটাই কুনূতে নাযেলার উৎপত্তির কারণ ও
ঐতিহাসিক ঘটনা। তবে বিস্তারিত জানার জন্য বিভিন্ন তাফসীর ও হাদীছ শরীফের আলোকে
নিম্নে দলীলভিত্তিক আলোচনা করা হলো- তাফসীরের আলোকে কুনূতে নাযেলার উৎপত্তির কারণ
ও ইতিহাস [৮১] “তাফসীরে জালালাইন শরীফের” ৬০
পৃষ্ঠায় ليس لك من الامر شئ অর্থাৎ “এ বিষয়ে আপনার আর কিছু করার প্রয়োজন নেই।” আয়াত শরীফের শানে নুযূলে ১৭নং
হাশিয়ায় উল্লেখ আছে যে,
قال قوم نزلت فى اهل بير معونة وهو سبعون رجلا من القراء بعثهم رسول الله صلى الله عليه وسلم الى بير معونة فى صفر سنة اربع من الهجرة على راس اربعة اشهر من احد ليعلموا الناس القران والعلم اميرهم المنذر بن عمرو فقتلهم عامر بن الطفيل فوجد عليهم رسول الله صلى الله عليه وسلم وجدا شديدا قنت شهرا فى الصلوات كلها يدعو على جماعة من تلك القبائل باللعن والسنين.
অর্থঃ- “মুফাস্সিরীন
রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের একটি জামায়াত বলেন যে, ليس لك من الامر شئ. অর্থাৎ “এ বিষয়ে
আপনার আর কিছু করার প্রয়োজন নেই।” আয়াত শরীফটি অবতীর্ণ হয় ‘বীরে মাউনা’-এর
শহীদগণের ঘটনার প্রেক্ষিতে,
আর তাঁরা ছিলেন, ৭০ জন ক্বারী তথা কুরআন শরীফ
তিলাওয়াতকারী। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চতুর্থ হিজরীতে উহুদ
যুদ্ধের চার মাসের শেষের দিকে ছফর মাসে তাঁদেরকে ‘বীরে মাউনায়’ প্রেরণ
করলেন এ উদ্দেশ্যে যে,
তাঁরা মানুষদেরকে কুরআন শরীফ এবং ইল্ম শিক্ষা দিবেন। আর
হযরত মুনযির বিন আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁদের মধ্যে আমীর তথা প্রধান
ছিলেন। অতঃপর তাঁরা যখন বীরে মাউনায় পৌঁছলেন তাঁদেরকে নিষ্ঠুর ভাবে শহীদ করে দেয়
আমির ইবনে তুফায়েল নামক (মুনাফিক) ব্যক্তি। অতঃপর হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে এক কঠিন মর্মান্তিক অবস্থায় ফিরে পান অর্থাৎ শহীদ
অবস্থায়। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই গোত্রসমূহের মধ্য
থেকে একটি জামায়াত তথা গোত্রের প্রতি দুর্ভিক্ষের বদ্দোয়ায় একমাস যাবৎ প্রত্যেক
ফরয নামাযে কুনূতে নাযেলা পাঠ করেন।” [৮২] তাফসীর জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
হযরতুল আল্লামা কাযী মুহম্মদ ছানাউল্লাহ্ পানিপথী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বিখ্যাত
তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরুল মাযহারী”-এর ২য় খ-ের ১৭২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
وقال قوم نزلت هذه الاية فى شهداء بير معونة وكان سبب ذلك على ماروى محمد بن السحاق وعبد الله ابن ابى عن انس رضى الله تعالى عنه وغيره قال قدم عامر بن مالك بن جعفر ملاعب الاسنة العامرى على رسول الله صلى الله عليه وسلم واهدى له فرسين راحلتين فابى رسول الله صلى الله عليه وسلم ان يقبلها وقال لا اقبل هدية مشرك فاسلم فان اردت ان اقبل هديتك فلم يسلم ولم يبعد وقال يا محمد ان الذى تدعو اليه حسن جميل فلو بعثت ان يستجيبواك فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم انى اخشى عليهم اهل نجد-
فقال ابو براء انا له جار فبعث المنذر بن عمرو رضى الله تعالى عنه اخا بنى ساعدة فى سبعين رجلا من خيار المسلمين من الانصار يسمون القراء وفيهم عامر بن فهيرة مولى ابى بكر فى صفر سنة اربع حتى نزلوا بير معونة وهى ارض بين ارض بنى عامر وخرة بنى سليم فبعثوا حرام ابن ملحان رضى الله تعالى عنه بكتاب رسول الله صلى الله عليه وسلم الى عامر بن الطفيل فى رجال من بنى عامر فقال حرام بن ملحان انى رسول رسول الله اليكم جميعا انى اشهد ان لا اله الا الله وان محمدا عبده ورسوله فامنوا بالله ورسوله فخرج اليه رجل من كسر البيت برمح فضرب فى جنبه حتى مخرج من الشق الاخر فقال الله اكبر فزت ورب الكعبة ثم استصرخ عامر بن الطفيل عليهم بنى عامر فابوا ان يجيبواه الى ما دعا هم اليه قالوا لا تخفروا جوار ابى براء فاستصرخ عليهم قبائل من بنى سليم عصية ورعل وذكوان فاجابواه فخرجوا .... حتى قتلوا كلهم الا كعب بن زيد تركواه وبه رمق فعاش حتى قتل يوم الخندق واخذ عمرو بن امية اسيرا فلما اخبرهم انه من مضر اطلقه عامر بن الطفيل فقدم على رسول الله صلى الله عليه وسلم اخبر له الخبر.
অর্থঃ- কোন কোন
মুফাস্সিরীন রহমতুল্লাহি আলাইহিম বলেন, ولاتحسبن الذين قتلوا فى سبيل الله امواتا. অর্থাৎ “যাঁরা
আল্লাহ পাক-এর রাস্তায় শহীদ হয়েছেন, তাঁদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না।” আয়াত শরীফখানা অবতীর্ণ হয়েছে “বীরে
মাউনায়” শহীদগণের সম্পর্কে। ঘটনাটি হযরত মুহম্মদ বিন ইসহাক ও হযরত আব্দুল্লাহ বিন উবাই
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মাধ্যমে
বর্ণনা করেছেন এভাবে যে,
তিনি বলেন আমির বিন মালিক বিন জাফর আমিরী ওরফে মালায়িব
আসিন্না সাইয়্যিদুনা হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে
হাজির হয়ে দু’টি ঘোড়া, দু’টি উট হাদিয়া হিসেবে পেশ করলো। কিন্তু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম সে হাদিয়া গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন এবং বললেন, আমি
মুশরিকের হাদিয়া কবূল করবনা। আর যদি তুমি চাও আমি তোমার হাদিয়া কবুল করি তাহলে
তুমি মুসলমান হয়ে যাও। কিন্তু
আমির বিন মালিক ও তার সাথীরা ইসলাম গ্রহণ করলো না এবং ইসলামকে অপছন্দ তথা তা থেকে
দূরেও সরে পড়ল না। অর্থাৎ অস্বীকারও করলনা। দলপ্রধান আমির বললো, ইয়া
রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি যে আহবান জানাচ্ছেন তা অত্যন্ত
সুন্দর। যদি আপনি আপনার কতক ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে নজদবাসীদের
নিকট প্রেরণ করতেন তবে আমি আশা করি, তারা আপনার ডাকে সাড়া দিবে। অতঃপর
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নজদবাসীদের নিকট লোক পাঠাতে আশংকা
বোধ করছি। অতঃপর হযরত আবূ বারা
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, আমি তাঁদের প্রতিবেশী অর্থাৎ আমি তাঁদের নিরাপত্তার
জিম্মাদারী গ্রহণ করছি। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্তর জন
ক্বারী তথা কুরআন শরীফ পাঠকারী ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে একত্রিত
করে প্রেরণ করলেন। আর তাঁদের প্রধান হলেন হযরত মুনযির বিন আমর রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু, যিনি বনী সায়িদা গোত্রের ভাই। আর ঐ সত্তর জন ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণ তাঁরা সকলেই ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে সর্বোত্তম আনসার ছাহাবী। আর হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু-এর মুক্ত গোলাম হযরত আমির বিন ফুহাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও ছিলেন
তাঁদের দলে। আর ঐ সময়টি ছিল চতুর্থ হিজরীর
ছফর মাস। অতঃপর ক্বারী ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ পথ চলতে চলতে
গিয়ে পৌঁছলেন বীরে মাউনায়। আর বীরে মাউনা ছিলো বনু আমির এবং বনূ সুলাইম এর
মধ্যবর্তী একটি পাথরের প্রান্তর। সেখান থেকে হযরত হারাম বিন মিলহানকে বনূ আমিরের
কিছু লোকের সাথে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চিঠিসহ আমির বিন
তুফাইলের নিকট পাঠানো হলো। হযরত হারাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, আমি
আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রেরিত দূত। আমি
সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,
আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই এবং সাইয়্যিদুনা হযরত
মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রসূল। তোমরা আল্লাহ্ পাক ও
তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করো। তৎক্ষণাত এক ভাঙ্গাচুড়া বাড়ী থেকে
বেরিয়ে আসল এক বল্লমধারী ব্যক্তি। সে বল্লম নিক্ষেপ করে হযরত হারাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে এফোঁড় ওফোঁড়
অর্থাৎ একদিক থেকে অপর দিকে বের করে দিল। বল্লমবিদ্ধ হযরত হারাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু বললেন,
‘আল্লাহু আকবার।’ অর্থাৎ আল্লাহ পাক মহান। কা’বার
প্রভুর কসম! আমি সফলকাম হয়েছি। অতঃপর, আমির বিন
তুফাইল (চরম মুনাফিক) চিৎকার করে বনী
আমিরকে ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণের উপর আক্রমণ করার আদেশ দিল। কিন্তু বনী আমির তার কথা তথা আদেশকে
প্রত্যাখ্যান করে বলল,
আবূ বারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর জিম্মাদারী ভঙ্গ
করনা। আমির বিন তুফাইল তখন ডাক দিলো বনূ সুলাইমকে। সুলাইম গোত্রের রিল, আছিয়্যা, যাকওয়ান
ও অন্যান্যরা লাব্বায়িক বলতে বলতে ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে ঘিরে
ফেলল। অতঃপর এ অতর্কিত আক্রমণের
ফলে হযরত কা’ব বিন যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছাড়া অন্য সকল ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণ শাহাদত বরণ করলেন। গুরুতর আহত কা’ব বিন যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু শহীদপ্রায় অবস্থায় পড়ে ছিলেন শহীদ সঙ্গীগণের পাশেই। কাফিরেরা তাঁকে মৃত মনে
করেছিল। হযরত কা’ব বিন যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পরে খন্দকের যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। কাফিরেরা সেখানে উপস্থিত আমর বিন উমাইয়া
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকেও বন্দী করলো। হযরত আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
বললেন, আমি মুদার গোত্রের লোক। তখন তাঁকে ছেড়ে দেয়া হলো। অতঃপর
তিনি হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট গিয়ে এ করুণ
মর্মান্তিক ঘটনাটি বিবৃত করেন। (এ ঘটনার
প্রেক্ষিতে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রতি বদ্দোয়ায় কুনূতে
নাযেলা পাঠ করেন) [৮৩-৮৫] “তাফসীরুল মাযহারী”
কিতাবের ২য় খ-ের ১৭৩/১৭৪ পৃষ্ঠায় আরো বর্ণনা করা হয়েছে,
وفى الصحيحين عن قتادة عن انس ان رعلا وذكوان وعصية وبنى لحيان اتوا رسول الله صلى الله عليه وسلم فزعموا انهم اسلموا واستمدوا على عدوهم فامدهم بسبعين من الانصار كنا نسميهم القراء فى زمانهم كانوا يحطبون بالنهار ويصلون بالليل حتى كانوا ببير معونة فقتلواهم غدروا بهم فبلغ النبى صلى الله عليه وسلم فقنت شهرا يدعو فى الصبح على احياء من احياء العرب على رعل وذكوان وعصية وبنى لحيان وروى احمد والشيخان والبيهقى والبخارى عن عروة ان اناسا جاءوا الى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقالوا ابعث معنا رجالا يعلمون القران والسنة فبعث اليهم سبعين رجلا من الانصار يقال لهم القراء فتعرضوالهم فقتلواهم قبل ان يبلغوا المكان قالوا اللهم بلغ نبينا وفى لفظ خواننا انا قد لقيناك فرضينا عنك ورضيت عنا فاوحى الله انا رسولهم اليكم انهم قد رضوا ورضى عنه. قال انس فقرانا فيهم بلغوا عنا قومنا انا قد لقينا ربنا فرضى عنا وارضينا ثم نسخ فدعا رسول الله صلى الله عليه وسلم اربعين صباحا على رعل وذكوان وعصية وبنى لحيان الذين عصوا الله ورسوله.
অর্থঃ- বুখারী শরীফ ও
মুসলিম শরীফে হযরত কাতাদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে। হযরত আনাস
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রিল,
যাকওয়ান ও বনূ লিহ্ইয়ান-এর কিছু লোক হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে হাযির হয়ে ভান করে বললো যে, তারা
মুসলমান হয়েছে। অতএব শত্রুদের মুকাবিলা করতে হবে। তাই আমাদেরকে কিছু সৈন্য সাহায্য
দিন। হযরত রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্তরজন শ্রেষ্ঠ ক্বারী
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে তাদের সাহায্যকারী হিসেবে পাঠিয়ে
দিলেন। তারা সকলেই কাঠ কেঁটে
জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং রাতে নামাযে তথা ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন। এমনকি ‘বীরে
মাউনা’ নামক স্থানে মুসলমান নামধারী কপটেরা তাঁদের সকলকেই শহীদ করে দেয়। এই দুঃখজনক
সংবাদ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য ছিল অত্যন্ত মর্মবিদারক।
অতঃপর তিনি একমাস ধরে ফজরের নামাযে কুনূত (নাযেলা) পড়েছিলেন আর এই কুনূতই ছিলো রিল, যাকওয়ান, আছিয়্যা
এবং বনূ লিহ্ইয়ান গোত্রের জন্য বদদোয়া। অর্থাৎ তাদের প্রতি বদ্দোয়ায় হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাস যাবৎ কুনূতে নাযেলা ফজরের নামাযে পড়েছিলেন। ইমাম আহমদ, মুসলিম
এবং বাইহাক্বী হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে, বাইহাক্বী
হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে এবং বুখারী হযরত উরওয়া
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বরাতে বর্ণনা করেছেন। “একদল লোক
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে হাযির হয়ে আরয করলো, ইয়া
রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! কুরআন শরীফ এবং হাদীছ শরীফ শিক্ষা
দেয়ার জন্য আমাদের সঙ্গে কিছু লোক প্রেরণ করুন। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম “আনছার ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মধ্য থেকে ‘সত্তরজন’ ক্বারী
তথা কুরআন শরীফ পাঠকারীগণকে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। যথাস্থানে পৌঁছার পূর্বেই
(ঐ কপটচারী মুনাফিক যালিমরা) ক্বারীগণের সবাইকে শহীদ করে দিলো। শাহাদতের
প্রাক্কালে তাঁরা বলেছিলেন,
আয় আল্লাহ পাক!
আমাদের এই বিপর্যস্ত অবস্থার সংবাদ আমাদের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে পৌঁছে দিন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয় আল্লাহ
পাক! আমাদের ভাইদের কাছে পৌঁছে দিন যে, আমরা আপনাকে পেয়েছি। আমরা আপনার
প্রতি সন্তুষ্ট। আপনিও আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট। তখন আল্লাহ পাক ওহীর মাধ্যমে তাঁর
রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানিয়ে দিলেন, আমি
তাদের পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে সংবাদ দিব। যে তাঁরা আল্লাহ্ পাক-এর প্রতি সন্তুষ্ট
এবং আল্লাহ্ পাক ও তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট। হযরত
আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন, প্রথম দিকে আমরা বীরে মাউনার
শহীদগণের প্রসঙ্গে অবতীর্ণ এই আয়াত শরীফ খানা পড়তাম,
اللهم بلغ عنا قومنا انا قد لقينا ربنا فرضى عنا وارضانا.
অর্থঃ- “আয়
আল্লাহ্ পাক! আমাদের ক্বওমের কাছে সংবাদ পাঠিয়ে দিন যে, আমরা
আমাদের প্রতি পালকের সাথে মিলিত হয়েছি। আমরা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তিনিও আমাদের
প্রতি সন্তুষ্ট।”
অবশ্য পরবর্তীতে এ আয়াত শরীফ খানা মানসূখ হয়ে যায়। এ ঘটনার পর ‘চল্লিশ
দিন যাবৎ হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযে রিল, যাকওয়ান, আছিয়্যা
এবং বনু লিহ্ইয়ান গোত্রের প্রতি বদদোয়ায় কুনূতে নাযেলা পড়েছেন যারা আল্লাহ্ পাক
এবং তার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি নাফরমানী করেছিল। অতঃপর
আল্লাহ পাক ليس لك من الامر شئ. অর্থাৎ “এ বিষয়ে আপনার আর কিছু করার প্রয়োজন নেই।” আয়াত শরীফ নাযিল করে কুনূতে
নাযেলাকে নিষেধের মাধ্যমে মানসূখ করে দেন।
[ ৮৬] ‘তাফসীরে মাযহারী’
কিতাবের ২য় জিঃ ১৩৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, لمنعه عن الدعاء عليهم. অর্থঃ- “তাদের
উপর বদ্দোয়া করতে নিষেধ করা হয়।” অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঐ সকল গোত্রের প্রতি বদদোয়া করতে নিষেধ করেন। [ ৮৭] “তাফসীরে
ইবনে কাছীর” কিতাবের ১ম খ-ের ৩৩৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,
روى ابن جرير بسنده عن انس بن مالك فى قصة اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم الذين ارسلهم نبى الله الى اهل (بير معونة) قال لا ادرى اربعين او سبعين او على ذلك الماء عامر بن الطفيل الجعفرى فخرج اولئك النفر من اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى أتوا غارا مشرفا على الماء فقعدوا فيه ثم قال بعضهم لبعض ايكم يبلغ رسالة رسول الله صلى الله عليه وسلم اهل هذا الماء؟ فقال اراه ابو ملحان الانصارى انا ابلغ رسالة رسول الله صلى الله عليه وسلم فخرج حتى اتى حول بيتهم فاجتثى امام البيوت ثم قال يا اهل بير معونة انى رسول رسول الله اليكم انى اشهد ان لا اله الا الله وان محمدا عبده ورسوله فامنوا بالله ورسوله خفرج اليه رجل من كسر البيت برمح فضربه فى جنبه حتى خرج من الشق الاخر فقال الله اكبر فزت ورب الكعبة فاتبعوا اثره حتى اتوا اصحابه فى الغار فقتلهم اجمعين.
অর্থঃ- “হযরত
ইবনে জারীর রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তয়ালা আনহু থেকে
ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেন যে, হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সেই সকল ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণের কাহিনীর ব্যাপারে বর্ণনা করা হয় যে, যাদেরকে তিনি দ্বীনের দাওয়াতের
জন্য বীরে মাউনাবাসীদের নিকট পাঠিয়ে ছিলেন তাঁহারা চল্লিশ জন অথবা সত্তর জন ছাহাবী
ছিলেন। সেই কুপটির মালিক ছিলো মুনাফিক, কাফির
আমির বিন তুফাইল জাফরী। অতঃপর রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
ছাহাবীদের দলটি বাহির হলেন এবং কুপের নিকট অবস্থিত একটি গুহায় অবস্থান গ্রহণ
করলেন। অতঃপর তারা একে অপরকে বলতেছিলেন ঐ কূপের পার্শে বসবাসকারীদের নিকট
সাইয়্যিদুনা রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আহবান পৌঁছে দিতে কার
সাহস আছে? তখন আবূ মিলহান আনসারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়লা আনহু হাত উঠিয়ে বলেন, আমার
সাহস আছে, সেখানে সাইয়্যিদুনা রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দাওয়াত
পৌঁছে দিতে। অতঃপর তিনি সৎ
সাহসে বের হয়ে মহল্লার একেবারে নিকটে পৌঁছে যান এবং তাঁকে দেখে গৃহকর্তা বাইরে
আসলে তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, হে বীরে মাউনার অধিবাসীগণ! আমি
তোমাদের নিকট আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন দূত। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ্ পাকই একমাত্র ইলাহ এবং
সাইয়্যিদুনা হযরত মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা এবং রসূল।
তোমরাও আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ঈমান
আনয়ণ কর। হঠাৎ একজন লোক দৌঁড়ে এসে তাঁকে লক্ষ্য করে বল্লম দিয়ে আঘাত করল এবং
বল্লমটি তাঁর পাঁজরের একদিক দিয়ে লেগে অপর দিকে ভেদ করে চলে গেলো। সেই মুহুর্তে
তাঁর মুখনিসৃত বাণী ছিলো-
الله اكبر فزت ورب الكعبة.
অর্থাৎ- ‘আল্লাহ
পাকই সর্বাপেক্ষা বড়।’
কা’বার রবের শপথ! আমি সফল হয়েছি। এটার পর সেই কাফিরেরা তাঁর পদচিহ্ন অনুসরণ করে
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের গুহায় চলে আসে এবং আমির বিন
তুফাইল একা তাঁদের সকলকেই হত্যা করে ফেলে।” (আর এ মর্মান্তিক ঘটনা জানার পর সাইয়্যিদুনা মহানবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম অত্যন্ত আন্তরিক কষ্ট অনুভব করেন এবং শহীদকারীদের (রিল, যাকওয়ান, আছিয়্যা
গোত্রের) প্রতি বদদোয়ায় একমাস ফজরের নামাযে কুনূতে নাযেলা পাঠ করলেন।) [৮৮-৯০] “তাফসীরে ইবনে কাছীর” কিতাবের
১ম খ-ের ৩৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়।
وقد ثبت فى الصحيحين عن انس رضى الله تعالى عنه فى قصة بير معونة السبعين من الانصار الذين قتلوا فى غداة واحدة وقنت رسول الله صلى الله عليه وسلم يدعو على الذين قتلوهم ويلعنهم.
অর্থঃ- “বুখারী ও
মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে,
হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, বীরে
মাউনার সেই সত্তরজন আনছার ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম যাদেরকে নির্মমভাবে
শহীদ করা হয়েছিল। আর এঘটনার প্রেক্ষিতে হযরত রসূলুল্লাহু ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম শহীদকারীদের প্রতি অভিশাপ তথা বদ্দোয়ায় নামাযে কুনূতে নাযেলা পাঠ
করেছিলেন।” (আর এ শহীদকারীরা হলো রিল, যাকওয়ান এবং আছিয়্যা গোত্রের লোকেরা। আর এদের বদ্দোয়ায়
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযে কুনূতে নাযেলা পড়তেন এবং
বলতেন আল্লাহ পাক তাদের উপর আপনার শাস্তিকে কঠোর করুন এবং হযরত ইউসূফ আলাইহি ওয়া
সাল্লাম এর সময় যেরূপ দুর্ভিক্ষ দিয়েছিলেন ঐরূপ দুর্ভিক্ষ তাদের উপর নাযিল করুন।
এটাই ছিল কুনূতে নাযেলা পাঠের দোয়া।) [৯১]
“তাফসীরে ইবনে কাছীর”
কিতাবের ১ম খ-ের ৩১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
اللهم اشدد وطأتك على مضر واجعلها عليهم سنين كسنى يوسف يجهر بذلك وكان يقول فى بعض صلاته فى صلاة الفجر اللهم العن فلانا وقلانا لاحياء من احياء العرب.
অর্থঃ- “আয়
আল্লাহ পাক! আপনি মুদার গোত্রের উপর কঠোর শাস্তি দিন এবং তাদের উপর দুর্ভিক্ষ দিয়ে
দিন যেমনটি দুর্ভিক্ষ হযরত ইউসূফ আলাইহিস্ সালাম-এর সময় হয়েছিল। সাইয়্যিদুনা হযরত
রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কতক নামাযে উচ্চস্বরে বলেছিলেন তবে
বিশেষ করে ফজর নামাযে বলেছিলেন, আয় আল্লাহ্ পাক! আরব গোত্রদের মধ্য থেকে অমুক, অমুক
গোত্রের প্রতি লা’নত তথা অভিশাপ বর্ষণ করুন।” প্রকাশ থাকে যে,
আরবের কতক গোত্র বলতে রিল, যাকওয়ান এবং আছিয়্যা গোত্রদেরকে
বুঝানো হয়েছে। আর ফজরের নামাযে এক মাস কুনূতে নাযেলা পাঠ করার প্রচলন শুরু হয়
চতুর্থ হিজরীতে তাদের প্রতি বদ্দোয়ার প্রেক্ষিতে। কেননা, তারা
সত্তরজন ক্বারী ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে বীরে মাউনায় শহীদ করে।
[৯২-৯৪] “তাফসীরে মাযহারী”
কিতাবের ২য় খ-ের ১৩৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
ما راواه مسلم من حديث ابى هريرة انه صلى الله عليه وسلم كان يقول فى الفجر اللهم العن رعلا وذكوان وعصية حتى انزل الله تعالى هذه الاية فان قصة رعل وذكوان كان بعد ذلك وهم اهل بير معونة بعث اليهم رسول الله صلى الله عليه وسلم سبعين رجلا من القراء ليعلموا الناس القران والعلم اميرهم المنذر ابن عمرو فقتلهم عامر بن الطفيل فوجد من ذلك وجدا شديدا وقنت شهرا فى الصلوات كلها يدعو على جماعة من تلك القبائل باللعن والسنين قال الحافظ ثم ظهرت لى علة فى حديث ابى هريرة هذه وان فيه ادراجا فان قوله حتى انزل الله منقطع من رواية الزهرى عمن بلغه بين. ذلك مسلم وهذا البلاغ لايصح يحتمل ان يقال ان قصة رعل وذكوان كان عقيب غزوة احد باربعة اشهر فى صفر سنة اربع من الهجرة فلعلها نزلت فى جميع ذلك وتأخير نزول الاية عن سبب نزولها قليلا غير مستبعد.
অর্থঃ- ‘হযরত
ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর
সূত্রে যেটা বর্ণনা করেছেন। তাহলো- হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
বলেন যে, নিশ্চয়ই নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযে বদ্দোয়ায় বলতেন,
اللهم العن رعلا وذكوان وعصية.
অর্থাৎ- আয় আল্লাহ্ পাক! আপনি রিল, যাকওয়ান
এবং আছিয়্যা গোত্রের উপর লা’নত বর্ষণ করুন। পরে আল্লাহ্ পাক ليس لك من الامر شئ অর্থাৎ “এ বিষয়ে আপনার আর কিছু করার প্রয়োজন নেই।” এ আয়াত শরীফখানা অবতীর্ণ করেন।
অতঃপর বদ্দোয়া বন্ধ করেন। অবশ্য রিল, যাকওয়ান
এবং আছিয়্যা এর ঘটনা উহুদ যুদ্ধের পরে বীরে মাউনার সাথে সংযুক্ত। হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে সত্তরজন ক্বারী ছাহাবায়ে কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে পাঠিয়েছিলেন এ উদ্দেশ্যে যে, তাদেরকে
কুরআন শরীফের তা’লীম এবং অন্যান্য দ্বীনি ইল্ম শিক্ষা দিবেন। তাদের এ দলের আমির ছিলেন হযরত
মুনযির ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। অতঃপর মুনাফিক, কাফির
আমির ইবনে তুফাইল জাফরী বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁদের সবাইকে শহীদ করে ফেললো। পরে
সাইয়্যিদুনা হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে এ নিদারুন
কঠিন অবস্থায় পেয়ে মনে প্রচ- আঘাত পান এবং একমাস যাবৎ প্রত্যেক নামাযে তিনি কুনূতে
নাযেলা পাঠ করে সংশ্লিষ্ট গোত্রগুলোর উপর লা’নত এবং দুর্ভিক্ষের বদ্দোয়া করেন।
তবে হাফিয বলেন, এ হাদীছ শরীফের একটি ইল্লত রয়েছে
তাহল ইদরাজ তথা বর্ণনাকারী কিছু সংযোগ করেছেন। কেননা, অবশেষে
আল্লাহ পাক এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ করেন এ কথাটি ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এর
বর্ণনানুসারে হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কর্তৃক বর্ণিত নয়। বরং
হযরত ইমাম যুহরী রহমতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক সংযোজিত। তবে পরিশেষে বলা যায় যে, রিল এবং যাকওয়ান এর (বীরে মাউনার) ঘটনাকে শামিল করে, যা উহুদ
যুদ্ধের চার মাস পর চতুর্থ হিজরীর ছফর মাসে সংঘটিত হয়েছিল। অবশ্য উহুদ যুদ্ধের চার
মাস পরে উভয় ঘটনার প্রেক্ষিতে আয়াত শরীফ খানা নাযিল হয়েছে এতে কোন অসম্ভবের কিছুই
নেই। (এরূপ বর্ণনা হাশিয়াউছ্ ছবী ১ম খ-ের
১৭৮ পৃষ্ঠায় আছে) [৯৫] “তাফসীরে
কুরতুবী” কিতাবের ৪র্থ খ-ের ২০১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,
ناسخة للقنوت الذى كان النبى صلى الله عليه وسلم يفعله بعد الركوع فى الركعة الاخيرة من الصبح احتج بحديث ابن عمر انه سمع النبى صلى الله عليه وسلم يقول فى صلوة الفجر بعد رفع راسه من الركوع فقال اللهم ربنا ولك الحمد فى الاخرة ثم قال اللهم العن فلانا وفلانا.
অর্থঃ- “সাইয়্যিদুনা হযরত রসূলে পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযে দ্বিতীয় রাকায়াতে রুকুর পরে যে
কুনূতে নাযেলা পড়েছিলেন তা মানসুখ হয়ে গেছে। আর
এ ব্যাপারে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর হাদীছ শরীফ
খানা দলীল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে, হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযে শেষ রাকায়াতে রুকূ থেকে মাথা উঠানোর সময় সামি
আল্লাহুলিমান হামিদাহ এবং আল্লাহুম্মা রব্বানা লাকাল হামদ বলে অতঃপর শেষে বলতেন,
اللهم العن فلانا وفلانا.
অর্থাৎ- “আয় আল্লাহ পাক! অমুক অমুক গোত্রের
প্রতি লা’নত বষর্ণ করুন।” [৯৬-৯৭] “তাফসীরুল
কুরআনিল আ’যীম” (ইবনু কাছীর) কিতাবের ১ম খ-ের ৬০২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
قال البخارى حدثنا حبان بن موسى انبانا عبد الله رضى الله تعالى عنه انبانا معمر عن الزهرى حدثنى سالم عن ابيه انه سمع رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول اذا رفع راسه من الركوع فى الركعة الثانية من الفجر اللهم العن فلانا وفلانا بعد ما يقول سمع الله لمن حمده ربنا ولك الحمد.
অর্থঃ- “ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি
বলেন, হাব্বান ইবনে মুসা আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, তিনি হযরত আব্দুল্লাহ
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে, তিনি আবার মু’মার থেকে, তিনি
যুহরী থেকে। তিনি বলেন,
আমার কাছে বর্ণনা করেছেন হযরত সালিম রহমতুল্লাহি আলাইহি
তাঁর পিতা থেকে। তাঁর পিতা সাইয়্যিদুনা হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম থেকে এরূপ বলতে শুনেছেন যে, ফজরের নামাযে দ্বিতীয় রাকায়াতে
রুকূ থেকে যখন হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা মুবারক উঠাতেন
তখন তিনি সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ ও রব্বানা লাকাল হামদ বলে উঠাতেন। অতঃপর তিনি
এ রকম বলতেন যে, আয় আল্লাহ পাক! আপনি অমুক এবং অমুক গোত্রের প্রতি লা’নত বর্ষণ
করুন।” [৯৮] “তাফসীরুল
কুরআনিল আ’যীম” (ইবনু কাছীর) কিতাবের ৬০২ পৃষ্ঠায়
উল্লেখ আছে,
وعن عبد الله ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يدعو على اربعة.
অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারটি গোত্রের (রিল, যাকওয়ান, আছিয়্যা
ও লিহইয়ান-এর) প্রতি বদ্দোয়া করেছেন।” [৯৯] “তাফসীরুল কুরআনিল আ’যীম” (ইবনু কাছীর) কিতাবের ৬০২ পৃষ্ঠায় আরো
বলা হয়েছে,
وعن ابن عمر رضى الله عليه تعالى عنهما قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يدعو على رجال من المشركين يسميهم باسمائهم.
অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুনা
হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (বদনামে কিংবা) নাম ধরে মুশরিকদের
বদ্দোয়া দিতেন।” [১০০] “তাফসীরুল
কুরআনিল আ’যীম” (ইবনু কাছীর) কিতাবের ১ম খ-ের ৬০২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
وعن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كان اذا اراد ان يدعو على احد او يدعو لاحد قنت بعد الركوع وبما قال اذا قال سمع الله لمن حمده ربنا ولك الحمد اللهم انج الوليد بن الوليد وسلمة بن هشام وعياش بن ابى ربيعة والمستضعفين من المؤمنين اللهم اشدد وطأتك على مضر واجعلها عليهم سنين كسنى يوسف يجهر بذلك وكان يقول فى بعض صلاته فى صلاة الفجر اللهم العن فلانا وفلانا لاحياء من احياء العرب.
অর্থঃ- “হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুনা হযরত রসূলে পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কারো উপর বদ্দোয়া অথবা দোয়া করার ইচ্ছা করতেন
তখন রুকূর পর কুনূত পড়তেন এবং যখন সামি আল্লাহুলিমান হামিদাহ্ ও রব্বানা ওয়া
লাক্বাল হামদ বলে দাঁড়াতেন তখন বলতেন, আয় আল্লাহ পাক! ওলীদ ইবনে ওলীদ, সালামা
ইবনে হিশাম এবং আইয়্যাশ ইবনে আবি রবীয়াহ এবং দুর্বল মু’মিনদেরকে
পরিত্রান দান করুন।”
আয় আল্লাহ্ পাক! মুদার গোত্রের উপর কঠোর শাস্তি নিপতিত করুন
এবং তাদের উপর দুর্ভিক্ষ অবর্তীণ করুন। যেমন দুর্ভিক্ষ হয়েছিল হযরত ইউসূফ আলাইহি
ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে। এভাবে তিনি উচ্চ স্বরে তাঁর কতক নামাযে বলতেন। আর বিশেষ করে
ফজরের নামাযে বলতেন,
যে আল্লাহ পাক! আরব গোত্রের মধ্য থেকে অমুক এবং অমুক
গোত্রের প্রতি আপনি লা’নত বর্ষণ করুন।” [১০১-১০৩] “তাফসীরুল
কুরআনিল আ’যীম” (ইবনু কাছীর) কিতাবের ১ম খ-ের ৬৪২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
قد ثبت فى الصحيحين عن انس فى قصة اصحاب بير معونة السبعين من الانصار الذين قتلوا فى غداة قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم يدعو على الذين قتلوهم ويلعنهم قال انس ونزل فيهم قران قراناه حتى رفع ان بلغوا عنا قومنا انا قدلقينا ربنا فرضى عنا وارضانا.
অর্থঃ- “ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিম শরীফে
হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সূত্রে বীরে মাউনার অধিবাসীদের ঘটনা
বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা ছিলেন সত্তরজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম। তাঁরা সবাই
একই দিনে সকালে কাফিরদের তরবারীর আঘাতে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে শহীদ হন। তাঁদের
শহীদকারী মুনাফিক ও কাফিরদের প্রতি বদ্দোয়ায় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম কুনূতে নাযেলা পাঠ করে তাদেরকে লা’নত করেছিলেন। হযরত আনাস
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, তাঁদের (শহীদগণের) ব্যাপারে কুরআন শরীফের যে আয়াত শরীফ খানা
অবতীর্ণ হয়েছিল তা আমরা পড়তাম এমনকি পরে তা তিলাওয়াত রহিত হয়ে যায়। আয়াত শরীফ
খানার অর্থ হচ্ছে আমাদের সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের সংবাদ পৌঁছে দিন যে, আমরা
আমাদের রবের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং আমরাও তাঁর
প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছি।” [১০৪] “তাফসীরে সমরক্বন্দী” কিতাবের ১ম খ-ের ২৯৭ পৃষ্ঠায়
উল্লেখ আছে,
وكان سبعون رجلا من الصحاب الصفة خرجوا الى الغزو محتسبين فقتل السبعون جميعا فشق ذلك على النبى صلى الله عليه وسلم فدعا الله عليهم اربعين يوما فى صلاة الغداة.
অর্থঃ- “আছহাবে ছুফফাহ-এর সত্তরজন ছাহাবী
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ছিলেন, তাঁরা সকলেই নেক কাজের উদ্দেশ্যে
কোন এক অভিযানে বের হন। পথিমধ্যে (মুশরিক, কাফিররা) তাঁদের সবাইকে শহীদ করে
দেয়। এ মর্মবিদারক ঘটনা সাইয়্যিদুনা হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম-এর কাছে পৌঁছামাত্র তিনি কঠিনভাবে ব্যাথিত হন। অতঃপর সাইয়্যিদুনা হযরত
রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চল্লিশ দিন পর্যন্ত ফজরের নামাযে
শহীদকারীদের প্রতি বদ্দোয়া করেন। অর্থাৎ কুনূতে নাযেলা পাঠ করেন।” [১০৫] “তাফসীরুত
ত্ববারী” কিতাবের ৪র্থ খ-ের ৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه يقول كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول حين يفرغ فى صلوة الفجر من القراأة ويكبر ويرفع راسه سمع الله لمن حمده ربنا لك الحمد ثم يقول وهو قائم اللهم انج الوليد بن الوليد وسلمة بن هشام وعياش ابن ابى ربيعة والمستضعفين من المؤمنين اللهم اشدد وطأتك على مضر واجعلها عليهم كشنى يوسف اللهم العن لحيان ورعلا وذكوان وعصية عصت الله ورسوله.
অর্থঃ- “হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযের ক্বিরায়াত শেষ করতেন তখন
তাকবীর বলতেন এবং সামি আল্লাহুলিমান হামিদাহ বলে মাথা উঠাতেন। অতঃপর দাঁড়িয়ে বলতেন, আয়
আল্লাহ পাক! আপনি ওলীদ ইবনে ওলীদ, সালামা ইবনে হিশাম, আইয়্যাশ
ইবনে আবি রবীয়াহ এবং দুর্বল মু’মিনদেরকে নাযাত তথা পরিত্রাণ দান করুন।” আয় আল্লাহ পাক! মুদার গোত্রের উপর আপনি আপনার
শাস্তিকে কঠোর করুন এবং তাদের উপর দুর্ভিক্ষ দান করুন! যেমন, দুর্ভিক্ষ
হযরত ইউসূফ আলাইহিস্ সাল্লাম-এর সময় ছিল। আয় আল্লাহ্ পাক! লিহইয়ান, রিল, যাকওয়ান
এবং আছিয়্যা গোত্রের উপর লা’নত বর্ষণ করুন। যারা আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অবাধ্যচারিতা করেছিল।” [১০৬-১১২] “তাফসীরে যাদুল মাসীর”
১ম খ-ের ৩৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
ان سبعين من اهل الصفة خرجوا الى قبيلتين من بنى سليم عصية وذكوان فقتلوا جميعا فدعا النبى صلى الله عليه وسلم عليهم اربعين يوما.
অর্থঃ- “আহলে ছুফফাহ-এর সত্তরজন ছাহাবী
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম তাঁরা বণী সালিমের আছিয়্যা এবং যাকওয়ান গোত্রদ্বয়ের
উদ্দেশ্যে বের হলেন। অতঃপর (ঐ গোত্রদ্বয়ের লোকেরা) পথিমধ্যে তাঁদের সবাইকে শহীদ
করে দিল। অতঃপর সাইয়্যিদুনা হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
শহীদকারীদের প্রতি চল্লিশ দিন (ফজরের নামাযে) বদ্দোয়ায় কুনূতে নাযেলা পাঠ করেন।” অনুরূপ
বর্ণনা নিম্নোক্ত তাফসীর সমূহেও রয়েছে। যেমন, তাফসীরু রুহিল মায়ানী ৩য় খ-ের ৫০
পৃষ্ঠা, তাফসীরুল বাগবী,
তাফসীরুল খাযিন, তাফসীরুল কবীর, তাফসীরুল মাওয়ারদী, জামিউল
কুরআন ইত্যাদি) হাদীছ শরীফের আলোকে কুনূতে
নাযেলার উৎপত্তির কারণ ও ইতিহাস [১১৩] “বুখারী শরীফ” এর ১ম
খ-ের ১৩৬ পৃষ্ঠায় আছে,
حدثنا مسدد قال حدثنا عبد الواحد قال حدثنا عاصم قال سالت انس بن مالك عن القنوت فقال قد كان القنوت قلت قبل الركوع او بعده قال قبله قال فان فلانا اخبرنى عنك انك قلت بعد الركوع فقال كذب انما قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم بعد الركوع شهرا اراه كان بعث قوما يقال لهم القراء زهاء سبيعن رجلا الى قوم من المشركين دون اولئك وكان بينهم وبين رسول الله صلى الله عليه وسلم عهد فقنت رسول الله صلى الله عليه وسلم شهرا يدعو عليهم اخبرنا احمد بن يونس قال حدثنا زائدة عن التيمى عن ابى مجلز عن انس رضى الله تعالى عنه قال قنت النبى صلى الله عليه وسلم شهرا يدعو على رعل وذكوان.
অর্থঃ- “হযরত মুসাদ্দাদ রহমতুল্লাহি
আলাইহি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, হযরত আব্দুল ওয়াহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন আমাদের
কাছে বর্ণনা করেছেন,
হযরত আছিম তাবিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমি হযরত
আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে কুনূত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি
বললেন, কুনূত অবশ্যই পড়া হত। আমি আরো জিজ্ঞাসা করলাম, রুকূর আগে না পরে? তিনি
বললেন, রুকূর আগেই। হযরত আছিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, অমুক ব্যক্তি আমাকে আপনার বরাত
দিয়ে বলেছেন যে, আপনি বলেছেন,
রুকূর পরে। তখন হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়লা আনহু বলেন, সে ভুল
বলেছে তবে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাস রুকূর পরে একমাস ধরে কুনূত
(নাযেলা) পাঠ করেছেন। আমার জানা মতে, অর্থাৎ আমি যা দেখেছি, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্তরজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণের একটি দল যাঁদেরকে কুররা (অভিজ্ঞ ক্বারী) বলা হয় তাঁদেরকে মুশরিকদের একটি
ক্বওমের কাছে প্রেরণ করলেন। যারা রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে নাই, তাদের ব্যতীত অন্যান্যদের অর্থাৎ যারা চুক্তি বা ওয়াদা ভঙ্গ
করেছে তাদের প্রতি বদদোয়া করার লক্ষ্যে কেবলমাত্র একমাস (ফজর নামাযে) কুনূতে
নাযেলা পাঠ করেন। হযরত আছিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যেটা
আমাদের কাছে আহমদ ইবনে ইউনুস, তিনি বলেন, আমাদের কাছে হযরত যায়েদ রহমতুল্লাহি আলাইহি, তিনি
তাইমিয়ী থেকে, তিনি আবূ মিজলিয থেকে,
তিনি হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবলমাত্র একমাস ধরে রিল এবং যাকওয়ান
গোত্রদ্বয়ের প্রতি বদদোয়ায় (ফজরের নামাযে) কুনূতে নাযেলা পাঠ করেন।” (বুখারী
শরীফ) [১১৪] “বুখারী
শরীফের” ১ম খ-ের ১৭৩ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে,
حدثنا عمرو بن على حدثنا محمد بن فضيل حدثنا عاصم الاحول عن انس رضى الله تعالى عنه قال قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم شهرا حين قتل القراء فما رايت رسول الله صلى الله عليه وسلم حزن حزنا قط اشد منه.
অর্থ- “আমর ইবনে আলী বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন
মুহম্মদ বিন ফুযাইল,
তিনি আবার আছিম
আহওয়াল রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণনা
করেন। তিনি বর্ণনা করেন,
হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন, বীরে
মাউনার ঘটনায় ক্বারী ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে যখন
(কাফির-মুশরিকরা) শহীদ করেছিল তখন শহীদকারীদের প্রতি বদদোয়ায় কুনূতে নাযেলা হযরত
রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাস পাঠ করেছিলেন। হযরত আনাস
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আর কখনও আমি
এর চেয়ে অধিক শোকাবহ অবস্থায় দেখিনি।” [১১৫] “বুখারী শরীফের”
২য় খ-ের ৫৮৬ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে,
وعن انس بن مالك ان رعلا وذكوان وعصية وبنى لحيان استمدوا رسول الله صلى الله عليه وسلم على عدو فامدهم بسبعين من الانصار كنا نسميهم القراء فى زمانهم كانوا يحتطبون بالنهار ويصلون بالليل حتى كانوا ببير معونة قتلوهم وغدرو بهم فبلغ النبى صلى الله عليه وسلم فقنت شهرا يدعو فى الصبح على احياء من احياء العرب على رعل وذكوان وعصية وبنى لحيان قال انس فقرانا فيهم قرانا ثم ان ذلك رفع بلغوا عنا قومنا اتا لقينا ربنا فرضى عنا وارضانا وعن قتادة عن انس بن مالك حدثه ان نبى الله صلى الله عليه وسلم قنت شهرا فى صلاة الصبح يدعو على احياء من احياء العرب على رعل وذكوان وعصية وبنى لحيان.
অর্থঃ- “হযরত আনাস ইবনে মালিক
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত যে, রিল, যাকওয়ান, আছিয়্যা
ও বণী লিহ্ইয়ানের লোকেরা শত্রুর মুকাবিলা করার জন্য সাইয়্যিদুনা হযরত রসূলুল্লাহ
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলে হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্তর জন আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণকে পাঠিয়ে দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করলেন। সে সময়ে আমরা তাঁদেরকে
ক্বারী নামে অভিহিত করতাম। তাঁরা দিনের বেলায় লাকড়ি সংগ্রহ করতেন এবং রাতের বেলায়
নামাযে নিমগ্ন থাকতেন। অবশেষে যেতে যেতে তাঁরা যখন বীরে মাউনার নিকট পৌঁছলেন তখন
মুনাফিকরা (আমির বিন তুফাইল-এর আহবানে চারিগোত্রের লোকেরা) তাঁদের সাথে বিশ্বাস
ঘাতকতা করে এবং পরে তাঁদের সবাইকে শহীদ করে দেয়। এ মর্মান্তিক সংবাদ সাইয়্যিদুনা
হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পৌঁছলে তিনি একমাস পর্যন্ত
ফজরের নামাযে আরবের কতিপয় গোত্র তথা রিল, যাকওয়ান, আছিয়্যা
এবং বণী লিহইয়ান এর প্রতি বদ্দোয়ার উদ্দেশ্যে কুনূতে নাযেলা পাঠ করেন। হযরত আনাস
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন যে, তাঁদের সম্পর্কে আমরা আয়াত শরীফ
পাঠ করতাম। অবশ্য পরে তার তিলাওয়াত রহিত হয়ে যায়। আয়াত শরীফখানা ছিল এই-
بلغوا عنا قومنا انا قد لقينا بنا فرضى عنا وارضانا.
অর্থাৎ- “আমাদের
ক্বাওমের লোকদেরকে জানিয়ে দিন। আমরা আমাদের প্রভূর সান্নিধ্যে পৌঁছে গিয়েছি। তিনি
আমাদের প্রতি সন্তুষ্টি হয়েছেন এবং আমরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্টি।” [১১৬-১২৮] “বুখারী
শরীফের” ২য় খ-ের ৫৮৬ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে,
حدثنا ابو معمر قال حدثنا عبد الوارث قال حدثنا عبد العزيز عن انس رضى الله تعالى عنه قال بعث النبى صلى الله عليه وسلم سبعين رجلا لحاجة يقال لهم القراء فعرض لهم حيان من بنى سليم رعل وذكوان عند بئر يقال لها بئر معونة فقال القوم والله ما اياكم اردنا انما نحن مجتازون فى حاجة للنبى صلى الله عليه وسلم فقتلوهم فدعا النبى صلى الله عليه وسلم عليهم شهرا فى صلاة الغداة وذلك بدء القنوت وما كنا نفنت.
অর্থঃ- “ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি
বলেন, আমাদের কাছে আবূ মু’মার রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের
কাছে হযরত আব্দুল ওয়ারিস রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের
কাছে আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে
বর্ণনা করেন। হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক প্রয়োজনে সত্তরজন লোক তথা ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমকে বীরে মাঊনা নামক স্থানে পাঠালেন। যাঁদেরকে ক্বারী বলা
হত। বণী সুলাইম গোত্রের দু’শাখা রিল
ও যাকওয়ান বীরে মাউনা নামক একটি কুপের নিকট তাঁদেরকে আক্রমণ করলে তাঁরা বললেন, আল্লাহ্
পাক-এর কসম! আমরা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমরা তো কেবল মাত্র হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশিত একটি কাজের উদ্দেশ্যে এ পথ দিয়ে যাচ্ছি। এতদ্বসত্ত্বেও তারা তাঁদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করে
ফেলল। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মর্মান্তিক সংবাদ জেনে
একমাস যাবৎ ফজরের নামাযে তাঁদের তথা ঐ কাফিরদের প্রতি বদ্দোয়ায় কুনূতে নাযেলা পাঠ
করেন। আর এভাবেই তথা এ ঘটনার প্রেক্ষিতে কুনূতে নাযেলা পড়ার উৎপত্তি শুরু হয়। হযরত
আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, এর পূর্বে আমরা কখনও কুনূতে নাযেলা পড়িনি।” ‘কুনূতে নাযেলা’ সম্পর্কিত অনুরূপ বর্ণনা
নিম্নোক্ত কিতাবসমূহেও রয়েছে। যেমন, মুসলিম শরীফ ১ম খ- ২৩৭ পৃষ্ঠা, তিরমিযী
শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ,
ইবনে মাজাহ শরীফ, নাসাঈ শরীফ, ফতহুল
বারী ২য় খ-, উমদাতুল ক্বারী ৬ষ্ঠ খ-, ইলাউস্ সুনান ৬ষ্ঠ খ- ৮২ পৃষ্ঠা, ইরশাদুস্
সারী, শরহে ইমাম নববী ৩য় খ-,
মুয়াত্তা ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি, হিদায়া) [১২৯ ] “মিশকাত শরীফের” ১১৩
পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
وعن عاصم بن الاحول قال قبله انما قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم بعد الركوع شهرا انه كان بعث اناسا يقال لهم القراء سبعون رجلا فاصيبوا فقنت رسول الله صلى الله عليه وسلم بعد شهرا يدعو عليهم.
অর্থঃ- “(তাবিয়ী) হযরত আছিম ইবনে আহওয়াল
রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
একদা আমি হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে
জিজ্ঞাসা করলাম, নামাযের কুনূত রুকূর পূর্বে না পরে? তিনি উত্তরে বললেন, রুকূর
পূর্বে। আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকূর পরে কেবলমাত্র একমাস
কুনূত পড়েছিলেন। অবশ্য ব্যাপারটি এই ছিল যে, একবার তিনি বীরে মাউনার দিকে
সত্তরজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমকে প্রেরণ করেছিলেন, যাঁদেরকে
ক্বারী (কুরআন শরীফের আলিম) বলা হতো, তাঁরা তথায় (কাফির, মুশরিক ও
মুনাফিক কর্তৃক) শহীদ হন। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে
রুকূর পরে শহীদকারীদের প্রতি বদ্দোয়ায় একমাস কুনূত তথা কুনূতে নাযেলা পাঠ করেন।
(আর ঘটনাটি কোন সময়ে সংঘটিত হয়েছিল।) [
১৩০] এ সম্পর্কে মিশকাত শরীফের ১১৩ পৃষ্ঠার ৭নং হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,
انه كان بعث الخ كان ذلك فى سرية المنذر ابن عمرو الى بير معونة فى سفر على رأس اربعة عشر من الاحد وهذه الغزوة تعرف بسرية القراء وهم سبعون وفى رواية انهم يحتطيون فى النهار ويصلون بالليل.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের ছত্রিশ মাসের মাথায় ছফর মাসে উহুদ যুদ্ধের চৌদ্দদিন পর
মুনযির ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করে বীরে মাউনার
দিকে সারিয়্যায় প্রেরণ করলেন। তবে এ গাযওয়া সারিয়্যা নামে পরিচিত। আর তাঁরা ছিলেন
সত্তরজন ক্বারী (কুরআন শরীফের আলিম) অন্য বর্ণনায় এসেছে তাঁরা সকলেই দিনের বেলায়
(জীবিকা নির্বাহের জন্য) কাঠ সংগ্রহ করতেন এবং রাত্রি বেলায় ইবাদত বন্দিগীতে মশগুল
থাকতেন।” [১৩১-১৩৬] “মিরকাত
শরীফ” এর ৩য় খ-ের ১৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,
وعن عاصم بن الاحول قال سالت انس بن مالك عن القنوت فى الصلوة كان قبل الركوع او بعده قال قبله انما قنت كان رسول الله صلى الله عليه وسلم بعد الركوع شهرا انه كان بعث اناسا يقال لهم الراء سبعون رجلا فاصيبوا فقنت رسول الله صلى الله عليه وسلم بعد الركوع شهرا يدعو عليهم.
অর্থঃ- “হযরত আছিম ইবনে আহওয়াল
রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আমি হযরত আনাস ইবনে মালিক
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে নামাযের কুনূত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, কুনূত
রুকূর পূর্বে, না পরে? তিনি বললেন, রুকুর পূর্বে তবে হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল মাত্র
রুকূর পরে একমাস কুনূতে নাযেলা পড়েছিলেন।” তিনি সত্তরজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণকে বীরে মাউনায় প্রেরণ করলেন, যাদেরকে
ক্বারী নামে অভিহিত করা হত। সেখানে (কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকরা) যখন তাঁদের
সবাইকে শহীদ করে ফেলল,
তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শহীদকারী
কাফিরদের প্রতি বদ্দোয়ায় ফজরের নামাযে রুকূর পরে শুধুমাত্র একমাস কুনূতে নাযেলা
পাঠ করেন। উল্লেখিত বর্ণনাসমূহ নিম্নের
শরাহগুলোতেও রয়েছে। যেমন,
মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, মিরয়াতুল মানজীহ, আশরাফুত
তাওযীহ, তানযীমুল আশতাত ইত্যাদি। উপরোক্ত
তাফসীর ও হাদীছ শরীফের আলোকে বর্ণিত ঘটনাবলীই ‘কুনূতে নাযেলা’-এর
উৎপত্তির কারণ। অর্থাৎ ‘বীরে মাউনা’ নামক ঐতিহাসিক স্থানে সত্তরজন ক্বারী ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমকে নির্মমভাবে শহীদ করার কারণে আখিরী নবী, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রি’ল, যাকওয়ান, আছিয়্যা ও লিহ্ইয়ান গোত্রসমূহের প্রতি একমাস নামাযে
বদদোয়া করেন। এটাই মূলতঃ ‘কুনূতে নাযেলা’-এর সঠিক ইতিহাস ও উৎপত্তির কারণ। (অসমাপ্ত) পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় থাকুন
0 Comments:
Post a Comment