সুওয়াল : মাসিক মুঈনুল ইসলাম সেপ্টেম্বর/৯৬ সংখ্যার
জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগের কোন এক জিজ্ঞাসার সমাধানে লেখা হয়েছে যে, “আযান-এক্বামতে বা অন্য কোনভাবে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
পবিত্র নাম শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুমু খেয়ে চোখে নাগানোর বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ
কোথাও নেই। যে কারণে তা বিদ্আত হিসেবে চিহ্নিত।” অর্থাৎ তাদের উপরোক্ত বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে- (১)
আযান ও ইক্বামতের সময় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক
শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করার বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ তাফসীর, হাদীছ
শরীফ,
ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কোন কিতাবেই উল্লেখ নেই। (২) আর যে সকল
বিষয় সহীহ্ বা বিশুদ্ধ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা
বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্।
এখন আমার
সুওয়াল হলো- আযান ও ইক্বামতের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করার প্রমাণ সহীহ্ পবিত্র হাদীছ শরীফ আছে কি? আর সহীহ্ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত না হলেই কি তা বিদ্য়াত? নির্ভরযোগ্য দলীল-আদিল্লার ভিত্তিতে জাওয়াব দানে খুশী করবেন।
জাওয়াব : আযান ও ইক্বামতের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন
করা সম্পর্কিত মাসিক মুঈনুল ইসলামের উপরোক্ত বক্তব্য ডাহা মিথ্যা, মনগড়া,
বিভ্রান্তিকর ও জেহালতপূর্ণ। তাদের এ বক্তব্য এটাই প্রমাণ
করে যে,
তারা হাদীছ শরীফ ও তার উছূল সম্পর্কে নেহায়েতই অজ্ঞ। কেননা
তারা প্রথমেই বলেছে যে, বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করা সম্পর্কে
বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ কোথাও নেই। অথচ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার কিতাবে
বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করার ব্যাপারে সহীহ্ হিসেবে মরফু ও মাওকুফ হাদীছ বর্ণিত
রয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ জঈফ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মারাকিউল ফালাহ্-এর
১৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
وذكر
الديلمى فى الفردوس من حديث ابى بكر رضى الله عنه مرفوعا من مسح العين بباطن انملة
السابتين بعد تقبيلهما عند قول المؤذن اشهد ان محمدا رسول الله وقال اشدان محمدا-
عبده ورسوله .......... حلت له شفاعتى.
অর্থ :“ইমাম দায়লামী রহমতুল্লাহি আলাইহি
(উনার
বিখ্যাত ও মশহুর হাদীছ শরীফের কিতাব) “ফিরদাউস লিদ্ দায়লমীতে” হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম থেকে মরফু হাদীছ উল্লেখ করেন যে, যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের আযানের সময় মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ শুনে অঙ্গুলী
চুম্বন করে চোখে বুছা দিবে ..... তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব।” এছাড়াও ইমাম ছাখাবী রহমতুল্লাহি আলাইহিউনার “মাকাসিদুল হাসানা” কিতাবে, মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি
আলাইহিউনার “মওযুআতুল কবীর” কিতাবে এবং মুহাম্মদ তাহের ফাত্তানী রহমতুল্লাহি আলাইহিউনার “মাজমাউল
বিহার”
কিতাবে আযানের সময় অঙ্গুলী চুম্বন করা সম্পর্কিত হাদীছ শরীফ উনাকে মরফু হিসেবে সহীহ্ বলে উল্লেখ
করেছেন। আর মুফতী আমীমুল ইহ্সান সাহেব উনার “ফতওয়ায়ে বরকতীয়ায়” এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকে“মওকুফ” হিসেবে সহীহ্ বলে উল্লেখ করেন।
অতএব, মাসিক মুঈনুল ইসলাম পত্রিকায় যে লিখেছে, “আঙ্গলী
চুম্বনের ব্যাপারে বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ কোথাও নেই।” তা
উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক বর্ণনা দ্বারা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রমাণিত হলো। দ্বিতীয়তঃ
তারা বুঝাতে চেয়েছে যে, “যে বিষয়ে বিশুদ্ধ (হাদীছ শরীফ উনার) প্রমাণ নেই, তা করা বিদ্আত।” তাদের এ বক্তব্যটিও নিতান্ত অজ্ঞতামূলক, দলীল বিহীন। পবিত্র কুরআন
শরীফ,
হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের খেলাফ তো অবশ্যই। কারণ শরীয়তের
কোথাও একথা উল্লেখ নেই যে, কোন বিষয়ে সহীহ্ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার প্রমাণ না থাকলেই তা বিদ্য়াত।
বরং শরীয়তের বিধান হলো- যেসকল বিষয় সহীহ্ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং জঈফ হাদীছ
দ্বারা প্রমাণিত, সেসকল বিষয়ও ফযীলত লাভের উদ্দেশ্যে আমল করা কখনো বিদ্য়াত নয়
বরং জায়েয ও মুস্তাহাব। এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব “ফতহুল ক্বাদীর”-এ উল্লেখ আছে যে,
الا ستحباب يثبت بالضعيف غير الموضوع.
অর্থ :“জঈফ পবিত্র হাদীছ শরীফ, যা মওজু নয়,
তদ্বারা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়।” কাজেই
যেখানে “আযানের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করা সম্পর্কে” জঈফ হাদীছ
তো অবশ্যই,
উপরোন্ত মরফূ ও মওকুফ পবিত্র হাদীছ শরীফ সহীহ হিসেবে বর্ণিত
আছে। সেখানে এটাকে বিদ্য়াত বলা কি করে জায়েয বা শরীয়তসম্মত হতে পারে? মূলতঃ এটাকে বিদয়াত বলার অর্থই হচ্ছে- পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উছূলকে
অস্বীকার করা এবং অনুসরণীয় হক্কানী-রব্বানী আলেমগণ উনাদের প্রতি বিদয়াতের তোহমত দেয়া। কেননা অনুসরণীয় ও বিশ্বখ্যাত বহু ইমাম, মুজতাহিদ ও আউলিয়ায়ে কিরামরহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের স্ব স্ব কিতাবে “আযানের মধ্যে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করে
চোখে বুছা দেয়ার আমলকে” মুস্তাহাব বলে ফতওয়া দিয়েছেন।
যেমন এ প্রসংগে আল্লামা কাহেস্তানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতওয়া হলো-
اعلم
انه يستحب ان يقال عند سماع الاولى من الشهادة الشانية قرة عينى بك يارسل الله صلى
الله عليه وسلم وعند سماع الثانية يقال
اللهم متعنى بالسمع والبصر بعد وضع ظغر الابها مين على العنين فانه صلى الله عليه
وسلم يكون قائدا له الى الجنة.
অর্থ :“জেনে রাখ, আযানের
সময় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক শুনে প্রথমবার “র্কুরাতু আইনী বিকা ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” এবং দ্বিতীয়বার “আল্লাহুমা মুতয়িনী বিস্সাময়ি ওয়াল বাছার” পাঠ করার পর বৃদ্ধা অঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন করে উভয় চোখে বুছা দেয়া মুস্তাহাব। আর
এরূপ আমলকারীকে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে টেনে বেহেশত নিয়ে যাবেন। (জামিউর রুমুজ, কানযুল ইবাদ, শরহে কবীর, শরহে ইলিয়াছ)এছাড়াওনিম্নোক্ত সকল
কিতাবে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন
করে চোখে বুছা দেয়াকে জায়েয, ফযীলতের কারণ ও মুস্তাহাব বলে
উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে
রুহুল বয়ান,
শরহে নেকায়া, মাজমাউল বিহার, ফতওয়ায়ে শামী, মাযমুয়ায়ে ফতওয়া, ফতওয়ায়ে খাজানাতুর রেওয়ায়েত, ফতওয়ায়ে সিরাজুম মুনীর, ফতওয়ায়ে মেফতাহুল যিনান, ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া, ফতওয়ায়ে বরকতীয়া, মাকাসিদুল হাসানা, এয়ানাতুত্ তালেবীন আলা হল্লে আলফাযে ফাত্হিল মুবীন, কেফায়াতুত্ তালেবীর রব্বানী লি রেসালতে আবি যায়িদিল কায়রুয়ানী, মুনীরুল আইন ফী তাকবীলুল ইবহামাইন,
নাহ্জুস্সালামাহ্ ফী তাকবীলিল ইবহামাইনে ফিল ইক্বামা, ছালাতে নক্শী, হুজ্জাতুল্লাহি আলাল আলামীন, কুওয়াতুল
কুলুব,
কিতাবুন নেয়ামুল ইনতেবাহ্, তরীকুল
ইসলাম,
জা’য়াল হক্ব ইত্যাদি আরো অনেক
কিতাবেই এটাকে জায়েয, ফযীলতের কারণ ও মুস্তাহাব বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- মাসিক
মুঈনুল ইসলামের বক্তব্য মোতাবেক উল্লিখিত কিতাবসমূহের লেখকগণ এটাকে জায়েয-মুস্তাহাব
বা ফযীলতের কারণ বলে বিদ্য়াতীদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন কি? (নাউযুবিল্লাহ্
মিন যালিক)
এখানে
বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, শরীয়ত যে বিষয়ে স্পষ্টভাবে কোন
আদেশ বা নিষেধ প্রদান করেনি, তা মোবাহ্ হওয়ার ব্যাপারে সকলেই
একমত। তবে “আযানের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করার আমল” যেখানে
মরফু ও মওকুফ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত, তা কি
করে বিদ্য়াত হতে পারে? আর যদি উক্ত হাদীছ শরীফকে জঈফও ধরে নেই, তথাপিও তা বিদ্য়াত হতে পারেনা। কারণ সকল মুহাদ্দিসগণের মতেই জঈফ হাদীছ শরীফ
ফযীলত অর্জনের জন্য আমল করা জায়েয। আর জঈফ হাদীছ শরীফ দ্বারাও মুস্তাহাব প্রমাণিত
হয়।
কাজেই
কোন বিষয়ে বিশুদ্ধ প্রমাণ না থাকলেই তা বিদ্য়াত নয়। বরং শরয়ী দলীল-প্রমাণ ব্যতীত
কোন বিষয়কে বিদ্য়াত বলা জেহালত ও গোমরাহী বৈ কিছুই নয়।উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, আযানের
সময় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন
করে চোখে বুছা দেয়া সম্পর্কিত মাসিক মঈনুল ইসলামের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ অশুদ্ধ, দলীলবিহীন,
বিভ্রান্তিকর ও উলামায়ে কিরামগণ উনাদের প্রতি বিদয়াতের তোহমত স্বরূপ। মূলকথা হলো, আযান-ইক্বামত
ও অন্যান্য সময় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন
করে চোখে বুছা দেয়া জায়েয ও মুস্তাহাব হওয়ার মতটিই অধিক সহীহ্, গ্রহণযোগ্য ও সর্বজন স্বীকৃত। যার প্রমাণ তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বাহ,
ফতওয়া ও অন্যান্য কিতাবসমূহে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
[বিঃদ্রঃ আরো বিস্তারিত
জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যার “অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” পাঠ করুন।]
আবা-৩৭
0 Comments:
Post a Comment