সুওয়াল : মাসিক মদীনা সেপ্টেম্বর/৯৬ইং সংখ্যায়
নিম্নবর্ণিত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়-
প্রশ্ন : সুদ দাতা, সুদ
গ্রহীতা,
সুদের দলীল লেখক ও সাক্ষীদাতা সবাই সমান অপরাধী। এ হাদীসের
মর্ম অনুযায়ী যারা ব্যাংকে চাকরী করে, তারা সুদের হিসাব করে বলে কি
গুণাহ্গার হবে?
উত্তর : যে দেশে ইসলামী শরীয়ত বিশেষতঃ ইসলামী আইন ও
অর্থ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত ও রাষ্ট্রিয়ভাবে পরিত্যাক্ত, সে দেশে প্রচলিত ব্যাংকে সুদের লেনদেন হয়, তাতে
চাকরী করা যায়েয হবেনা - এমন কথা বলা যাবেনা।
এখন আমার
সুওয়াল হলো- মাসিক মদীনার উক্ত উত্তর অনুযায়ী সত্যিই কি সুদভিত্তিক ব্যাংকে চাকরী
করা জায়েয?
অথচ আমরা আগে জানতাম, সুদভিত্তিক
কোন প্রতিষ্ঠানেই চাকরী করা জায়েয নেই। মদীনার প্রদত্ত্ব উত্তরের কারণে আমরা
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের মধ্যে পড়েছি। এখন কোন্টি সঠিক, দয়া করে
দলীল ভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করে আমাদের ঈমান হিফাযতে সাহায্য
করবেন।
জাওয়াব : মাসিক মদীনার উক্ত উত্তর সত্যিই
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয় সৃষ্টিকারী ও বিভ্রান্তিকর হয়েছে। মূলতঃ মদীনার সম্পাদকের
উপরোক্ত উত্তর সম্পূর্ণই ভুল হয়েছে। কারণ সে প্রথমতঃ সুদ ভিত্তিক ব্যাংকে চাকরী
করা জায়েয বলে ফতওয়া দিয়েছে। অর্থাৎ সুদী লেনদেনকে জায়েয বলেছে। দ্বিতীয়তঃ অসৎ
কাজে উৎসাহ প্রদান করেছে এবং তৃতীয়তঃ হারামকে হালাল বলে সাব্যস্ত করেছে। যা
সম্পূর্ণ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের খেলাফ তথা কুফরী হয়েছে।
নিম্নে
পর্যায়ক্রমে তার প্রদত্ত ভুল উত্তরের দলীল ভিত্তিক সঠিক জাওয়াব উল্লেখ করা হলো।
প্রথমতঃ
সে সুদ ভিত্তিক ব্যাংকে চাকরী করা তথা সুদী লেনদেনকে জায়েয বলে সাব্যস্ত করেছে।
অথচ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সুদী লেনদেন হারাম ও তার শাস্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে কঠোর
বাণী উচ্চারণ করেছেন।
এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
احل الله البيح وحرم الربوا.
অর্থ : “মহান আল্লাহ
পাক বেচা-কেনাকে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৭৫)
অর্থাৎ
সুদ চিরতরেই হারাম। সুদের ভয়াবহতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো বলেন,
يا
ايها الذين امنوا اتقوا الله وذروا ما بقى من الربوا ان كنتم مؤمنين. فان لم
تفعلوا فأذنوا بحرب من الله ورسوله.
অর্থ : “হে
ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহ
পাক উনাকে ভয় কর এবং সুদের যা বাকী রয়েছে
তা ছেড়ে দাও,
যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক। অতঃপর যদি তোমরা সুদ
ত্যাগ না কর,
তাহলে তোমরা জেনে রাখ, মহান আল্লাহ
পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার পক্ষ
থেকে (তোমাদের জন্য) যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৭৯)
অর্থাৎ
সুদ ও সুদ সম্পর্কিত বিষয়াবলী যে ব্যক্তি পরিত্যাগ না করবে, মহান আল্লাহ পাক ও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত
হয়েছে,
لعن
رسول الله صلى الله عليه وسلم اكل الرلابوا ومو كله وكاتبه وشاهديه وقال هم سواء.
অর্থ : “মহান
আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদ দাতা, সুদ
গ্রহীতা,
সুদের লেখক ও সুদের সাক্ষীদাতার উপর লা’নত বা অভিসম্পাত বর্ষণ করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, উক্ত
ব্যক্তিরা (লা’নত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে) সকলেই সমান।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, শরহে
নববী,
ফতহুল মুলহীম, তা’লীকুছ
ছবীহ,
আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত
ত্বীবী)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত
হয়েছে,
درهم
ربوا يأ كله الرجل وهو يعلم اشد من ستة وثلثين زينة.
অর্থ : “কোন
ব্যক্তি জেনেশুনে এক দিরহাম সুদ খেল, তাহলে সে যেন ছত্রিশবারেরও অধিক
যিনা করলো।”
(নাউযুবিল্লাহ) (আহমদ, দারে
কুতনী,
বায়হাক্বী, মিশকাত শরীফ)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
الربوا سبعون جزء ا ايسرها ان ينكح الرجل امه.
অর্থ : “সুদের
(গুণাহের) সত্তরটি শাখা বা অংশ রয়েছে, (তার মধ্যে) সর্বনিম্ন (গুণাহ্)
হলো সুদখোর ব্যক্তি তার মায়ের সাথে যিনা করা” (নাউযুবিল্লাহ্)।
(ইবনে মাযাহ্,
বায়হাক্বী, আহমদ, মিশকাত শরীফ)
অর্থাৎ
সুদ খাওযা,
দেয়া, সাক্ষী হওয়া এবং সুদ সংক্রান্ত
দলীলের লেখক ইত্যাদি সকলের উপরেই মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার লা’নত রয়েছে।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টরূপেই প্রমাণিত হলো যে, সুদের
লেনদেন হয়,
যেমন- ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ইত্যাদি সুদ ভিত্তিক
প্রতিষ্ঠানে চাকরী করা জায়েয হবেনা। কেননা উক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহে চাকরী করলে সূদের
লেখক,
সাক্ষ্যদাতা অথবা সাহায্যকারী অবশ্যই হতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ
সে অসৎ কাজে উৎসাহ প্রদান করেছে। অথচ মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন
শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ولا تعاونوا على الاثم والعدوان.
অর্থ : “তোমরা
পাপ ও সীমালংঘনের মধ্যে সাহায্য করোনা।” (পবিত্র সুরা মায়িদা
শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীরে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত
হয়েছে,
اذا
عملت الخطيئة فى الارض من شهدها فكر هها كان كمن غاب عنها ومن غاب فر ضيها كان كمن
شهدها.
অর্থ : “যমিনে
যখন কোন অন্যায় বা পাপ কাজ সংঘটিত হয়, তখন যে ব্যক্তি উক্ত স্থানে
উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তা অপছন্দ করে, সে যেন তা হতে অনুপস্থিত ছিল। আর
যে ব্যক্তি দূরে থাকা সত্ত্বেও উক্ত সংঘটিত গুণাহের কথা শুনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে
সে এরূপ,
যেন তথায় উপস্থিত ছিল।” (আবূ দাউদ, বযলুল মাজহুদ)
অর্থাৎ
মদীনার সম্পাদক উক্ত হারাম কাজে সম্মতি প্রকাশ করে সেও হারাম কাজে শরীক হয়ে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাফরমানী করলো।
তৃতীয়তঃ
সে হারামকে হালাল বলে সাব্যস্ত করেছে, অথচ শরীয়তে হালাল-হারাম স্পষ্ট ও
নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। নতুন করে কোন হারাম হালাল
হবেনা এবং হালালও হারাম হবেনা। মূলত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করা
সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহ
পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
বিরোধীতার শামিল।
এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ
পাক তিনি বলেন,
فيحلوا ما حرم الله.
অর্থ : “অতঃপর মহান আল্লাহ পাক যা হারাম করেছেন, তারা (কাফেররা) তা হালাল করে। (পবিত্র সুরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৭)
তিনি আরো
বলেন,
لا يحر مون ما حرم الله ورسوله.
অর্থ : “মহান আল্লাহ
পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা হারাম করে দিয়েছেন, তা তারা
(কাফেররা) হারাম (তওবা) করেনা।” (পবিত্র সুরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৭)
এ
প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ
উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
الحلال
بين والحرام بين ودعما يربيك الى مالا يربيك.
অর্থ : “হালাল
স্পষ্ট,
হারামও স্পষ্ট। যা সন্দেহে পতিত করে, তা ছেড়ে দাও। আর যা সন্দেহাতীত, তার প্রতি ধাবিত হও।” (বুখারী শরীফ)
অর্থাৎ
হারামকে হালাল বলা কুফরী। যে হারামকে হালাল বলবে তার স্ত্রী তালাক হবে, হজ্জ্ব করে থাকলে তা বাতিল হয়ে যাবে, জীবনের সমস্ত নেকী বরবাদ হয়ে
যাবে। (ফতওয়ায়ে আজিজিয়া, বাহরুর রায়েক, দুররুল মোখতার, কাজীখান, ফতওয়ায়ে আনকারুবীয়া, ফতওয়ায়ে খানিয়া ইত্যাদি।
এখন হয়তো
কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছে- যারা
ব্যাংক,
ইন্সুরেন্স কোম্পানী ইত্যাদি সুদ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে
চাকরীরত রয়েছে এবং এ আয়ের দ্বারাই সে ব্যক্তি, তার
পিতা-মাতা,
সন্তান-সন্ততি অর্থাৎ অধীনস্থ সকলেরই জীবিকা নির্বাহের
দায়িত্ব পালন করে থাকে। এমতাবস্থায় সে যদি উক্ত চাকুরী ছেড়ে দেয়, তবে সে তার অধীনস্থদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কিভাবে পালন করবে?
এ
প্রশ্নের জাওয়াব হলো- হ্যাঁ, কোন ব্যক্তি যদি সুদ ভিত্তিক
প্রতিষ্ঠানে যেমন- ব্যাংক, ইন্সুরেন্স কোম্পানী ইত্যাদিতে
চাকরীরত থাকে,
তবে তার জন্য ওয়াজিব উক্ত প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে দেয়া এবং
সুদহীন হালাল কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরী নিয়ে অথবা কোন হালাল ব্যবসার মাধ্যমে নিজে ও
তার পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করা।
আর যদি
কেউ ব্যাংক,
ইন্সুরেন্স ইত্যাদি সুদ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে চাকরী ছেড়ে
দিয়ে কোন সুদমুক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরীর ব্যবস্থা করতে না পারে, কিম্বা কোন হালাল ব্যবসারও ব্যবস্থা না করতে পারে, তাহলে সে
মা’জুর হিসেবে উক্ত সুদ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানেই চাকরীরত থাকবে। যা তার জন্য মা’জুর হিসেবে মুবাহ হবে। যেমন মৃত প্রাণীর গোশত খাওয়া হারাম। কিন্তু কেউ যদি তিন
দিন বা তার চেয়ে বেশীদিন না খেয়ে থাকে, তাহলে তার জন্য মৃত প্রাণীর গোশত
জরুরত আন্দাজ খাওয়া মা’জুর
হিসেবে মুবাহ হয়ে যায়।
তবে উক্ত
ব্যক্তির জন্য শর্ত হচ্ছে- সে হালাল চাকরী করার জন্য অথবা হালাল ব্যবসা অবলম্বনের
জন্য কোশেশ করতে থাকবে। যখনই তার কোন হালাল চাকরী বা ব্যবসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তখনই সে উক্ত সুদ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের চাকরী ছেড়ে দিয়ে হালাল চাকরী বা
ব্যবসায় যোগ দিবে।
আরো শর্ত
হচ্ছে- যতদিন পর্যন্ত সে ব্যক্তি সুদী প্রতিষ্ঠানে চাকরীরত থাকবে এবং হালাল চাকরী
বা ব্যবসার ব্যবস্থা করতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত দায়েমীভাবে তাকে
তওবা,
ইস্তেগফার ও দোয়ার মধ্যে মশগুল থাকতে হবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে রোনাজারী
করতে থাকবে,
যাতে আল্লাহ পাক তাকে একটি হালাল ব্যবসা বা চাকরীর ব্যবস্থা
করে দেন।
আবা-৪২
0 Comments:
Post a Comment